গত ৩ জুন সংসদে ২০২১-২২ সালের বাজেট পেশ হলো। আর ৫ জুন পত্রিকায় রিপোর্ট এলো – আজ যে শিশুটি জন্ম নিল, তার মাথায়ও ঋণের বোঝা চাপবে ৮৪ হাজার ৭৭০ টাকা। এবারের ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে ঘাটতি ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এ বিপুল ঘাটতি মেটাতে দেশের ভেতর থেকে ও বিদেশ থেকে সরকারকে আরও ঋণ করতে হবে। ফলে আগামী ১ বছরে মাথাপিছু ঋণ আরও কমপক্ষে ১৩ হাজার ৬০ টাকা বাড়বে। ফলে আগামী বাজেটের আগে মাথাপিছু ঋণ দাঁড়াবে প্রায় ৯৮ হাজার টাকা। এ ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে জনগণকেই। এটি গত এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা জবাবদিহিহীন আওয়ামী লীগ সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের নমুনা। বাজেটের সাথে ঋণের বোঝা বাড়ার একটা সম্পর্ক আমরা দেখছি। আসুন, এবারের বাজেটটাই বিচার করে দেখা যাক – মাথাপিছু ঋণ কেন বাড়ছে? ঋণের টাকা কার জন্য ব্যয় হবে? বাজেটের সাথেই বা আমার-আপনার সম্পর্ক কী?
বাজেটের অর্থ যোগাবে কে?
সাধারণভাবে বাজেট হচ্ছে সরকার এক বছরে কোন খাত হতে কত টাকা যোগাড় করবে, আর কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করবে তার হিসাব। আবার বাজেটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের উন্নয়ন দর্শন ও রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি বা পলিসিও বোঝা যায় অর্থাৎ রাষ্ট্র জনগণের কোন অংশকে গুরুত্ব দেবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষকে নাকি মুষ্টিমেয় ধনী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আমলাদের?
সরকার বাজেটে এক বছরে কত টাকা খরচ করবে, তা প্রথমে নির্ধারণ করে। এরপর কত টাকা সংগ্রহ বা আয় করবে, তা ঠিক করে। সরকার টাকা পায় কোথায়? এ টাকা যোগান দেয় দেশের জনগণ। বিভিন্ন কর ও শুল্ক বা ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে সরকার এ টাকা সংগ্রহ করে, যাকে বাজেটে রাজস্ব আয় বলা হয়। এ রাজস্ব আয়ের একটা উৎস হলো প্রত্যক্ষ কর। যেমন ব্যক্তির ওপর আয়কর, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আয়ের উপর কর বা কর্পোরেট কর, সম্পত্তি কর। আয়ের আরেকটি উৎস হলো পরোক্ষ কর, যেমন – ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, পর্যটন কর ইত্যাদি। পরোক্ষ কর বাস্তবে জনগণের ঘাঁড়েই পড়ে। সরকার ব্যবসায়ীদের উপর যে ভ্যাট-শুল্ক চাপায়, ব্যবসায়ীরা তা নিজের পকেট থেকে দেয় না। তারা তা পণ্যের মূল্যের সাথে যুক্ত করে দেয়। ফলে বাজারে যে কোনো জিনিস কিনতে গেলে জনগণকেই সে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়। এবারের বাজেটে প্রত্যক্ষ কর, আয়কর, কর্পোরেট কর হলো রাজস্ব আয়ের মাত্র ৩২%। আর পরোক্ষ কর হচ্ছে রাজস্ব আয়ের ৬৮%। এর মধ্যে ভ্যাট হচ্ছে ৩৮.৭% বা ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। যা ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট থেকে ১১% বেশি। অর্থাৎ এবারের বাজেটের তিনভাগের দুই ভাগ টাকাই আসবে সাধারণ জনগণের পকেট থেকে। বাজেটে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তদের জন্য কোনো করছাড় নেই। অথচ ব্যবসায়ীদের জন্য কর্পোরেট কর আড়াই ভাগ কমানো হয়েছে, গতবারও যা আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছিল। দেওয়া হয়েছে আরও নানা করছাড়। আবার সরকার যে পরিমাণ ব্যয় করবে, রাজস্ব আয় থেকে পুরোটা যোগাড় হবে না। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি ধরায়, ২ লাখ কোটি টাকার বেশি ঘাটতি মেটাতে সরকার যে ঋণ করবে, তার সুদ আসল আবার জনগণ থেকেই সরকার আদায় করবে। প্রশ্ন হলো, যাদের থেকে নেওয়া হবে প্রায় সমুদয় টাকা, বাজেটে তাদের কথা কি মনে রাখা হলো?
টাকা দেয় কে, আর পায় কে?
বাজেটে ব্যয় দুই ধরনের। একটা হলো রাজস্ব বা অনুন্নয়ন ব্যয়, যার বড় অংশ ব্যয় হয় সরকার পরিচালনার কাজে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত আমলা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়, সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণসহ নানাবিধ খরচ চালাতে। এর বাইরে সরকার বিভিন্ন খাতে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি, প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য যে খরচ করে, তা বাজেটের উন্নয়ন ব্যয়। এবারের বাজেটে মোট ব্যয়ের ৬০% বরাদ্দ রাখা হয়েছে অনুন্নয়ন খাতে। অথচ, স্বাভাবিক ছিল করোনাকালীন বাস্তবতা বিবেচনায় সরকার অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কাঁটছাট করবে, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কর্মসংস্থান ইত্যাদি জরুরি সেবামূলক খাতে ব্যয় বাড়াবে। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। আবার উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশই লুটপাট-দুর্নীতি-অপচয়ের ফলে জনগণের কাছে পৌঁছায় না।
দেখা যাচ্ছে এবারের বাজেটে সিংহভাগ বরাদ্দ রাখা হয়েছে অনুৎপাদনশীল জনপ্রশাসন, সুদ পরিশোধ, প্রতিরক্ষা, জনশৃঙ্খলা ইত্যাদি খাতে। জনপ্রশাসন খাতে বেতন-ভাতা পরিশোধ, পেনশন, ভর্তুকি, প্রণোদনাসহ মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৮.৭%। প্রতিরক্ষা(সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) এবং জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর (পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-আনসার) সদস্যসংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। এ দুইখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে বাজেটের মোট ১১% (প্রতিরক্ষা ৬.২%, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ৪.৮%)। ঋণের সুদ পরিশোধেই বাজেটের ১১.৪% ব্যয় হবে। অর্থাৎ এ চারটি খাত মিলেই বাজেটে ৪১.১% বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর সাথে লুটপাট ও দুর্নীতির মেগাপ্রজেক্টে বরাদ্দ (৯%) যোগ করলে বাজেটের ৫০%-এর বেশি এসবেই ব্যয় হবে। এ হলো প্রত্যক্ষ বরাদ্দ, এর বাইরেও এসব খাতে থাকে নানা অপ্রত্যক্ষ বরাদ্দ, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এর বাইরে সংশোধিত বাজেট থেকে দেখা যায় – বছর শেষে প্রতিরক্ষা, জননিরাপত্তা ইত্যাদি খাতে বরাদ্দ বেড়ে যাবে, কিন্তু শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি ইত্যাদি খাতে বরাদ্দ ছাঁটাই হবে। অথচ ১৭ কোটি মানুষের জন্য মৌলিক খাত স্বাস্থ্য (৫.৪%), শিক্ষা (১১.৯২%) আর কৃষি (৫.৩%) মিলে বরাদ্দ বাজেটের মাত্র ২২.৬২%। বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ, যারা বাজেটের সিংহভাগ যোগান দেয়, তাদের বঞ্চিত করে বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় করা হবে অনুৎপাদনশীল ও সামরিক-বেসামরিক আমলা খাতে। সুতরাং বাজেটের উদ্দেশ্য যে জনগণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান ইত্যাদি মৌলিক অধিকারের বাস্তবায়ন নয়, তা বাজেট দেখলেই বোঝা যায়।
ব্যবসায়ীদের উজাড় করে দাও
পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও সরকার মালিক, শিল্পপতি, পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করবে – এটাই স্বাভাবিক। কারণ রাষ্ট্র মানেই কোন-না-কোন শ্রেণির রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের ‘উন্নয়ন’ বলতে দেশের শিল্পপতি, পুঁজিপতি, মালিকদেরই ‘উন্নয়ন’। সে উন্নয়ন দর্শনের ভিত্তিতেই রচিত হয় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বাজেট। পুঁজিপতিশ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ। পূর্বে বিভিন্নসময় বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাত এরাও পুঁজিপতিশ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবেই এ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। আওয়ামী লীগ জনগণের বিনা ভোটে ক্ষমতা আঁকড়ে আছে এবং আরও দীর্ঘ সময় থাকতে চায়। ফলে তাকে দেশি-বিদেশী পুঁজিপতি, ব্যবসায়ী, আমলা, সামরিক বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী – এদের যেকোনোভাবে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিরাপত্তা বাহিনী এদের জন্য বিশাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর বড় ব্যবসায়ীদের নানা ছাড় দিয়েছে মুক্তহস্তে।
আগেই বলা হয়েছে, ব্যবসায়ীদের জন্য কর্পোরেট কর কমানো হয়েছে। পোশাকশিল্পের মালিকদের গত কয়েক বাজেটে একের পর এক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এবারও পোশাকশিল্পে বিদ্যমান প্রণোদনার সাথে ১% হারে অতিরিক্ত রপ্তানি প্রণোদনা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। শিল্পে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর ৪% থেকে কমিয়ে ৩% করা হয়েছে। অটোমোবাইল থ্রি হুইলার ও ফোর হুইলার উৎপাদনকারী কোম্পানিকে মোট ২০ বছরের কর অব্যাহতি বা ট্যাক্স হলিডে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের বছরে ৩ কোটি টাকা টার্নওভারে শতকরা ৫০ ভাগ থেকে ২৫ ভাগে নামিয়ে নতুন কর প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা কর ফাঁকি দিলে পূর্বে যে জরিমানা ছিল, তাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে আরও ছাড়। ব্যবসায়ীরা খুব খুশি, তারা বাজেটকে ‘ব্যবসাবান্ধব’ বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। অর্থমন্ত্রী নিজেই বাজেটকে ‘পুরোই ব্যবসাবান্ধব’ বলে অভিহিত করেছেন। বলেছেন প্রয়োজনে আরও করছাড় দেওয়া হবে। সাংবাদিক কামাল আহমেদ পরিস্থিতিটা চমৎকার করে তুলে ধরেছেন অল্প কথায় – “ ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ উপকথাই এখন আমাদের একমাত্র অগ্রাধিকার। বাজেট বিশ্লেষণে যে কথা ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়েছে, তা হচ্ছে এটি একটি ব্যবসাবান্ধব বাজেট। পেশার দিক থেকে সাংসদদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে বেশ আগেই। মন্ত্রীদের মধ্যেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সুতরাং, ব্যবসাবান্ধব না বলে এখনকার বাজেটকে ব্যবসায়ীদের বাজেট বললেও কোনো অতিরঞ্জন বা তথ্যবিকৃতি ঘটে না। অবশ্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যে ব্যবসায়ীদের এই সংজ্ঞায় পড়েন না, সে কথাও বলে নেওয়া জরুরি।” (কামাল আহমেদ, ৮ জুন, প্রথম আলো)
প্রাধান্য দাবি করা হলেও বাজেটে জীবন-জীবিকা উপেক্ষিত
অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটের শিরোনাম দিয়েছেন – ‘জীবন জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। করোনা মহামারীর মধ্যেই দ্বিতীয় বাজেট বলে জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন। অথচ জীবন ও জীবিকা রক্ষার বাজেট বলে যতই ঢোল পেটানো হোক, বাজেটে তার ন্যূনতম প্রতিফলন নেই। করোনা মহামারীতে জীবন রক্ষার জন্য ভগ্ন স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজানোর কোনো পরিকল্পনা ও সে অনুযায়ী সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানের বরাদ্দ নেই। ১৭ কোটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের মাত্র ৫.৪% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের (৬.২%) চেয়েও কম। গত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.২%, এবার তা কমে জিডিপির ০.