স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১২ই মে পর্যন্ত প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছে প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ, আর দ্বিতীয় ডোজের টিকা গ্রহণ করেছে ৩৬ লাখ মানুষ। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের নিজস্ব টিকা উৎপাদন বা সে সম্পর্কিত গবেষণার দুর্বল অবস্থার নিরীখে দেশের মানুষের জন্য টিকা নিশ্চত করা দুরূহ কাজ নিঃসন্দেহে। আবার বিজ্ঞানের উন্নতির যুগে যেসব ভ্যাক্সিন তৈরিতে দীর্ঘসময় লাগত, সেখানে খুব দ্রুতই ভ্যাক্সিন চলে আসছে প্রয়োজনীয়তার জায়গা থেকে। কিন্তু এসবই নিষ্ফল হয়ে যায় যখন বাজারি পণ্যের তকমা গায়ে এঁটে ‘টাকা যার ভ্যাক্সিন তার’-এই নীতিতে চলে এবং ‘কেউ পায় কেউ পায় না’।
আমরা জানি, কোভিড-১৯ একটি আর এন এ ভাইরাস, যা দ্রুত মিউটেশন বা নিজেকে পরিবর্তন করে এর বিভিন্ন সক্রিয়তার ধরণ ও রূপ বা ভ্যারিয়েন্টে পরিবর্তন হয়। অপর দিকে ভ্যাক্সিন বা টিকা তৈরি হয় যে জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য, ওই জীবাণু দিয়েই। জীবাণুটির রোগ সৃষ্টিকারী অংশটি নষ্ট করে দিয়ে নিষ্ক্রিয় জীবাণুই মানবদেহে টিকা হিসেবে দেয়া হয়। মানব দেহে নিষ্ক্রিয় জীবাণু প্রবেশের ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধী অংশগুলো এই জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বলয় গড়ে তুলতে পারে। তাই যখনই বাহিরে থেকে ওই একই ধরনের কোনো সক্রিয় বা রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে, তখন আগেই তৈরি হওয়া সুরক্ষা বলয় সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং রোগ সৃষ্টি করতে দেয় না। এভাবেই স্মল পক্স, হাম পোলিওর মতো রোগ প্রায় নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে পৃথিবীজুড়ে। কোভিড-১৯ এর দ্রুত মিউটেশনের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভ্যাক্সিন যে সবসময়ই কাজ করবে তা বলা মুশকিল। ইতোমধ্যেই কোভিড-১৯ এর ভারতীয়, সাউথ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্যসহ নানা ধরনের ভ্যারিয়েন্ট সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে । সব ভ্যারিয়েন্টের জন্য যে একটি নির্দিষ্ট ভ্যাক্সিন কাজ করবে তা বলা যায় না। পৃথিবীর মানুষকে তাই যত দ্রুত টিকা দিয়ে এই রোগ প্রতিরোধী করা যায় তত দ্রুত করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব।
ইমিউনাইজ্ড বা রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে সারা বিশ্বে প্রায় ৭০% মানুষের প্রায় ১১ বিলিয়ন ডোজ টিকা দরকার । গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৮.৬ বিলিয়ন টিকা উৎপন্ন হয়েছে যা এক অর্থে অভাবনীয় এবং বিজ্ঞানের সক্ষমতাকেই প্রমাণ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এর ৬ বিলিয়ন ডোজ চলে যাবে ধনী এবং উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। এই ৬ বিলিয়ন ডোজ দিয়ে পৃথিবীর প্রায় ৮০% মানুষকে ইমিউনাইজ করা যেত। আবার ৮.৬ বিলিয়ন ভ্যাক্সিনের মধ্যে ৪.৬ বিলিয়ন ভ্যাক্সিন চলে যাবে ধনী দেশগুলোতে, যেখানকার জনসংখ্যা সারা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ১৬%। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, ধনী দেশগুলো ভ্যাক্সিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আগে থেকেই টাকা দিয়ে ভ্যাক্সিনের অর্ডার করে রাখে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে জীবনের চেয়ে মুনাফা আগে, সেখানে অনেক স্বল্প বা নিম্ন আয়ের দেশগুলোর এর অর্ধেক জনসংখ্যার জন্যও ভ্যাক্সিন কেনার মতো সামর্থ্য নেই।
আবার ধনী দেশগুলো ১৬% জনসংখ্যার জন্য ৫৩% ভ্যাক্সিন কিনে মজুদ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৩০০ মিলিয়ন উদ্বৃত্ত ভ্যাক্সিনের মধ্যে ৪ মিলিয়ন অব্যবহৃত ভ্যাক্সিন বাইডেন প্রশাসন কানাডা ও মেক্সিকোকে পাঠিয়েছে। যেহেতু সম্পূর্ণ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভ্যাক্সিন উৎপাদন ও বণ্টন হচ্ছে সেক্ষেত্রে ‘টাকা যার ভ্যাক্সিন তার’-এই নীতিতেই চলছে ভ্যাক্সিন ব্যবসা। কিন্তু এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, অক্সফোর্ড/এস্ট্রজেনিকার ভ্যাক্সিন তৈরির পিছনে ৯৭% অর্থই এসেছে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা ও দাতব্য সংস্থার থেকে । যুক্তরাষ্ট্রের ৬ টি ভ্যাক্সিন কোম্পানির ভ্যাক্সিন তৈরির জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার অর্থ এসেছে জনগণের পকেট থেকে। অথচ ভ্যাক্সিন বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন রকম দামে, ২ ডলার থেকে ৪০ ডলারের মতো। এস্ট্রেজেনিকার ভ্যাক্সিন-এর দাম ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে বাংলাদেশ, সাউথ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে বেশি। ফাইজার বলেছে, কোভিড আক্রান্তের পরিস্থিতির ভয়াবহতা চলে গেলেই দাম বাড়াবে। জনসন এন্ড জনসন আর মডার্নাও একি পথে হাঁটবে। আবার অনেক দেশ বিনামূল্যে ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা করলেও মুক্ত বাজার অর্থনীতির ধ্বজাধারী অনেক দেশে বেসরকারিভাবে ভ্যাক্সিন বিক্রি হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেখানে প্রতিদিন অক্সিজেন সংকটে মানুষ মারা যাচ্ছে, সেখানে টিকার দাম ২৫০ রুপি নির্ধারণ হলেও তা বিক্রি হচ্ছে ৬০০/৭০০ রুপিতে। ভারতে বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাক্সিনের ডোজ বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৫০০ রুপিতে।
করোনা মহামারীতে যখন মানুষের জীবন বিপর্যস্ত, তখনি কয়েকটি ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানির একচেটিয়া মুনাফার পণ্য হয়েছে এই ভ্যাক্সিন। করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য সারাবিশ্বের বিজ্ঞানীরা প্যাটেন্ট বা ইন্টিলেকচুয়াল প্রোপার্টি (মেধাসত্ত্ব) রাইট করোনা পরিস্থিতিতে তুলে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। ভ্যাক্সিনের প্রোপার্টি রাইট তুলে নেওয়া হলে বা এর ফর্মুলা উন্মূক্ত করে দিলে, অনেক দেশই ভ্যাক্সিন উৎপাদন করে দ্রুতই সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারত। এক হিসেবে বলছে, এভাবে ভ্যাক্সিনেশন হলে ২০২২ সালের মধ্যে ৬০% মানুষ ভ্যাক্সিনের আওতায় আসবে।
যখন সারাবিশ্বে একটা বৈশ্বিক মহামারী, ভারতের রাজধানী দিল্লিতে রাস্তায় রাস্তায় মানুষ মরে আছে, শ্মশানে জায়গা হচ্ছে না, তখন প্রোপার্টি রাইটের প্রয়োজন কার স্বার্থে? তাহলে যে গবেষণা করা হচ্ছে, তা হাতে গোনা ৪/৫টা কোম্পানির লাভের জন্য নাকি সারাবিশ্বের মানুষের কল্যাণে জন্য? যদি কিছু কোম্পানির স্বার্থে গবেষণা হয়, সে গবেষণা দিয়ে মানব জাতির কী লাভ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্যাটেন্ট করা পেনিসিলিন উন্মুক্ত করে দিয়ে অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিল। চাল-ডালের মতো ভ্যাক্সিন যখন বাজারের পণ্য, তখন মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে ‘টাকা যার ভ্যাক্সিন তার’-এই নীতিই চলবে সেটাই স্বাভাবিক।
সর্বশেষে একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। মাদাম কুরী ও পিয়েরে কুরী একটি ভাঙা ফুটো টিনের চালের ঘরে সারাদিন পিচব্লেন্ড- জাল দিতেন আর রেডিয়াম নিষ্কাশন করতেন। তাঁরা জানতেন, এই গবেষণায় তাঁদের মৃত্যু হতে পারে। পিয়েরে কুরী ঘোড়ার গাড়ির ধাক্কায় মারা যান। ধারণা করা হয় সেটাও ছিল তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব। রেডিয়াম আবিষ্কারের পর যখন বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য তাঁর কাছে আবেদন আসলো, তিনি সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, “কারোর ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করা রেডিয়ামের কাজ নয়। রেডিয়াম মৌলিক পদার্থ মাত্র। তার ওপর সবার সমান অধিকার। আমাদের আবিষ্কারের যদি কোনো ব্যবসায়িক সাফল্য থাকে তা আকস্মিক ঘটনামাত্র, তার দ্বারা লাভবান হওয়া আমাদের কখনোই উচিৎ নয়। তাছাড়া চিকিৎসার কাজেই রেডিয়ামের সার্থকতা। এর সুযোগ নেওয়া অত্যন্ত নিচু মনোবৃত্তির পরিচয় হবে।” সেই মাদাম কুরীর আবিষ্কার এখনো মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এথিক্স বা নৈতিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন মেরি কুরী। সে বিজ্ঞান আজ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের হিসেবের খাতায় আবদ্ধ।