বাসদ(মার্কসবাদী)-র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এদেশের অনন্যসাধারণ বিপ্লবী চরিত্র কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণসভা আজ ১৫ জুলাই ২০২২ বিকাল ৪টায় বিএমএ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন বাসদ (মার্কসবাদী)-র সমন্বয়ক কমরেড মাসুদ রানা ও সভা সঞ্চালনা করেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের সদস্য কমরেড জয়দীপ ভট্টাচার্য। স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন ভারতের এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ, বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের সমন্বয়ক শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাবেক সভাপতি মোস্তফা ফারুক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “শোষণমুক্তির চিন্তাটাই কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীকে আজীবন তাড়া করে ফিরেছে। তাই সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতেই তিনি তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন। বিপ্লব হচ্ছে সার্বক্ষণিক কাজ। এই চর্চার দিকটাকেই তিনি সামনে এনেছেন। বিপ্লব মানে মূলত সমাজ বিপ্লব, সেই সমাজ বিপ্লব করতে হলে সাংগঠনিক প্রস্তুতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির দিকটাকে কমরেড হায়দার সবসময় সামনে রাখতেন। বর্তমানে বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রভাবে সমস্ত ঐক্য ভেঙে যাচ্ছে। সভ্যতা বিশ্বব্যাপী একটা ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই পুঁজিবাদের সকল ধরনের ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতিকে আমাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে। মানুষের মধ্যে হতাশা, আত্মহত্যা যেসব প্রবণতা বাড়ছে, এসব তো পুঁজিবাদের কারণেই হচ্ছে। তাই বিপ্লবী রাজনীতির জন্য আমাদের হতাশাকে দূরে ঠেলে দিতে হবে। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী কখনও হতাশ হননি। তিনি আজীবন লড়াই করেছেন সামাজিক মালিকানার সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। তাঁর প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।”
উল্লেখ্য গত বছর ৬ জুলাই ৮৭ বছর বয়সে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী প্রয়াত হন। তিনি আমৃত্যু এদেশের শোষিত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তিনি কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শ ও চরিত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে শৈশবেই ভারতে এসইউসিআইসি দলের সাথে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবিরে কাজ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি এদেশে আসেন। সদ্য-স্বাধীন দেশে বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে জনগণ যুদ্ধ করেছিল, তাদের স্বপ্ন অপূরিত থেকে যায়। এদেশে পুরাতন ও প্রচলিত বামপন্থী রাজনীতির ধারা মুক্তিযুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা নিতে পারেনি, শোষিত মানুষের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে দেশের যুবক-তরুণরা এই শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা ধারণ করলেও সঠিক পথের দিশা না পাওয়ায় দিকভ্রান্ত–এরকম প্রেক্ষাপটে এদেশের শ্রমজীবী মেহনতী সাধারণ মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় সত্যিকারের শ্রমিকশ্রেণির দল গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশে আসেন।
কমরেড মুবিনুল হায়দার মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে পাথেয় করে সারাজীবন ধরে এদেশে শোষিত মেহনতী মানুষের মুক্তির জন্য শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী দল গড়ে তোলার সংগ্রাম করেছেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় তিনি শিখিয়েছেন, বিপ্লবী রাজনীতির চেয়ে মর্যাদাময় জীবন আর নেই। রাজনীতি হলো হৃদয়বৃত্তি, বিপ্লবী রাজনীতি হলো উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি। শোষিত নিপীড়িত মানুষের প্রতি ভালবাসা ও দরদবোধই এই রাজনীতির আধার। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় তিনি শিখিয়েছেন, আজকের এই যুগে সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। কমিউনিস্ট আন্দোলনকেও তা প্রভাবিত করছে। তাই এই যুগে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হলে কমিউনিস্ট চরিত্র গড়ে তুলতে হবে। এই শিক্ষায় দলের কর্মীদের গড়ে তুলেছেন। জীবনভর সংগ্রামে তিনি অসংখ্য বিপ্লবী কর্মী তৈরি করেছেন। ‘দলই জীবন, বিপ্লবই জীবন’–এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর শিক্ষায় আজকের দিনে এই চরিত্র গড়ে তোলার সাধনার পাশাপাশি দেশের শোষিত মানুষের মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশের মানুষের উপর আজ ফ্যাসিবাদী শাসন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। এই ফ্যাসিবাদী শাসনকে উচ্ছেদ করার লড়াইয়ের পাশাপাশি পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে বেগবান করতে হবে। এই সংগ্রামে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর উজ্জ্বল চরিত্র আলোকবর্তিকার মতো আমাদের পথ দেখাবে।