একেবারে গরীব মজুর মেহনতী, চাষাভূষা, যাদের চালচুলো নেই, হাজার বছরের কুসংস্কারের অন্ধকারে যাদের বাস, গতর খাটানোই জীবন, সুস্থ সুন্দর জীবন যাদের কাছে ভাগ্যের বঞ্চনা- সেই নীচুতলার মানুষদের আবার লেখাপড়া! পুরো দুনিয়ার সামনে যা ছিল অকল্পনীয়, তাই ইতিহাসে বাস্তব করে তুলেছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন।
শিক্ষা নিয়ে আজ পর্যন্ত পুরো দুনিয়ার আলোচনার শেষ নেই। শিক্ষা কাকে বলে, শিক্ষিত লোক কে – তা নিয়েও সবার মত এক নয়। ধনী ও দরিদ্রে বিভক্ত এ সমাজে শিক্ষা ও শিক্ষার উদ্দেশ্য একই রকম থাকে না। ছোটবেলায় বড়জনেরা বলত ‘বড় হও, মানুষ হও বাবা’। এই মানুষ হওয়া বলতে কি বোঝায়? প্রকৃতির নিয়মে আমরা বেড়ে উঠি। এটাই কি বড় হওয়া? সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই ইংরেজরা শিক্ষার উদ্দেশ্য বলতে শিখিয়েছিল – লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। আমাদের দেশে তো বটেই দুনিয়া জুড়েই আজ একথার পেছনে সবাই ছুটছে। মানে লেখাপড়া শেষ করে বড় হয়ে কেউ চাকরি করবে, অনেক টাকা আয় করবে, বাড়ি, গাড়ি ধনদৌলত বানাবে। তাহলে এটাই কি শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য? আজ শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালেই আমরা এ চিত্রই পাবো। কারণ শিক্ষার এ দর্শনের পেছনে কাজ করছে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। পুঁজিবাদ এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের শ্রম শোষণ করে মুষ্টিমেয় মালিকশ্রেণি মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে। পুঁজিপতিরা তাদের নিয়ম নীতি, আইন কানুন দিয়ে এ সমাজের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই মালিক এবং শ্রমিকে বিভক্ত এ সমাজে মালিকশ্রেণি ততটুকু শিক্ষা দেয় যতটুকু তাদের মুনাফার জন্য প্রয়োজন। তাই সকল মানুষের স্বার্থে মানবজাতির সঞ্চিত জ্ঞানকে সে কাজে লাগাতে পারে না। মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, কুসংস্কারমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও মানবিক মন গড়ে তুলতে হয় সে ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, দুনিয়াজুড়ে পুঁজিবাদ আজ শিক্ষার মহত্তম উদ্দেশ্যকে ভুলিয়ে দিয়ে একে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করেছে। কেড়ে নিয়েছে শিক্ষার অধিকার। অন্যদিকে সমাজতন্ত্র শুধু শিক্ষার অধিকার দেয়নি, কর্মে, সৃজনে, মননে সৃষ্টি করেছে একেবানে নতুন মানুষ। সেই শিক্ষা ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা পুরো দুনিয়ার সামনে আজও শ্রেষ্ঠ আসন নিয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
বিপ্লবের আগে: পেছন ফিরে দেখা
রাশিয়া ছিল সম্রাট জারের অধীন। শিল্প কারখানার দিক থেকে এটি ছিল অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশ। বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। জারের মন্ত্রী, আমলা, সেনাবাহিনী, সুবিধাভোগী গোষ্ঠী আর ধনী জমিদার- শিল্পপতি মিলে পুরো দেশের শ্রমজীবী মানুষের উপর শোষণ, লুণ্ঠণ, অত্যাচার চালাত। জারের ক্ষমতার আগ্রাসন ক্রমে আশেপাশের রাজ্যগুলোকে দখল করে নিল। সেগুলোকে প্রদেশ বানিয়ে দুর্বল জাতিগুলোকে বছরের পর বছর শাসন-শোষণ চালাত।
