গোটা মধ্যযুগ ধরে ভারতের সংস্কৃতি, স্থাপত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলার ঔৎকর্ষ, হিন্দু—মুসলমানের মিলিত সাধনার ফল। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ভারতবর্ষের সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি হিন্দু মুসলমানের সংমিশ্রণে বিচিত্র সৃষ্টি জেগে উঠেছে। তারই পরিচয় ভারতবর্ষীয় পূর্বপরিচয়।” তাই মুসলমান জনগোষ্ঠী, তাদের সাহিত্য সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিলে ভারতবর্ষের অখণ্ড ধারণা কি বাস্তবসম্মত হতে পারে?
আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে দেখেছি, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কিছু বিরোধ থাকলেও এবং মুসলমান শাসক ও হিন্দু জনগণের মধ্যে কিছু বিরোধ থাকলেও সেটাই প্রধান ছিল না। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, “হিন্দুদের সাহিত্যের প্রতি মুসলমানদের আক্রোশের কোন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।” ঐতিহাসিক কালিকারঞ্জন কানুনগো বলেছেন, “Islam did not sriously disturb the continuity of Indian culture … Islam never waged war against culture at any stage of its history in India or outside.” সমগ্র মধ্যযুগ ধরে মুসলমান শাসকরা আমাদের ভারতবর্ষের নানা রাজ্যে রাজত্ব করলেও আমরা দেখেছি মন্দিরের মধ্যে ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন, ইসলামের অনুশাসনে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, সঙ্গীত ও শিল্পের প্রভূত চর্চ্চা হয়েছিল। শিল্পে ফুল লতাপাতা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বস্তুর অনুকরণও ইসলামে নিষিদ্ধ ছিল। মধ্যযুগে ভারতীয় মুসলমান শাসকরা মসজিদে এই ইসলাম নিষিদ্ধ শিল্পের চর্চ্চা করেছে। প্রখ্যাত শিল্প ঐতিহাসিক হ্যাভেল মন্তব্য করেছিলেন, “Tajmahal belongs to India, not to Islam.” যে ফৈয়াজ খাঁ ‘বন্দে নন্দকুমার’ গানটি গেয়ে গোঁড়া মুসলমানদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, গুজরাট দাঙ্গায় ‘হিন্দুত্ববাদী’ দুবৃর্ত্তরা তাঁর কবরটি ভেঙ্গে তছনছ করে রাতারাতি সেখানে পিচের রাস্তা করে দিয়েছে প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে। মোঘল সম্রাট আকবরের দরবারে ভারতীয় সঙ্গীতের আচার্যের মধ্যে পাঁচ জন হিন্দু ছিলেন। এমনকি যে ঔরঙ্গজেব সঙ্গীতশাস্ত্রকে নিষিদ্ধ করেন বলে প্রচার আছে, তার দরবারের প্রিয় গীত কবি ছিলেন ব্রাহ্মণ বংশীয় আলম পণ্ডিত।
এইরকম অজস্র নিদর্শন রয়েছে — যা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে ভারতবর্ষের সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, সবকিছুই মিলিত সাধনার ফলশ্রুতি। যে আর্যগোষ্ঠী ভারতে এসেছিল, তাদের ভাষা দেবভাষা বলে আখ্যায়িত হয়েছে হিন্দুদের মধ্যে। মধ্যযুগের শাসনে হিন্দুদের সেই দেব ভাষায় কাব্য রচনা করেছেন দরাফ খাঁ ও আব্দুর রহিম। বাংলার সুলতান হুসেন শাহ’র দরবারে রূপ, সনাতন, পুরন্দর খাঁ প্রমুখ হিন্দু মুসলমান একত্রে শাস্ত্র অনুশীলন ও আলাপ আলোচনা করতেন। তাঁরই আমলে পরাগল খাঁ মুসলমান হয়েও বাংলায় মালাধর বসুকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন ‘পরাগলী মহাভারত’। বিপ্রদাস পিপলাই ও বিজয়গুপ্তের বিখ্যাত মনসামঙ্গলও এই সময়ে লেখা হয়। হলির দিনে ব্রাহ্মণেরা যে মদনাষ্টক পাঠ করে, তার রচয়িতা আকবরের সেনাপতি ও মন্ত্রী আব্দুর রহিম খানা। আকবর বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয়ে দীন-ইলাহী ধর্মের প্রবর্তন করেন তাই নয়, তাঁর আদেশে বহু সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়, এই সময়ে ফতেহপুর সিক্রির এবাদতখানায় সমস্ত ধর্মের প্রধান ও দার্শনিকদের মতবিনিময় চলত। ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, “আকবরই প্রথম মুসলিম সম্রাট যিনি সচেতন ভাবে উভয়সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতু বাঁধতে চেয়েছিলেন, যদিও তার পিছনে ছিল ঐহিক প্রেরণাও ছিল। প্রথমেই তিনি তুলে দিলেন জিজিয়া। তারপর হিন্দু তীর্থে যাবার জন্য মাথট। হিন্দুদের দেওয়া হলো বড় বড় মনসবদার (তার সঙ্গে জায়গীর)। মানসিংহ সাত হাজারী (সর্বোচ্চ) মনসবদার, টোডরমল-দেওয়ান, বীরবলপ্রিয় সভাসদ। … হিন্দুদের সতীদাহ বন্ধ করতে চাইলেন তিনি, ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন, মহাভারত, রামায়ণ, গীতা ফার্সিতে অনুবাদ করালেন। বৃন্দাবনের বৈষ্ণব মঠের পৃষ্ঠপোষকতাও করলেন।” আকবরের সময় গো-হত্যা বন্ধের নির্দেশ ছিল। বেদান্ত চর্চা চলতো। সুন্নি মুসলিম মৌলবাদ তখন শিয়া, উলেমা, সুফীদের গৃণা করতো।
শাজাহান প্রথম রাজ খরচে বাংলাদেশে দুর্গা পূজার প্রচলন করেন ব্যাপক হারে। অভিযানের সময় সহযাত্রী হিন্দু রাজাদের রাণীরা গঙ্গাস্নান করে শিবনাথ মন্দিরে পুজো দিয়ে ফেরার পর দেখা যায় কচ্চের রাজরানী নিখোঁজ। সমগ্র বারাণসী তোলপাড় করার পর মন্দিরের গর্ভগৃহে বিগ্রহের নিচে গুপ্ত প্রকোষ্ঠে খুঁজে পাওয়া যায় লাঞ্ছিতা ধর্ষিতা অর্ধমৃতা রাণীকে। ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ হিন্দু রাজারা প্রতিকার চান, চার কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। তাঁদের পীড়াপীড়িতেই অপবিত্র হয়ে যাওয়া স্থান থেকে বিশ্বনাথের পবিত্র বিগ্রহ অন্যত্র সরিয়ে দেন ঔরঙ্গজেব, ধূলিসাৎ করেন মন্দির। দোষী মোহন্তকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেন।
(পথিকৃৎ, অক্টোবর ২০০৩ থেকে সংগৃহীত)
[উৎস: সাম্যবাদ, ৮ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা, নভেম্বর ২০২১]