Friday, November 22, 2024
Homeসংবাদ ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিপার্টি ও সংগঠন সংবাদব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক নিষিদ্ধ নয়, আধুনিকীকরণ করে বৈধ কর

ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক নিষিদ্ধ নয়, আধুনিকীকরণ করে বৈধ কর

বাংলাদেশের শহর-মফস্বল-গ্রাম সর্বত্রই যে জিনিস সমানভাবে চোখে পড়ে তা হলো ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক। ব্যাটারিচালিত এসব যানবাহন দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে। অল্প খরচে সব জায়গায় চলাচল উপযোগী এ যান মানুষের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করেছে। একদিকে চালকের অমানবিক পরিশ্রম-কষ্ট কমিয়েছে, একইসাথে প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের কষ্টসাধ্য অনেক কাজকে সহজ করেছে। হাটবাজার, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, উৎসব-অনুষ্ঠান থেকে রোগী পরিবহনসহ গ্রামীণ জীবনের নিত্যসঙ্গী এসব যানবাহন। ফলে কোটি কোটি বেকারের দেশে ব্যাটারিচালিত যানবাহন খুব দ্রুত হয়ে উঠেছে লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যম। গণমাধ্যমের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১৫-১৭ লাখ ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলছে। এসকল যানবাহনের উপর নির্ভরশীল চালক-মালিক-ব্যবসায়ী-যাত্রী-মিস্ত্রী মিলে বিরাট সংখ্যক মানুষ। অর্থাৎ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে চলতি কথার ‘অটো’ গাড়িগুলো।

অথচ ছোট এ যান আলোচিত হয় তার সামাজিক-অর্থনৈতিক গুরুত্বের জন্য নয়, বরং সমালোচিত হয় সামাজিক বিশৃঙ্খলার উপাদান হিসেবে। এর চালক বা যাত্রীরা যেমন এ রাষ্ট্রে ব্রাত্য, যানবাহনটিও তেমনি উপেক্ষিত। মাঝে মাঝেই বিপুল জনপ্রিয় এ যানবাহনটির উপর খড়গহস্ত হয়ে ওঠে রাষ্ট্র। কখনও চলাচলে নিষেধাজ্ঞা, কখনও আটক, কখনওবা বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া। সর্বশেষ গত ২০ জুন সড়ক পরিবহন বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের এক সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন দেশে সকল ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা-ভ্যান বন্ধের। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন—জীবিকার কথা একবারও ভাবলেন না তারা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অটোরিকশা বন্ধের যুক্তি হিসেবে বললেন – ‘রিকশার সামনের চাকায় ব্রেক আছে। পেছনের চাকায় ব্রেক নেই। এগুলোতে ইঞ্জিন লাগিয়ে চালানোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সারা দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারি হবে।’

এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে রিকশা চালক-মালিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। প্রথমত ব্রেক বা অন্য কোনো কাঠামোগত সমস্যার জন্য সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য যানবাহন সরকার নিষিদ্ধ করতে পারে না। ব্রেকের সমস্যা বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট চালক-মিস্ত্রীদের পরামর্শ নিয়ে সমাধান করা কোনো আহামরি বিষয় নয়। দ্বিতীয়ত সড়ক দুর্ঘটনার যে কথা বলেছেন সেখানেও রয়েছে ফাঁকি। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫০০০ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। রিপোর্ট অনুযায়ী এর বেশিরভাগ ঘটে বড় গাড়ি – বাস, ট্রাক, মাইক্রো ইত্যাদিতে। অতিরিক্ত গতি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, চালকের অদক্ষতা ইত্যাদি হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। এসকল সমস্যা পাশ কাটিয়ে কেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার দায় ব্যাটারিচালিত যানবাহনের ওপর দিচ্ছেন? এর বাইরে সরকার অনেকসময় বলে থাকেন – ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ করার কারণে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। অথচ এটা কোনোভাবেই বিদ্যুতের অপচয় নয়। বরং এ খাতে অল্প বিদ্যুৎ ব্যয়ে আমরা অনেক রিটার্ন পাচ্ছি। অপরদিকে সরকার বলছে, দেশ এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকারি হিসেবে প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াট। তার বিপরীতে চাহিদা গ্রীষ্মকালে ১২ হাজার মেগাওয়াট, শীতকালে ৮ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদনক্ষম অনেক বিদ্যুৎপ্ল্যান্টকে অলস বসিয়ে রেখে সরকার হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিচ্ছে। অথচ প্রতিদিন ব্যাটারিচালিত যানবাহন চার্জের জন্য প্রয়োজনীয় ১-২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অতিরিক্ত উৎপাদন করলে অলস পড়ে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে কিছুটা কাজে লাগানো যেত। এতে সবদিক থেকেই জনগণ লাভবান হতো। কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে উল্টো ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধ করতে চায় কার স্বার্থে? অনেকসময় শহরাঞ্চলে ব্যাটারিচালিত যানবাহনের কারণে যানজট সৃষ্টি হয় – এ অজুহাতে সেগুলো বন্ধের আলাপ ওঠে। যদিও এ আলাপ ওঠে চকচকে প্রাইভেট কারে যারা আরামে চলাফেরা করতে চান সেসব উচ্চমধ্যবিত্ত বা ধনীদের দিক থেকে। যানজটের মূল কারণ কিন্তু অটো বা রিকশা নয়। মূল সমস্যা প্রয়োজন অনুযায়ী রাস্তা না থাকা বা প্রশস্ততা কম থাকা, অপরিকল্পিত নগরায়ন ইত্যাদি। এ সকল সমস্যার সমাধান না করে দায় চাপানো হচ্ছে ব্যাটারিচালিত যানবাহনের উপর। এক্ষেত্রে শহরে প্রয়োজন অনুযায়ী অটোরিকশার লাইসেন্স প্রদান, টার্মিনাল নির্মাণ করা যেতে পারে।

উপরোক্ত আলোচনায় আমরা দেখলাম সরকার যেসকল সমস্যার কথা বলে ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধ করতে চায়, সেসব সমস্যা সমাধানযোগ্য। পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত যানবাহনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে কেন সরকার বারবার বিভিন্ন কৌশলে এমন গুরুত্বপূর্ণ যানবাহন বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়? এর কারণ – আমাদের দেশের পরিবহন খাত মুনাফালোভী একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের দখলে। তারা জনগণকে জিম্মি করে হাজার কোটি টাকা মুনাফা লোটে। বাস্তবে তারাই সরকার। পরিবহন খাতের সকল সিদ্ধান্ত তাদের স্বার্থেই নেওয়া হয়। ব্যাটারিচালিত যানবাহনের মূল্য কম হওয়াতে গরিব সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষও এগুলোর মালিকানা লাভ করেছে। ফলে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের মুনাফার বিরাট অংশ হাতছাড়া হচ্ছে। পরিবহন খাতের এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী চক্রের মুনাফালোভের বলি হতে হচ্ছে ব্যাটারিচালিত যানবাহন ও তাদের মালিক-যাত্রীদের। সরকার এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে।

সরকার লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থান, কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের অল্প পয়সার যাতায়াত সুবিধার কথা চিন্তা করে না। ফলে কখনও আইন করে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ করে। পুলিশ দিয়ে হয়রানি করে। জরিমানা করে, হাতুড়ি-বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়। সরকারের এ মনোভাবের কারণে সরকার দলীয় নেতাকর্মী, স্থানীয় মাস্তান-পুলিশ সবাই অবাধে চাঁদাবাজি করে ব্যাটারিচালিত যানবাহন থেকে। একদিকে আইনি নিপীড়ন, অন্যদিকে চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ব্যাটারিচালিত যানবাহনের মেহনতকারী চালক। রাষ্ট্রীয় প্রচারণার ফলে এসকল শ্রমজীবী মানুষও ভাবে অটোরিকশা চালানো যেন অপরাধ। কিন্তু উপরোক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় ব্যাটারিচালিত যানবাহন চালানো কোনো অপরাধ নয়। বরং দেশের মানুষের বিরাট উপকারে আসছে এসকল যানবাহন।

সরকারের উচিত ছিল দ্রুত এ সকল যানবাহনের লাইসেন্স দিয়ে একটা নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু সরকার তা না করে বারবার যে নিপীড়ন করছে, তাতে সরকার গণবিরোধী কাজ করছে। সরকারের এসকল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরামহীন আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া ব্যাটারিচালিত যানের চালক-মালিকদের ভিন্ন কোনো পথ নেই। সরকার দলীয় নেতাকর্মী-পুলিশ কেউই শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াবে না। ব্যাটারিচালিত যানবাহনসমূহের চালক-মালিক-যাত্রী মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে সকল অন্যায় সিদ্ধান্ত এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেই কেবল ন্যায্য অধিকার পাওয়া সম্ভব।

সাম্যবাদ-আগস্ট ২০২১

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments