Thursday, December 5, 2024
HomeUncategorizedস্বাস্থ্যব্যবস্থার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট : ব্যক্তিস্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য

স্বাস্থ্যব্যবস্থার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট : ব্যক্তিস্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য

বর্তমান মুনাফা কেন্দ্রিক বিশ্বের চেহারাটি অত্যন্ত বীভৎস; কোভিড-১৯ বাস্তবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এই কুৎসিত চেহারাটি সকলের সামনে নগ্ন করে দিয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, আপনারা সবকিছুতেই রাজনীতি খুঁজেন। মহামারীতে আবার রাজনীতি কী? আসুন সবাই মিলে কাজ করি! এখন কোন পার্থক্য রাখার সময় নয়।

সত্যিই কি এটি পার্থক্যের সময় নয়? নাকি পার্থক্য করার জন্য সত্যিকারের সঠিক সময় এটি?

কোভিড-১৯ সংক্রমণে সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেন ভেঙে পড়লো? বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেন দাঁড়াতেই পারলো না? সরকার কেন হাত ধুয়ে, মুখ মুছে বসে আছেন? যুদ্ধ শুরুর আগেই করোনার চেয়ে শক্তিশালী এই সরকারের অসহায় আত্মসমর্পন কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করতে পারলেই আমরা উপরের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব।

স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি রাষ্ট্রনীতির উর্ধ্বে?

মূল প্রশ্নটির মীমাংসার সাথে আলোচ্য প্রসঙ্গটির সমাধান প্রধানত নির্ভরশীল। তাই শুরুতেই স্বাস্থ্য সম্পর্কে সারা বিশ্বে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাটি উল্লেখ করতে চাই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে “Health is a state of complete physical, mental and social well-being and not merely the absence of disease or infirmity”

স্বাস্থ্যের এই সামগ্রিক আয়োজন কি সমাজ পরিচালনার নিয়মের বাইরে গিয়ে সম্পাদন করা সম্ভব?

Declaration of Alma-Ata-তে বলা হচ্ছে “the conference strongly reaffirms that health is a state of complete physical, mental and social well being, and not merely the absence of disease or infirmity, is a fundamental right and the attainment of the highest possible level of health is a most important world-wide social goal whose realization requires the action of many other social and economic sectors in addition of the health”

এখানে স্বাস্থ্যকে একটি মৌলিক অধিকার ঘোষণা করে একে অর্জনের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। যা একটি দেশের রাজনৈতিক নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।

সবার জন্য স্বাস্থ্য

১৯৭৭ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে। এরও একটা প্রেক্ষাপট আছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে। রাষ্ট্রের উদ্যোগেই সেখানে সবার জন্য সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়া ছিল একা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন ও পূর্ব ইউরোপের অনেকগুলো দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাষ্ট্রগুলো নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখায় গুরুত্ব দিয়েছে, চিকিৎসায় নয়। অর্থাৎ রোগ হবার আগেই একে প্রতিহত করার উদ্যোগ নিয়েছে।

বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সক্ষমতা বিভিন্নরকম থাকলেও দেশের মানুষের মধ্যে পুঁজিবাদী সমাজের মতো প্রকট ধনবৈষম্য ছিলনা। ফলে সকল নাগরিকই একটা ন্যূনতম মাত্রায় পুষ্টিকর খাবার ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবযাপন করতো। প্রত্যেক নাগরিককেই কোন না কোন প্রকার খেলাধুলায় যুক্ত থাকতে হত। তাদের বিনোদনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। ফলে এই দেশগুলো জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিল।

অপরদিকে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালির মতো বনেদি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে অনেক উন্নত হাসপাতাল ও উন্নত গবেষণার ব্যবস্থা ছিল ঠিকই কিন্তু জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে তারা ছিল দুর্বল এবং সবচেয়ে উন্নত সেই চিকিৎসা গুটিকয়েক সম্পদশালী লোক ছাড়া বেশিরভাগ জনগণের পক্ষে নেয়া সম্ভব ছিল না।

