Friday, April 19, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - মে-জুন ২০২৩ফ্রান্সের গণআন্দোলন, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও বামপন্থীদের নবজাগরণ

ফ্রান্সের গণআন্দোলন, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও বামপন্থীদের নবজাগরণ


মার্চের ১৯ তারিখ। প্যারিসের রাস্তায় দু’পাশে পড়ে আছে হাজার হাজার টন আবর্জনা। কারণ যারা আবর্জনা সংগ্রহ করেন, সেই শ্রমিকরা ধর্মঘটে। এ ধর্মঘটে কে যায়নি? রিফাইনারি, বিদ্যুত বিতরণ, পাবলিক পরিবহন, নার্স, এয়ারপোর্টের কর্মচারী, মেট্রোরেল স্টাফসহ সর্বস্তরের শ্রমিক-কর্মচারীরা ধর্মঘটে। এ ধর্মঘট শুরু হয়েছিল জানুয়ারির ১৯ তারিখ থেকে। থেমে থেমে একদিন-দু’দিন করে চলছে ধর্মঘট। ধর্মঘটের ধারবাহিকতায় ৭ মার্চ বিক্ষোভ হয় প্যারিসে, তাতে অংশ নেন প্রায় ৩৫ লক্ষ লোক। মনে রাখা ভাল ফ্রান্সের জনসংখ্যাই মোট ৬ কোটি ৮০ লক্ষ।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাঁক্রর সরকার ফাসিবাদী পথে জনমত অগ্রাহ্য করে এবং পার্লামেন্টকে পাস কাটিয়ে আর্টিকেল ৪৯.৩ ধারায় পেনশন আইনকে সংশোধন করার পর থেকে। নতুন আইনে পেনশনের বয়স ৬২ বছর থেকে দুই বছর বাড়িয়ে ৬৪ বছর করা হয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর কাজের জন্য ৬০ বছরের আগে পেনশনে যাওয়ার যে বিধান ছিল সেটা বাতিল করা হয়। ইমানুয়েল ম্যাঁক্রর গণবিরোধী পেনশন সংস্কারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে ফ্রান্সের আপামর জনগণ।
ফ্রান্সের শ্রমিকশ্রেণি, সামাজিক নিরাপত্তা ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা
ফ্রান্স একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। তাই মজুরি দাসত্ব ও শোষণ বঞ্চনার শিকার দেশের শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষ। তবে বাংলাদেশের শ্রমিকদের শোষণের সাথে ফ্রান্সের শ্রমিকদের শোষণকে মেলানো যাবে না। কারণ শ্রমিকদের যেসকল অধিকার বাংলাদেশে অবলীলায় হরণ করা যায় কিংবা দেয়ার চিন্তাও মালিকদের করতে হয় না, ফ্রান্সের পরিস্থিতিটা তেমন নয়। ইউরোপের জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার নামে কিছু অধিকার সেখানকার শ্রমিকরা পেয়ে থাকেন। এই জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা প্রচলিত পুঁজিবাদী সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই জনগণের ন্যূনতম মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করার চেষ্টা করে। এর উদ্ভবের একটা ইতিহাস আছে। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সোভিয়েত রাশিয়ায় বেকারত্বের ঐতিহাসিক পরিসমাপ্তি ঘটে। শ্রমিকরা পায় সামাজিক নিরাপত্তা ও সাচ্ছন্দ্য। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা পান সোভিয়েতের নাগরিকেরা। সমাধান হয় আবাসন সমস্যার। প্রতিষ্ঠিত হয় নারীর সমঅধিকার। প্রতিবন্ধী মানুষ পায় আমৃত্যু রাষ্ট্রীয় ভাতা, সর্বস্তরের মানুষের মৌলিক অধিকারের রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক সমাজ পশ্চিম ইউরোপের শ্রমিক আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করতে থাকে।
বিপ্লবের রাঙা পথ তখন গোটা দুনিয়ায় এঁকেবেঁকে ছুটছে। এই ঝড় তীব্র হতে থাকে পশ্চিম ইউরোপে। সেখানকার বামপন্থী ও কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে শ্রেণিআন্দোলন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপে অতি উৎপাদনের ফলে অর্থনৈতিক মন্দার হাওয়া বইতে শুরু করে এবং শিল্প-কারখানা ঢালাও ভাবে বন্ধ হয়। শিল্প-কারখানার শ্রমিক-কর্মচারিরা বেকার হয়ে পড়ে। ১৯২৯ সালে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মহামন্দার সময় বামপন্থী-কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে পুঁজিরবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী আকারে রূপ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে পশ্চিম ইউরোপে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শ্রেণি সচেতন শ্রমিক-কর্মচারিদের ব্যাপক আন্দোলনে ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি ও ইতালিতে তৈরি হতে থেকে বিপ্লবী পরিস্থিতি। মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার আন্দোলন ক্রমাগত তীব্র শ্রেণিসংগ্রামে রূপ নিতে থাকে। এতে শোষক বুর্জোয়া শ্রেণি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মুখ থুবরে পড়ার অবস্থা থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সাময়িক উদ্ধারের দাওয়াই দেন বৃটিশ অর্থনীতিবিদ কেইনস। তিনি সরকারি তহবিলের টাকা সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় করার পরামর্শ দেন। এতে বাজারে অর্থ সঞ্চালন ও চাহিদা বাড়ে। আবার জনগণের কল্যাণ যে শুধু সমাজতন্ত্রই করেনা, পুঁজিবাদও করে- এটাও দেখানো যায়। পুঁজিবাদকে রক্ষার প্রয়োজনেই তখন পশ্চিম ইউরোপের বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মানুষের মৌলিক অধিকারের দায়িত্ব রাষ্ট্র মেনে নেয় অর্থাৎ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বাস্তবায়নে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বামপন্থীদের তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ফ্রান্সে জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে চালু হয়। ফ্রান্সের নাগরিকদের শিক্ষা অবৈতনিক। তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা পান, আবাসন (বাড়ি ভাড়ার জন্য) ভাতা পান। গর্ভবতী মায়েরা মাতৃত্বকালিন ছুটি ও ভাতা পান। মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় শিশুর চার মাস বয়স থেকে শিশু ভাতা চালু হয়। যেহেতু শিশু মায়ের গর্ভে খাদ্য গ্রহণ করে সেজন্য চার মাসের গর্ভাবস্থা থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর প্রতিপালনের সমস্ত খরচ রাষ্ট্র শিশু ভাতা হিসেবে প্রদান করে। প্রতিবন্ধী নাগরিকদের আমৃত্যু প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান করা হয়। নাগরিকদের কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা এবং কর্ম হারানোর নিরাপত্তা ভাতা (নতুন চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বেসিক বেতনের ৮০% হিসেবে) প্রদান করা হয়। এ ছাড়া কর্মহীন নাগরিকগণ নিয়মিত বেকার ভাতা পান। সরকারি-বেসরকারি বা জীবনে যে কোন দিন কাজও করে নাই অর্থাৎ সবার জন্য মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাধ্যতামূলক পেনশন প্রদান করা হয়। ফ্রান্স সরকার খাদ্যদ্রব্য স্বল্প দামে সরবরাহ অব্যাহত রাখতে কৃষিখাতে ব্যাপক কৃষি ভর্তুকি প্রদান করে। রুটি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, তেল ও পানীয় দ্রব্যের উপরে বিশেষ কর ছাড় দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী জনগণের জন্য স্বল্প মুল্যে বাজারে সরবরাহের ব্যবস্থা করে।
জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টাতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো কেইনসিয় মডেল থেকে সরে গিয়ে নব্য উদারিকরণ অর্থনীতি চালু করে। প্রচলন হয় মুক্ত বাজার অর্থনীতি তথা পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের। উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থায় কর্পোরেট পুঁজির দাপটে ইউরোপের কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সামাজিক নিরাপত্তা দিনে দিনে ফ্যাকাশে হয়ে উঠতে থাকে। পশ্চিম ইউরোপে আজকের যে সামাজিক অস্থিরতা এটা তারই প্রতিক্রিয়া। যে কারণে গোটা ইউরোপ জুড়ে থেমে থেমেই চলছে গণবিক্ষোভ ও ধর্মঘট। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও জার্মানীর চলমান বিক্ষোভ ও গণরোষ এরই ধারাবাহিকতা।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্র পেনশনের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে জনগণের শ্রম শোষণের রাষ্ট্রীয় লাইসেন্স আরও দুই বছর বৃদ্ধি করেছে। এই কালো আইনের বিরোধিতা করতে গিয়েই চলমান গণআন্দোলনের সূত্রপাত। পেনশন সংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি আরও অনেক গণদাবি উঠে এসেছে। দৈনন্দিন কাজের সময়সীমা কমানো, জ্বালানীর মূল্য হ্রাস ও বেতন বৃদ্ধির দাবিও আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে ইউরোপ আমেরিকায় শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় মালিকশ্রেণির মুনাফা বেড়েছে অনেক গুণ কিন্তু জনগণের আয় বাড়েনি। সে জন্য জনগণের মধ্য থেকে দাবি উঠেছে সপ্তাহে ৩২ ঘন্টা কাজ অর্থাৎ সপ্তাহে চারদিন কাজ ও তিনদিন ছুটির। মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে ন্যূনতম বেতনের ২০% বৃদ্ধির দাবি আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রধান দাবি হিসেবে যুক্ত হয়েছে।
কমিউনিস্ট রোভিয়া
ফ্রান্সের সকল শহর বন্দর ও জনপদে ঐক্যবদ্ধভাবে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ। ছোট-বড় বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি একমঞ্চে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। সরকারবিরোধী গণআন্দোলন বাস্তবে গণপ্রতিরোধে রূপ নিচ্ছে। ফ্রান্সসহ ইউরোপ-আমেরিকায় সম্প্রতি ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধির ফলে জনগণের আবাসন ব্যয় আরও বেড়ে গিয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাত দেখিয়ে ফ্রান্স সরকার একদিকে সামাজিক সুযোগ সুবিধা সংকুচিত করছে, অন্যদিকে সামরিক বাজেট অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে চলেছে। প্যারিসের রাস্তায় আন্দোলনকারীদের প্ল্যা-কার্ডে লেখা দেখা যাচ্ছে- Money for wages, money for pensions, not for war! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছে শ্রমিক-কর্মচারীদের সাথে। ফ্রান্সের রাজপথ থেকে পার্লামেন্ট, সর্বত্র একই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তা হলো ‘কমিউনিস্ট রোভিয়া’ অর্থাৎ ‘কমিউনিস্টদের নবজাগরণ’ ঘটছে। এর অর্থ হারিয়ে যাওয়া কমিউনিস্টরা আবার জেগে উঠেছে। ফ্রান্স একসময় শক্তিশালী কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্থান ছিল। বিদ্যমান গণআন্দোলনে দেশের শ্রমিক-মেহনতি, সংগ্রামী জনতা আবার জেগে উঠেছে লড়াইয়ের মেজাজ নিয়ে ।
এই লড়াই চলতে চলতে যদি আন্দোলনে সঠিক মার্কসবাদী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আন্দোলন যদি বৈপ্লবিক ধারায় আরও উচ্চতর স্তরে উঠে আসতে পারে, তাহলে চলমান এই দাবি আদায়ের গণআন্দোলন ভবিষ্যতে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে পরিণত হতে পারে।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments