রাষ্ট্রের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক কেমন হবে? অধীনতার, আধিপত্যের নাকি সহযোগিতার? রাষ্ট্র কেমন ভূমিকা পালন করলে বিশ্ববিদ্যালয় তার যোগ্য দায়িত্ব পালন করতে পারবে? জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারবে? প্রশ্নগুলো দার্শনিক, তাই উত্তরগুলো সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেয়া আবশ্যক। বিশ্ববিদ্যালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যেহেতু সমাজের মানুষকে নিয়েই তার কারবার। এটি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, অর্থ উপার্জনের পথ তার অজানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দায়িত্ব জ্ঞানের অনুশীলন, জ্ঞান সৃষ্টি এবং তার বিতরণ। এতসব আয়োজনের জন্য অর্থের প্রয়োজন। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হতে হয়। অর্থ বরাদ্দ দেয় বলে রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আধিপত্য দেখাতে পারে না। আধিপত্য দেখালে কিংবা রাষ্ট্রের অধীন হলে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে। রাষ্ট্র এমন করতে পারে না করুণা থেকে নয়, প্রয়োজন থেকে। কেননা রাষ্ট্রকে জনকল্যাণমুখী চরিত্র বজায় রাখতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়কে সজীব রাখতে হয়। আর স্বাধীনতা ছাড়া সজীবতা মেলে না। তাইতো বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আরেক রাষ্ট্র।
ব্যাপারটা এমন হলেই ভালো হতো। কিন্তু বাংলাদেশের সকল পাবলিক প্রতিষ্ঠানের যে হাল, সরকারি নিয়ন্ত্রণ-দলীয়করণ-প্রশাসনিক দৌরাত্ম্য-দুর্নীতি-পেশিশক্তির মহড়া-সরকারি অবহেলা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা তার বাইরে নয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই যেমন ধরা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য সংকটের কথা বাদ দিলেও শিক্ষার্থীদের একান্ত ন্যায্য দাবি, আবাসিক ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ হল নির্মাণ নিয়ে গত দুই সরকার (আওয়ামী লীগ-বিএনপি) যে কা- করলো- তাকে কি-ই বা বলা যেতে পারে? এটা সরকারের চূড়ান্ত অবহেলা আর দায়িত্বহীনতারই উদাহরণ। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১১ বছর আগে। অথচ আজ পর্যন্ত একটি আবাসিক হল নির্মাণ করার মুরোদ হলো না সরকারের? হল ছাড়া যে বিশ্ববিদ্যালয় হয় না- একথা আজও যুক্তি করে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হয়। কেবল যুক্তি উত্থাপন নয়, দিনের পর দিন রাস্তায় অবস্থান করে, ক্লাশ-পরীক্ষা বাদ দিয়ে তাদের আন্দোলন করতে হয়। দেশের অন্যতম প্রধান এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকার কোন্ দৃষ্টিতে দেখে তা তো স্পষ্টই বোঝা যায়। রাষ্ট্রের সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক চূড়ান্ত অসহযোগিতার এবং অবহেলার।
গত দুই মাস আগে হলের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবারও আন্দোলনে নেমেছিলো। আন্দোলন শুরু হয়েছিলো ২ আগস্ট। চলেছে টানা ৩৩ দিন। এতদিন ধারাবাহিক আন্দোলন পরিচালনা করা এদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আন্দোলনকে বহুভাবে নস্যাৎ করার চেষ্টা হয়েছে। আক্রমণ এসেছে বারবার। কখনো রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী, কখনো বা সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছে। পুলিশের টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটে আহত হয়েছে বহু শিক্ষার্থী। মিঠুন রায় নামে এক শিক্ষার্থী টিয়ারশেলে আহত হয়ে আজও চিকিৎসাধীন। ছাত্রলীগের দফায় দফায় হামলার শিকার হয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেহরাব আজাদ, দপ্তর সম্পাদক গোলাম রাব্বী, স্কুল সম্পাদক সমিত ভৌমিক, সদস্য অনিমেষ রায়সহ শিক্ষার্থী মনিরুল ইসলাম রাজন, রাশেদুল ইসলাম, কাজী হুমায়ূন, নাজমুল হাসান, মনিরুজ্জামান রিপন, , মাহিদুল ইসলাম মাহিম, মিরাজ, তারেক হাসান, ফয়সাল খানসহ আরও অনেকে। নারী শিক্ষার্থীদের বুকে-পেটে লাথি মেরেছে সন্ত্রাসীরা। শিক্ষার্থীদের উপর নিক্ষেপ করেছে জলন্ত টায়ার। এতসব অত্যাচার শিক্ষার্থীদের সহ্য করতে হয়েছে কেননা তারা একটা ন্যায়সঙ্গত দাবি তুলে ধরেছিলো! আমাদের দেশে এ অবস্থা অবশ্য নতুন নয়, ব্যতিক্রমও নয়। ন্যায়ের শক্তি এখানে প্রতিনিয়ত পর্যদুস্ত হচ্ছে। তবে আশার কথা, শিক্ষার্থীরা হাল ছাড়েনি। বহু বাধার সম্মুখীন হয়েও ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে গেছে। ফলে এক পর্যায়ে গত ৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নতুন হল নির্মাণের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুশীলনের সাথে আবাসিক ব্যবস্থাপনার একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। হল থাকলে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে যেমন সম্পর্কের নৈকট্য বাড়বে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনবোধ গড়ে উঠবে। একটা ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে। ক্লাসরুমে, ল্যাবরেটরিতে, গ্রন্থাগারে বিদ্যার যে অনুশীলন হবে, তার পরিপূরক এবং সহায়ক ব্যবস্থা থাকবে আবাসিক হলগুলোতে। ফলে এটা নিছক থাকবার জায়গা মাত্র নয়। উচ্চশিক্ষার সাথে যুক্ত যে উচ্চ মননশীলতার সৃজন, তার স্বার্থেই আবাসিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।
সরকারের তো অর্থের কোনো অভাব নেই। আমরা তো জানি, বিগত কয়েক বছরে লোপাট হয়েছে আড়াই লক্ষ কোটি টাকার বেশি, ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হয়েছে ৮১০ কোটি মার্কিন ডলার, কিংবা সেনা সদস্য-পুলিশের ব্যারাক করতে তো জমির অভাব হয় না, মন্ত্রী- এমপিদের থাকার জায়গারও তো অভাব হয় না। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ হাজার শিক্ষার্থীর থাকার জন্য হল নির্মাণ হয় না কেন? এখানেই আছে রাষ্ট্রের চরিত্রকে চিনে নেবার বিষয়টি। উপরের বিবৃত কথাগুলো নিছক কিছু সংখ্যা নয়, রাষ্ট্রের সার্বিক দুর্নীতি-অনিয়মেরই কিছু প্রতিচ্ছবি। এমন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানকে কি চোখে দেখবে তা বোধহয় বলাই যায়। এখানে পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে থাকবে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত অবহেলা আর প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান হলে শিক্ষা টাকার বিনিময়ে বিক্রি হবে। যদিও এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও চলছে ‘টাকার বিনিময়ে শিক্ষা’ কর্মসূচি। এমন ব্যবস্থার যারা প্রতিনিধি তাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান সৃষ্টির কারখানা নয়, মুনাফা তৈরির জায়গা, মানুষ নয় কেরানি তৈরি তাদের লক্ষ্য। দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক দুরাবস্থার কারণও এই।
সরকারের শত অবহেলার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীর হল নির্মাণের ঘোষণা ধারাবাহিক ছাত্রআন্দোলনের প্রাথমিক বিজয়। ঘোর অমানিশার মাঝে এটাই আশার আলো। তবে কেবল ঘোষণা যথেষ্ট নয়। অতীতেও বহুবার বহুকিছু ঘোষণা আকারে এসেছে। কিন্তু বাস্তবতার মুখ দেখেনি। এবারও তেমন কিছু হলে ছাত্রসমাজ কোনোভাবে মেনে নেবে না। ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে তারা আরও একবার মাঠে নামবে।