দেশের সাড়ে ৬ কোটি শ্রমিকের ৮৬ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যুক্ত। তারা যে জায়গায় শ্রম দেন সেখানে কোন চুক্তিপত্র নেই। নির্দিষ্ট বেতন নেই। ছুটি নেই, বোনাস নেই, পেনশন নেই। তারা অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য সামান্য সঞ্চয়ের টাকা ভাঙতে হয়, আবার কাজ না করতে পারার কারণে সেই দিনের উপার্জনটাও যায়। যারা চাকরি করেন, স্থায়ী আয় আছে, তারাও ভালো নেই। সম্প্রতি ডব্লিউএফপি’র প্রতিবেদনে এসেছে—এ বছরের আগস্ট মাসে পরিবারের খাদ্য কেনার জন্য দেশের ৬৪ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়েছেন। ২৯ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙেছেন। এর মধ্যে ১০ শতাংশ পরিবার তাদের ১২ মাসের সব সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছেন।
এই অবস্থার মধ্যেই আসছে নির্বাচন। গত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেননি। দেশের মানুষের মনে ভোটাধিকার হারানোর জ্বালা আছে, সাথে যুক্ত হয়েছে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট। সরকারি সকল অফিসে, পাড়ায়-মহল্লায়, ব্যবসাক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য ও চাঁদাবাজিতে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। গোটা দেশে আওয়ামী মাফিয়াতন্ত্র কায়েম হয়েছে। চাকরি থেকে ব্যবসা, বিয়ে কিংবা কুলখানি—কোন কিছুই আওয়ামী মাফিয়াতন্ত্রের মতামত ও তাদেরকে হিস্যা দেয়া ব্যতিরেকে সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়। এই সকল কারণে দেশের মানুষের মধ্যে তীব্র আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাব আছে। নির্বাচনকে ঘিরে তাই জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। ভোটের অধিকারের সাথে সাথে সাংবিধানিক সংস্কারের দাবিও এসেছে রাজনীতির মাঠে। এগুলো কোনটাই ফেলে দেয়ার নয়। সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার দূর করার জন্য সাংবিধানিক সংস্কারও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এতকিছুর পরেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। আওয়ামী লীগের পতন ও একটা সুষ্ঠু নির্বাচন কি মানুষকে মুক্তি দিতে পারবে? সংবিধান সংশোধন করে কি রুখে দেয়া যাবে বুর্জোয়া দলগুলোর ক্ষমতার অপব্যবহার-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতায় টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা?
নির্বাচনী ব্যবস্থা একটা সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরিকাঠামো
দুনিয়াতে নির্বাচন ও সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একটা ইতিহাস আছে। একটি সামাজিক প্রয়োজনীয়তা তখন দেখা দিয়েছিলো। সামন্ত অর্থনীতি ভেঙে যখন পুঁজিবাদের জন্ম হয়, অর্থনীতিতে তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অবস্থান ছিলো। এই ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিলো অবাধ প্রতিযোগিতা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই অবাধ প্রতিযোগিতা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্ম দেয়। কিন্তু কালক্রমে ঐতিহ্যবাহী পুঁজিবাদী দেশগুলোতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই অবাধ প্রতিযোগিতার স্তর পার হয়ে একচেটিয়া পুঁজিবাদের জন্ম হয়। এ পর্যায়ে পুঁজিবাদ তার প্রগতিশীল ভূমিকা হারিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হয়। এই সকল দেশের একচেটিয়া পঁুজিপতিরা তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি অনুন্নত দেশগুলোতে খাটানো শুরু করে। শুরু হয় বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মাধ্যমে অনুন্নত দেশের সস্তা শ্রম শোষণ। মহান লেনিন একে বলেছেন, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর—সাম্রাজ্যবাদ। অর্থনীতির এই পরিবর্তনের প্রভাব উপরিকাঠামোয়ও প্রভাব ফেলে। বৃহৎ পুঁজিবাদী দেশগুলোর পার্লামেন্টেও পরিবর্তন আসে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টগুলো পরিণত হয় দ্বি-দলীয় পার্লামেন্টে, বহুদলীয় ব্যবস্থা লুপ্ত হয়। বাইরে থেকে দেখা যায় যে, নির্বাচনটা ঠিকঠাকই হচ্ছে, কিন্তু ভেতরে সেটি অন্তঃসারশূণ্য। বড় দুই দলের বাইরে কোন দলের জেতা তো দূরের কথা, প্রচারে ভোটারদের সামনে আসারও কোন উপায় নেই।
বিশ্ব পুঁজিবাদের এই ক্ষয়িষ্ণু পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্ম। এই দেশ স্বাধীন করতে দেশের সাধারণ মানুষের অশেষ ত্যাগ ও আত্মদান থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেহেতু তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি পুঁজিপতিদের দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়, সেহেতু দেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় আসলো, কিন্তু মুক্তি আসলো না। পুঁজিবাদের এই প্রতিক্রিয়াশীল যুগে বাংলাদেশের পুঁজিবাদের চরিত্র খুব বিপ্লবাত্মক হওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে অবশ্যম্ভাবী উপজাত হিসেবে লুটপাট, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ শুরু হয়। আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যায় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এর আগে ও পরে সমস্ত রকম নীতিবর্জিত কর্মকাণ্ড।
বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস—দুর্বৃত্তায়নের ইতিহাস
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কাঠামোয় অনুষ্ঠিত ১৯৭০ সালের শেষ নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে নির্বাচিত লোকদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়, এই গণপরিষদে ১৯৭২ এর সংবিধান পাস হয়। সেই সরকারের অধীনে স্বাধীন দেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। আওয়ামী লীগ তখন স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বকারী দল আর আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবর রহমান তখন দেশের অবিসংবাদিত নেতা। আওয়ামী লীগের এ নির্বাচয়ে জয় নিশ্চিত ছিলো। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ১১টি আসনে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিতও হয়েছিলো। কিন্তু তারপরও ১৫টি আসনে আওয়ামী লীগ মারদাঙ্গা, এজেন্ট হাইজ্যাক ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়।
১৯৭৭ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তার শাসনকে বৈধতা দেয়ার জন্য একটি গণভোটের আয়োজন করেন। এই নির্বাচনে কোন বিরোধী পক্ষ ছিলো না। ভোটের কিছুদিন আগে জিয়াউর রহমান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে দিয়ে নিজে রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৭ সালের এই গণভোট ছিলো তার বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য। ভোটের ব্যালটে লেখা হয়—‘রাষ্ট্রপতি হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের উপর আপনার আস্থা আছে কিনা?’ এর উপর ভিত্তি করে ভোটারদের ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ভোট দিতে হবে। নির্বাচনের পর সরকারি রিপোর্টে দেখা যায় যে, নির্বাচনে ৯০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি ছিলো আর জিয়াউর রহমানের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছে ৯৯ শতাংশ। প্রায় খালি ভোটকেন্দ্রগুলো যখন মানুষ দেখেছেন তখন ৯০ শতাংশের উপস্থিতি দেখানোটা এতটাই অতিরঞ্জিত ছিলো যে সেটি দেশ ও বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এরপর ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কিংবা ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন—সবকিছুই ছিলো জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য। ১৯৭৮ সালের নির্বাচনের পর জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের পরের জাতীয় সংসদ ছিলো সর্বাপেক্ষা বিরোধী দলে সজ্জিত সংসদ। কিন্তু সেটাও অবাধ ও সুষ্ঠু ছিলো না। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির অনেক প্রার্থী অভিযোগ করেন যে তাদেরকে হারিয়ে পরিকল্পিতভাবে বিরোধীদের আসন দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ নিজের জয় নিশ্চিত করে সংসদটি সর্বাপেক্ষা গণতান্ত্রিক দেখানোর জন্যই এই সংসদে এত বিরোধীদলের সমাহার ছিলো। এরপর থেকে জিয়াউর রহমানকে বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে প্রচারে নিয়ে আসে। যদিও সবকিছুই ছিলো পরিকল্পিনারই অংশ।
স্বৈরাচারী এরশাদের অধীনে ১৯৮৬ সালের নির্বাচন নিয়ে মক্তব্য নিষ্প্রয়োজন। এরশাদের শাসনকে পাকাপোক্ত করার জন্যই এই নির্বাচন। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের অধীনে ১১ ফেব্রুয়ারি ও আওয়ামী লীগের অধীনে ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিলো একপাক্ষিক। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সকল দল অংশগ্রহণ করেছিলো। কিন্তু সেই নির্বাচনের রিগিং ছিলো দেশের ইতিহাসে অদ্বিতীয়। নির্বাচনের আগের দিন রাতে প্রশাসনের কর্মকর্তা—কর্মচারীরাই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে দেন। ১৯৯১, ১৯৯৬ কিংবা ২০০৮ সালের নির্বাচন আপেক্ষিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও টাকা, পেশিশক্তি ও মিডিয়ার প্রভাব ছিলো প্রাধান্যে।
শুধু নির্বাচনের দিন কারচুপি কিংবা ভোট ছিনতাই নয়, নির্বাচনের আগে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংও এই সংসদীয় গণতন্ত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ যেমন তথ্য সচিব ও পুলিশের দুজন এসপিকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছেন, নির্বাচনের আগে পুরো মাঠ প্রশাসনকেই ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেছে, ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে বিএনপি আমলেও। ২০০২ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ৪৮ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও ৩৮ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন হওয়ার পর ক্ষমতাসীন সকল দলই চেষ্টা করেছেন যেকোন উপায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে নিজের দলীয় লোকের আসার ব্যবস্থা করতে। সেজন্য বিচার বিভাগে প্রয়োজনীয় রদবদল করেছেন, আইন সংশোধন করেছেন, এমনকি প্রধান বিচারপতির অবসরের সময়সীমা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সাথে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছে, আবার এখন বিএনপিকেই যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগে অভিযুক্ত করছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন প্রনয়ণের পর আওয়ামী লীগ এটাকে লড়াই করে গণতন্ত্রের পক্ষে আনা একটা বড় জয় বলে আখ্যায়িত করেছে, এর সমস্ত ক্রেডিট দাবি করেছে। আবার নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বাতিল করেছে। বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলো তাদের ২০০০ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত শাসনামলে, ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’-এর মধ্য দিয়ে। আর আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে তালিকা করে বিরোধীদের হত্যা করছে। দুর্নীতি-দুঃশাসনে এরা কেউ কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই। তারা বিরোধী দলে অবস্থানকালীন সময়ে গণতন্ত্র আর সরকারে থাকলে উন্নয়নের ঝাণ্ডাবাহী। মিথ্যার পর মিথ্যা বলা আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা তাদের ঐতিহ্য। তাই সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন, সামরিক সরকারকে বৈধতা দেয়ার নির্বাচন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন—যে ধরনের নির্বাচনই হউক না কেন, এর মধ্য দিয়ে জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। তারা এক স্বৈরাচারীর হাত থেকে আরেক স্বৈরাচারের হাতে পড়বে। ফুটন্ত কড়াই থেকে প্রাণ রক্ষার জন্য লাফ দিয়ে পড়বে জ্বলন্ত চুলায়।
আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাবই বিএনপির শক্তির উৎস
জিয়াউর রহমানের শাসনকাল বাদেও বিএনপি দুই দফায় শাসনক্ষমতায় ছিলো। যে সকল নীতিগত সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলে নেয়া হয়েছে তার সবকিছুই বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে বহাল ছিলো। বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থে দেশ পরিচালনা, বহুজাতিক কোম্পানির হাতে দেশের সম্পদ তুলে দেয়া, ভারতের সাথে বাংলাদেশের পক্ষে অপমানজনক পররাষ্ট্রনীতি বহাল রাখা, ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট, তারেক রহমানের নেতৃত্বে হাওয়া ভবনে সিভিল প্রশাসনের সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে তোলা ও এই কেন্দ্র থেকে মাফিয়াতন্ত্র পরিচালনা করা—সবই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার করেছে। তাদের ভোটের সেস্নাগানও অভিন্ন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি সকল দলই ভোটের সময় পাল্লা দিয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে। সবাই ভোটের আগে জনগণকে কম খরচে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি আর কৃষককে তার ফসলের ন্যায্য মূল্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রতিশ্রুতি দেয় বেকারকে চাকরি দেয়ার। এই দলগুলো এই একটা জিনিসই সত্যিকার অর্থে জনগণকে দেয়, সেটা হলো প্রতিশ্রুতি। ক্ষমতায় যাওয়ার পর যে শ্রেণি তাদেরকে ক্ষমতায় এনেছে, সেই ব্যবসায়ী শ্রেণির স্বার্থেই সকল রকম নীতি ও পরিকল্পনা তারা প্রণয়ন করে। দল ও দলীয় নেতাকর্মীরা সেই সকল ব্যবসার কমিশন পায়, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের টাকা লুটপাটের ভাগ পায়। এর কোন ব্যত্যয় নেই। জনগণ তা জানেন।
কিন্তু কোন শক্তিশালী বিকল্প না থাকায় জনগণের আওয়ামী বিরোধী ক্ষোভকে বিএনপি পুঁজি করতে পেরেছে। এই সমর্থন বিএনপির রাজনীতির প্রতি সমর্থন নয়। বিএনপি আন্দোলন আন্দোলন ভাব দেখানোর জন্য দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বেশকিছু জনপ্রিয় ইস্যুকে তাদের সভাগুলোর দাবিনামায় রেখেছিলো। কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই কালক্রমে আলোচনার ভরকেন্দ্র এসব দাবি থেকে সরে গিয়ে আওয়ামী লীগ পতনের এক দফাতে গিয়ে ঠেকেছে। যারা রাজনীতিসচেতন, তারা একথাটা খুব পরিষ্কারভাবেই বুঝেন যে, একদলকে সরিয়ে আরেক দলকে ক্ষমতায় আনলেই সমস্যার সমাধান হবে না। মানুষের জীবনের সমস্যার সমাধান করতে হলে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।
নির্দলীয় তদারকি সরকার কি সাংবিধানিকভাবে এখন সম্ভব নয়?
নির্বাচন সমস্যার সমাধান করতে না পারলেও মানুষের মধ্য থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি মোহ এখনও যায়নি। যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণের রাস্তা হিসাবে এখনও বুর্জোয়া দলগুলোর বিকল্প হিসেবে বামপন্থী দলগুলো দাঁড়াতে পারেনি। আবার বামপন্থী দলগুলো প্রভূত শক্তি অর্জন করলেও যতক্ষণ না জনগণ সমাজবিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের সংগ্রামে নামছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচনের ভূমিকা রাষ্ট্রে থাকবেই। বাংলাদেশে বারবার তৈরি হওয়া শাসনতান্ত্রিক এই সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের দাবি এসেছে। সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে তাদের পালিত বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে যে, যা সংবিধানে নেই, সেই দাবি রাজনৈতিক দলগুলো কিভাবে করছে। তাদের মনে রাখা দরকার যে, এরশাদ পতনের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুসারে যখন বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, তখনও তা সংবিধানসম্মতভাবে হওয়ার পথ ছিলো না। রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমেই তা করা হয়েছিলো। উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমেদ তখন পদত্যাগ করেছিলেন, তার স্থলে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এরপর এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তখন উপরাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন। তিনি তখন তিন জোটের প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়োগ দেন। ফলে রাজনৈতিক সমঝোতা হলে সংবিধান সংশোধন না করেও নিরপেক্ষ তদারকি সরকার গঠন করা যায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এটা চাইছে না। অনাবশ্যকভাবে সংবিধানের অজুহাত দাঁড় করাচ্ছে।
নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ সাংবিধানিক সংশোধন এখন সময়ের দাবি
বাংলাদেশে দল ও গোষ্ঠীস্বার্থে সংবিধান কাঁটাছেড়া ধর্তব্যের মধ্যে না এনে সংবিধান সম্পর্কে আলোচনা করলে এটা অনস্বীকার্য যে, এটি কোন শাশ্বত বিধান নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান কোনদিন শাশ্বত হতে পারে না। সময়ের প্রয়োজন অনুসারে এটি পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশে শাসন ব্যবস্থার সংকট পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকট, একথা সত্য। আবার এই শাসন ব্যবস্থার মধ্যেই প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি বামপন্থী দলগুলোকেও করতে হয়। এটা করতে হয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার লড়াইয়ের অংশ হিসেবেই। এ কারণে বাম গণতান্ত্রিক জোটের আত্মপ্রকাশের সময়ই সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ বাতিল, নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক কাঠামোগুলোর স্বাধীন কর্মকাণ্ড নিশ্চিত করা, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচনব্যবস্থা সাজানোসহ বেশকিছু সাংবিধানিক কাঠামোগত পরিবর্তনের দাবি তোলা হয়েছিলো। বামজোটের বাইরেও কিছু দল ও সংগঠন এই দাবিগুলো বেশ জোরালোভাবেই তুলেছে। এই দাবিগুলো বাস্তবায়িত হলেই শাসনব্যবস্থার সংকট দূর হয়ে যাবে এটা আমরা মনে করি না। কারণ সংকট সংবিধানের মধ্যে নেই, সংকট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে। সংবিধানে উজ্জ্বল কালিতে লিখে দিলেও, ঢাক বাজিয়ে এ সংক্রান্ত আইন পাশ করালেও—এর একটি শব্দও বুর্জোয়া দলগুলো না মানতে পারে। না মানা তাদের স্বভাব। প্রতিশ্রুতি আর চুক্তির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য তাদের কাছে নেই। আবার যে বৃহৎ পুঁজিপতিশ্রেণির আনুকূল্যে তারা ক্ষমতায় যান, সেই শ্রেণিটি বহাল থাকা পর্যন্ত তাদের পঁুজির নিশ্চয়তা দেয়ার আইনই সবচেয়ে কঠোরভাবে পালিত আইন, বাকি সব আইন গৌণ। ফলে সংবিধান সংশোধন কিংবা আইন প্রণয়ন করে সমস্যার সমাধান হবে না। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর ফ্যাসিবাদী আক্রমণ কিছুটা ঠেকানো যায়, কিছু গণতান্ত্রিক সংগ্রামের রাস্তা বের করা যায়। এই লক্ষ্যেকে সামনে রেখেই বামপন্থীরা প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের দাবি তুলেন। সংস্কারের মাধ্যমে মানুষের সমস্যার সমাধান হবে এটা মনে করার কোন কারণ নেই।
ব্যবস্থা পরিবর্তনের সংগ্রাম জোরদার করতে হবে
তাই এদেশের মানুষের কাছে আমরা আহবান জানাচ্ছি, আপনারা এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণ অনুসন্ধান করুন। কারণ অনুসন্ধান করলে এ কথা স্পষ্ট সামনে আসে যে, সংকটটা কোন দল বা ব্যক্তি তৈরি করেনি। সংকটটা তৈরি করেছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। আসুন এই ব্যবস্থা পাল্টানোর লড়াই করি। একমাত্র সমাজতন্ত্রই মানবসভ্যতাকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতির বদলে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিলো। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পাল্টে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লড়াই-ই আজ আমাদের প্রকৃত মুক্তি দিতে পারে।