ফলে এইসকল দেশের মানুষের কাছে সমাজতান্ত্রিক দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা একটা আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এবং খুব স্বাভাবিকভাবে নিজেদের দেশেও স্বাস্থ্যব্যবস্থার রাষ্ট্রীয়করণের দাবি ওঠে, জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার দাবি ওঠে। এরই মধ্যে বাজার সংকট এবং সমাজতান্ত্রিক দেশের এই অর্জনের চাপে পড়ে সামাজিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রকল্প যে সকল পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গ্রহণ করে তারা তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয়করণ করে।

এই দুইয়ের প্রভাবে, জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠা প্রবল জনমতের কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৭ সালে এই ঘোষণা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাজাখস্তানের আলমা আতায় এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় এবং সম্মেলন শেষে Declaration of Alma-Ata ঘোষিত হয়। এই ঘোষণায় স্বাস্থ্যকে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয় স্বাস্থ্যগত দিক থেকে ধনী গরীব বৈষম্য বা অসম অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয়। আর্থ সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নির্ভর একটি নতুন ধরণের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলে পারিবারিক চিকিৎসকদের জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার সাথে সমন্বয় করতে হবে।

এই ঘোষণা দেয়ার কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক। রাষ্ট্রনীতির কারণেই স্বাস্থ্যনীতি ব্যক্তিমুখী না হয়ে সমাজমুখী হয়েছে। ব্যক্তিস্বাস্থ্যের স্থান নিয়েছে জনস্বাস্থ্য। সকলে ভাল থাকলে নিজেও ভাল থাকা যাবে এই চিন্তা এসেছে।

‘আলমা আতা ঘোষণা’ বাস্তবায়িত হল না কেন?

সেটা বুঝতে হলে বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের দিকে নজর দিতে হবে। সোভিয়েত রাশিয়া তখন সংশোধনবাদী নেতৃত্বের মারফত পুঁজিবাদী অর্থনীতির নানা নিয়ম, প্রণোদনা ইত্যাদি চালু করছে। জনস্বাস্থ্য থেকে তখনও না সরলেও রাষ্ট্রনীতিতে ব্যক্তিমালিকানা আসার রাস্তা প্রস্তুত করছে।

অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তখন নয়া উদারনৈতিক নীতি গ্রহণ করছে। রকফেলার ফাউন্ডেশনের প্রবল প্রতাপে ‘আলমা আতা ঘোষণা’র অল্পদিনের মধ্যে পুঁজিবাদী দুনিয়া সেখান থেকে সরে আসে। ‘কাঠামোগত উন্নয়ন’ ও ‘নয়া উদারনৈতিক’ নীতির মাধ্যমে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ঠেলে দেয়া হয়। ফলে একদিকে টাকার বিনিময়ে চিকিৎসাকে বিক্রি করার সকল আয়োজন নিশ্চিত হতে থাকে, কিন্তু ঘোষণা হিসেবে সামনে থাকে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য চাই-এই মহান -স্লোগান। গোটা বিশ্বের মানুষকে ধোঁকা দেয়ার এ এক অদ্বিতীয় উদাহরণ!

তাই আমরা দেখবো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮৮ সালে সবার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার স্লোগান প্রবলভাবে প্রচার করছে, আর তার বিপরীতে ১৯৮২ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উরুগুয়ে রাউন্ডে আলোচনা শুরু হয়েছে সেবা খাতকে কর্পোরেট বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করার বিষয়ে। আলোচনা, দেন-দরবার ১৯৯৪ সালে  শেষ হয়। ১৯৯৪ সালে স্বাস্থ্যসহ ১৬১টি পরিসেবা খাতকে দেশি-বিদেশী পুঁজির মুনাফা লুটের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে সম্পন্ন করা হয় ‘গ্যাটস’ চুক্তি। ১৩০ টি দেশ ব্যবসা করার জন্য দেশী-বিদেশী পুঁজির কাছে স্বাস্থ্য খাতকে উন্মুক্ত করে দেয়।

বাংলাদেশও এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। আইএফসি’র ভাষ্য অনুযায়ী ১৯৯১ থেকে শুরু করে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি অর্থাৎ পুঁজিপতিরা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্যখাতেও প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে। তার ফলাফল কী?

ফলাফল দেখানোর জন্য আমরা কিছু তথ্য উপস্থাপন করতে চাই। বর্তমান বাংলাদেশে মোট ৩ কোটি ৯৩ লাখ ২৯ হাজার পরিবার বসবাস করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে হতদরিদ্র পরিবারের চেয়ে সবচেয়ে ধনী পরিবারের আয় ১১৯ গুণ বেশি। গত ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল, এই ছয় বছরে ৫ শতাংশ ধনী পরিবারের আয় বেড়েছে ৫৭ শতাংশ আর একই সময়ে একই পরিমাণ দরিদ্র পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ ধনী আরও ধনী হচ্ছে আর দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে। অর্থাৎ দেশে প্রবল বৈষম্য তৈরি হয়েছে। সরকার চিকিৎসা বাবদ মাথা পিছু ব্যয় করে মাত্র ৩০৭১ টাকা। দেশে মোট হাসপাতালের মধ্যে সরকারি ৬১০টি, আর বিপরীতে বেসরকারি হাসপাতাল ৫০২৩টি। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুয়ায়ী প্রতি ৩ হাজার জনের জন্য হাসপাতালে বেড আছে মাত্র ১টি। ১১১টি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৭৭টি বেসরকারি। আমাদের সর্বশেষ বাজেটে মাত্র ৪.৯ ভাগ বরাদ্দ হয়েছে স্বাস্থ্যখাতে। গোটা ঔষধ শিল্প একচেটিয়া ধনকুবের গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি। মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান দেশের ঔষধ উৎপাদনের ৭০ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসেবাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়ে তারস্বরে ঘোষণা করা হচ্ছে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা’ নিশ্চিত হচ্ছে। অদ্ভুত কৌতুক বটে!

ব্যক্তিগত রোগ নিরাময় নয়; সুসংবদ্ধ, সামাজিক ব্যবস্থাপনা চাই

কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর এই প্রশ্নটিই সামনে এসেছে। তথাকথিত ‘ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড’ এর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা যখন তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়েছে, তখন কিউবা গোটা বিশ্বকে চমকে দিচ্ছে। এই পার্থক্যটি মূলত: একটি সু-সমন্বিত, সু-সংবদ্ধ, সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার সাথে স্বতস্ফুর্ত, ব্যক্তি নির্ভর ও মুনাফাভিত্তিক ব্যবস্থার পার্থক্য।

তথাকথিত উন্নত দেশসমূহে আমরা দেখবো চিকিৎসা বিজ্ঞান, উন্নত প্রযুক্তি, গবেষক সবই আছে। কিন্তু তা পরিচালিত হয় মূলত অর্থের বিনিময়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুনাফার স্বার্থে। তাই এখানে ব্যক্তিগত রোগ নিরাময় প্রক্রিয়া অনুসরন করা হয়। একজন নাগরিক তার অর্থের বিনিময়ে সবচেয়ে জটিল ও স্পর্শকাতর রোগের চিকিৎসা পেতে পারেন, আবার একই ভাবে চিকিৎসক বা প্রতিষ্ঠান রোগ নিরাময় করে তার উন্নতি করতে চায়। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় কখন কোথায়, কোন প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠবে তার চেয়ে বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুনাফার প্রয়োজনেই এসব গড়ে উঠে। ফলে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটি থাকে মূলত স্বতস্ফূর্ত ও বিচ্ছিন্ন। একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিকল্পনা থাকলে সামগ্রিক কোন পরিকল্পনা থাকে না। এ অবস্থায় আজকে যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঘটলো তখন এসকল দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারে ধ্বসে পড়েছে। ব্যক্তির হাতে টাকা আছে, কিন্তু সে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। টাকায় কি না হয়-এই কথাটা এ সময়ে এসে হাস্যকর হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ এই বিশ্ব পুঁজিবাদী স্বাস্থ্যব্যবস্থার জুনিয়র পার্টনার। এখানেও অর্থের বিনিময়ে অত্যন্ত জটিল রোগের চিকিৎসা হয়, প্রতিবছর অনেক দক্ষ চিকিৎসক এবং অনেক আধুনিক প্রতিষ্ঠান এখানে গড়ে উঠছে। এগুলো সবই একটা মুনাফাভিত্তিক, স্বতস্ফুর্ত প্রক্রিয়া। তাই দেখবো কোভিড রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার হতে না হতেই সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থাটি মুখ থুবরে পড়লো।

এই যখন পুজিঁবাদী বিশ্বের চিত্র, তখন কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বিশ্বকে চমকে দিচ্ছে কিউবা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা ব্যবস্থা কিউবার। শুধু কিউবা নয়, জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নে বরাবরই সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব এগিয়ে ছিল। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত রাশিয়া গড়ে তুলেছিল এক অভূতপূর্ব চিকিৎসা সেবা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানান শাখাকে দৃঢ় সংযোজিত করে পরস্পরের গভীর বোঝাপড়ার মারফত নাগরিকের যত্ন নেয়া হত। ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে আর্থিক লেনদেনর ব্যপার না থাকায় তাদের মধ্যে গড়ে উঠতো সরল-বিশ্বাস ও আস্থা। চীন বিপ্লবের পরও এমন ঘটেছিল, চীনের ‘খালি পায়ের ডাক্তার’রা বিশ্বে আলোচনার ঝড় তুলেছিল। এই সকল ব্যবস্থার আরেকটি মৌলিক দিক হলো চিকিৎসা সেবাটি নাগরিকদের জন্য ছিল বিনামূল্যে। এ সম্ভব হয়েছিল মূলত সমন্বিত, সু-সংবদ্ধ ও সামাজিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

রোগ হলে চিকিৎসা নয়, হওয়ার আগে প্রতিরোধ 

পুজিঁবাদী বিশ্বে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা বললেও তা কার্যকর করার ন্যূনতম ইচ্ছা তাদের নেই। কেননা অসুস্থ হবার পর চিকিৎসা করলে প্রচুর মুনাফা করা যায়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে মানুষ অসুস্থ হবে কম, ফলে মুনাফা হবে কম। আবার একজন মানুষ সুস্থ থাকবে কিনা তা নির্ভর করে প্রধানত তার সামাজিক, আর্থিক ও মানসিক অবস্থার উপর। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা প্রমাণিত যে, ধন-বৈষম্য, অনিশ্চয়তা, বেকারি, অবসাদ ইত্যাদি শারীরিক অসুস্থতা বৃদ্ধি করে। তাই এখানে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রায় অসম্ভব।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা দেখবো রাশিয়ায় স্বাস্থ্যকে সর্বপ্রথম মৌলিক অধিকার ঘোষণা দিয়ে ব্যাপক প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা দেশব্যাপী স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, আনন্দঘন কর্মপরিবেশ, শ্রমের মর্যাদা ও সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ নির্মাণ করে। ব্যাপক আকারে ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম করে। সংক্রামক রোগ মোকাবেলায় বিভিন্ন জায়গায় স্যানেটোরিয়াম গড়ে তুলে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, রন্ধনশালা, গৃহস্থালী, শিল্পকারখানা ইত্যাদিতে স্যানিটারি ব্যবস্থাপনা, হাইজিন নিয়মিত পরীক্ষা করা হত। বিপ্লবের পর চীনে প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে আধুনিক চিকিৎসার সমন্বয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ‘জনগণের সেবা কর’-এই নীতির ভিত্তিতে চীনের ‘খালি পায়ের ডাক্তার’রা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমান কিউবার প্রতিরোধমূলক মডেলের সাফল্য নিহিত আছে তাদের বার্ষিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনায়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট ডাক্তার বা ক্লিনিকের আওতায় কিছু পরিবার থাকে, তাদেরকে বাৎসরিক এদের স্বাস্থ্যের রিপোর্ট দিতে হয়। এর ভিত্তিতে কে ঝুঁকিমুক্ত আর কে ঝুঁকিপূর্ণ তা বিবেচনা করে রোগাক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করা হয়। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছে রোগী না আসলে ডাক্তাররাই রোগীকে খুঁজে বের করেন। আমেরিকার একদল চিকিৎসক কিউবায় গিয়ে দেখেন ডাক্তাররা আক্ষরিক অর্থেই রোগীর বাড়ি-ঘর, পরিচয় এসব জানে। এটি তাদের বিস্মিত করেছিল। আর সবগুলো সমাজতান্ত্রিক দেশের বৈশিষ্ট্যই হলো সমস্ত চিকিৎসাই বিনামূল্যে।

কোন মডেল গ্রহণ করবো?

বড় বড় পুঁজিবাদী দেশগুলোতে রাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমরা দেখি, বিশেষত, পূর্বের কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে। রাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত ব্যবস্থা কথা শুনতে চমকপ্রদ মনে হলেও মানুষের সত্যিকারের চিকিৎসা সেবা সেখানে নিশ্চিত করা যায় না। চিকিৎসাব্যবস্থা রাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত করলেও রাষ্ট্র বিনিয়োগ করে কম। পূর্বে চিকিৎসা ক্ষেত্রে যতটুকু রোগীর দায় নেয়া হত, বর্তমানে তা ক্রমান্বয়ে কমছে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারিকরণের দিকে এগোচ্ছে। অনেক জায়গায় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ চালু করে আস্তে আস্তে বেসরকারিকরণের দিকে তারা যাচ্ছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে একটা অধিকার যখন দেশের লোক ভোগ করে তখন হঠাৎই সেটা কেড়ে নেয়া যায় না।

আরেকটি ব্যবস্থা পুঁজিবাদী দেশগুলোতে প্রচলিত, সেটা হলো বীমা ব্যবস্থা। বীমা নির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থা হেলথ ইনসিওরেন্স, হেলথ কার্ড ইত্যাদির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এ সকল বীমা কোন না কোন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত। কর্পোরেটদের সর্বোচ্চ মুনাফার ভিত্তিতেই এটি পরিচালিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থা শতভাগ বেসরকারি এবং বীমা নির্ভর। মাইকেল মুর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘সিকো’-তে এই আমেরিকার বীমা ব্যবস্থার অসারতার দিকটা উঠে এসেছে।

আমাদের দেশের মতো বেশিরভাগ পুঁজিবাদী দেশগুলোর স্বাস্থ্যব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি দু’ধরনের ধারাই আছে, তবে বেসরকারি ধারাই প্রধান। সরকারি খাত বলে যা আছে তা হলো বেসরকারি খাতের প্রচারের জন্য। অর্থাৎ মানুষ যাতে সরকারি খাতের উপর বিরক্ত হয়ে সব বিক্রি করে হলেও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যায়। একমাত্র উপায়হীন লোকেরাই যাতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা করায়। তাছাড়া চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার জন্য এই হাসপাতালগুলোর প্রয়োজন হয়। কারণ দিনের পর দিন চিকিৎসাবঞ্চিত হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকা এত বিচিত্র ধরনের রোগী এই হাসপাতালগুলো ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না।

পুঁজিবাদী দুনিয়ার সরকারি, বেসরকারি কোন মডেলই মডেল জনস্থাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারেনা। এর একমাত্র রাস্তা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কিন্তু যতদিন পুজিঁবাদ আছে, ততদিন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিতে বাধ্য করতে হবে, এ ছাড়া এই ব্যবস্থায় ন্যূনতম স্বাস্থ্য অধিকার পাওয়ার আর কোন রাস্তা নেই।

 

 

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments