আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভেতর থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে। অনেকটা ধীর বিষক্রিয়ার মতো। বিশ্ববিদ্যালয় বাধাহীন জ্ঞানচর্চা ও সৃষ্টির কেন্দ্র হবার বদলে দিন দিন স্বৈরতন্ত্রের নিগড়ে বন্দী হয়ে পড়ছে। শিক্ষা-গবেষণা ও শিক্ষার্থীর জন্য বরাদ্দ প্রায় শূণ্যের কোঠায়। বিভিন্ন বিভাগে চালু হচ্ছে প্রফেশনাল কোর্স, বাণিজ্যিক নাইটকোর্স, হেকেপ। প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ চালু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানামুখী প্রয়োজনে বরাদ্দ দিচ্ছে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি কোম্পানি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন-ফি দিন দিন বাড়ছে। এভাবে রাষ্ট্র দিনদিন শিক্ষায় বরাদ্দ কমিয়ে আনছে। ফলাফলে নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও ক্রমবর্ধমান হারে শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশের কৃষক-শ্রমিকের সন্তানদের এখানে আসা কঠিন হয়ে পড়ছে।
২০০৬ সালে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন ‘উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্র : ২০০৬-২০২৬’ নামে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর মূল কথা : বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব আয়ে চলবে; চাকুরি ও বাজারমুখী বিষয় পড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্ব দেবে, কম গুরুত্ব পাবে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ; সিলেবাস ও গবেষণার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করবে দাতা গোষ্ঠী ও কর্পোরেট সংস্থা; আবাসিক হল বন্ধ হবে; উচ্চশিক্ষায় ছাত্র সংখ্যা হ্রাস করতে হবে; শিক্ষক নিয়োগ করবে সরকার, ভিসি নিয়োগ করবে সার্চ কমিটি; শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন থাকবে না।
এই দশ বছরে ইউজিসি কৌশলপত্রের একটা ধাপ অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময় প্রতিটি সরকার তা বাস্তবায়ন করেছে। এক দলের সাথে অন্য দলের অনেক বিরোধ কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা একমত। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাকছে না।
বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে প্রণীত ইউজিসি’র কৌশলপত্রের ১০ বছরের বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র কি দাঁড়িয়েছে এ নিয়ে আমাদের সংগঠনের মুখপত্র ‘অনুশীলন’র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করি। দেশের ১৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের কাছে আমরা প্রকাশনা নিয়ে যাই। ঘোষণা হয় ১৮ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনব্যাপী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে।
১৮ মে বৃহস্পতিবার, সকাল সাড়ে ৯ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় তেজোদীপ্ত তরুণদল মিছিল যোগে একে একে উদ্বোধন মঞ্চে প্রবেশ করে। হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র প্রতিনিধিরা কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট’র কেন্দ্রীয় সভাপতি নাঈমা খালেদ মনিকার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী রিন্টুর পরিচালনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। বক্তব্য রাখেন বাসদ (মার্কসবাদী)’র কেন্দ্রীয় নেতা সাইফুজ্জামান সাকন। উদ্বোধন শেষে একটি র্যালি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজপথ প্রদক্ষিণ করে।
বিকাল ৩টায় টিএসসি অডিটোরিয়ামে শুরু হয় দ্বিতীয় অধিবেশন। আলোচনা করেন ডেইলি নিউ এইজ’র সম্পাদক নুরুল কবির, স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্রআন্দোলনের নেতা আ ক ম জহিরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানজীম উদ্দিন খান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা, সাপ্তাহিক’র সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা ও ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক রাখাল রাহা। পরিশেষে ‘কনভেনশন ঘোষণা’ পাঠ করার মধ্য দিয়ে আগামী দিনে ইউজিসি’র ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমাজের সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অন্যতম জায়গা
— উদ্বোধনী বক্তব্যে আনু মুহাম্মদ
এই কনভেনশনে উপস্থিত সকলকে শুভেচ্ছা জানাই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে এই কনভেনশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পাবলিক বা সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনেক রকম আক্রমণের মুখে। তা নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচাতে কর্মসূচি নিতে হবে।
শিক্ষার সকল স্তরে বাণিজ্যিকীকরণই এখন প্রধান প্রবণতা, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে সর্বজনের প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুনাফামুখি তৎপরতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এসব ঘটছে হঠাৎ করে নয় বা বিচ্ছিন্নভাবেও নয়। এর পেছনে সুনির্দিষ্ট নীতি কাঠামো কাজ করছে ৮০ দশক থেকেই, বলা যায় ৯০ দশকের গোড়া থেকেই তা কার্যকর হওয়া শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সবচাইতে গোছানো পরিকল্পনা করা হয়েছে ৯০ দশকের শেষে, বিশ্বব্যাংকের সেই পরিকল্পনার ধারাবাহিকতাতেই তৈরি হয়েছে ইউজিসি’র নামে ‘২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র’। এখন সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ে হেকেপ, উইকেন্ড, ইভনিং সব বাণিজ্যিক তৎপরতা সেই কৌশলপত্রে বিধৃত নীতিমালারই বাস্তবায়ন।
বিশ্বব্যাংকের ঋণ ও তত্ত্বাবধানে যে ‘উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প’ বা হেকেপ চালু করা হয়েছে তার পুরো বিষয়টি নিয়ে এখানে ব্যাখ্যা করার সময় নেই। তবে এতটুকু বলা যায়, এর গঠনটাই এমন, কাঠামোটাই এমন বা নিয়মাবলীই এমন যে সেটা দুর্নীতি, অপচয় এবং টাকাকেন্দ্রিক, মুনাফাকেন্দ্রিক। অর্থ-উন্মাদনা বা বাণিজ্যিকীকরনের প্রবণতা তৈরি করা ছাড়া এটি শিক্ষা অনুকূল কোনো ফলাফল তৈরি করতে পারবে না।
এর পাশাপাশি উইকেন্ড বা ইভনিং প্রোগ্রামগুলোতে নানা বাণিজ্যিক কর্মসূচি আমরা দ্রুত সম্প্রসারিত হতে দেখছি। তার মানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জায়গা, যে শিক্ষক, যে লাইব্রেরি, ক্লাসরুম, অফিস যার সমস্ত কিছু জনগণের টাকায় তৈরি, সেগুলো কিছুজনের বাণিজ্যিক কাজে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ব্যক্তিগত লাভ হচ্ছে। তাদের পকেটে টাকা আসছে। কিন্তু এর কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাঠামোটি ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে। এর পরিণতিটা কী? এর একটি পরিণতি হচ্ছে শিক্ষাখাতে ব্যয় বৃদ্ধি এবং শিক্ষার সুযোগ সংকোচন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে যাদের আগ্রহ আছে তাদের যদি আর্থিক সংগতি না থাকে তাহলে তাদের প্রবেশাধিকার আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে যাবে। অনেকের আর উচ্চশিক্ষা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবেনা। দ্বিতীয় পরিণতি হচ্ছে, শিক্ষায় যে সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপার থাকে, জনগনের টাকায় যে শিক্ষা আমরা নিচ্ছি সেই শিক্ষায় যে একটা নৈতিক দায়িত্ব থাকে জনগনের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো, সেটা থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে শুধু মাত্র টাকা যেখানে আছে সেখানে নিজেকে বিক্রি করার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। অথচ হবার কথা ছিল যারা এখানে জ্ঞান অর্জন করছে তাদের ভূমিকা থাকবে তারা সমাজের জন্য, দেশের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য এবং নিজের জন্য, সকলের জন্য, সর্বজনের মুক্তির জন্য নিজের কোনো না কোনো ভূমিকা পালন করবে। সবাই রাস্তায় মিছিল করবে তা নয় কিন্তু যে বিজ্ঞানী সে বিজ্ঞানের এমন গবেষণা করবে, যে গবেষণাটা সকলের কাজে লাগবে। যে সমাজবিজ্ঞানী সে সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার এমন কাজ করবে যেটা সকলের কাজে লাগে, বর্তমানের কাজে লাগে, ভবিষ্যতের কাজে লাগে। যে সাহিত্য চর্চা করছে সে সাহিত্যচর্চার মধ্যেও প্রাণ পাবে এবং অন্যদের তার সন্ধান দেবে।
কিন্তু বাণিজ্যিক বিষয়টা যদি প্রধান হয় তখন একজন বিজ্ঞানীর মূল লক্ষ্য থাকে কোন ধরনের গবেষণা করলে বা কোন ধরনের রিপোর্ট লিখলে সে বেশি টাকা পাবে। সে বিবেচনা করবে, ‘সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবন শেষ হবে’ এই সত্য গবেষণালব্ধ হলেও তা লিখলে কি আমার জন্য অসুবিধাজনক হবে না, ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলেও সুন্দরবনের ক্ষতি হবেনা’ এই লেখা-বলাই আমার জন্য লাভজনক? আমরা তাই দেখি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন এক ধরনের এক্সপার্ট তৈরি হচ্ছে যারা বিভিন্ন কর্পোরেট গ্রুপ, দেশি কিংবা বিদেশি মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন গ্রুপের এক একটা ইনস্ট্রুমেন্টে পরিণত হয়েছে। এর ফলে বিদ্যমান যে মুনাফাকেন্দ্রিক অপতৎপরতা তার পূর্ণ বিজয় সাধিত হয়। এইভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানের জগৎকে পুঁজির অধীনস্ত করা হয়, জ্ঞানের জগৎকে জনশত্রুদের কর্তৃত্বের মধ্যে নিয়ে আসা হয়। এগুলোই আছে এই কৌশলপত্রে এবং বর্তমান সময়ের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সেই ধারাই শক্তিশালী করা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থী যাদের মধ্যে ন্যূনতম বোধশক্তি আছে, দায়বদ্ধতা আছে, যাদের মধ্যে নিজে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার আত্মসম্মানবোধ আছে তাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের যে অপতৎপরতা চলছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করা।
সরকারের যুক্তির কথা আমরা জানি। অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছেন যে, ফি ৫ গুণ বাড়াতে হবে। এই কথাটা ২০০০ সালে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টেও ছিল যে ফি বাড়াতে হবে। অর্থমন্ত্রী নতুন কিছু বলেননি, এটা ওই ধারাবাহিকতায় এসেছে। ৫ গুণ ফি বাড়াতে হবে কেন? কারণ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেবার মতো অর্থ রাষ্ট্রের নেই। এই হিসাবটিই তারা সবসময় দিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের দাবি করতে হবে বেতন ফি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ ৫ গুণ বাড়াতে হবে। অর্থমন্ত্রীর কাছে আমি এই পাল্টা ৫ গুণের একটা হিসাব দিতে চাই যেটা অবশ্য অর্থমন্ত্রী নিজেও জানেন। যদিও না জানার ভান করেন। অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এখন মেগা প্রকল্প হচ্ছে মেগা চুরির জন্য।’ অর্থমন্ত্রীর এই কথার সাথে আমি শতভাগ একমত। তিনি বলেছেন, ‘পুকুর চুরি না, বাংলাদেশে এখন সাগর চুরি হচ্ছে।’ আক্ষরিকভাবেও সাগর চুরি হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ রপ্তানির জন্য বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। যাহোক, দুর্নীতি, কমিশন, চুরি, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে সম্পদ লুট হয় এবং পাচার হয় তার পরিমাণ এখন বছরে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। আন্তর্জাতিক ঐক্যমত অনুযায়ী জিডিপি’র শতকরা ৭ ভাগ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হবার কথা, কিন্তু বরাদ্দ হচ্ছে শতকরা ২ ভাগেরও কম। আমরা সবাই বুঝি, এই বরাদ্দের জন্য সম্পদের অভাব বাংলাদেশে নেই। অথচ আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মাত্রায় বরাদ্দ করলে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা অভিন্ন মানসম্মত ও অবৈতনিক করা সম্ভব হতো। কিন্তু সম্পদের কোনো অভাব না থাকলেও অভাব আছে রাজনৈতিক অবস্থানের। যারা লুটেরাদের পক্ষে, ধর্ষকদের পক্ষে, খুনীদের পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে তাদের পক্ষে খুনী-ধর্ষকদের যেমন বিচার করা সম্ভব না, তেমনি লুটেরাদের লোক যারা তাদের পক্ষে সম্পদ পাচারও বন্ধ করা সম্ভব না। কারণ কেউ নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারতে পারেনা। সুতরাং তারা একদিকে সম্পদ পাচার করে আর শিক্ষাখাতে বরাদ্দের প্রশ্ন আসলেই বলে ‘টাকা নেই।’
এগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কে করবে? তরুণরাই তো করবে। তরুণ শিক্ষার্থীরা করবে, তরুণ বিজ্ঞানীরা করবে, তরুণ শিল্পীরা করবে, তরুণ সমাজবিজ্ঞানীরা করবে। সেটা করার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটা অন্যতম জায়গা। এখান থেকে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ আসতে হবে। শিক্ষকদের মধ্যে থেকেও আসতে হবে। এবং আসে বলেই বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৫২’র সৃষ্টি করেছে তরুণরা, সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রাম করেছে তরুণরা, ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ করেছে তরুণরা, তারপরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনও তারা করেছে। বরং বিশ্বাসঘাতকতা করেছে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিংবা যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছেন তারা। সেই বিশ্বাসঘাতকতার জবাব দিতে তরুণরা যাতে সংগঠিত হতে না পারে সে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনও বন্ধ রাখা হয়েছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন এই কনভেনশনেরও অন্যতম দাবি।
আজকে শিক্ষাখাতে যে বিপর্যয় এবং যেভাবে এটাকে ভয়ংকর সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের লক্ষ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আজকে অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি। এই দাবির ভিত্তিতে শুধুমাত্র ছাত্ররাই নয়, ছাত্রসমাজের বাইরেও ব্যাপক জনগণের মধ্যে এই দাবি নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। সেই কাজে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট আরও অনেক সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে — এই প্রত্যাশা আমার আছে এবং এই প্রত্যাশা নিয়ে আজকের এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশনের উদ্বোধন ঘোষণা করছি।
নুরুল কবীর, সম্পাদক, ডেইলি নিউ এজ
আজকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কনভেনশনে সম্মানিত সভাপতি ও উপস্থিত সুধীবৃন্দ ও সামনে উপবিষ্ট ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ, আমি যখন এখানে এসে পৌঁছাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনদের মতো ব্যাপারটা আমার জন্য নস্টালজিয়া হয়ে দাঁড়ায়। আপনারা হয়ত একদিন দাঁড়াবেন। সঙ্গত কারণেই যে সমস্ত কথাগুলো মনে পড়বে— এইখানে মিছিল হয়েছিল, এইখানে পুলিশের সাথে মারামারি হয়েছিল, ওইখানে আমার অন্য এক ছাত্রসংগঠনের সহকর্মী বন্ধু শহীদ হয়েছিলেন এবং তার মধ্য দিয়ে কী অর্জিত হলো এবং কী হলো না — এই বিষয়গুলো মনের মধ্যে ভিড় করতে বাধ্য। এইটা চিন্তা করতে করতে যখন আমি হল ঘরে ঢুকছিলাম একজন ছাত্র বন্ধুর বক্তৃতায় শুনলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে একটি বিশেষ ছাত্রসংগঠনের নেতাদের অনুমতি ছাড়া বা তাদের কথা শোনা ছাড়া নাকি থাকা যায় না। একটি দল যার ঐতিহ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সবচেয়ে বড়, যে দলের ছাত্রসংগঠন একসময় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছিল, সেই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ শিক্ষার্থীদের হলে থাকতে দেয় না। সৃষ্টির পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সমস্ত প্রথার বিরুদ্ধে এস্টাবলিসমেন্টের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল, সবচেয়ে বেশি সংগ্রামী, সবচেয়ে বিদ্রোহী। সেই বিদ্রোহের অঙ্গন আজ এমন এক জায়গায় অধঃপতিত হয়েছে কেন? এখানে নির্বিচার অবিচার হয়, এখানে আইন মানা হয় না, এখানে এমনকি নিজেদের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা নেই। এটা অত্যন্ত ভয়াবহ একটি ব্যাপার।
বক্তৃতার মধ্যে একটা কথা আমার কানে বেজেছে। একজন বললেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কথা। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক ভাষার ব্যবহার ও শব্দের প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই ৮০’র দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল এবং ৮০’র দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেটি সামরিক স্বৈরাচার, এখন স্বৈরাচারবিরোধী কোনো সরকার বললে শুধুমাত্র এরশাদ সরকারকেই বোঝায়। খুব পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করা দরকার, ওই সময়ে ৮০’র দশকে একটা সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র সংগ্রাম হয়েছিল, গণআন্দোলন হয়েছিল। এই মুহূর্তে একটা বেসামরিক স্বৈরাচার বা এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এই সংগ্রাম গড়ে তোলবার প্রয়োজনীয়তা কেবলমাত্র এই জায়গা থেকে নয় যে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেয়েছে তাদের একটা Philanthropic কর্তব্য রয়েছে। এই জন্যও নয় যে লেখাপড়ার বাইরেও ছাত্রসমাজের যে সামাজিক কর্তব্য আছে সেটা অব্যাহত রাখবার জন্য করতে হবে। আসলে নিজের জন্যও করতে হবে। এই যে সরকারের একজন উপদেষ্টা বেআইনিভাবে অধিষ্ঠিত হবার পর বক্তৃতা করেন, ‘এখন থেকে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের বাইরে কারও চাকরি হবে না।’ যুবলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে যাবার পরে প্রকাশ্যে দম্ভ করে বলেন যে, ‘এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীদের চাকরি দিতে কোনো নিয়ম কানুনের প্রয়োজন হয় না।’ এরকম অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবতীয় যোগ্যতা অর্জন করবার পরও আপনার নিজেরই চাকরি হবে না। ফলে কেবল দেশের নয়, নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতেও এসবের বিরুদ্ধে আপনাদের প্রতিবাদ করতে হবে।
একটি ছোট্ট প্রশ্ন আমি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রায়ই করে থাকি, সুযোগ পেলেই বলি, কেন যেন ভেতর থেকেই আসে, আমি নিজেও এভাবে ভেবেছি। আপনি লক্ষ্য করবেন বিশেষত গ্রামাঞ্চলে যখন একজন গরীব কৃষক তার সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠায় কখনো কখনো তাকে জমি জমা বিক্রি করতে হয়। পড়াশুনা শেষ করে যখন চাকুরি হয় না তখন অভিভাবক বা আশেপাশের লোকজন তা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে, কখনো এ কথাও বলে- এই ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে না পাঠালেই ভালো হতো। কখনো মা-বাবাও ধারণা করেন, ছেলেটি একটি অকর্মণ্য সন্তানে অধঃপতিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ওই যে অভিভাবক যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ানোর জন্য নিজের জমিটুকু বিক্রি করেছেন তিনি মাসে কত টাকা করে পাঠিয়েছেন? ৩০০০-৪০০০ টাকা। তিনি তো জানেন না যে তার সন্তানের পেছনে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কার্পণ্যসহ এবং রাষ্ট্রের সকল প্রতিক্রিয়াশীল নীতিসহ কত হাজার টাকা মাসে খরচ করা হয়েছে? একটা মোটামুটি হিসেব করলে দেখা যায় একজন ছাত্রের পিছনে সরকারের দিক থেকে ৩০,০০০-৪০,০০০ টাকা খরচ হয়। যে ছাত্রটিকে অভিভাবকের প্রতিদান দেয়নি বলে সমাজের ভিতর কলঙ্কিত হতে হয়, বাবা-মায়ের কথা শুনতে হয়, তাহলে যারা তার পিছনে ৩০,০০০-৪০,০০০ টাকা মাসে মাসে দিচ্ছেন তাদেরটা ফিরিয়ে দেবার দায়বোধ কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তৈরি হবে না? তাহলে একদিকে যেমন আপনার নিজের জন্যে অন্যদিকে সমাজ আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠানোর জন্য যে টাকা খরচ করেছে সেই দুটো ঋণ অন্তত শোধ করা উচিত একজন কৃতজ্ঞ মানুষের।
আপনি কী করে ফিরিয়ে দেবেন? আপনি যদি মনে করেন আপনি একাকী, তাহলে আপনার ফিরিয়ে দেবার পথ নেই। একাকী ফিরিয়ে দেবার পথ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় থাকে না। তার জন্য সঙ্গবদ্ধতার প্রয়োজন পড়ে। তার জন্য একটা মানদন্ড লাগে, যাকে সামনে রেখে আপনি লড়াই করবেন। এই মানদ- মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা-সাম্য, ন্যায় বিচার।
বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যে তো এক ধারার শিক্ষার কথা বলা রয়েছে। অথচ দেশে ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম, আরবি, উর্দ্দু বা ফরাসি মিডিয়ামের এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যে দেশের মানুষ পরস্পর পরস্পরের বিরোধী হয়ে উঠছে। বাংলা মাধ্যমে যারা পড়ছে তারা মনে করে মাদ্রাসায় যারা পড়ে তারা লেখাপড়া জানে না। মাদ্রাসায় যারা পড়ে তারা মনে করে বাংলা মাধ্যমে পড়ুয়ারা নাস্তিক। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে যারা তারা মনে করে এরা কেউ কিছু জানে না। আর অন্য দুই গ্রুপ মনে করে তারা টেমস নদীর গভীরতা জানলেও বুড়িগঙ্গার তীরে কোন শহর গড়ে উঠেছে তা জানে না। এইরকম একটা জনগোষ্ঠী যখন বছরের পর বছর গড়ে উঠবে তখন সেখানে সিভিল ওয়ার ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। কারণ তারা সংখ্যায় ক্রমাগত বাড়ে একটি নির্দিষ্ট চিন্তাকে ধারণ করে। আর যখন তারা সংখ্যায় বাড়বে তখন সে কূপমন্ডুক হোক বা শিক্ষিত, সে তার দাবি আদায় করতে চাইবে। কেউ কারও কথা বুঝতে পারবে না। এর চেয়ে ভয়াবহ আর কী হতে পারে?
তাহলে করণীয় কী? একটা গল্পের কথা মনে পড়ল। ১৯০৫ সালে রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতার সময়ে যখন খুব বিপর্যস্ত অবস্থা, তখন লেনিন ট্রটস্কিকে পাঠিয়েছিলেন এক অঞ্চলে সংগঠন গড়ে তোলবার জন্য। ট্রটস্কি চার পাঁচদিন ঐখান থেকে ঘুরে এসে লেনিনের কাছে রিপোর্ট করলেন, ‘কমরেড ওখানকার মানুষ রাজনীতির উপর এমনভাবে বিরক্ত যে রাজনীতি সংক্রান্ত আলোচনা ওই অঞ্চলের মানুষ শুনতে চায় না।’ লেনিনের উত্তর ছিল, ‘কমরেড ট্রটস্কি আমি তো বহু বছর ধরে এই রকম একটা সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। যখন প্রচলিত রাজনীতির কথা মানুষ শুনতে ঘৃণা করে, সেই রাজনীতিরই কথা বলতে তোমাকে সেখানে পাঠাইনি। তুমি সেই রাজনীতির কথা বলো যা তুমি বিশ্বাস কর। যে রাজনীতির কথা প্রচলিত রাজনীতির সাথে মিলবে না। যে কথা শুনলে লোকে উদ্দিপ্ত বোধ করবে, তার অধিকার বোধ জেগে উঠবে, এবং মনে করবে তুমি তাদের নিয়ে সংগ্রাম করতে এসেছো। সেই রাজনীতির কথা বললে তারা তোমাকে অভিনন্দন জানাবে।’ ট্রটস্কি সেদিন ফিরে গিয়েছিলেন এবং চারদিন পর এসে বললেন, ‘আমি সেই কাজ করেছি এবং সেখানে আমাদের সংগঠন গড়ে উঠছে।’ এগুলো ঐতিহাসিক সত্য। যত দুঃসময়ই আসুক, মানুষ ঘুরে দাঁড়াবেই।
আপনারা যারা প্রচলিত গড্ডালিকার মধ্যে গা ভাসিয়ে দেননি, তারা এই বিদ্যমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলবার জন্য নিজেদের অজান্তেই সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। কিন্তু একা করা সম্ভব নয়। সংগঠিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আপনাদের একটি কথা খুব পরিষ্কারভাবে বিশ্বাস রাখতে হবে, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা যে, নৈতিকভাবে যারা দুর্বল কেবলমাত্র পেশি শক্তির জোরে যারা শাসন করতে চায়, তাদের চেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠী বা সংগঠন পৃথিবীতে নেই। আমরা যখন ৮০’র দশকে এইখানে ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ছিলাম, আমি খুব পরিস্কারভাবে লক্ষ্য করেছি, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে পুলিশের পাহারায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা আক্রমণ করতে এসেছে, তারা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভাঙা ইটের টুকরোর কাছে বারবার পরাজিত হয়েছে। আপনি লক্ষ করুন আপনার লক্ষ্য ঠিক আছে কিনা, আপনি নিজেকে সম্মান করেন কিনা। অন্যায়কে মেনে নেওয়ার মধ্যে মানবিক মর্যাদাবোধকে অপমান করার সারৎসার রয়ে যায়।
যারা এই কনভেনশন আয়োজনের বাইরে, শাসকশ্রেণির চেতনার বাইরে যারা নিজেদের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, সেই উদ্বুদ্ধ চৈতন্য সংকলিতভাবে জাগ্রত হলে এই দেশের মানুষ জিতবে। ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ আছে। একটা দুর্বল সরকার যারা শিক্ষা ধ্বংস করছে, অর্থনীতি ধ্বংস করছে কেবল মাত্র নিজের বিত্ত-বৈভব গড়ে তুলছে তাদের জন্য বলার কিছুই নেই। আপনারা নিজেদের ভয়কে জয় করুন, সংঘবদ্ধ হোন, রুখে দাঁড়ান। ইতিহাস আপনাদের পক্ষে। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
আ ক ম জহিরুল ইসলাম, স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা
সংগ্রামী সহযোদ্ধা সভাপতি, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজিত তারুণ্য ছাত্র-ছাত্রী, প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমার কথা বলার শুরুতে আপনাদের জানাই রক্তিম শুভেচ্ছা ও সংগ্রামী অভিনন্দন। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের জন্য সরকার বিশ্বব্যাংকের পরামর্শের জন্য গিয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বজনীন চরিত্রে সর্বনাশা পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শমত তারা তৈরি করে ২০০৬ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র। যাকে আমরা ‘অপকৌশল’ বলে মনে করি। কী কৌশল তারা করতে চায় তা দেখতে গেলে আপনারা দেখতে পাবেন এদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে চেতনা গড়ে উঠেছে তার ভিত্তিতে দেশের মাত্র ৪ টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ‘বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩’ কার্যকর করা হয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে বিশেষত উপাচার্য নির্বাচনে সিনেটের নিরঙ্কুশ ভূমিকা না থাকাসহ দুই একটা ছোট খাট সীমাবদ্ধতা বাদে ভালোই চলছিল ‘৭৩’র অধ্যাদেশ’। সেখানকার রীতিনীতি পাল্টানোর জন্য আনা হয়েছে আমব্রেলা এ্যাক্ট। পাশাপাশি তারা সুন্দর নাম দিয়ে Higher Education Quality Enhancement Project (HEQEP) চালু করে। এর ফলে বিশ্বব্যাংক থেকে ব্যাপক পরিমাণ টাকা ঋণ নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালানোর ফলে উচ্চশিক্ষায় গবেষণায় সরকারের যে সামান্য ভূমিকা ছিল, তা থেকেও সরকারের পালানোর সুযোগ তৈরি হলো। আরেকটি অপকৌশল হলো ‘সেলফ এ্যাসেসমেন্ট’ প্রক্রিয়া। মানে নানা অকাজ করে তার মাহাত্ম্য বর্ণনা করার প্রক্রিয়া। যেমন- বিশ্ববিদ্যালয় যদি নিজস্ব স্থাপনা ভাড়া দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে টাকা কামাইয়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে কিংবা গবেষণার নামে ঋণের টাকা তসরুপ করে বা নাইট কোর্স চালু করে তবুও সেলফ এ্যাসেসমেন্ট করে দেখাতে হবে যে, আরও কীভাবে এই কাজগুলো ত্বরান্বিত করা যেত।
আপনারা জানেন ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উট সম্মেলনে ২৩ টি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র GATT (General Agreement of Trade and Tariff) গঠন করে। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালে World Trade Organisation গড়ে তোলে। বাজারের ভয়াবহ সংকটকে মোকাবেলা করার জন্য ১৬১ টি সেবাখাতকে (এর মধ্যে শিক্ষাও আছে) উন্মুক্ত করে দেয়। সেই হলো শিক্ষা ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অবাধ সুযোগের শুরু। এর ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে ২০০৬ সালে কৌশলপত্র এলো। জ্ঞানের সামাজিকীকরণ না বাণিজ্যিকীকরণ হবে — এই প্রশ্নের মিমাংসা করতে হবে। এ কথা বলে কবি কামিনী রায়ের একটি কবিতা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি- ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।’ ধন্যবাদ সবাইকে।
ড. মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান, সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আজকের এই কনভেনশনের সভাপতি এবং উপস্থিত সমাবেশ, প্রথমে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই আমাকে এই ধরনের আয়োজনে আমন্ত্রণ করার জন্য। আমি মনে করি, শিক্ষা এবং জাতীয় সম্পদ দুটিই আসলে সম্পদ। যার জন্য এগুলোকে আলাদা করে দেখি না। আজকের এই কনভেনশনের যে বিষয়, অর্থমন্ত্রীর ৫ গুণ বেতন বৃদ্ধির ঘোষণার প্রতিবাদ এবং ইউজিসি’র কৌশলপত্র যেটি ২০০৬ সালে প্রণীত হয়েছে তা বাতিল করা। একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, ব্যাপারগুলো নতুন কিছু নয়। এটি হচ্ছে শিক্ষার যে সংকট, শিক্ষার পণ্যায়ন, তারই রূপ। পণ্যায়নের এই প্রক্রিয়াটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসেছে। আমি প্রাথমিক শিক্ষা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা আলাদা করে দেখতে চাই না। কেননা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ পর্যন্ত যে ধরনের শিক্ষার্থী তৈরি হয়, তার প্রেক্ষাপট এবং গুণগত মান নির্ধারিত হয় আসলে স্কুল থেকে। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী পেয়ে থাকি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রণীত কৌশলপত্র তৈরির ক্ষেত্রে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক। ফলে ২০০৬ সালে প্রণীত হবার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় পুরোমাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণের প্রক্রিয়া চলেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোটা রেখেই এর মধ্যে বেসরকারিকরণ হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ দেখুন। ‘বিজয় একাত্তর’ নামে নতুন একটি হলে ফি নেওয়া হয় অন্য হলের চেয়ে ৬ গুণ বেশি। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ও ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগে। যেখানে একক প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় হল এবং বিভাগগুলো চালিত হবার কথা সেখানে আবাসিক হল আর বিভাগ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন ফি কীভাবে নির্ধারিত হয়? তার মানে হচ্ছে এক ধরনের বেসরকারিকরণ আছেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সরকারি কাঠামোর মধ্যে। এগুলো সবই হচ্ছে কৌশলপত্রের আলোকে!
এত কিছুর পরও শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। যারা ছাত্র সংগঠন করে, বিশেষ করে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন করে, তাদের বাইরে তো একেবারেই নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি যখন ইউজিসি’র কৌশলপত্র নিয়ে লড়াই করছি, যখন পাঁচ গুণ বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদ করছি, তখন কেন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারছি না? এটা না পারার কারণ হচ্ছে, প্রশ্নহীন আনুগত্যের যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে তার ধারক ও বাহক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সমান ভাবেই। শুধুমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তার সাথে স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থাতেও এটি চালু আছে। তাই স্কুলের শিক্ষাকাঠামো এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর জন্য কী ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জন্য জরুরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকাঠামো কেমন হওয়া উচিৎ এবং সেই শিক্ষাকাঠামোর মধ্যে দিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন করার সামর্থ্য তৈরি হচ্ছে কি-না এই বিষয়গুলোও আলোচনার মধ্যে আনা খুবই জরুরি।
আমি দুইটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমি সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলাম Social Scientists’ Association (SSA) -এর একটা সম্মেলনে অংশ নিতে। অনেকের মধ্যে সেখানে কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকও একটি প্রবন্ধ পড়লেন। শিক্ষার্থীরা সেই প্রবন্ধ নিয়ে যেভাবে প্রশ্ন করলেন এবং যেভাবে Critic করলেন, আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, এই জায়গায় আমাদের ছাত্ররা থাকলে হয়তো প্রশ্ন করার পরিবর্তে শুধু হাত তালি দিত। আরেকটা ঘটনা বলছি। রানা প্লাজায় যখন শ্রমিক হত্যাকা- ঘটে, আমি সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শেষ করে দুপুরবেলা টিভি নিউজ দেখছি। ঠিক ওই মুহূর্তে কোনো এক ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থীরা ‘র্যাগ ডে’ উদযাপন করছিলো খুব উচ্চ শব্দে ধূমধাম হিন্দিগানের সাথে নেচে। অথচ এই শিক্ষার্থীরা ওই মানুষগুলোর করের টাকায় পড়ে। তাদের বোধ নেই, যখন এই মানুষগুলো একের পর এক মারা পড়ছে ইট-বালি-রড-সিমেন্টের নীচে, ঠিক সেই সময়ে এ ধরনের আচরণ কতটা মানবিক?
শিক্ষকরাও একই ধরনের চর্চার মধ্যে নিযুক্ত আছেন। এবং এই নিযুক্ত থাকার একটা বড় কারণ হচ্ছে সরকার ও রাষ্ট্রের সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর যে সম্পর্ক, এটা আমাদের সামগ্রিক সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে Client এবং Patron এর সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের ধারাবাহিকতাতেই আমাদের এই সংকট।
এখন এই শিক্ষার্থীকে কীভাবে আপনাদের কাজের মধ্যে তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন? সেই জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা। আমরা দেখব শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে ব্যাপক ফাঁকিবাজি তৈরি হয়েছে। তথাকথিত Multiple Choice Question, তথাকথিত সৃজনশীল প্রশ্নের মধ্যে মুখস্ত শেখানো হয়। পড়াশুনার মানে যেন তথ্য মুখস্ত করা। কিন্তু তথ্যটি কীভাবে উৎপাদিত হয়, তথ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কী ধরনের রাজনীতি, কী ধরনের মতাদর্শ থাকে সে বিষয়গুলো আড়াল করে কেবল তথ্য মুখস্ত এবং তথ্যের প্রতি একটা আনুগত্য তৈরি হয় এবং সেই ধারাবাহিকতা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসেও বজায় থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা ভর্তি হয় তাদের চারপাশকে ক্রিটিকালি দেখার যতটুকু মানদ- থাকা উচিত, তারও সম্ভাবনা কিন্তু প্রায় শুণ্য। ক্লাসরুমেও যে প্রক্রিয়ায় আমরা পাঠদান করি তা ভীষণ ত্রুটিপূর্ণ। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির এক শিক্ষার্থী আমরা রুমে এসেছিল। ওর সামনে একটা চেয়ার ছিল। যখন আমি ওকে বসতে বললাম, দেখি খুব লজ্জা পাচ্ছে। আমি ধমক দিয়ে বললাম, ‘এই চেয়ারগুলো কি আমার জন্য না তোমাদের জন্য?’ অদ্ভুত! মালিক ও ভৃত্যের সম্পর্কের মতো শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক পৌঁছে গেছে। আমাদের ক্লাসে প্রথম হওয়া এক ছাত্রকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত কয়টা কোর্স পড়েছো?’ সে বলল ‘স্যার ৩২ টা।’ আমি বললাম, ‘তুমি কি ৩২ টি বইয়ের নাম বলতে পারবে?’ ও খুব অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তখন আমি বললাম, ‘ঠিক আছে তুমি ৪ টা বইয়ের নাম বল। বেসিক বই, যেগুলো তুমি পড়েছো।’ নাম বলতে সে হিমসিম খাচ্ছে। সে বলল, ‘স্যার, আপনি বইয়ের কথা বলছেন। অনেক স্যার তো বলেন, ক্লাস লেকচার লিখলেই কেবল মার্কস।’ এভাবে প্রশ্নহীন আনুগত্য তৈরির চেষ্টা চলছে। এমন আনুগত্যের মধ্যে যে প্রজন্ম গড়ে উঠে, বিকাশ লাভ করে তারা কীভাবে ইউজিসি’র কৌশলপত্র কী ধরনের ক্ষতি করছে, বেতন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে কী ধরনের শ্রেণিচরিত্র তৈরি হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায়, সেটা ভাববে বা কাজ করবে?
ইউজিসি’র কৌশলপত্র কাদের আমলে হয়েছিল? বিএনপি-জামাতের আমলে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাকে পরিবর্তন করেনি। এই ধরনের কাঠামোর সুবিধাভোগী তারাই যারা ক্ষমতাসীন। এটা হলো একটা উপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা আরেকটি রাষ্ট্র কাঠামো যা প্রকারান্তরে বিশ্বপর্যায়ের কাঠামোর সাথেও যুক্ত। এজন্য আমার এটাও মনে হয় যে, আমাদের আন্দোলনটির বিশ্বায়নও খুব জরুরি। এই আন্দোলন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে, এই আন্দোলন অস্ট্রেলিয়াতে আছে, এই আন্দোলন ভারতেও আছে। একটা যোগাযোগ দরকার যার মধ্য দিয়ে আমাদের শক্তি এবং আন্দোলনের বিকাশ আরও ত্বরান্তিত হবে। তার সাথে আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিগুলোকে চিহ্নিত করে কীভাবে কাজ করতে পারি সেটাও ভাবতে হবে। একটা সামগ্রিক আলোচনার ভিতর দিয়ে, নতুন রূপরেখা প্রণয়ন, নতুন শিক্ষাব্যবস্থার আয়োজন ও প্রস্তাবনা সামনে আনাকে খুব জরুরি বলে আমার মনে হয়। এই কথাগুলো যদি বিভিন্ন উপায়ে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় তা খুবই ফলপ্রসু হবে এবং সেই অর্থে এটা এক দিনের লড়াই নয়। এটি দীর্ঘমেয়াদী লড়াই এবং মনে রাখতে হবে আমরা সংখ্যায় খুবই কম। কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও চেতনাতে অনেক শক্তিশালী। এই শক্তিটাই আমাদের ভবিষ্যতের পথ তৈরি করবে। নিজেদের মধ্যে বিভেদ ভুলে আমরা আরও যেন শক্তিশালী হই, আরও ঐক্যবদ্ধ হই এই প্রত্যাশা করি। সবাইকে ধন্যবাদ।
ড. সামিনা লুৎফা, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সমবেত ছাত্র এবং সুধী যারা শুনছেন, আজকে এখানে মঞ্চে উপবিষ্ট যারা আছেন আলোচক, বক্তা সকলকে শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি আসলে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টকে ধন্যবাদ দেই, আজকের দিনে তারা যে বিষয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন করছেন, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হওয়া দরকার। তার অন্যতম কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে উচ্চশিক্ষায় খুব দ্রুত কিছু পরিবর্তন আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নিজস্ব আয় বৃদ্ধির নামে নানা রকম প্রকল্পের দিকে বিভিন্ন বিভাগকে নানাভাবে জোর করছে এবং সেই জোরের একটা অংশ হিসাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্স বা বিবশবহফ কোর্স নামে এক ধরনের ব্যবসায়ী কোর্স চালু করা হয়েছে। এগুলো চালু করার ক্ষেত্রে শিক্ষাকে অনেক দূর ছড়িয়ে দিতে হবে — এই ধরনের কথাগুলো আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। আবার ছাত্রদের কাছ থেকে আমরা শুনতে পাই — শিক্ষকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান থেকে শুরু করে অনেক অর্থকারী প্রতিষ্ঠানের কাজে যুক্ত থাকেন বলে এবং সেখানে প্রচুর সময় দেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ ক্লাস তাঁদের নেওয়ার কথা তাঁরা অনেকেই তা নিতে পারেন না। তাহলে এই বিভাগগুলো যখন সান্ধ্যকোর্স বা বিবশবহফ কোর্স চালু করে তখন কি বাইরে থেকে অন্য শিক্ষককে আনা হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সান্ধ্যকোর্স হবে তখন বিভাগের শিক্ষকরাই পাঠদান করবেন। যেই শিক্ষকরা সকালবেলা, দিনের বেলা প্রবল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাসে সময় দেন না, তারা কি সন্ধ্যায় বেশি টাকা পাবেন বলে বেশি সময় দেবেন? তাহলে কি ব্যাপারটা এরকম হয়ে যাচ্ছে না যে, শিক্ষাকে একটা পণ্যে পরিণত করার খুব উলঙ্গ একটা পর্যায়ে আমরা আছি? আপনারা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে দেখেন কিংবা অন্যান্য অনুষদেও দেখেন সেখানে এই ধরনের সান্ধ্যকোর্সের ব্যাপার রয়েছে। বিশেষ করে ব্যবসা প্রশাসন অনুষদে সেটা সবচেয়ে বেশি এবং সেখান থেকেই মূলত অন্যান্য অনুষদগুলো একে আত্মীকরণ করেছে। UCG’র কৌশলপত্রে এ ধরনের কোর্স খোলার প্রস্তাবনা পরিষ্কারভাবে বলা আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন হেকেপ বাHigher Education Quality Enhancement Project (HEQEP) এর মাধ্যমে নানা বিভাগকে গবেষণার জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এই অর্থ ব্যবহার নিয়েও প্রচুর প্রশ্ন আছে। সামাজিক মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে এই সমস্ত প্রজেক্টের টাকার ব্যবহার ও তহবিল তসরুফের নানা ধরনের অভিযোগ আমরা পেয়েছি। তার মানে বিভিন্ন ব্যাক্তির পকেট ভরা ছাড়া আর তেমন কোনো কাজ কিন্তু এই উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্রের মাধ্যমে হচ্ছে না। এই কৌশলপত্রকে যদি এখনো আমরা মনে করি যে এটা খুব দূরের ব্যাপার তাহলে খুব বড় ভুল হয়ে যাবে। কৌশলপত্রের দেখানো পথ যদি সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বন্ধ করা না যায় তাহলে সামনে খুব খারাপ সময়। খুব পরিষ্কারভাবে বুঝে নিতে হবে যে, আপনি যদি কোনো কারণে খুব বেশি টাকা দিয়ে পড়তে সমর্থ না হোন, তাহলে আপনার জন্য কিন্তু উচ্চশিক্ষার দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে। আপনি যদি কোনো না কোনভাবে এই সরকারি শাসকগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত হতে না পারেন তাহলে আপনার গবেষণায় বরাদ্দ পাবার কোনো সম্ভাবনাই আর থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মূল চেতনা, যেখানে ছাত্ররা কেবল পাঠ নেবে না, এখান থেকে তারা সারা বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারের সাথে যুক্ত হবে, তার মানে একজন মানুষ হবে- তার প্রত্যেকটি জায়গা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বিযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠক্রমের বাইরেও নানা সাংস্কৃতিক কিংবা সাহিত্যিক কার্যক্রমের সাথে শিক্ষার্থীরা যুক্ত থেকেছেন, সেই জায়গাগুলোও ধীরে ধীরে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে। আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা যেগুলো ছিল খোলামেলা, যেখানে আমরা সবসময় আড্ডা দিতাম, গল্প করতাম, গান-বাজনা হতো সেই জায়গাগুলো আস্তে আস্তে সংকুচিত হচ্ছে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো জায়গাগুলো ব্যবহার করে অন্য লোকদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করছে। এগুলোর বিপরীতে আজকেও যদি আমরা না দাঁড়াই তাহলে আর কিন্তু সময় পাওয়া যাবে না।
প্রশ্ন উঠতে পারে শিক্ষা কি এমন হওয়া উচিত নয় যে, একজন শিক্ষার্থী বহির্বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে, পড়াশুনা শেষ করে চৌকস, ঝকঝকে মানুষ হিসাবে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে? খুব ভালো কথা। আমি কিন্তু বুঝি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অর্থ কেবল skill বা দক্ষতা বৃদ্ধি নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার আরও গভীর অর্থ আছে। বাংলাদেশের যে মানুষেরা সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থ দিয়ে যাচ্ছেন, সেই মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তনের জায়গায় আমি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছি সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। হাওরে যখন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তখন কি আমি দাঁড়াতে পারছি? নাকি অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্ররা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হতে চায় তাদেরকে ঠেকাতে রাস্তায় নামছি? কেবল দক্ষতা বৃদ্ধির কথা ভাবলে বড় ভুল হয়ে যাবে। খুব কষ্ট হয় যখন দেখি, যে শিক্ষার্থীরা এখানে ঢুকছেন তারা এক একজন মেশিন হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। শুধু নিজের ক্যারিয়ার ছাড়া আর কিছু ভাবছেন না। আমি বলি যদি শুধু নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভাবেন তাহলেও কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, আপনাকে নানা দ্বন্দ্বের মধ্যে জিততে হবে। আপনাকে আওয়ামী লীগের মধ্যে বা ছাত্রলীগের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছাত্রলীগ প্রমাণ করতে না পারলে আপনার সেই চাকুুিরটি হবে না। যে জায়গায় আপনি পৌঁছাতে চাচ্ছেন, সেখানে যেতে পারবেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোথায় অবস্থান করছেন? যখন তাদেরকে আমাদের দেশের সরকার প্রধান ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন যে এখন বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন করার দরকার নেই তখন তারা তাদের সেই উষ্মা-ক্ষোভ সব ঢেকে রেখে এক হয়ে গেলেন। তার মানে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও সেই রাজনীতি করেন যেটা কোনভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি নয়। এটা যার যার ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতি। সেই স্বার্থের খাতিরে তারা ভাগ হন আবার স্বার্থের খাতিরেই তারা এক হয়ে যান। সুতরাং তাদের কাছে আমাদের খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই। এখন বাকি থাকছে শিক্ষার্থীরা। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা নিজেদের প্রয়োজনে এবং দেশের প্রয়োজনে শিক্ষাকে ব্যবসা উপকরণে পরিণত করার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আপনাদের যেমন রাস্তায় নামা প্রয়োজন, শিক্ষকদেরও সেভাবে আপনাদের সাথে শামিল হওয়া প্রয়োজন। আপনারা যেমন সুন্দরবন আন্দোলনে, বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য সবসময় সামনে থাকছেন সেই একইভাবে শিক্ষাকে রক্ষার জন্য সামনে থাকবেন এই আশা ব্যক্ত করে আমি বক্তব্য শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশনে উপস্থিত আমার শ্রদ্ধেয় এবং সম্মানিত অতিথিবৃন্দ এবং বন্ধুরা, ইউজিসি’র কৌশলপত্র নিয়ে আপনাদের যে বক্তব্য, যা এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং একটি প্রচারপত্র আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। আপনাদের হয়তো স্মরণে থাকবে ইউজিসি‘র ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্রে যে বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্সের সুপারিশ আছে তার বিরুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে একটি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সেই আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালায় এবং ২৭ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। একজন শিক্ষার্থীর চোখে গুলি লাগার কারণে তার চোখটাই নষ্ট হয়ে যায়। আমার পরিষ্কার মনে আছে, প্রক্টররা মুখে কাপড় পড়ে ছাত্রদেরকে পেটাচ্ছিলেন। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ দৌঁড়ে লাইব্রেরিতে ঢুকে বাঁচার চেষ্টা করছিলো, তাদেরকে সেখানেও পেটানো হয়েছে। সেই ঘটনার পর এই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেই তিনটি মামলার বিষয়ে আমার এই মূহুর্তে মনে পড়ছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি নষ্ট করার জন্যও মামলা দেয়া হয়েছিল। এবং এরপর থেকে পুলিশ ঘরে ঘরে ঢুকে তাদেরকে গ্রেফতার করারও চেষ্টা করছিলো। সেই সময়টায় আমার কাছে খবর আসে যে, তাদেরকে ঘরেও থাকতে দেয়া হচ্ছে না। একটি রাষ্ট্রের চেহারা এবং একটি রাষ্ট্রের পরিকল্পনা যখন আসলে এরকম আগ্রাসী ভূমিকা নিতে শুরু করে, যখন বিশ্বব্যাংক বা এডিবি’র মতো দাতা সংস্থার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য একটি রাষ্ট্র উঠে পড়ে লাগে এবং সেটাকেই তাদের নীতি হিসেবে ধরে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে তখন আসলে ঘরে ঘরে গিয়ে আপনাদের গ্রেফতারই করা হবে। এটাই নিয়ম, এটাই হবে। তবে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলনটা গড়ে তুলেছিলো তা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। আমার জানা মতে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন প্রায় ১২ টি বিভাগে সান্ধ্যকোর্স চালু আছে। জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্স চলছে। সমন্বিতভাবে আন্দোলন করে, একতাবদ্ধ হয়ে আমরা যদি এ ধরনের বাণিজ্যিক অপতৎপরতা রুখে দিতে পারতাম তাহলে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় নির্লজ্জভাবে সার্টিফিকেট বিক্রির দোকানে পরিণত হতো না।
আমরা আইনজীবীরা খুব বড় গলায়, ফুলিয়ে ফাপিয়ে কিছু কথা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করি। কিছু ভারী ভারী শব্দ বলি- ‘আইনের শাসন’, ‘সংবিধান সমুন্নত রাখা’ ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো যদি সত্যিকার অর্থে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যাবে, এর ভেতরে আসলে আপনি-আমি নেই। পেশাগতভাবেও আমরা এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কাজ করি না। আমি নিজের দোষ নিয়েই বলছি। এই যেমন ধরুন, আমার আগে কিছু ছাত্র যারা এখানে বক্তব্য দিল, তারা বলল শিক্ষা হলো অধিকার। এটা কি মুখের কথা যে, শিক্ষা অধিকার? শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এরকম কোনো আইন কি আমাদের দেশে আছে? আছে। এই যে আবার ফাপা কথা বলতে শুরু করেছি। আমাদের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে কিছু বলা আছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে কিন্তু শিক্ষাকে অধিকার হিসেবেই বলা আছে। তাহলে ইউজিসি’র এই যে কৌশলপত্র, বাণিজ্যিকীকরণের যে চেষ্টা, বিশ্ববিদ্যালয়কে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার যে প্রকল্প, তা সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক নয় কেন? কেন তাহলে রাষ্ট্রের আরেকটি আইন, আরেকটি নীতিমালা? এই ইউজিসি’র কৌশলপত্র তো রাষ্ট্রেরই আরেকটি নীতিমালা যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলবে। সেটি কেন তাহলে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বিবেচনায় বাতিল হবে না? এটাই হলো বাস্তবতা। বইয়ে আছে, কেতাবে আছে কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। সেই জায়গাটা ধরে এগিয়ে যাবার যে চেষ্টা, সেটাও নেই। এতটাই অভাগা-দুর্ভাগা আমরা। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনার কথা আমরা বলি, সেই সত্যিকারের চেতনা, সত্যিকারের প্রয়োজনটুকু মেটানোর জন্যই আমাদের দেশটাকে অন্যরকমভাবে গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল।
কৌশলপত্রে এমন এমন বিষয় পড়ানোর কথা বলা হয়েছে যেগুলোতে সরাসরি চাকুরির নিশ্চয়তা আছে। তাহলে কি কেউ বাংলা সাহিত্য পড়বে না? বাংলা পড়লে কি আপনার চাকুরি হবে না? তাহলে কি আমাদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যেসমস্ত সুকুমার বৃত্তি বিকাশের প্রয়োজন, যেগুলোতে চাকরির সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই; সেগুলোর অধ্যায়ন হবে না? বিশ্বব্যাংক ঠিক করে দেবে এই দেশের মানবসম্পদ কীভাবে তৈরি হবে? রাষ্ট্র তার নিজের গরজে নিজের প্রয়োজনে বিনিয়োগ করে মানবসম্পদ তৈরি করার জন্য। এই বিনিয়োগের জায়গা হলো বিশ্ববিদ্যালয়। যে টাকা সরকার বিনিয়োগ করে সেটা দেয় দেশের জনগণ। সুতরাং জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে তাদের টাকা কোথায় খরচ হবে। এখানে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেবার কোনো এখতিয়ার নেই। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশতন্ত্র বলতে যেটা বোঝায় — বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য যে চেষ্টা, গত ৪৬ বছরে এই চেষ্টা হয়নি। আজকে থেকেই শুরু করি আমরা। সেই শপথ নেই। ধন্যবাদ সবাইকে।
গোলাম মোর্তাজা, সম্পাদক, সাপ্তাহিক
শুভেচ্ছা, ধন্যবাদ ও অভিনন্দন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টকে এবং শিক্ষাকে কেন্দ্র করে কনভেনশন আয়োজন করার জন্য। আমরা খুব কঠিন একটি সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সেই সময়ে সবচেয়ে বেশি যেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলা দরকার তা হলো শিক্ষা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, এ ব্যাপারটি নিয়েই আমরা কম কথা বলছি। যেমন ইউজিসি’র কৌশলপত্র, যার কাজ শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে । যে সময়ে এটি শুরু হয়েছে তখন যে আন্দোলন হয়নি তা নয়। কিন্তু আন্দোলনকে সফল করার জন্য যে উদ্যোগ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রত্যাশিত ছিল, সমাজের নানা জায়গা থেকে যেভাবে আন্দোলনটি বেগবান হবার প্রয়োজন ছিল, সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে জনগণের মধ্যে যেভাবে বিষয়টি তুলে ধরার দরকার ছিল তা আমরা পারিনি।
একটি বিষয় খেয়াল করবেন। বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ সাধারণ শিক্ষার উপর নির্ভরশীল। হয়তো ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছে ইংরেজি মাধ্যমে। বিষয়টি গভীরভাবে লক্ষ্য করার মতো। ইংরেজি মাধ্যমে যে সমস্ত উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা পড়াশুনা করছেন, শ্রেণিগতভাবে তাদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো যে, ৯৫% মানুষের সন্তানরা যে শিক্ষা নিচ্ছেন সে শিক্ষাটি সুপরিকল্পিতভাবে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। ৫% মানুষের যে শিক্ষা তার জায়গাটি অক্ষুণœ থাকছে। সেই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে না। তারা কিন্তু ঠিকই আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী পড়াশুনা করছে। কিন্তু ওই ৯৫% সাধারণ মানুষের সন্তানরা যদি কেবল সার্টিফিকেটসর্বস্ব মানুষে পরিণত হন, তাহলে বাংলাদেশটা কাদের হাতে চলে যাবে? চলে যাবে ৫% মানুষের হাতে। ৯৫ ভাগ থাকবে প্রজার ভূমিকা আর রাজত্ব করবে ৫ ভাগ। এই সুচতুর বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে আমরা কথা বলছি কিন্তু কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছি না। কেউ কিছু করছে না – এভাবে বলাটা হয়তো ভুল। আপনারা চেষ্টা করছেন। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীকে বাধ্য করা যায় এরকম অবস্থায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি।
পরিকল্পিতভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যে এভাবে খাদের কিনারে নিয়ে যাওয়া হলো, এ থেকে বের হবার পথ কী? আমি ঠিক জানি না এই কনভেনশন থেকে আপনাদের কর্মকৌশলটা ঠিক কী হবে। কিন্ত আমার মনে হয়, একটি জায়গায় আমাদের সকলের একমত হওয়া দরকার। যেসব জায়গায় অন্যায় এবং অনিয়ম হচ্ছে এরকম সুনির্দিষ্ট করে ছোট ছোট দু-একটি জায়গায় আপনাদের যে শক্তি আছে, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের যে শক্তি আছে, আপনাদের সমমনা সংগঠনগুলোর যে শক্তি আছে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিতভাবে বড় প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। মানুষের নজরে আনা দরকার যে কতবড় অন্যায় বা অনিয়ম ঘটছে। আপনারা সারা দেশে এরকম ছোট ছোট দু একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে যদি আঘাত করতে পারেন তাহলে আমার ধারণা কিছুটা ফল আসতে পারে। আপনারা সেই চেষ্টা করুন। আমরাও গণমাধ্যমের জায়গা থেকে চেষ্টা করব আপনাদের সাহায্য করতে। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।