Wednesday, November 13, 2024
Homeফিচারপ্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা কী পেলাম?

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা কী পেলাম?

দেশ একটা সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গোটা বিশ্ব মরণঘাতী করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত। আমাদের দেশে সরকারি হিসেবে এ পর্যন্ত ৩৯ জন আক্রান্ত, ৫ জন মৃত, ৫ জন সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পেরেছে। আইইডিসিআর এই তথ্য দিলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ পরীক্ষা করছে না। একটিমাত্র ল্যাবে প্রতিদিন খুব সামান্য সংখ্যক পরীক্ষা করা হচ্ছে। ফলে সীমিত সংখ্যক আক্রান্ত দেখানো হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিজেই ঘোষণা করেছে যে, এটি কমিউনিটি পর্যায়ে ট্রান্সমিশন হয়েছে, অর্থাৎ সংক্রমণের তৃতীয় ধাপে এটি প্রবেশ করেছে। সরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়নি, বিদেশ থেকে আসা লোকেদের সঠিকভাবে স্ক্রিনিং ও কোয়ারেন্টাইন করা হয়নি, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত পিপিই বরাদ্দ করা হয়নি – অথচ আমরা ৩ মাস সময় পেয়েছিলাম প্রস্তুতি নেয়ার জন্য। সাধারণ মানুষের মধ্যে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে এ ব্যাপারে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এরই মধ্যে তৃতীয় ধাপের সংক্রমণের হার রোধ করতে সরকার ২৫ মার্চ থেকে সারাদেশ লক ডাউন ঘোষণা করেছে। এ সময় সকল সরকারি ও বেসরকারি অফিস আদালত বন্ধ থাকবে। আন্তঃজেলা যোগাযোগও বন্ধ থাকবে। মানুষকে প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বের না হতে বলা হচ্ছে। এই পদক্ষেপ বিজ্ঞানসম্মত। এটা একটা পাবলিক হেলথ্ ইমার্জেন্সি। এটা নেয়া দরকার ছিল। কিন্তু সাথে সাথে একথাটাও সরকারের ভাবতে হবে যে, কোটি কোটি নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের এই সময়ে কাজ বন্ধ হয়ে গেলÑতাদের উপায় কী হবে? যারা গৃহহীন, ভূমিহীন, দিনমজুর – তাদের উপায় কী হবে? লক-ডাউনের সাথে সাথে এদের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করাটাও সরকারের দায়িত্ব। অথচ এর কোনো উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে আমরা দেখছি না।

এরইমধ্যে গতকাল ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন। আমাদের প্রত্যাশা ছিল প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে-

  • কমিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে বলবেন।
  • প্রতিদিন স্বল্প সংখ্যক পরীক্ষা করা ও কিটের স্বল্পতার ব্যাখ্যা দেবেন।
  • চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহ করতে না পারার ব্যাপারে বলবেন।
  • নিম্ন আয়ের মানুষ, গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তা বলবেন।
  • গার্মেন্টসগুলো এখনও বন্ধ হয়নি। তাদের সবেতনে ছুটি দেয়া ও গার্মেন্টসের সাথে যুক্ত অসংগঠিত সেক্টরের শ্রমিকদের রেশনের ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত করবেন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এসকল বিষয়ে যতটুকু আলোচনা তিনি করেছেন, তাতে আমাদের নিরাশ হতে হয়েছে। তাঁর বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের জন্য কিছু ঘোষণা আছে। যেমন:

  • ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ
  • বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুন মাস পর্যন্ত কোনো গ্রাহককে ঋণখেলাপী ঘোষণা করবে না
  • রপ্তানী আয় আদায়ের সময়সীমা দুই মাস থেকে বৃদ্ধি করে ৬ মাস ঘোষণা
  • আমদানী ব্যয় মেটানোর সময়সীমা ৪ মাস থেকে বৃদ্ধি করে ৬ মাস ঘোষণা

কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ, অসংগঠিত সেক্টরের শ্রমিক, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষÑতাদের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসলো না। আসলো কিছু আশ্বাস। যেমন:

  • ‘ঘরে ফেরা’ কর্মসূচির আওতায় তাদেরকে নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা করা হবে।
  • গৃহহীন, ভূমিহীনদের জন্য ঘর, ৬ মাসের খাবার ও নগদ টাকা দেয়া হবে।
  • ভাষানচরে এক লাখ মানুষের থাকার ও কর্মসংস্থান উপযোগী আবাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে কেউ যেতে চাইলে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
  • বিনামূলে ভিজিএফ, ভিজিডি, ১০ টাকা কেজির চাল সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। সরকারি উদ্যোগে যে ৩০ প্রকার ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে তা অব্যাহত থাকবে।

এই কথাগুলো সাধারণ কথা। এর কোনো সুনির্দিষ্টতা নেই। কারা ভূমিহীন, কারা গৃহহীন? তাদের তালিকা কি আছে? না থাকলে কে করবে? কীভাবে করবে? ঘর কোথায় দেবেন? খাবার ও নগদ টাকার বরাদ্দ কোন খাত থেকে আসবে? এ ব্যাপারে কারা দায়িত্ব পালন করবে? ভাষানচরে কারা যাবে? যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশই বা কার কাছে করবে? না গেলে তাদের কোথায় জায়গা দেবেন? এসকল প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। আমরা পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাস্তবে এই কথাগুলো কিছু  ফাঁকা আশ্বাসমাত্র। গার্মেন্টসের শ্রমিক ও এদের সাথে যুক্ত অসংগঠিত খাতের শ্রমিকদের ব্যাপারে তিনি কিছু বললেন না।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বিভিন্নভাবে পিপিই’র অপ্রতুলতার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলে আসছেন, পর্যাপ্ত পিপিই সরবারাহ করার দাবি তুলে আসছেন, প্রধানমন্ত্রী এক কথায় সেটাকে অস্বীকার করলেন। দেশের এই দুর্যোগে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করবে – তাদের সাথে এটা যুক্তিসঙ্গত আচরণ হলো কি? কোথায় পর্যাপ্ত ছিল? এখন কোথায় মজুদ আছে? কী কাজে লাগছে ওগুলো? হাসপাতালের ডাক্তাররা নিজেরা টাকা দিয়ে আনভেরিফায়েড পিপিই বানাচ্ছেন, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা তাদেরকে সাপ্লাই দিচ্ছে পাবলিক ডোনেশন কালেকশন করে, প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসছে সেগুলো – অথচ প্রধানমন্ত্রী বললেন, পর্যাপ্ত পরিমাণ সরবরাহ করা হয়েছে ও যথেষ্ট পরিমাণ মজুদ আছে। এটা চিকিৎসাকর্মীদের প্রতি একপ্রকার প্রহসন নয় কি?

বাইরে থেকে আসা এই ভাইরাস প্রথম ধাপেই নিয়ন্ত্রণ করা গেল না কেন? ৩ মাস সময় পাওয়ার পরও আমরা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেইনি কেন? এসকল প্রশ্নের দিকে তিনি গেলেনও না। কিটের স্বল্পতা নিয়ে কোনো কথা বললেন না। শুধু এখন কত মজুদ আছে, আরও কত আসছে সেটাই বললেন। ৭টি বিভাগে ল্যাব স্থাপনের প্রস্তুতির কথা জানালেন এমন সময় যখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে। তিন মাস সময় পাওয়ার পরও এই প্রস্তুতি নেননি কেন – এর জবাব দিলেন না।

এককথায় বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে দেশের শিল্পপতি-পুঁজিপতি ছাড়া আর কেউ কোনো সারবস্তু পাবেন না। দেশের এরকম একটা মানবিক সংকটের সময় তাঁর এ বক্তব্য বাস্তবে জনগণকে হতাশ করল, আতঙ্কের মাত্রা বাড়ালো। আমরা দেশবাসীর কাছে আবেদন করছি, যেহেতু এখন রাস্তায় বেরিয়ে প্রতিবাদ করার উপায় নেই, তাই আপনারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ দ্বারা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করুন, এই বক্তব্যের অসারতা তুলে ধরুন ও এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলুন। আমরা একটা কঠিন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর বক্তব্যে যদি পরিস্থিতির সঠিক প্রতিফলন না ঘটে, তবে এটাকে মোকাবেলায় তারা কেমন পদক্ষেপ নেবেন তা আন্দাজ করা যায়। তাই আমাদের জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে ও প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে। এই পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।

 

 

 

 

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments