Monday, April 29, 2024
Homeসংবাদ ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিপার্টি সংবাদচট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে সিআরবি রক্ষা আন্দোলন

চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে সিআরবি রক্ষা আন্দোলন

চট্টগ্রামের সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং), বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর। ইট-পাথরের নগরীতে এক চিলতে ব্যতিক্রম। অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ, শতবর্ষী গাছসহ অসংখ্য গাছগাছালি ঘেরা উম্মুক্ত স্থান। বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠা নগরীতে নগরবাসীর একটু স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা। সকাল-বিকাল মানুষ এখানে হাঁটতে আসে। নববর্ষ উদ্যাপনসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ঢল নামে লক্ষ মানুষের। সেই সিআরবির ওপরও চোখ পড়েছে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের। রেল কর্তৃপক্ষ বৃহৎ কর্পোরেট হাউস ইউনাইটেড গ্রুপকে একটি প্রাইভেট হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট করার জন্য লিজ দিয়েছে সিআরবি—তে অবস্থিত রেলের বক্ষব্যাধি হাসপাতালসহ ছয় একর জায়গা। সিআরবিতে ইউনাইটেড হাসপাতাল ও একে কেন্দ্র করে অন্যান্য স্থাপনা গড়ে উঠলে, সিআরবির শতবর্ষের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। এ জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না।

চট্টগ্রাম শহরে অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে এর মধ্যেই উম্মুক্ত স্থান, গাছপালা, পাহাড়, খেলার মাঠ ধ্বংস করা হয়েছে। জনগণের মুক্তভাবে শ্বাস নেওয়ার প্রাকৃতিক উম্মুক্ত স্থান তেমন নেই। অবশিষ্ট সিআরবিকেও মুনাফালোভীরা আজ গ্রাস করতে চাইছে। সিআরবি এলাকায় আছে ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন সিআরবি ভবনটি। এটি ছিল ব্রিটিশ আমলে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার। চট্টগ্রামকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সিডিএ’র(চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) গৃহীত মাস্টারপ্ল্যান ও পরবর্তীতে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) পুরো সিআরবি এলাকাকে ‘সংস্কৃতি ও  ঐতিহ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাতে স্পষ্ট বলা আছে, এখানে কোনো বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। ড্যাপ ২০০৯ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয়। মাস্টারপ্ল্যান ও ড্যাপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কীভাবে রেল ‘ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি’ হিসেবে চিহ্নিত সিআরবিতে হাসপাতাল করার বেআইনি এ চুক্তি করতে পারল? ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান সিআরবি। যে স্থানে হাসপাতাল হবে, সেখানে চাকসুর সাবেক জিএস শহীদ আবদুর রবের কবরসহ দশ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিসৌধ ও নানা স্মৃতিচিহ্ন আছে। অথচ সংবিধানের ১৮ক ও ২৪ অনুচ্ছেদে প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ  স্থান, স্মৃতিস্মারক ইত্যাদি রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষণের নির্দেশ আছে। ফলে ইউনাইটেডের সাথে রেলের এ চুক্তি শুধু বেআইনি নয়, সংবিধানবিরোধীও।

রেলের হাসপাতালটি ইউনাইটেড গ্রুপের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) প্রকল্পের আওতায়। সোজা কথায় বেসরকারিকরণ। যত বড় গালভরা নামই দেওয়া হোক, পিপিপি বাস্তবে হলো পাবলিক প্রপার্টি টু প্রাইভেট পকেট, অর্থাৎ জনগণের সম্পত্তি মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর পকেটে ঢোকানোর আয়োজন। যেভাবে পাটকল-চিনিকলগুলোকে আধুনিকায়ন করে লাভজনক করার উদ্যোগ না নিয়ে সরকারি কারখানা, দামি জমি তুলে দেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে। আর এ চুক্তি অনুমোদন করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রামের জনগণের জন্য নতুন হাসপাতাল প্রয়োজন। কিন্তু যে প্রশ্নটা আড়াল করা হচ্ছে তা হলো, সরকারি জমিতে প্রাইভেট হাসপাতাল কেন হবে? প্রাইভেট হাসপাতালের দরজা যে সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ, তা কে না জানে? জনগণের কথা ভাবলে রেলের যে হাসপাতালটি আছে, তাকে আধুনিকায়ন করা যেত। চট্টগ্রাম মেডিকেল ও জেনারেল হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ও চিকিৎসা সুবিধা দ্বিগুণ বাড়ানো যেত বা অন্যত্র নতুন সরকারি হাসপাতাল বানানো যেত। বলা হচ্ছে, এর ফলে রেলের আয় বাড়বে। বাস্তবে কি তাই? ৬ একর জমি ৫০ বছরের জন্য ইউনাইটেডকে লিজ দিয়ে রেলের আয় হবে সর্বসাকুল্যে ৮-১০ কোটি টাকার মতো। অথচ সে জমির বাজারদরই ৫০০ কোটি টাকার মতো।

এর বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে উঠায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় অনেক নেতাকর্মীরাও আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন। এমনকি যে আওয়ামী লীগ নেতারা এ চুক্তির পক্ষে নানাভাবে সাফাই গাইছিলেন, তারাও জনরোষ বুঝে আপাত নীরব থেকে সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বোঝানো হয়েছে বলেও কেউ কেউ দাবি করছেন। প্রশ্ন হলো Ñ গত একমাস ধরে এত আন্দোলন, লেখালেখি, আলোচনা-সমালোচনার পরও ভুল ভাঙছে না কেন? যদিও চট্টগ্রামে সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের নগর সেক্রেটারি আজম নাছির বলেছিলেন, এ প্রকল্প এগিয়ে নিতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদেরের সম্মতি আছে। বাস্তবে, এটি মূলত সরকারের অর্থনৈতিক পলিসির সাথেই যুক্ত। আওয়ামী লীগ সরকার দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের আশীর্বাদেই ক্ষমতায় টিকে আছে। তাদের খুশি রাখতে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ পুঁজিপতিদের উপহার দেওয়া হচ্ছে। জনগণের টাকায় গড়ে উঠা রেল একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। রেলের প্রধান কাজ যাত্রী সেবা, মালামাল পরিবহন। জমি ভাড়া দিয়ে বাণিজ্যিক হাসপাতাল, হোটেল, অ্যাপার্টমেন্ট, মার্কেট ব্যবসা কি রেলের কাজ? অথচ সারাদেশে রেলের বিপুল জমি ও রেল পরিচালিত হাসপাতালগুলো আজ পিপিপির আওতায় তুলে দেওয়া হচ্ছে ব্যক্তিমালিকদের মুনাফার স্বার্থে। বাস্তবে এ কর্মকাণ্ড ধীরে ধীরে পুরো রেলকে বেসরকারিকরণে সরকারি নীতিরই অংশ। ফলে সিআরবি ধ্বংস করে ইউনাইটেড গ্রুপের সাথে হাসপাতাল নির্মাণে অবৈধ চুক্তি বাতিলের দাবির পাশাপাশি জনগণের সম্পদ রেল বেসরকারিকরণের সরকারি নীতির বিরুদ্ধেও আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে।

আশার কথা, সিআরবির প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে ইউনাইটেড হাসপাতাল করার এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দল-মত নির্বিশেষে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ-আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। সিআরবি রক্ষার এ আন্দোলনকে আপোসহীন ধারায় এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তিকে যুক্ত করে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমানকে সমন্বয়ক করে গড়ে তোলা হয়েছে ‘সিআরবি রক্ষা মঞ্চ’ নামে আন্দোলনের একটি নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। সিআরবি রক্ষা মঞ্চ বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, অবস্থান, সাইকেল র‌্যালি, ম্যারাথন, প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশসহ লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে। জনগণকে সংগঠিত করে রাজপথে আন্দোলনই আজ জনগণের সম্পদ সিআরবি রক্ষার একমাত্র পথ।

সাম্যবাদ-আগস্ট ২০২১

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments