[সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক, ত্রৈমাসিক ‘নতুন দিগন্ত`। গত ৬ জুলাই ২০২১ তারিখে বাসদ (মার্কসবাদী)‘র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এদেশের অনন্যসাধারণ কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর প্রয়াণে তিনি স্মরণসভায় লিখিত বক্তব্য পাঠান। পরবর্তীতে তা কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ-এ সংকলিত আকারে প্রকাশিত হয়। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে লেখাটি পুনরায় প্রকাশিত হলো।]
মুবিনুল হায়দার চৌধুরী অসুস্থ ছিলেন জানতাম, কিন্তু তাঁকে দেখে কখনও মনে হয়নি তাঁর কোনো প্রকার অসুখ ছিল। প্রসন্ন থাকতেন; এবং সর্বদাই অবিচলিত। আসলেই অত্যন্ত শক্ত ছিল তাঁর মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড সবারই থাকে, থাকতে হয়; কিন্তু শক্ত মেরুদণ্ড বেশ বিরল। আমাদের এই কমরেডের মেরুদণ্ড ছিল বিস্ময়কর রকমের দৃঢ়। কোনো অবস্থাতেই তিনি নড়তেন না। সঙ্কটে থাকতেন ধীর ও স্থির।
হায়দার ভাই রাজনীতিক ছিলেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে দল অনেক; কিন্তু ধারা দু’টি। একটি ধারা রক্ষণশীল, অন্যটি বিপ্লবী। রক্ষণশীল ধারার মধ্যে এপার ওপার আছে; কেউ কট্টরপন্থী, এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল; অন্যরা উদারনীতিক। উদারনীতিকরা সংস্কারপন্থী হতে পারেন, এমনকি বিপ্লবের কথা বলাও তাদের জন্য অসম্ভব নয়। কিন্তু উদারনীতিকেরাও শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীলই। বিপ্লবীরা সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করেন। পথের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তারা চান সমাজে ও রাষ্ট্রে মৌলিক পরিবর্তন। ধারা দু’টি স্বতন্ত্র। হায়দার ভাই বিপ্লবী ধারার রাজনীতিক ছিলেন।
কিশোর বয়সেই তাঁকে বিপ্লবের স্বপ্নে পেয়েছিল। আমৃত্যু সেই স্বপ্নকে লালন করেছেন। কিন্তু তিনি তো বিপ্লবকে পাননি। না-পাওয়ার কারণ আমরা সবাই জানি সমাজে ও রাষ্ট্রে অনেক কিছুই ঘটেছে; কোনো কোনো পরিবর্তন বেশ বড় রকমের, কিন্তু আসল বিপ্লব যে সমাজ বিপ্লব সেটা ঘটেনি। হায়দার ভাই সেই বিপ্লবকে সম্ভব করবার জন্য নিজের জীবনকে নিযুক্ত করেছিলেন। সরেননি, নড়েননি।
ব্যক্তি হিসেবেও হায়দার ভাই ছিলেন অসাধারণ। আমার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে একবার কলকাতায় যাবার। সময়টা ছিল নজরুল জন্মশতবর্ষের। সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া পশ্চিমবঙ্গ শাখা বিপ্লবী কবির জন্মশতবর্ষ উদযাপন করছিল। সে উপলক্ষেই যাওয়া। সেখানে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে; অংশগ্রহণ ঘটেছে। সবটাই ছিল আনন্দের। কিন্তু সবচেয়ে বেশী আনন্দের ছিল হায়দার ভাইয়ের সঙ্গ। কলকাতা ছিল তাঁর নখদর্পণে। ছেলেবেলায় আমিও কিছুকাল ওই শহরে কাটিয়েছি। আমরা দু’জনে অনেক জায়গায় গেছি। দেখেছি সাংস্কৃতিকভাবে তিনি কতটা উন্নতমানের ছিলেন।
বস্তুত সংস্কৃতিতে ছিল তাঁর বিশেষ অবস্থান। তাঁর নিজের সংস্কৃতিতে ছিল পরিচ্ছন্ন রুচি ও বৈজ্ঞানিকতা। সংস্কৃতিকে উন্নত না করতে পারলে যে সামাজিক বিপ্লব ঘটবে না এটা তাঁর দল জানতো, হায়দার ভাইও জানতেন বিশেষভাবে। আর ছিল নৈতিকতার বোধ। রাজনৈতিক নীতির প্রশ্নে যেমন অবিচল ছিলেন তেমনি ব্যক্তিগত নৈতিকতার ব্যাপারেও ছিলেন অত্যন্ত শক্ত। শক্ত হতে তিনি অন্যদেরকেও বলতেন। নৈতিক মেরুদণ্ড যে দৈহিক মেরুদণ্ডের চাইতেও অধিক কার্যকর এটা তাঁকে দেখে নতুন করে বুঝতাম।
মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ভেতর আত্মপ্রকাশের কোনো আগ্রহ ছিল না। নিজেকে তিনি প্রচ্ছন্ন রাখতে চাইতেন। সেটাও ছিল তাঁর সংস্কৃতি ও নৈতিকতার অংশ। ভাবতেন তিনি জীবিত ও জীবন্ত থাকবেন তাঁর কাজের মধ্যে। কাজই হবে তাঁর পরিচয়। কাজে তাঁর বিরাম ছিল না। কিন্তু আবার অস্থিরতাও দেখিনি। রাজনীতিকদের মধ্যে তাঁর মতো অঙ্গীকারবদ্ধ অথচ মৃদুভাষী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। যুক্তি ছাড়া কথা বলতেন না; অথচ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ছিলেন অনড়।
ভেতরে নিশ্চয়ই অনেক রাগ ছিল। রাগ অনুরাগেরই ভিন্ন প্রকাশ। অনুরাগটা ছিল সুন্দর এক সমাজের প্রতি। আর সে জন্যই রাগটা ছিল বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার অমানবিকতার ওপর। অনুরাগটা ছিল অত্যন্ত প্রবল, তাই রাগটাও ছিল গভীর ও গাঢ়। ঘৃণাহীন ভালোবাসা বলে তো কিছু নেই; হায়দার ভাই ভালোবাসতেন তাঁর স্বপ্নকে, বরং সে কারণেই ঘৃণা করতেন বিদ্যমান ব্যবস্থাকে। তাঁর সেই প্রেম ও ক্রোধ তাঁকে আজীবন ব্যস্ত রেখেছে। ব্যস্ত, কিন্তু অস্থির নন। তিনি জানতেন বিপ্লব ছাড়া মুক্তি নেই।
পুঁজিবাদ এখন তার নিজেরই নিকৃষ্টতম ও নিষ্ঠুরতম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলছে। চলবে। সেই সংগ্রামে হায়দার ভাই ছিলেন, এবং থাকবেন। তাঁর মতো মানুষদের প্রয়োজন সব সময়েই ছিল, এখন অনেক বেশী। সমাজ বিপ্লবের পথে আমরা যতই এগুবো হায়দার ভাই ততই উজ্জ্বল হয়ে উঠবেন। তাঁর মতো মানুষদের প্রস্থান আছে, মৃত্যু নেই।
তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রইলো; এবং কৃতজ্ঞতা রইলো তাঁর কাজের জন্য।
অনিবার্য সামাজিক বিপ্লব ত্বরান্বিত হোক।