সোভিয়েত সরকার প্রতিষ্ঠার আগে সেখানে সার্বজনীন শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না, তাই লক্ষ লক্ষ শিশু কখনোই স্কুুলে যায়নি। বেশিরভাগ কৃষক ছিল অজ্ঞ, মূর্খ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সংখ্যালঘু জাতিগুলোর অবস্থা আরও করুণ। রাশিয়ার ১৭৫ টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ১২৪ টির কোনো লিখিত হরফ ছিল না। ইউক্রেনীয়, জর্জিয়ানরা সংবাদপত্র, বই, এমনকি আদালতে পর্যন্ত নিজেদের ভাষা ব্যবহার করতে পারত না। রাশিয়ান ভাষায় তাদের পড়ালেখা শিখতে হতো। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৭৩ শতাংশ প্রাপ্ত বয়ষ্ক জনগণ ছিল অশিক্ষিত। কিছু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিতের হার ৫ শতাংশেরও কম ছিল। (যেমন- কাজাকিস্তানে ২ শতাংশ, উজবেকিস্তানে ১ শতাংশ, তাজিকিস্তানে ০.৫ শতাংশ।)
জার আলোকজান্ডারের নির্দেশনা মন্ত্রী শিকভের একটি বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা যাবে সে সময়ে শিক্ষা সর্ম্পকে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি — “জ্ঞান হলো লবনের মতো, যা জনগণের অবস্থা এবং চাহিদা অনুসারে অল্প পরিমাণে ব্যবহার এবং প্রদান করা হয়।… সকলকে এমনকি বেশিরভাগ মানুষকে শিক্ষিত করলে ভালোর চেয়ে অনিষ্ট হয় বেশি।” ফলে স্কুল-কলেজগুলো ছিল বড়লোকের সন্তানদের জন্য। স্কুল কলেজের পড়াশুনা ছিল ভয়ংকর চাপ, একঘেঁয়ে, আনন্দহীন। পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল যে, বাচ্চাদের আত্মহত্যার ঘটনা হর-হামেশায় ঘটত। মিস হেবে স্পাউলের ‘দি ইউথ অব রাশিয়া’ বইটির মতে, এই প্রবণতা এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল যে ছাত্রদের মধ্যে আত্মহত্যার কারণ উদ্ঘাটন করতে সরকারের Ministry of Public Instruction কে একটি কমিশন গঠন করতে হয়েছিল।
বিপ্লবের পর : নতুন যুগের কেতন
এই প্রেক্ষাপটে ১৯১৭ সালে শ্রমিকশ্রেণী ক্ষমতা দখল করল। শত শত বছরের গভীর অন্ধকার ভেদ করে আলোর দরজা খুলে গেল। পরিস্থিতি যত কঠিন হোক ,জনগণের দাবি পূরণের কাজ শুরু হলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার সরকার (তখনও বিপ্লব হয়নি) অংশ নেয়ার কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে বহু তরুণ-যুবককে এতিম, সম্বলহীন, গৃহহীন করে দেয়। আবার বিপ্লব পরবর্তী গৃহযুদ্ধ ও ১৯২১ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কারণে পরিস্থিতি আরও সংকটগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিপ্লবের আগেই কিশোরদের একটা অংশ বিভিন্ন অপরাধ চক্র গড়ে তুলে নানা আইনবিরোধী কর্মকান্ড পরিচালনা করত। অনেকেই চুরি করে জীবিকা নির্বাহ করত এবং নিয়মিত খুন-খারাবি করে গ্রামে ও শহরে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করত। তারা বসবাস করত সুরিখানা ও নালা-নর্দমার ধারে। ফলে শারীরিক-মানসিকভাবে ছিল প্রচ- অসুস্থ। এই শিশুদের কেবল শিক্ষা নয়, নৈতিক মুক্তিরও প্রয়োজন ছিল। এসব শিশুদের স্কুলের আওতায় আনা আর বিশাল নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার মহান ব্রত নিয়ে শুরু হয় বিপ্লবী সরকারের কাজ।
সোভিয়েত সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২১-এ বলা হয়েছে, ‘ইউএসএসআর- এর নাগরিকদের শিক্ষার অধিকার হবে সুরক্ষিত। সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক, বুনায়াদী শিক্ষার দ্বারা এই অধিকার নিশ্চিত করা হবে। অবৈতনিক উচ্চশিক্ষাসহ ; উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর রাষ্ট্রীয় উপবৃত্তি প্রদান করা হবে। স্কুল শিক্ষা স্থানীয় মাতৃভাষার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। রাষ্ট্রীয় খামার, ট্রাক্টর স্টেশন এবং যৌথ খামারে পরিশ্রমী বা মেহনতিদের বৃত্তিগত, প্রযুক্তিগত ও কৃষি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অবৈতনিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে।’
বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার জন্য পরিপূরক প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জামের অভাব, তীব্র সংকট ছিল প্রয়োজনীয় শিক্ষক-বিল্ডিং-বইপত্রের। ফলে বহু বছর ধরে মস্কোর মতো ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকার স্কুলগুলোতে বিভিন্ন শিফটে পড়াতে হতো। এছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পূর্বে শোষিত হওয়া উপজাতিদের মধ্যে থাকা প্রবল অন্ধবিশ্বাস ও অজ্ঞতা যেটি শিক্ষকদের পাঠদানে সরাসরি বাধাপ্রদান করত, তাকেও অতিক্রম করতে হয়েছিল।
সোভিয়েত শিক্ষাকাঠামো
শৈশব থেকে ৮ বছর পর্যন্ত: Creches (কর্মরত মায়েদের শিশুদের দেখাশোনার জন্য সাধারণ শিশুভবন), কিন্ডারগার্টেন, প্লেগ্রাউন্ড, নার্সেরি স্কুল। (এগুলো ঐচ্ছিক) * ৭ বছরের স্কুল শিক্ষা: সকলের জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। ৮-১৫ বছর পর্যন্ত। * ১০ বছরের স্কুল শিক্ষা: ৮-১৮ বছর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ছিল। পরে সেটি ১৫ বছর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করে। * শিল্প কারখানায় শিক্ষা: ফ্যাক্টরি এবং ব্যবসায় শিক্ষা স্কুল। * পেশাগত শিক্ষা: পেশাগত শিক্ষার স্কুল ও একাডেমিসমূহ। * উচ্চশিক্ষা: বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল এবং বিশেষায়িত ইনস্টিটিউটসমূহ। *প্রাপ্ত বয়স্কদের শিক্ষা: ক্লাব, বিভিন্ন সহযোগী কোর্স, সিনেমা ইত্যাদি
প্রাক-স্কুল শিক্ষা: জন্মের পর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শিশুকে পুরো সমাজের সম্পদ গণ্য করা হত। শিশুদের জন্য এখানে চালু করা হয়েছিল শিশু সদন বা Creches ( ক্রেস)। বিভিন্ন কাজের এলাকা যেমন- ফ্যাক্টরি, যৌথখামার বা কতকগুলি বাসভবনকে কেন্দ্র করে শিশুভবনগুলো গড়ে উঠে। আমাদের জানা থাকা দরকার সোভিয়েত ইউনিয়নে সমস্ত নারী কাজের সুযোগ পেত। যেসব কর্মজীবী মায়েদের সন্তানদের ছেড়ে কাজে যেতে হয়, তারা যেন সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট সময় পান। সেকারণে শিশুভবনগুলো ছিল তাদের কর্মক্ষেত্রের কাছে। কেবল পিতামাতা নয়; বিভিন্ন ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপনা ও ট্রেড ইউনিয়নের কমিটিসমূহ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই শিশুভবনগুলো সচল রাখতে সচেষ্ট থাকত। Mrs. Beatrice King-এর বর্ণনায় একটি আদর্শ শিশুসদনের সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা যায় —“কক্ষগুলো অনেক প্রশস্ত ও উঁচু যাতে প্রচুর আলো-বাতাস ঘরে আসতে পারে। প্রত্যেকটি রুমের একটি বারান্দা আছে যেখানে গ্রীষ্মে ও শীতে শিশুরা ঘুমায়। বিশাল রান্নাঘরে প্রধান খাবারগুলো প্রস্তুত করা হয়, ধোলাইখানাও আছে। ভ্রমণকালে আমি দেখেছি, শিশুভবনগুলোতে খেলার জন্য বিশাল মাঠ, ফুলের বাগান আছে। প্রত্যেক গ্রুপের (১২-১৫ জন) তত্ত্বাবধানের জন্য একজন যোগ্য ব্যক্তি নিযুক্ত থাকেন। শিশুভবনগুলো মা-বাবাকে যোগ্য করে তোলার জন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠান।”
৮ বছর পর্যন্ত প্রাক স্কুল শিক্ষার চালু ছিল। নার্সারি স্কুলগুলো শিশুসদনের ধারাবাহিকতায় এগুলো পরিচালিত হত। এখানে শিশু ভর্তির ব্যাপারটি ছিল ঐচ্ছিক। এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিশুদের ভর্তির সংখ্যা ১৯২৮ সালে ছিল ৮ লক্ষ, ১৯৩৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ালো ১৫ লক্ষে এবং ১৯৪০ সালে তা আরও বেড়ে হলো ৩৫ লক্ষ। সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে প্রাক স্কুল বয়ষ্ক ছেলেমেয়েদের পদার্থবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, এবং এমনকি ভাষাতত্ত্বের মত বিজ্ঞানগুলোর বিষয়ে মৌলিক জ্ঞানদানের বিষয় আবিষ্কৃত হয়েছিল। এরকম শিক্ষা কার্যক্রম শিশুর স্মৃতিকে ভারাক্রান্ত না তার মনন শক্তির বিকাশ ঘটাত। বিশেষ করে খেলাধুলা, বিভিন্ন জিনিসপত্র, ছবি আর মডেলের মাধ্যমে এসব শিক্ষা দেয়া হত। এই শিক্ষাব্যবস্থায় বাবা মার ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাবা-মা এবং স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। প্রতি মাসে স্কুলের স্টাফদের সাথে Parents’ Council-এর একটি মিটিং হত। নিয়মিত স্কুলে আসার জন্য মা-বাবাকে উৎসাহ দেয়া হত, তেমনি শিক্ষকদের উৎসাহ দেয়া হত বাচ্চাদের বাসায় যাবার জন্য। বাচ্চারা বয়স অনুযায়ী কিছু পড়াশুনা আর প্রচুর খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমানোর সুযোগ পেত। প্রতিটি স্কুলে স্টাফ হিসেবে একজন ডাক্তার ও নার্স নিযুক্ত থাকতেন। ছোট বেলা থেকেই স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার নিয়ম-নীতিগুলো শেখানো হত। নানা কর্মকা- এমনকি খেলাধূলা পর্যন্ত এমনভাবে সাজানো হত যেন একটি শিশুর সামাজিক অভ্যাসগুলো উন্নত হয়, তারা আত্মনির্ভরশীল এবং দায়িত্ববান হয়ে গড়ে উঠে। উদাহরণ হিসেবে শিশুদের একটি জনপ্রিয় খেলা রঙ্গিন ইট সাজানোর কথা বলা যায়। এই ইটগুলো এত বড় যে শিশুদের একার পক্ষে নাড়ানো এবং কিছু তৈরি করা সম্ভব হত না। তাই ইট দিয়ে কিছু তৈরি করতে হলে তাকে অবশ্যই অন্য সাথীদের কাছে সাহায্য চাইতে হত। এই সহয়োগিতা আর মিলে মিশে থাকার মধ্যেই গড়ে উঠত ভবিষ্যতের মানুষ।
বাধ্যতামূলক স্কুলশিক্ষা
ক্রেশ ও কিন্ডারগার্টেন শেষ করে ছেলেমেয়েদের যেতে হতো স্কুলে। আট থেকে পনের বছর পর্যন্ত হলো বাধ্যতামুলক মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষা। পনেরো বছর পর্যন্ত স্কুলজীবন শেষ করে আগ্রহীরা আরও দু’বছর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। বিপ্লব পরবর্তী স্কুল শিক্ষা নিয়ে লেনিন বলেছিলেন , “জীবনের ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, কেবলমাত্র স্কুলের গন্ডির মধ্যেই যা বন্দী তেমনি শিক্ষাদান, ট্রেনিং বা বিদ্যায় আমরা বিশ্বাস করি না… আমাদের স্কুল থেকে তরুণদের পাওয়া উচিত জ্ঞানের মূল সূত্রগুলি, স্বাধীনভাবে সাম্যবাদী মতবাদ গড়ে তোলার ক্ষমতা, এবং শিক্ষিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারা।” নতুন যুগের ছেলে মেয়েদের গড়ে তোলার জন্য লেনিনের মত ছিল ‘তরুণদের শিক্ষার সঙ্গে উৎপাদনশীল শ্রমের মিলন ব্যতীত ভবিষ্যৎ সমাজের কল্পনা অসম্ভব।’
সোভিয়েত সমাজের উদ্দেশ্য ছিল নতুন মানুষ গড়ে তোলা। সোভিয়েত শিক্ষাবিদদের মতে, সততা, শ্রমশীলতা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, মাতৃভূমি রক্ষার্থে আত্মোৎসর্গের মনোভাব- এই গুণাবলি নিয়ে কেউ জন্মায় না। তা অর্জিত হতে পারে সুশিক্ষার মাধ্যমে। বিপ্লবের আগে বহু বিজ্ঞানী প্রমাণ করতে চাইতেন, শিশুদের সবাই লেখাপড়া করতে, এমনকি প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যসূচি আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়। কিন্তু ৩০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বজনীন শিক্ষা চালুকরণের অভিজ্ঞতায় ‘ছেলে মেয়ে মানুষ করা প্রসঙ্গে’ বইতে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, এ ধারণা সর্ম্পূণ ভ্রান্ত। তাঁরা দেখিয়েছেন, কেবল কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রতিভাহীন লোক সাধারণত হয় না এবং সব মানুষই কোন না কোন নৈপুণ্যের অধিকারী। স্কুল এবং পরিবারের কর্তব্য হচ্ছে সেই নৈপুণ্যের আবিষ্কার ও বিকশিত করা।
মানুষ গড়া- সে হচ্ছে বহুমূখী এক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার দুটি দিক খুব গুরুত্বপূর্ণ, অনুভূতি আর হৃদয় গড়ে তোলা এবং বুদ্ধির উন্মেষ ঘটানো। আর সর্বাঙ্গীন বিকশিত মানুষের অপরিহার্য গুণ হলো শ্রমশীলতা তৈরি করা। কিন্তু হিতোপদেশ দিয়েই এই শ্রমশীলতা বা মানবিক নৈতিকতা তৈরি করা যায় না। একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং ছাত্র শিক্ষক , বাবা-মা, স্কুলের পরিবেশ, রাষ্ট্রের অংশগ্রণের মাধ্যমে এ কাজটি করতে হয়। তাই বাইরে রাজনীতি, অর্থনীতির সাথে ও সময়ের সাথে সোভিয়েত শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে জড়ানো ছিল। শিক্ষা বলতে সেখানে শিল্প, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, ভাষা, কাজ, খেলা, নৈতিক চরিত্র, আচার-আচরণ সবই বোঝাত। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, “কমল হীরের পাথরটি হল বিদ্যে আর তার ঠিকরে পড়া জ্যোতি হলো কালচার”। শিক্ষা আর সংস্কৃতির এই অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছিল সেখানে।
আমাদের দেশে শিক্ষার সাথে জীবনের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দেশপ্রেম বা শ্রমের মর্যাদা নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা রচনা লেখার পরও একজন ছাত্র এগুলো শুধু পরীক্ষা পাসের বস্তু মনে করে। হৃদয়কে তা কখনো প্রভাবিত করে না। পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থা আসলে কৌশলে সমাজকে অবহেলা করে নিজেকে বড় হতে শেখায়, সবাইকে নিজ নিজ ভবিষ্যৎ আর ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শেখায়। সোভিয়েত শিক্ষা কাঠামো তোতা পাখির মত মুখস্ত শেখাতো না। কী শেখানো হচ্ছে , কেন শেখানো হচ্ছে, শেখার পর সমাজে তাদের কি অবস্থা হবে এবং কী তাদের ভবিষ্যৎ এসব তারা স্পষ্ট ছিল। তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীতে সোভিয়েত রাষ্ট্রের ইতিহাস পড়ানো হত। বুর্জোয়া ইতিহাস যেখানে কিছু ঘটনার তারিখ, সম্রাট বা সম্রাজ্ঞী, যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি মিলে একটা জগাখিচুরি তৈরি করে, তাতে সমাজ পরিবর্তনের কোনো প্রকৃত ধারণা গড়ে উঠে না। সোভিয়েত স্কুলে প্রথম ক্লাস থেকে আরম্ভ হত ইতিহাসের পাঠ যেমন- এসিরিয়, ব্যাবিলন, ভারতবর্ষ, মিশর, চীন, গ্রীস ও প্রাচীন সভ্যতা এবং শতাব্দী ধরে কীভাবে সামন্তবাদের বৃদ্ধি হয়েছে। এক একটি দেশ ধরে তাদের বিশ্লেষণ করে দেখানো হত। এভাবে পড়া শেষ পর একজন ছাত্র পৃথিবীকে স্বচ্ছভাবে বুঝতে শিখত। সাধারণ জ্ঞানের সাথে ব্যবহারিক জ্ঞানও তাকে অর্জন করতে হত। প্রত্যেক স্কুলে সিনেমা যন্ত্র, স্লাইড শো, যন্ত্রপাতির চালু করেছিল। শিক্ষকেরা ইতিহাস, ভুগোল বা বিজ্ঞানের যেকোন শাখা সম্বন্ধীয় ফিল্মের সাহায্যে তাদের পাঠকে চিত্রিত করতেন। প্রত্যেক স্কুলে ছিল প্রাণি বিভাগ। যাতে শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষভাবে জীব জন্তুদের জন্ম, বৃদ্ধি, উৎপাদন ক্রিয়া প্রভৃতির সর্ম্পকে জানতে পারে।
সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ে তার মাতৃভাষায় ও সাহিত্যের প্রতি বিশেষভাবে অনুরাগী হতে শেখে। স্কুলের দেয়াল পত্রিকা, বিভিন্ন শিশু পত্রিকায় তারা নিয়মিত লেখক ও পাঠক। স্কুলের পড়াশোনার বাইরে, সোভিয়েত ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যক্তিগত আগ্রহ বা রুচি মাফিক তারা অন্য কাজে যুক্ত থাকে। তবে তা সবার জন্য বাধ্যতামুলক নয়। আগ্রহী ছাত্ররা নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর গ্রুপ তৈরি করে স্কুল ছুটির পর এসব কাজে সময় দেয়। যার নাটক ও সাহিত্য সম্বন্ধে আগ্রহ তারা সাহিত্য চক্রে, যারা সঙ্গীতজ্ঞ হতে ইচ্ছুক তারা শিল্পী চক্রে যোগ দেয়। যারা বিজ্ঞানে আগ্রহী তারা পদার্থ বা রসায়ন চক্রে যোগ দেয়। ইঞ্জিনিয়ারিং বা নির্মাণ কাজের জন্য টেকনিক্যাল বিষয় শিখার জন্য ব্যবস্থা ছিল। এইসব চক্র বিশেষ উৎসবে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের পরিবেশনা করে। (চলবে)