৯৫ %-এ নেমে এসেছে। স্বাস্থ্যখাতে এ সামান্য বরাদ্দ নিয়েও কি পরিমাণ হরিলুট হয়, তা যেকেউ জানেন। লুটপাট-দুর্নীতির পাশাপাশি বরাদ্দের একটা বড় অংশ যে জনগণের জন্য খরচ হবে না, তাও বিগত বাজেটে স্পষ্ট। গত ১০ মাসে চলতি বাজেটের মাত্র ২৫ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। অথচ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ হতে হবে জিডিপির ৫ শতাংশ ও মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ। করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ চলছে, তৃতীয় ঢেউ আসবে, তা কিভাবে মোকাবেলা করা হবে, বাজেটে তার কোনো পরিকল্পনা নেই। অর্থমন্ত্রীর পরিকল্পনামতো প্রতিমাসে ২৫ লাখ করে টিকা দিলেও, ৮০ ভাগ জনগোষ্ঠীকে টিকা দিতে চার বছর লেগে যাবে। জনগণের স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বরাদ্দ কমায় রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। বাংলাদেশে একজন রোগীকে চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৪ শতাংশ মেটাতে হয় নিজের পকেটের পয়সায়, যা ২০১২ ছিল ৬৪ শতাংশ। বর্তমানে সরকার ব্যয় করে মাত্র ২৬ শতাংশ। যার ফলে চিকিৎসাব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশের ১ কোটি ১৪ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। বেসরকারি চিকিৎসাই এখন দেশের প্রধান খাত। সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা নেই, আইসিইউ নেই, ভেন্টিলেটর নেই, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ নেই, পর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্স-টেকনিশয়ান নেই। বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়া হলেও, কীভাবে ব্যয় হবে, তার নির্দেশনা নেই। স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান গবেষণার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিগত বাজেটেও এ জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নীতিমালা প্রণয়ন করতে করতেই একবছর পার করে দেওয়া হলো, গবেষণার জন্য কোনো অর্থ খরচ হয়নি।
জীবিকা রক্ষার জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। সারা দেশে (প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের) ১ কোটি ৪৪ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন অর্থাৎ এখনও কাজে ফিরতে পারেননি। যারা কাজ পেয়েছেন, তাদের আবার আয় কমেছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৫২ শতাংশ মানুষের খাদ্য গ্রহণ কমেছে। জাতীয়ভাবে মাথাপিছু আয় বাড়লেও শ্রমজীবীদের মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে। এ কর্মহীন ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো পরিকল্পনা নেই। কাজ হারিয়ে প্রায় ৫ লক্ষ প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু দেশে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো পরিকল্পনা বাজেটে নেই।
করোনায় বিপর্যস্ত শিক্ষাখাত কী পেল
শিক্ষাখাত করোনার কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, সে ক্ষতি পোষাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নেই। শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবিতেও প্রতারণা আছে। শিক্ষাখাতে বরাদ্ধের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দও ঢুকিয়ে দিয়ে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে মোট বরাদ্দ ১৫.৭২% দেখানো হচ্ছে। এর মধ্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ ১৮ হাজার ৪২৬ কোটি ১৬ লাখ টাকাও অন্তর্ভুক্ত। আলাদাভাবে শিক্ষাখাত হিসাব করলে বরাদ্দ বাজেটের মাত্র ১১.৯২%। জিডিপিতে বরাদ্দ ২%-এর বেশি হবে না। অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তানও শিক্ষাখাতে জিডিপির ৪.১%, দরিদ্র ভুটান জিডিপির ৭% শিক্ষাখাতে ব্যয় করে। জিডিপিতে বরাদ্দের দিক হতে বাংলাদেশ ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৯২তম। দেশের দরিদ্র মানুষের সন্তানেরা যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে, তার হাল সবার জানা। পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে দেশের মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো বাধ্য হয়ে, প্রয়োজনে জমিজমা বিক্রি করে হলেও সন্তানদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াচ্ছে। শিক্ষার এ বাণিজ্যিক ধারাকে সংকুচিত করা দূরে থাক, সরকার এ শিক্ষার্থীদের উপর বাজেটে ১৫% ভ্যাট আরোপ করেছে। করোনার কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নান এমপিওভুক্ত ১০ লাখ শিক্ষক, কিন্ডারগার্টেনের ৬ লাখ ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আড়াই লাখ শিক্ষকের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, পরিবারের আয় কমে যাওয়ার কারণে প্রায় ৪০% শিশু শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে ঝরে পড়বে। গত বছরের তুলনায় এবছর এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীও ভর্তি হয়নি। ঝরে পড়া থেকে রক্ষা করতে শিক্ষার্থীদের বেতন ফি মওকুফের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।
অর্থনীতির চাকা ঘোরানো মানুষগুলো চাকার নিচেই থাকুক
কৃষক ও কৃষিশ্রমিক, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক এবং লক্ষাধিক প্রবাসী শ্রমিক-এদের শ্রমে-ঘামেই ঘুরছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা। অথচ এরাই রাষ্ট্রের সবচেয়ে অবহেলার শিকার, বাজেটে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দেওয়া ও ৪০ ভাগ কর্মসংস্থানসহ বিশাল অংশের মানুষ যে খাতের উপর নির্ভরশীল, সে কৃষি খাতে বাজেটের মাত্র ৫.৩% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কৃষক সংগঠনের দীর্ঘদিনের দাবি উন্নয়ন বাজেটের ৪০ ভাগ কৃষিখাতে বরাদ্দ করা। অথচ এবার উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৩.৪১% বরাদ্দ করা হয়েছে। কৃষকের ঘামে-শ্রমে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে, অথচ কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় না। কৃষক থেকে সরাসরি ফসল কেনার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নেই। বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদন চালু রাখলেও, নেই কোন ঝুঁকি ভাতা, ক্ষতিপূরণ, প্রণোদনার জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দ নেই। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা নেই। বন্ধ হওয়া পাটকল, চিনিকল শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের কোনো আয়োজন নেই। করোনাকালে চাকরি হারিয়ে দেশে আসা ৫ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানে কোনো বরাদ্দ নেই।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বেশি দেওয়ার দাবি করা হচ্ছে। অথচ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী পেনশনভোগীর পেনশন সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সাথে যুক্ত করে দিয়ে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে। এ খাতের ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকাই ব্যয় হবে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন খাতে। করোনার কারণে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। নতুন দরিদ্র হওয়া মানুষদের জন্য বাজেটের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কোনো বরাদ্দ নেই।
এদিকে মানুষের আয় কমে গিয়েছে,অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সংসারের ব্যয় বাড়ছে। মূল্যবৃদ্ধির খড়গ থেকে জনগণকে বাঁচাতে দরকার সরকারি সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি বাজার নিয়ন্ত্রণ, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আর্মি রেটে রেশনের ব্যবস্থা করা। সেজন্য টিসিবিকে প্রয়োজনীয় জনবল ও বরাদ্দ দিয়ে সক্রিয় করার লক্ষে বাজেটে কোনো পরিকল্পনা ও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ সারা বছর মূল্যবৃদ্ধির যাঁতাকলেই মানুষ পিষ্ট হতে থাকবে। আর সরকার টিসিবিকে সক্রিয় করার সে ভাঙা রেকর্ড বাজাতেই থাকবে!
জিডিপি উচ্ছ্বাস ও বাস্তবতা
জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটা সত্ত্বেও, কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এজন্য দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ এর নাম দিয়েছেন – কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। কাজের অভাবে তরুণ-যুবকরা সাগরে হাজারে হাজারে ডুবে মরছে, অনেকের ঠাঁই হচ্ছে থাইল্যান্ড-মালেশিয়ার গণকবরে, কোনো জঙ্গলের বন্দিশিবিরে বা বিভিন্ন দেশের কারাগারগুলোতে। চাকরি দেওয়ার নাম করে নারীদের পাচার করে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন দেশের পতিতালয়ে। কাজ নেই, সে দেশেই আবার কর্মসংস্থানের একটা ক্ষেত্র পাটকলসহ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বরং সংবিধান বর্ণিত কর্মসংস্থানে সৃষ্টিতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব অস্বীকার করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতাতেও বললেন, সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবে না। বলা হচ্ছে আইটি খাতে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে, কিন্তু কীভাবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা স্থাপনের কোনো পরিকল্পনাও নেই।
প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর নেশায় মেগা-লুটপাটের মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য বিশাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন বাজেটের ২৫ ভাগ মেগাপ্রকল্পগুলোতে ব্যয় হবে। বড় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সড়ক যোগাযোগ খাতে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। রূপপুর, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদি খাতে কী পরিমাণ দুর্নীতি-লুটপাট চলছে, তা কারো অজানা নয়। সে কারণেই প্রকল্পগুলোর ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। প্রতি কিমি রাস্তা, রেলপথ, সেতু, ফ্লাইওভার নির্মাণের খরচ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছর জনগণের করের টাকা লুটপাটের এ কার্যক্রমকে বাজেটে বৈধতা দেওয়া হয়, এবারের বাজেটও তার ব্যতিক্রম নয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব ব্যয় ও উন্নয়নপ্রকল্পের প্রতিটা ক্ষেত্রে মহালুটপাট, দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। নদী-খাল দখল, ভূমি দখল, পাহাড় দখল, শ্রমিক শোষণ, কর ফাঁকি, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লোপাট, পুরো ব্যাংক লোপাট, চোরাচালান, মাদকব্যবসা, মানবপাচার, সিন্ডিকেট করে রাতারাতি অস্বাভাবিক মুনাফা ইত্যাদি অবাধে চলছে। খেলাপী ঋণ ও কালো টাকা বাড়ছে। ফলে করোনার মধ্যেও বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা, বাড়ছে আয় বৈষম্য। সাথে বাড়ছে সম্পদ পাচার। এবং তা চলছে সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই। সেজন্যই কারা সম্পদ পাচার করছে, সরকারি সংস্থা সে সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারকে দিলেও, অর্থমসমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে দিব্যি বলছেন – কারা সম্পদ পাচার করছে, তার জানা নেই। বারে বারে সুযোগ দেওয়া হয় কালো টাকা সাদা করার। এবারও সরকার কালো টাকার মালিকদের অবৈধ আয়কে বাজেটে বৈধতা দিয়ে লুটপাটের অর্থনীতিকেই শক্তিশালী করলেন।
উপরের আলোচনাতেই স্পষ্ট, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রণীত ২০২১-২২ সালের বাজেট ব্যবসায়ী ও ধনীদের তুষ্ট করার বাজেট। দেশের সংখ্যাগরিষ্ট শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সাধারণ জনগণের জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কর্মসংস্থানের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। দেশের প্রচলিত লুটপাটের অর্থনীতির ধারাই এ বাজেটের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হবে। আমরা দাবি জানাই, জনগণের করের টাকা থেকে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে জনগণের স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কর্মসংস্থান-কৃষিসহ উৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।