এরপর বিকাল ৩টায় শুরু হয় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি কমরেড জহিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল রায়ের সঞ্চালনায় পরিচালিত এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ‘বাসদ (মার্কসবাদী)’ এর সমন্বয়ক কমরেড মাসুদ রানা, অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার (অওটঞটঈ)’ এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর দাশগুপ্ত, ‘স্কিম ওয়ার্কার্স ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া’ (অওটঞটঈ অনুমোদিত)’ এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড ইসমত আরা মণ্ডল, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি কমরেড মানস নন্দী, ‘শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ’ এর সাধারণ সম্পাদক শামীম ইমাম।
উদ্বোধনী বক্তব্যে আনু মুহাম্মদ বলেন, “বর্তমানে আমরা যে পরিস্থিতি পার করছি তা বিশ্বের সব দেশেরই অভিজ্ঞতা। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষ শোষিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে জরুরি কাজ হচ্ছে শ্রমজীবীদের সংগঠিত করা। শ্রমজীবীরাই এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। কিন্তু তারাই সবচেয়ে নিপীড়িত ও শোষিত। করোনাকালে অনেকে কাজ হারিয়েছে। করোনাকালে এবং যুদ্ধকালে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। গত দু-তিন বছরে সবচেয়ে বেড়েছে। সরকার বলছে, যুদ্ধের কারণে বেড়েছে। এটা ঠিক নয়। লুটপাট ও পুঁজিপতিদের সুবিধা দেওয়ার কারণেই দাম বাড়ছে। এই মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্য ছিল না।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারের মন্ত্রীদের ভাষ্য হলো রেডিও টেলিভিশন সত্য আড়াল করছে। সরকার আমেরিকা-ভারতকে খুশি রাখতে চায়। কারণ দেশের জনগণের মধ্যে তাদের ভিত্তি নেই। দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের খুশি রেখে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। এজন্য তারা সুষ্ঠু নির্বাচন দিতেও ভয় পায়। জনগণের ভোটাধিকার নেই, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারও নেই। একটা দেশে যখন গণতন্ত্র থাকে না, তখন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্রমজীবী মানুষ। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন থাকে না। তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলা যায় না। শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ, পেটোয়া বাহিনী দিয়ে দমন করে রাখে। তাই ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করার জন্য লড়াই করা ছাড়া, সংগঠিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই।”
কমরেড শঙ্কর দাশগুপ্ত বলেন, “সর্বপ্রথমে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এদেশের মাটিতে শ্রমিক-কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যিনি নতুন দিকদর্শন তুলে ধরেছিলেন, শ্রদ্ধেয় কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীকে। ভারতবর্ষে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে বলে শুধু ভারতবর্ষে নয়, তার বাইরেও ব্যাপক প্রচার হচ্ছে। এই উন্নতি কেমন? মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে সঞ্চিত হচ্ছে সমস্ত সম্পদ। ভারতবর্ষে ধনিক শ্রেণি কর ছাড় পাচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের ভারে জর্জরিত। একটা দেশে সত্যিই উন্নতি হচ্ছে কি না তার মাপকাঠি কী? তা কি কেবল সরকারি প্রচারের দ্বারাই নির্ধারিত হবে? সত্যিকার উন্নতির মাপকাঠি হচ্ছে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমছে কি না। আপনারা জানেন, এক সময় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কাজ ইত্যাদি মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মধ্য দিয়ে বৈষম্য ঘুচিয়ে দিয়েছিল। ধনী-গরিবের বিভাজন ছিল না। ফলে বৈষম্যও ছিল না। এই হচ্ছে সত্যিকারের উন্নয়ন। কিন্তু আজ সমস্ত পুঁজিবাদী দেশে ক্রমাগত বৈষম্য বাড়ছে।”
কমরেড মাসুদ রানা বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারও এদেশে উন্নয়নের গল্প প্রচার করছে। কিন্তু শ্রমজীবীদের জীবনে সেই উন্নয়নের ছাপ কতটুকু? যে শ্রমিকরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, তারা শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকার পাচ্ছে না। টানা ১৪ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে বড় ব্যবসায়ীদের লুটপাটের সুযোগ করে দিচ্ছে, তাদেরই স্বার্থ রক্ষা করছে। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের পর ২০১৮ সালে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় নৈশভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। এভাবে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে। নির্বাচনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে আওয়ামী লীগ দেশে এক দলীয় আধিপত্য তৈরি করেছে। সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে। দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে। এই ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে শ্রমজীবী মানুষসহ সমস্ত স্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।”
সমাবেশে বক্তারা আরও বলেন, চা শ্রমিকদের দীর্ঘ ১৯ দিন কর্মবিরতি, রাজপথ অবরোধসহ প্রতিরোধের মুখে মজুরি ৫০ টাকা বাড়ালেও এরিয়ার বিল নিয়ে প্রতারণা করে তাদের নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি ২৫ হাজার টাকা যৌক্তিক দাবি মানা হচ্ছে না, আপিল বিভাগের রায়কে অগ্রাহ্য করে এখনও ঢাকাসহ জেলা শহরে ব্যাটারিচালিত যানবাহন উচ্ছেদ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে, নাম্বার প্লেটের যৌক্তিক দাবি মানা হচ্ছে না, ঢাকাসহ সারাদেশে রেডিমেড দর্জি শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত মজুরি না দিয়ে তাদেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। নির্মাণ শ্রমিকদের পরিচয় পত্র, নিরাপত্তা ও মজুরির দাবি উপেক্ষিত হচ্ছে দিনের পর দিন। হরিজন সম্প্রদায়ের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সামাজিক মর্যাদা ও নায্য মজুরি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে না। শ্রমিকদের অধিকার আদায় করতে হলে সংগঠিত হয়ে লড়াই করতে হবে। পাশাপাশি যে মালিকী ব্যবস্থা শ্রমিকদের তীব্র শোষণ করছে, দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে সেই ব্যক্তিমালিকানাধীন মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উচ্ছেদের মাধ্যমে শোষণহীন সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিপূরক বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের পতাকাতলে শ্রমিকদের সমবেত হওয়ার জন্য নেতৃবৃন্দ আহ্বান জানান।
সম্মলনে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গণসংগীত পরিবেশন করে ও চা শ্রমিকদের পরিবেশনায় ঐতিহ্যবাহী কাঠি নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে জহিরুল ইসলামকে সভাপতি, মানস নন্দীকে সহসভাপতি, উজ্জ্বল রায়কে সাধারণ সম্পাদক ও মাসুদ রেজাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ২৮ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়।