Thursday, April 25, 2024
Homeফিচারসংখ্যালঘু নিপীড়ন — কাঁদছে মানবতা, জয়ী হচ্ছে শাসকেরা

সংখ্যালঘু নিপীড়ন — কাঁদছে মানবতা, জয়ী হচ্ছে শাসকেরা

44

একটু পেছনে তাকাই
উত্তম বড়ুয়া নামে এক ব্যক্তির ফেসবুক একাউন্টে পবিত্র কাবা শরীফ অবমাননার ছবি দেখা গেছে এই অজুহাত তুলে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলার রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলা করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায় যে, ছবিটা সে পোস্ট করেনি, কেউ তার একাউন্টে এই ছবি ট্যাগ করেছে। অথচ এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরের দু’দিনে রামু, উখিয়া, পটিয়া ও টেকনাফের প্রায় ১৯টি বৌদ্ধবিহার ও অর্ধশতাধিক বাড়িতে হামলা করা হয়, আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। উত্তম বড়ুয়া আজও নিখোঁজ। তার স্ত্রী এক বছর পর এলাকায় ফিরতে পেরেছেন। উত্তমের স্ত্রী বলে সরকারের ত্রাণও তার কপালে জুটেনি। উত্তমের মা পড়েছিলেন ভিটে আঁকড়ে। তার কপালে জুটেছিল অশ্রাব্য গালিগালাজ আর হাজতবাস।

এরপর ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা। এখানে দায়ী ব্যক্তির নাম রাজীব সাহা। পনের বছর বয়সের রাজীব সাহা দশম শ্রেণির ছাত্র। গুজব উঠল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে সে ফেসবুকে কটূক্তি করেছে। আবার বাড়ি ও মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। রাজীব সাহা ফেসবুক ব্যবহার করত কিনা সে বিষয়ে তার সহপাঠীরা কিছু বলতে পারেননি। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ব্যাপারটা পরিকল্পিত।

পরের ঘটনা ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। একইভাবে ফেসবুকে কাবাশরীফ অবমাননার অজুহাত এবং উপজেলা সদরের হিন্দু বসতি ও মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ। এবারের ঘটনার উৎস হিসেবে দেখানো হয় রসরাজ দাস নামের এক যুবককে। বলা হয়, তার ফেসবুক আইডি থেকে আপত্তিকর পোস্টগুলো করা হয়। রসরাজ দাসকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

প্রত্যেকটি ঘটনায় একটি ব্যাপার স্পষ্ট — ঘটনার উৎস যাদের পোস্ট, কোনো ঘটনায়ই তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। এবারও রংপুরের পাগলাপীরের ঠাকুরপাড়া গ্রামে যে ঘটনা ঘটে গেল, সেখানে টিটু রায় নামে এক ব্যক্তির ফেসবুক থেকে বিতর্কিত পোস্টের কথা বলা হয়েছে। অথচ আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের ভাষ্যমতে টিটু রায় নিরক্ষর। সে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে সাত বছর ধরে এলাকার বাইরে আছে। যে ফেসবুক একাউন্ট ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে তার নাম মুহাম্মদ টিটু। একাউন্টটি তিনমাস আগে করা। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটা একটা ফেইক একাউন্ট। একটা ফেইক একাউন্ট থেকে পোস্ট করা একটা স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে আবার আক্রমণ, মন্দির ও ঘরবাড়ি ভাঙচুর, আগুন লাগানো। এবারে ঘটনার সময় পুলিশের গুলিতে একজন মারা যান।

ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনো মিল আছে কি?
ঘটনাগুলো যদি আমরা একটু খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করি তবে প্রত্যেকটি ঘটনার মধ্যে একটি সাধারণ মিল দেখতে পাব। সেটা হলো ঘটনা ঘটার পূর্বে একটা বড় সময় ধরে ঘটনার প্রস্তুতি চলা, একটু একটু করে এর তীব্রতা বৃদ্ধি এবং এই সময়ে প্রশাসন কিংবা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা কিংবা জনপ্রতিনিধি কারোরই কোনো ভূমিকা না থাকা। রামু, সাঁথিয়া, নাসিরনগর কিংবা ঠাকুরপাড়ার ঘটনায় আমরা একই বিষয় দেখব। সবগুলো ঘটনার এই জায়গায় একটা মিল আছে। কোনো জায়গায় হয়তো মানুষ জড়ো হয়ে মিটিং করেছে, তারপর মিছিল নিয়ে এগিয়েছে। কোনো জায়গায় রাস্তা অবরোধ করে ছিল অনেকক্ষণ, তারপর এলাকায় হামলা করেছে। কোনো জায়গায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে হামলা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্রশাসন যে সময় পেয়েছে তাতে সে ধ্বংসযজ্ঞ সামলাতে পারতো। কিন্তু না প্রশাসন, না প্রভাবশালী নেতা, না জনপ্রতিনিধি — কেউই এগিয়ে আসেননি। ঘটনাকে বাধাহীনভাবে সংগঠিত হতে দিয়েছেন। প্রশ্ন ওঠে এ কাজ তারা করলেন কেন।

এই ‘কেন’ প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ?
আমরা কোনো কেস স্টাডিতে না গিয়ে (কারণ সেগুলো পত্র-পত্রিকায় বহুবার এসেছে)এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ ঘটনাগুলোকে পরিপক্ক হতে সময় দিয়েছে। উত্তেজনাকে ধীরে ধীরে আক্রোশে পরিণত হতে দিয়েছে। ঘটনা পরিণত না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন ও প্রবল ক্ষমতাধর আওয়ামী লীগ অপেক্ষা করেছে। কিন্তু কেন?
হামলা-ভাঙচুর-জ্বালানো পোড়ানো-লুটপাট কিংবা মানুষের মৃত্যু — কোনোটাই দেশের শাসকগোষ্ঠীর কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। দেশের শাসনব্যবস্থাটা পুজিবাদী। এখানে শাসকরা আসেই পুঁজির নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। মানুষের নিরাপত্তা তাদের ভাবনার বিষয় নয়। এক একটি মানুষ এখানে এক একটি ভোট। গোষ্ঠী মানে একটি ভোটার গোষ্ঠী। সাধারণভাবে রাষ্ট্র চালাতে কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলার ব্যাপার থাকে। সেদিক থেকে পুলিশ কিংবা প্রশাসন কিছু কাজ প্রতিদিনই করে। কিন্তু এটি বিশেষ ব্যাপার। একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী আক্রান্ত। একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর উপর ধর্মপরিচয়ের কারণে সংঘটিত আক্রমণ তাদের চিন্তায় প্রভাব ফেলে, তাদের রাজনৈতিক সমর্থন ও সক্রিয়তায় তার ছাপ পড়ে। ফলে রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর বিবেচনার ব্যাপার এ নয় যে, বাড়িঘর পুড়লে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হলে অসহায় মানুষগুলো কোথায় দাঁড়াবে; বরং বিবেচ্য বিষয় এই যে, এ ঘটনা তাদের কোন পক্ষে নিয়ে যাবে। ‘কেন’ এর উত্তর এখানেই নিহিত।

ঘটনার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য
প্রত্যেকটি ঘটনায় সংখ্যালঘুদের অসহায়ত্ব, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। দেশে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা যথেষ্ট শক্তিশালী না হওয়ার কারণে এই অসহায়ত্ব, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা তাদেরকে আরও বেশি করে আওয়ামী লীগমুখি করেছে। এরকম ঘটনাগুলোর সাথে স্থানীয় ও জাতীয় কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী জড়িত থাকে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ঘটনায় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তাদের নির্দেশে চলা প্রশাসন ঘটনাপূর্ব অবস্থাকে পরিক্ক করে তুলেন, ঘটনা সংঘটিত হওয়াকে নির্বিঘœ করেন এবং ঘটনার পর ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হন। এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী তখন পরবর্তী আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদেরকেই অবলম্বন করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের নিজেদের সংগঠিত প্রতিরোধ প্রায় নেই, নিজ সম্প্রদায়ের সম্পদশালী ও প্রভাবশালী লোকেরা ও কায়েমি স্বার্থের লোকেদের সাথে যুক্ত হয়ে ঘটনা থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা তুলতে ব্যস্ত কিংবা একেবারে নিশ্চুপ — এ অবস্থায় উপায়হীন হয়ে আওয়ামী লীগকেই আশ্রয় করেন তারা। আওয়ামী লীগ একদিকে তাদের ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত করেন, অন্যদিকে ঘটনার ভয়াবহতা ও ঘটনা পরবর্তী সময়ে উদ্ধারকার্যের ব্যাপক প্রচার দিয়ে মানবতার রাজমুকুট নিজের মাথায় সমুন্নত রাখেন। ঘটনার তদন্ত হওয়ার পূর্বেই বিএনপি-জামাতকে দায়ী করে নিজেদের বিরোধীপক্ষকে একেবারে কোণঠাসা করেন। এটা হলো ঘটনার রাজনৈতিক দিক।

23517426_705847916275893_5806241027340941613_n copy

এর একটা অর্থনৈতিক তাৎপর্যও আছে। দু’একটা খবর তুলে দিলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে।

১২ মে, ২০১৪, ‘বিডি নিউজ ২৪ ডটকম’ এর একটি সংবাদে বলা হয়েছে, ১১মে সন্ধ্যায় নওগাঁর নিয়ামতপুর সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি বজলুর রহমান নঈম এর নেতৃত্বে ১৮-২০টি মোটরসাইকেলসহ অর্ধশতাধিক যুবকের বাহিনী স্থানীয় মন্দিরে হামলা চালায়। সাবেক ইউপি সদস্য মহারাজপুর গ্রামের বসুদেব চন্দ্র বর্মন অভিযোগ করেন যে, শ্মশানের পুকুরসহ সম্পত্তির দখল নিতে আওয়ামী লীগের এ নেতা হামলা চালান।

২৩ মে, ২০১৪, যুগান্তর পত্রিকার একটি শিরোনাম ছিল- ‘ছাতকে সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখলের অভিযোগ।’ সেখানে বলা হয়- ছাতকে একটি হিন্দু পরিবারের বসতবাড়ির জায়গা জোরপূর্বক দখল ও গাছ কেটে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবৈধ দখলদারদের বাধা দেয়ায় জায়গার মালিক সমীরণ সরকার ও তার স্বজনদের হত্যার হুমকি দিয়েছে সন্ত্রাসীরা।

২৮ মে, ২০১৪, প্রথম আলো পত্রিকায় ‘৪০ বিঘা জমি আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে’ এই শিরোনামে একটি সংবাদ ছাপে যাতে বলা হয়- ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার দুধসর গ্রামে একটি হিন্দু পরিবারের পাকা বাড়িসহ ৪০ বিঘা জমি দখল করে রেখেছেন আওয়ামী লীগের দুই নেতা। তাঁরা সহোদর। আর সম্পত্তি উদ্ধারের মামলা করে ভয়ে পালিয়ে রয়েছেন পরিবারটির দুই সহোদর। তাঁরা এখন একটি ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

এটি শুধু ২০১৪ সালের মে মাসের কয়েকটি সংবাদ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রতি বছরের প্রতি মাসের হিসাব করলে এ লেখা শেষ করা যাবে না।

এ নিয়ে ব্যাখ্যা অনাবশ্যক। ঘটনাই কথা বলছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার পেছনে একটা অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত, জড়িত কায়েমি স্বার্থবাদীদের একটা বিরাট গোষ্ঠী। বেশিরভাগ জায়গায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের দলীয় পরিচয় হলো আওয়ামী লীগ। ফলে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ও সহিংসতার প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় আওয়ামী লীগ। যদি তাই হয়, তাহলে এ ঘটনা ঘটতে না দেয়ার কী কারণ থাকতে পারে তাদের পক্ষ থেকে?

ঘটনায় যে আওয়ামী লীগ জড়িত, এটি প্রমাণিত হয়েছে একাধিকবার। রামুর ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে। পরবর্তী সময়েও বেশিরভাগ ঘটনায় তাদের নাম এসেছে। দেখা গেছে শুধু হামলা চলতে দেয়া নয়, ঘটনাকে উস্কানো ও আক্রমণেও আওয়ামী লীগ নেতারা জড়িত।

গুজব যখন সত্য থেকেও শক্তিশালী
ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরের দিন ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকায় সংবাদ ছাপান হলো Ñ ‘বাবরি মসজিদ ভাঙা হল, ঢাকায় হিন্দুদের খুশিতে মিষ্টি বিতরণ’। এখনকার সময়ে আর পত্রিকার দরকার হয় না। ফেসবুক সে জায়গা নিয়েছে। বলা যায় কাজটাকে আরও সহজ করেছে। এ সময়ের সবগুলো ঘটনায় আমরা এর ভূমিকাই দেখব। এ ধরনের পরিকল্পিত মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের পেছনে পরিকল্পিত উদ্দেশ্য থাকে। পরিকল্পনা আগেই প্রস্তুত থাকে। এরপর চলে উস্কানোর কাজ। সেটা একটা মাত্রায় উঠলে তবেই কার্যসিদ্ধি হয়। অন্য ধর্মের নিরীহ মানুষের উপর আক্রমণের কথা কোনো ধর্মেই নেই। কিন্তু গুজব ধর্মের বাণীর চেয়েও শক্তিশালী। ধর্মরক্ষার জন্য ধর্মকেই তখন অগ্রাহ্য করে মানুষ। দিগি¦দিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে যায়। ধর্মের সাথে মানুষের আবেগ যুক্ত। আবেগের উপর আঘাতের কথা শুনে সে নিষ্ঠুর হয়। তখন যে আবেগ তাকে অনেক খারাপ কাজ হতে দূরে রাখতো সে আবেগই অন্ধতার দরুণ তাকে নিচে নামায়। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘হৃদয়াবেগ দুর্মূল্য বস্তু, কিন্তু চৈতন্যকে অন্ধ করে দাঁড়ালে এর চেয়ে বড় শত্রু আর নেই।’

গুজবের পেছনে মানুষ ছোটে কেন
মানুষ এই গুজবের পেছনে যে এভাবে ছোটে, শাসকশ্রেণি-সাম্প্রদায়িক শক্তি ও কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা যে এভাবে ব্যবহৃত হয় — এটা কি প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয়? এর কোনো ঐতিহাসিক-সামজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কি নেই? ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এরকম ব্যাপার চাইলেই ঘটান যায় কি? তাহলে আমাদের দেশে কিংবা ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমারে ব্যাপারটা এমন কেন?

আমরা দেখব, দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে লড়েছিল। তখন বিভক্তির সুর উঠতে পারেনি। কারণ পাকিস্তানি প্রায় উপনিবেশিক শাসনে সবাই নিষ্পেষিত হচ্ছিল। এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক এ শোষণ লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তাদের ঐক্যবদ্ধ করলেও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এই সংগ্রাম ভাল হয়নি। অথচ তা জরুরি ছিল। লড়াইয়ের প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধতার যে জায়গা করে দিয়েছিল সেটাকে ভিত্তি করে নিজেদের সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে কমিয়ে আনা যেত। সবরকম সংকীর্ণতা ও কূপমন্ডূকতাকে পরাস্ত করা যেত। সে চর্চা দেশের মুক্তির সংগ্রামের সময় হলে স্বাধীন দেশে কথায় কথায় এমন কান্ড তৈরি করা যেত না। কিন্তু তা হয়নি। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল পরাধীন দেশের উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণি। দেশ স্বাধীন করার তাদেরও প্রয়োজন ছিল, আবার দেশের মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত গরীব মানুষদেরও ছিল। সকলের প্রয়োজন এক ছিল না। লড়াইয়ে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য এক ছিল না। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বুর্জোয়ারা বিপ্লবভীতির কারণে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত-মেহনতি শ্রমিক কৃষকরা সাংস্কৃতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হোক তা চায়নি। ফলে ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিগত বিদ্বেষের মনোভাব এই দেশে থেকে গেছে। এই বিদ্বেষপূর্ণ মন তাদের শোষণের অস্ত্র। নির্মম পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে জনগণ যাতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে তার জন্য এই অস্ত্র সে সবসময়ই ধার দিয়ে রাখে। নিষ্পেষণ ও নিপীড়ণের আর সকল হাতিয়ারে মরিচা পড়তে পারে, কিন্তু এই হাতিয়ার সবসময়ই ঝকঝকে থাকে — কারণ এর ব্যবহার ও যত্ন দুই’ই বেশি।

আমাদের করণীয়
আজ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শুধু নয়, পাহাড়ের আদিবাসীরাও ভীষণ নিপীড়নের মধ্যে আছেন। সংখ্যালঘুদের থেকে তাদের অবস্থা আরও খারাপ, আক্রমণ আরও তীব্র, অসহায়ত্ব আরও বেশি। সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে তাও খবর হয়, সচেতন মানুষ প্রতিবাদ করেন — পাহাড়ে এর দশগুণ বেশি তীব্র নির্যাতনে এর দশভাগের একভাগ প্রতিক্রিয়াও হয় না। তবে কারণ দু’য়েরই এক। কারণ এই পুঁজিবাদী সমাজ। ধর্মীয় কিংবা জাতিগত নিপীড়নের প্রকৃতি যাই হোক না কেন, তার কারণ এই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যেই আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে পুঁজিবাদবিরোধী লড়াইয়ে শামিল হওয়া দরকার, তীব্র সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ঐক্যকে আরও দৃঢ় করা দরকার। পুঁজিবাদের এই ঝকঝকে অস্ত্রকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করা যাবে এই পথেই।

সাম্যবাদ নভেম্বর ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments