কথা হচ্ছিল রাস্তার পাশের টং-এর চা বিক্রেতা খালেদ চাচার সাথে। তার চোখেমুখে স্পষ্টত বিরক্তির ছাপ। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো একরাশ বিক্ষুব্ধ শব্দমালা। দুপুরবেলা বাসায় গিয়েছিলেন। দু’মুঠো খেয়ে একটু বিশ্রাম নেবেন বলে। বললেন, “গেছিলাম খাইতে। ২ ঘণ্টা ধইরা কারেন্ট নাই। সারাদিন কাস্টমারের লগে ৫ টাকা না ৭ টাকা নিয়া গ্যাঞ্জাম কইরা বাসায় গিয়াও শান্তি নাই। দিনের বেলা ঘরটা আন্ধাইর। গরমে ঘামতে ঘামতে শ্যাষ। মনে হইলো দোজখে আছি।” কথা যেন তার শেষই হতে চায় না। বলতে থাকেন, “চাইল, ডাইল, তেলের দাম বাড়ছে। এহন আবার চিনির দাম বাড়ছে। রিক্সাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা এখন কম আসে, কম খায়। কাস্টমার কইম্যা গেছে। সরকার ‘কসমেটিক’ এর লাহান উন্নয়ন করে। ‘কসমেটিক’ লাগাইলে দেখতে হুনতে সুন্দর লাগে। কিন্তু পানি দিলে ধুইয়া সাফ।”
খালেদ চাচার কথা মনে ধরলো। সত্যি তো তাই! সরকারের এই উন্নয়ন কসমেটিক উন্নয়নই বটে! আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন খালেদ চাচাদের কাছে কসমেটিক উন্নয়ন হিসাবে দেখা দিয়েছে।
শতভাগ নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন—এ দুটি ছিল আওয়ামী লীগের কথিত উন্নয়নের দৃশ্যমান মডেল, গালভরা প্রচার। বিদ্যুৎখাতে উন্নয়নের নমুনা আজ সকলের কাছে পরিষ্কার। একদিন সংসদে দাঁড়িয়ে যারা বিদ্যুৎ বিক্রি করার দম্ভোক্তি করতেন, আজকে তারাই জনগণকে কৃচ্ছতা সাধনের ছবক দিচ্ছেন। কিন্তু বিদ্যুতখাতে এহেন সংকটের কারণ কী?
সরকার বলছে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নাকি এই সংকটের কারণ। এ যুদ্ধের ফলে স্পট মার্কেট বা খোলাবাজারে এলএনজির দাম অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। রিজার্ভ ঘাটতির কারণে সরকারকে এই এলএনজি কেনা বন্ধ করতে হচ্ছে। একই কারণে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিও বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। সরকারের ভাষ্যে, এ জন্য ১ হাজার থেকে ১৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দেবে। আর এই ঘাটতি দূর করা হবে পরিকল্পিত লোডশেডিং করে, অফিস টাইম পরিবর্তন করে, উৎসবে আলোকসজ্জা বন্ধ রেখে। সরকার তার ভুল জ্বালানী নীতির, জ্বালানী খাতে লুটপাটের সকল দায় চাপিয়ে দিচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের উপর। বাস্তব সত্যটা কী?
সরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৪ মেগাওয়াট। আর গ্রাহক চাহিদা গরমকালে ১৪-১৫হাজার মেগাওয়াট আর শীতকালে ৮ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ দেশে বিদ্যুতের যা চাহিদা, তার থেকে বেশি উৎপাদন ক্ষমতা আছে। তারপরও সংকট কেন?
সরকার ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে নামে-বেনামে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। এর বেশিরভাগেই সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও উৎপাদন হয় না। কিন্তু প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ উল্টো এদের ভতুর্কি দিতে হচ্ছে। গত ১৫ বছরে কোন ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই সরকারকে ৭০ হাজার কোটি টাকা ভতুর্কি দিতে হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিকে অকার্যকর করে দিয়ে এই সব ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। শুরু থেকেই আমাদের দলসহ অনেকেই এই টোটকা পদ্ধতি যে কতিয় ব্যবসায়ীদের লুটপাটের জন্য এবং এটি যে বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর হবে সে হুশিয়ারি দিয়েছিল। তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি একটি বিকল্প জ্বালানী প্রস্তাবনাও দিয়েছিলো। কিন্তু বধির সরকার সেসব শোনেনি। সরকারের বেপরোয়া গোয়াতুর্মির মাশুল আজ জনগণকে দিতে হচ্ছে।
সরকার বিদ্যুখাতে একটি মহাপরিকল্পনা করেছে। এই মহাপরিকল্পনার মূলকথা হলো গোটা বিদ্যুৎখাতকে দেশি-বিদেশী ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়া। ক্রমাগত বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো। যে কারণে সরকার সকল ধরণের সাংবিধানিক নিয়ম কানুনকে অমান্য করে দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। গত ১১ বছরে বিদ্যুতে পাইকারি দাম ১১৬ শতাংশ বাড়িয়েছে। দেশের ভেতরে গ্যাস মজুদ থাকার পরও গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান বন্ধ রাখা হয়েছে। বাপেক্স-পেট্রোবাংলার সক্ষমতা না বাড়িয়ে দেশকে আমদানি নির্ভর করা হয়েছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজির মতো দামী গ্যাস আমদানির নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে আজকের এই সংকট। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ একটা অজুহাত মাত্র। গত বছরে ডিজেল চালিত কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে শতকরা মাত্র ০.৭৬ শতাংশ। দেশের বাইরে থেকে এলএমজি আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, এ রকম কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ১০টি এবং এই ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রই গত ৩ বছর ধরে বন্ধ। ফলে সরকার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের যে যুক্তি হাজির করতে চাচ্ছে তার এক বর্ণও সত্য নয়।
এটা স্পষ্ট যে, বিদ্যুৎখাতের সংকট বাস্তবে সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতির কারণেই হয়েছে। সরকারের এই নীতিটি হলো, বিদ্যুতখাতের উদারিকরণ। নিজেদের সক্ষমতা তৈরি না করে আমদানি নির্ভরতা। আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী নিজেদের শাসন ক্ষমতা রক্ষার জন্য বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর সাথে গাঁটছড়া বাঁধে। এ ছাড়া তাদের আর কোন পথ নাই। অনেকেই বলেন, এটা সরকারের ভুল নীতি। যেন সরকার বুঝতে না পেরে এই নীতি গ্রহণ করেছে। তারা সরকারের ভুল নীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেন। এর মধ্য দিয়ে সমস্যার প্রধান দিক থেকে জনগণের নজর সরিয়ে দেন। তাদের মধ্যে এ মোহ তৈরি করেন যে, সরকার ভুলনীতি সংশোধন ও দুর্নীতি নিমূর্ল করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিষয়টা মোটেও তেমন নয়। আসলে বর্তমান যুগটাই হলো বৃহৎ পুঁজির পরগাছাবৃত্তির যুগ। নব্য উদারিকরণ, দুর্নীতি, লুটপাট বর্তমান সময়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। তাই যেটাকে ভুলনীতি বলা হচ্ছে, সেটা শাসকদের ও বর্তমান সমাজের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যে রূপ নিয়েছে। তাই এটা শাসকদের ভুল নীতি নয়, এটাই শাসকদের মূলনীতি। আর এর ফলেই শাসকরা আজ কোথাও শিল্পের বিকাশ ঘটাতে আগ্রহী নয়। তারা লোক দেখানো বা অন্তঃসারশূন্য উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে নিজেদের রক্ষা করতে চায়। এটাই খালেদ চাচাদের কাছে ‘কসমেটিক উন্নয়ন’।
তাই আবেদন-নিবেদন করে তাদের ভুলনীতি সংশোধনের মোহ ছড়ানো সমাধান নয়। জনগণের শক্তিশালী আন্দোলনই শাসকদের বাধ্য করতে পারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতকে জনবান্ধব করতে। এ পথে অগ্রসর হওয়াই আজকের মূল কাজ। বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি বিকল্প প্রস্তাব রেখেছে অনেকদিন হয়। জাতীয় কমিটির এই প্রস্তাবকে কার্যকর করাতে হলেও আন্দোলনের বিকল্প নাই। আপনি কি করবেন? ভাবুন!