Friday, November 22, 2024
Homeসংবাদ ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিপার্টি ও সংগঠন সংবাদআফগানিস্তানে পিছু হটলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ

আফগানিস্তানে পিছু হটলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ

অবশেষে আফগানিস্তান থেকে ফিরছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। না, বিজয়ী নয়, অনেকটা আত্মসমর্পণের গ্লানি নিয়েই ফিরছে তারা। এর একটা প্রেক্ষাপট আছে। ২০০১ সালে আমেরিকার ‘টুইন টাওয়ার’-এ বোমা হামলা হয়। এ হামলায় ‘আল-কায়েদা’ ও তার নেতা ওসামা বিন লাদেন যুক্ত – এই আভিযোগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আল-কায়েদার আশ্রয়দাতা আফগানিস্তানের তালেবান সরকার – এই অযুহাতে আফগানিস্তানে আমেরিকা সামরিক হামলা চালায়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সেদিন বলেছিল, আফগানিস্তানে তারা ‘সন্ত্রাস ও তালেবান দমন’ এবং ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু তা হয়নি! ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই মার্কিন বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে। বাস্তবে কোনো দখলদার শক্তি, কোনোদিন, কোথাও শান্তি বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেনি। মার্কিনিরাও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে আফগানিস্তানে যায়নি।

দীর্ঘ ২০ বছর, প্রতিদিন-প্রতি মুহূর্তে মার্কিন দখলদারিত্বের জ্বালা সহ্য করেছেন আফগান জনগণ। চোখের সামনেই প্রিয়জনের মৃত্যু, পরিবারে উর্পাজনক্ষম মানুষটির পঙ্গুত্ব নারী নিগ্রহ কী দেখেনি আফগান জনগণ? উদ্বাস্তু-গৃহহীন জীবন, চারদিকে যুদ্ধের বিভীষিকা – কী উপহার দেয়নি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ? তারপরও দমাতে পারেনি আফগান জনগণকে। তারা ব্যর্থ করে দিয়েছে মার্কিন যুদ্ধ ও পররাষ্ট্র নীতিকে। ইতোমধ্যে ৯০ শতাংশ সেনা প্রত্যাহার হয়েছে, বাকিটা ফেরত যাবে সেপ্টেম্বরে। একই সাথে এটাও ঠিক যে, বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরপর দ্রুতই পতন ঘটবে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট বর্তমান ‘কাবুল’ সরকারের। ক্ষমতায় আসবে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ শক্তি তালেবান। বর্তমান আলোচনাটিতে আমারা আফগানিস্তানের বর্তমান অত্যন্ত জটিল ও স্পর্শকাতর এই পরিস্থিতির স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করব।

সন্ত্রাস দমনের নমুনা

২০০১ সালে আফগানিস্তানে সামরিক হামলা চালিয়ে তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।  ক্ষমতায় বসায় হামিদ কারজাইকে। মার্কিন বাহিনী ও তার মিত্রদের তথাকথিত এই তালেবান দমন অভিযানে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির মুখে পড়ে আফগান জনগণ। গৃহহীন হয়েছে ৩২ লক্ষ মানুষ। প্রায় ২৭ লক্ষ মানুষ দেশ ছেড়ে প্রতিবেশি দেশসমূহে আশ্রয় নিয়েছে। এই দীর্ঘ যুদ্ধে ২ লক্ষ ৪১ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। যার মধ্যে ৭১ হাজার ৩৪৪ জন আফগান সাধারণ নাগরিক, তালেবান (মার্কিন বিরোধী অন্য যোদ্ধাসহ) ৮৪ হাজার ১৯১ জন, আর সরকারি বাহিনী (সেনা ও পুলিশ) ৭৮ হাজার ৩১৪ জন। এরা সবাই আফগান নাগরিক। জিজ্ঞাসাবাদের নামে নিপীড়ন, গ্রেফতার, জেলখানায় নির্য়াতন, নারীদের উপর যৌন সন্ত্রাস ছিল মার্কিন বাহিনীর নিত্যদিনের কাজ। যুদ্ধকালীন সময়ে খাবার, রোগবালাই ও পানি সংকটে  মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ। এর কোনো সুনির্দিষ্ট তালিকা নেই। কত মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, কত শিশু অভিবাবক হারিয়েছে তার খবর কেউই জানে না। ২.২৬১ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে এই তাণ্ডব চালিয়েছে। অবকাঠামো ও উন্নয়ন কাজে যে টাকা আফগানিস্তানে খরচ হয়েছে তার বেশির ভাগটাই মার্কিন তাঁবেদার আফগান সরকার ও বিভিন্ন বাহিনীর দুনীর্তিবাজ কর্তা-ব্যক্তিরা লুট করেছে। ২০ বছরের মার্কিন দখলদারিত্ব থাকার পর মানব সম্পদ উন্নয়নে জাতিসংঘের ১৮৯টি দেশের মধ্যে আফগানিস্তান ১৬৯তম। ফলে ২০ বছরের মার্কিন দখলদারিত্বের খতিয়ান প্রমাণ করে – আফগানিস্তানে মুক্তি-গণতন্ত্র-শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি।

আমেরিকার টার্গেট কী ছিল?

এটা প্রমাণিত যে, আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস কিংবা তালেবান দমন করতে পারেনি। সন্ত্রাস দমন করতে পারেনি ঠিক নয়, বাস্তবিক সন্ত্রাস দমন করতে যায়ইনি! তাহলে কী ছিল মার্কিন সামরিক অভিযানের প্রকৃত লক্ষ্য? আফগানিস্তান সব সময়ই ছিল ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণ এশিয়া, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে সংযোগ ও বাণিজ্য পথ হিসেবে আফগানিস্তান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা চাইছিল এই রুটের নিয়ন্ত্রণ। দীর্ঘদিন থেকে পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার সামরিক মৈত্রী। পাকিস্তানের সমর্থন ও সহযোগিতা সে পাচ্ছিল। পাকিস্তানের পাশাপাশি আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ নিলে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার তার জন্য অনেক সহজ হবে। আর আফগানিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম মানে আঞ্চলিকভাবে চীন, রাশিয়া এবং ইরানের প্রভাব খর্ব করা। একই সাথে নজর ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সুবিশাল তেলক্ষেত্রের উপর। আর সেজন্য আফগানিস্তানকে টার্গেট করে আমেরিকা। আবার আফগানিস্তানের জনগণ রাজনৈতিকভাবে ছিলেন অসচেতন এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন। এদিকে আন্তর্জাতিকভাবে তালেবান সরকারের খুব একটা সমর্থনও ছিল না। এই পরিস্থিতিতে সন্ত্রাস দমনের কথা বলে আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ নেওয়াই ছিল আমেরিকার সামরিক হামলার মুখ্য উদ্দেশ্য।

আফগানিস্তানে মার্কিন নীতি ব্যর্থ হয়েছে!

আফগানিস্তানে মার্কিন সমর ও পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আমেরিকা চাইছিল আফগানিস্তানে তাদের একক দখলদারিত্ব কায়েম করতে। অথচ আফগান জনগণের প্রতিরোধের মুখে বাস্তবে বিনা শর্তেই দেশ ছাড়তে হচ্ছে তাদের। এমন কোনো দিন নেই যা ছিল প্রতিরোধহীন। ফলে কখনোই আফগানিস্তান সম্পূর্ণ দখলে যায়নি আমেরিকার। এদিকে তালেবান ও সন্ত্রাস দমনের নামে যে অভিযান আমেরিকা পরিচালনা করেছে, তাও ব্যর্থ হয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছর পর আজ দেখা যাচ্ছে যে, তালেবান আফগানিস্তানের প্রায় ৮৫ ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। অর্থাৎ বিশ্ববাসীর কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কার্যকারিতা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। ইসলামী মৌলবাদ বা সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের কথা বলে আমেরিকার হামলা চালানোর পর দেখা গেছে মৌলবাদী শক্তিই বিকশিত হয়েছে। শুধু তালেবান নয়, অন্যান্য দেশে ‘বোকো হারাম’, ‘আল শাবাব’, আইএস ইত্যাদির মতো জঙ্গি সংগঠন শক্তিশালী হয়েছে। তাই সন্ত্রাস দমনই বলুন, আর আফগানিস্তানে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েমই বলুন – কোনোটাই করতে পারেনি আমেরিকা।

ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পরাজয় ঘটেছে মার্কিন স্বার্থের। চীন ইতিমধ্যেই আমেরিকার প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে সামনে এসেছে। আফগানিস্তানেও চীনের প্রভাব তৈরি হচ্ছে। চীন তার ‘ওয়ান বেল্ট ইনিশিয়েটিভ’ পরিকল্পনায় আফগানিস্তানকে পেতে চায়। ভারত আফগানিস্তানে ইতোমধ্যে করা বিনিয়োগ রক্ষা এবং কাশ্মীরসহ ভারতের নানাস্থানে জঙ্গি তৎপরতা মোকাবেলায় আফগানিস্তানের সহযোগিতা পেতে তৎপর। তালেবানের সাথে নানা পর্যায়ের সম্পর্ক তৈরিতে ভারত সচেষ্ট আছে। ভারতের সাথে আমেরিকার এক ধরনের মিতালি থাকলেও আফগানিস্তানে ভারতের অবস্থান তুলনামূলক দুর্বল। রাশিয়ার জন্য আফগানিস্তান খুবই জরুরি, তারাও তালেবানের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখছে। অর্থাৎ রাশিয়া, চীন ও ভারত তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে তালেবানের সাথে সম্পর্ক বিনির্মাণের চেষ্টা করছে। এর মানে আফগানিস্তানকে ঘিরে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি পরাস্ত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী এই ভাগ-বাটোয়ারার প্রশ্নে মার্কিন নীতির পরাজয় ঘটলেও বাস্তবে আফগান জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। বরং আফগানিস্তান সাম্রাজ্যবাদের এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে যাচ্ছে।

গণতন্ত্র রপ্তানি তত্ত্ব, আফগান জনগণ ও তালেবান

বহুদিন ধরেই আফগানিস্তানের জনগণ একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করছেন। বিগত অন্তত অর্ধশতাব্দি ধরে বিভিন্ন শক্তি আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে এসেছে। ইতিহাস বলে, কোথাও বিপ্লব বা গণতন্ত্র রপ্তানি করা যায় না, আফগানিস্তানেও যায়নি। বাস্তবিক গত অর্ধশতাব্দি ধরে আফগানিস্তানে একের পর এক গণতন্ত্র রপ্তানির প্রচেষ্টা চলছে। এই গণতন্ত্র রপ্তানির প্রচেষ্টাই মূলত আফগানিস্তানের গণতন্ত্র ও আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতার বড় কারণ। ১৯৭৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। তখন সেদেশে শিক্ষার হার ছিল মাত্র ১০ শতাংশ। দেশটি সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে ছিল অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া। ক্ষমতা দখল করলেও পার্টিটি জনগণকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে শিক্ষিত ও প্রস্তুত করার কাজটি করেনি।  ১৯৭৯ সালে আফগান সরকারের আমন্ত্রণে সোভিয়েত ইউনিয়ন হস্তক্ষেপ করলেও তারাও একইভাবে জনগণের চেতনার মান ও আফগানিস্তানের মানুষের নিজস্ব রাজনৈতিক লড়াই বিকশিত করেনি।

শীতল যুদ্ধের রাজনীতিতে সোভিয়েতবিরোধী শক্তি হিসেবে ইসলামী জঙ্গি দলগুলোকে ব্যবহারের সুযোগ আমেরিকা কাজে লাগায়। এর মধ্যে ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদাকেও সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে  লড়ার জন্য মার্কিনীরা অর্থ-অস্ত্র-প্রশিক্ষণ দেয় পাকিস্তানের মাধ্যমে, সৌদি অর্থ সাহায্যে। ১৯৯১ সালে ইরাক কুয়েত দখল করলে ইরাকবিরোধী সামরিক অভিযানের প্রয়োজনে সৌদি আরবে সামরিক ঘাঁটি করে মার্কিন সেনাবাহিনী। এই উপসাগরীয় যুদ্ধের পরও সৌদিতে মার্কিন বাহিনী রয়ে গেলে ইসলামের ‘পবিত্র ভূমি’ মক্কা-মদীনায় বিধর্মীদের উপস্থিতি মেনে নিতে পারেনি ওসামা বিন লাদেন। এভাবে একদা মার্কিন মদদপুষ্ট আল-কায়েদার সাথে বিরোধ তৈরি হয় আমেরিকার। ১৯৯০ সালে সংশোধনবাদী রাশিয়ার পতন হলে ১৯৯২ সালে মুজাহিদিন বাহিনী কাবুল দখল করে। এ সরকার বেশিদিন টেকেনি, ১৯৯৭ সালে কাবুল দখল নেয় তালেবান। তালেবানের সাথেও শুরু থেকে আমেরিকা ও পাকিস্তানের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়াকে কেন্দ্র করে তালেবানের সাথে আমেরিকার মতভিন্নতা তৈরি হয়। ততদিনে তালেবানেরও একটা নিজস্ব শক্তি ও সামর্থ্য তৈরি হয়ে যায়। ধীরে ধীরে মতভিন্নতা মতবিরোধে রূপ নেয়। আর একে পুঁজি করে ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযা’-এর নামে ২০০১ সাল থেকে মার্কিন দখলদারিত্ব, হত্যাযজ্ঞ চলছে। এবার আমেরিকাও আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সন্ত্রাস দমনের নামে।

আফগান জনগণ কখনোই মার্কিন মদদপুষ্ট পুতুল সরকারকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। আবার মার্কিন দখলদারিত্ব, হত্যাযজ্ঞও স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল না। তাই একদিকে আফগান জনগণের স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আকুতি, অন্যদিকে এই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির গড়ে উঠতে না-পারা জনিত দুর্বলতা সেখানে বিরাজমান। এ অবস্থায় মোটাদাগে আফগান জনগণ দেখছে – প্রতিদিন মার্কিন বিরোধী  লড়াই করছে তালেবান, তারা জীবনও দিচ্ছে। এই কারণে আফগান জনগণের একটা সহানুভূতি পাচ্ছে তালেবান। আবার বর্তমান সময়ে ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় তালেবান মার্কিনবিরোধী অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের সহানুভূতি-সমর্থন পাচ্ছে। এ সকল কারণে আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পরপরই তালেবানের হাতে ক্ষমতা করায়ত্ত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

তালেবানের ক্ষমতা দখল ও তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া?

তালেবান আফগানিস্তানে কেমন শাসন চায়? গত তালেবান শাসনে তার স্পষ্ট উদাহরণ তারা তৈরি করে রেখেছে। তখন সে দেশে মুক্তমত ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, নারী জীবন ছিল দুর্বিষহ। ১০ বছর বয়সী মেয়েদের পড়ালেখা, একা রাস্তায় বের হওয়া, গান শোনা, সিনেমা-টিভি দেখা ছিল নিষিদ্ধ। ভোটাধিকার, নির্বাচনসহ নাগরিকদের কোনরকম গণতান্ত্রিক অধিকার ছিলো না। অর্থাৎ আধুনিক গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির বদলে আফগানিস্তানে এক মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। মূলত এ ধরনের শাসনই চায় তালেবান। তালেবান মূলত ওয়াহাবী ধারার পশতু ভাষী জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট। আফগানিস্তানে উজবেক, তাজিক জাতিগোষ্ঠীর লোকজন আছে। বিভিন্ন ধরনের ইসলামী সশস্ত্র গ্রুপ ক্রিয়াশীল। তালেবান ক্ষমতায় গেলে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক হিস্যা স্বাভাবিকভাবেই নিশ্চিত করতে পারবে না। আবার বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারও তাদের থাকবে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ সংঘাত বা ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষের সমূহ সম্ভাবনা আছে। অন্যদিকে বিশ্বের প্রধান ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আফগানিস্তানে পরাস্ত হয়েছে, এটা তালেবানসহ বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর পালে হাওয়া দেবে। পাকিস্তান, ভারতসহ বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিকাশ ও আক্রমণের নতুন টার্গেট হতে পারে। তালেবানের এই উত্থান বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক। আওয়ামী দুঃশাসনের ফলে যে বিক্ষুব্ধতা জনমনে বিরাজমান, এর বিরুদ্ধে বাম গণতান্ত্রিক শক্তির আন্দোলন যদি গড়ে না ওঠে, তবে এই বিক্ষুব্ধতা মৌলবাদী শক্তির দিকে হেলে পড়বে। যা থেকে যেকোনো পশ্চাৎপদ শক্তির উত্থান ঘটতে পারে।

আফগানিস্তানে গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশই জনমুক্তির পথ

আফগানিস্তানে একই সাথে দুটি সত্য আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। প্রথমটি হলো, কোনো দখলদার শক্তিই শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। মানে গণতন্ত্র বা বিপ্লব রপ্তানি করা যায় না। আর দ্বিতীয়টি হলো, যত বড় শক্তিই হোক জনগণের প্রতিরোধের মুখে সে পিছু হটতে বাধ্য। এই লড়াইয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির অনুপস্থিতি হলে যেকোনো দক্ষিণপন্থীরা তা করায়ত্ত করবে।

আমরা দীর্ঘ আলোচনায় দেখলাম যে, আফগানিস্তানে বর্তমান সমস্যার  একটা দীর্ঘ প্রেক্ষাপট আছে। তাই আফগান জনগণের সমস্যা সমাধানের কোনো টোটকা দাওয়াই নেই। মার্কিন বিরোধী লড়াই থেকে আফগান জনগণ যে মুক্তির আকাক্সক্ষা ধ্বনিত করছে, তালেবান সেই আকাঙ্ক্ষাকে ‘ইসলামী রাষ্ট্রে’ রূপান্তর করছে। ফলে আফগান জনগণ ও তালেবানের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে স্পষ্টতই পার্থক্য বিদ্যমান। তাই আফগান জনগণের লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যত দ্রুত একটি অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিবেন, তত দ্রুতই তাদের রাজনৈতিক ভাগ্যের বদল ঘটতে পারে। আফগানিস্তানে এই শক্তির বিকাশের লক্ষ্যে সকল ধরনের সহযোগিতা প্রদানই বিশ্বের মুক্তিকামী-গণতন্ত্রমনা মানুষের কর্তব্য হওয়া উচিৎ বলেই আমরা মনে করি।

সাম্যবাদ-আগস্ট ২০২১

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments