২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন গ্রীষ্মকালে পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিলো ৭০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট। পিডিবি’র জেনারেশন রিপোর্ট অনুসারে ২০০৯ সালের জুন মাসের ১৪ তারিখে ঘাটতি ছিল প্রায় ৭০০ মেগাওয়াটের মতো। একই রিপোর্টে উল্লেখ আছে যে, ওইদিন গ্যাস সংকটের কারণে ৩৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদিত হয় আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন ত্রুটি ও মেরামতকর্মের জন্য ৭০৭ মেগাওয়াট কম উৎপাদিত হয়। (সূত্র: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের অর্থনীতি’, লেখক- কল্লোল মোস্তফা)
অর্থাৎ দেশের সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ত্রুটি মেরামত করলে ৭০০ মেগাওয়াটের ঘাটতিটা আর থাকে না। এটা একটা দিনের কথা নয়। ঘাটতির হিসেবটা সেসময়ে গড়ে এইরকমই ছিলো। অর্থাৎ সরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে মেরামত ও আধুনিক করলে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন নেই। পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্র একই পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ নিয়েই পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে।
কিন্তু সেটা করা হলো না। বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণ হিসেবে গ্যাসের ঘাটতির কথাই বারবার সামনে আনা হলো এবং সেজন্য বেসরকারি মালিকানায় তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলো। তেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ, গ্যাস থেকে উৎপাদনের খরচের ৬ থেকে ৮ গুণ বেশি। উপরন্তু এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ব্যক্তিমালিকানায় স্থাপন করা হলো। এই কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্রের উৎপন্ন বিদ্যুতের ক্রয়মূল্য ‘এনার্জি প্রাইস’ ও ‘রেন্টাল প্রাইস’ এই দুইভাগে বিভক্ত। উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরকার এনার্জি প্রাইস দিয়ে কিনে নেবে। বিদ্যুৎ কম উৎপাদিত হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক এনার্জি প্রাইস কম পাবেন, কিন্তু রেন্টাল প্রাইস সরকারকে প্রতিমাসে পরিশোধ করতে হবে এবং সেটা এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ না কিনলেও। অর্থাৎ কোন কেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা যদি ৫০ মেগাওয়াট হয়, তাহলে ওই মালিককে প্রতিমাসে কিলোওয়াট প্রতি ১৫.৯ ডলার ভাড়া দিতে হবে।
এর ফলাফল হলো তিন বছরের মাথায় ২০১২ সালে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে পিডিবি’র দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়,“তরল জ্বালানীর ব্যবহার, বেসরকারি খাত হতে বিদ্যুৎ ক্রয় এবং জ্বালানী ব্যয়ের অংশবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।” এরপর গত ১১ বছরে ১০ বার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা হলো। এই ১১ বছরে গ্রাহক পর্যায়ে প্রায় ৯০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে।
অথচ বাংলাদেশের ৭৭ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রই পুরনো যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলছে। সেগুলো মেরামত করলে গ্যাসের দুষ্প্রাপ্যতার ব্যাপারটা আসতো না। যে সরবরাহ এখন আছে তা দিয়েই বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটানো যেতো। আবার গ্যাসের অভাব নিয়ে যা বলা হচ্ছে তাও সঠিক নয়। গ্যাস সম্পর্কিত আমাদের আলোচনায় আমরা দেখিয়েছি, নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র সন্ধান না করাসহ পেট্রোবাংলাকে অকার্যকর করে দিয়ে কিভাবে গ্যাস সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। এর বাইরে আছে গ্যাসের অপচয় ও সিস্টেম লস। গৃহস্থালী গ্যাসে খুব অল্প জায়গায় মিটার ব্যবহার করা হয়, মিটার না থাকায় গৃহস্থালীতে ব্যবহৃত গ্যাসের একটা বড় অংশই অপচয় হয়। আবার আমাদের শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত সেকেলে বয়লারও অপচয়ের একটা বড় কারণ। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী সার কারখানায় এক মেট্রিকটন ইউরিয়া সার উৎপাদন করতে খরচ হয় ২৪ হাজার ঘনফুট গ্যাস। একই পরিমাণ সার উৎপাদন করতে সরকারি যমুনা সার কারখানায় লাগে ৩২ হাজার ঘনফুট, চিটাগাং সার কারখানায় ৪২ হাজার ঘনফুট, ঘোড়াশালে ৪২ থেকে ৪৯ হাজার ঘনফুট, আশুগঞ্জে ৭৩ হাজার ঘনফুট আর ফেঞ্চুগঞ্জে ৮২ হাজার ঘনফুট গ্যাস। অর্থাৎ যে পরিমাণ গ্যাস অপচয় হয় তা রীতিমত আতংকের। তাই নতুন কূপ অনুসন্ধান ও সিস্টেম লস কমিয়ে আনলে গ্যাস সংকট সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়।
তা না করে সরকার আবার ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) বিল—২০২১’ সংসদে পাস করায়, যাতে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আরও পাঁচ বছর চালানোর আইনি স্বীকৃতি দেয়া হয়।
তবে তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকা সংসদেও কথা উঠেছে। এ কারণে এগুলো টেকসই নয় স্বীকার করে সরকার যে পরিকল্পনার দিকে হাঁটছেন, সেটাও সংকট সমাধান করবেনা, নতুন সংকট সৃষ্টি করা ছাড়া। সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছেন, তার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মেগা প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের খরচ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আড়াই—তিনগুণ বেশি। উপরন্তু এর পরিবেশে ক্ষতিকর প্রভাব ব্যাপক। রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী প্রতিবাদ—বিক্ষোভ হয়েছে ও হচ্ছে। বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে। তারপরও জনমতকে উপেক্ষা ও দমন করে সরকার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এই শখ করে লোকসান কেন? তার দায় আবার জনগণের কাঁধে চাপানো কেন? কেন পরিবেশ—প্রকৃতি ধ্বংস করা, যেখানে পুরনো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তরিত করে ফুয়েল এফিসিয়েন্সি বাড়ালে বর্তমানের অর্ধেক জ্বালানী ব্যবহার করে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব?
এর উত্তর একটিই। বৃহৎ পুঁজিপতিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। তারা এগুলো ফেলে রাখলেও টাকা পাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। আর লোকসান দেখাতে দেখাতে ধীরে ধীরে গোটা বিদ্যুৎখাতই এদের হাতে তুলে দেয়া হবে। এ লক্ষ্যেই চলছে সমগ্র আয়োজন।