Saturday, November 23, 2024
Homeফিচারআওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে বামজোট অংশগ্রহণ করবে না

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে বামজোট অংশগ্রহণ করবে না

[গত ১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় সমাবেশে জোটের সমন্বয়ক ও বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের সমন্বয়ক কমরেড মাসুদ রানার বক্তব্য কিছুটা সম্পাদনা করে প্রকাশ করা হলো]

বন্ধুগণ,

আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন, জিনিসপত্রের দাম কমানোসহ ১০ দফা দাবিতে বামজোট এই সমাবেশ আহবান করেছে। সমাবেশে উপস্থিত বিভিন্ন বামপন্থী দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, সারাদেশ থেকে আগত শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, ভূমিহীন, গৃহহীন, ক্ষেতমজুরসহ যারা আজকের এই সমাবেশে উপস্থিত হয়েছেন, বাম গণতান্ত্রিক জোট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদের পক্ষ থেকে ও আমাদের দল বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের পক্ষ থেকে আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।

বন্ধুগণ,

আমরা একথা স্পষ্ট করেই বলছি যে, ২০১৪ সালে ও ২০১৮ সালে কোন নির্বাচন হয়নি। নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে, মানুষকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তুলেছি। আমরা বলেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে বামজোট অংশগ্রহণ করবে না। আওয়ামী লীগ সংবিধানের কথা তুলছে। এটা কোন যুক্তিই হতে পারে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আওয়ামী লীগই লড়েছে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সেটা সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে। আবার এই আওয়ামী লীগই পরবর্তীকালে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই পদ্ধতি বাতিল করেছে। আদালত তাঁর রায়ে বলেছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া দরকার, যদি সংসদের সম্মতি থাকে। কিন্তু সে রায়কে আওয়ামী লীগ গ্রাহ্য করেনি। ফলে পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত হয়েছে কিনা সেটাই একটা প্রশ্ন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।

নির্বাচনের কথা, গণতন্ত্রের কথা বললে আমাদেরকে বলা হয় যে, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা গণতন্ত্র নিয়ে এত চিন্তিত কেন? উন্নয়ন কী হয়েছে সেটা আপনাদের ব্যাখ্যা করে বলার কিছু নেই। আপনারা জীবন দিয়ে সেটা বুঝতে পারছেন। দেশে মানুষের কাজ নেই, ভূমিহীন-গৃহহীন বাড়ছে, না খেয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যেও যারা কাজ করেন, তারা দিন আনেন, দিন খান। পরের দিনের কাজের নিশ্চয়তা নেই, খাবারের নিশ্চয়তা নেই। একটা বিশাল সংখ্যক মানুষের এই অবস্থা। অন্যদিকে আমরা দেখছি দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে, অতি ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ। সুইস ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি জমা আছে এমন বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশ আজ দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, সর্বশান্তমানুষ; অন্যদিকে অল্পকিছু বিত্তবান লোক। আওয়ামী লীগ সরকার এই অল্পসংখ্যক বিত্তবান লোকেদের স্বার্থই রক্ষা করছে। তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। অর্থনৈতিক শোষণ ও লুটপাটে বিপর্যস্ত মানুষ যাতে কোন প্রতিবাদ করতে না পারে সেজন্য দমনমূলক আইন প্রনয়ণ করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে গ্রেফতার হয়ে লেখক মোশতাকের জেলে মৃত্যুর ঘটনা আপনারা জানেন। এই আইনের মাধ্যমে বিরোধী মতকে দমন করা হচ্ছে। তুমূল সমালোচনার মুখে পড়ে এই আইনের নাম পাল্টে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নামে বহাল রাখা হয়েছে।

সমস্ত মতকে দমন করে একটা ফ্যাসিবাদী শাসন দেশে কায়েম করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদ মানুষের যুক্তি করার ক্ষমতাকে নষ্ট করে। বিজ্ঞানের কারিগরি দিকের সাথে আধ্যাত্মবাদের মিশ্রণ ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদ একটা যুক্তিহীন অন্ধ মনন তৈরি করে। আমরা যখন ফ্যাসিবাদী শাসন বলছি তখন মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদ কোন দল আনে না। ফ্যাসিবাদ একটা ব্যবস্থা আনে। এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকে থাকার জন্য ফ্যাসিবাদ নিয়ে এসেছে। এই পুঁজিবাদ একদিন সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার কথা বলেছিল। আজ সে ক্ষয়িষ্ণু। এই ক্ষয়িষ্ণু, অবক্ষয়ী পুঁজিবাদ ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছে। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সে যদি এই পুঁজিপতিদের স্বার্থে দেশ পরিচালনা করে তাহলে ফ্যাসিবাদ কায়েম করা ছাড়া তার অন্য কোন উপায় নেই। ফ্যাসিবাদ ছাড়া পুঁজিবাদ আজ টিকে থাকতে পারবে না। পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে হউক, একদলীয় শাসন হউক, দ্বিদলীয় শাসন হউক, মিলিটারি শাসন হউক- যে ফর্মেই রাষ্ট্র চলুক না কেন, ফ্যাসিবাদ তাকে কায়েম করতেই হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে উন্নত-অনুন্নত সকল দেশেই ফ্যাসিবাদ একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই ফ্যাসিবাদকে উচ্ছেদ করতে হলে এই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই যে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদের লড়াই- এই সত্য মানুষকে বুঝতে হবে। এটা যতদিন না তারা না বুঝবে, ততদিন একদলের শাসনে বিক্ষুব্ধ হয়ে আরেক দলকে ক্ষমতায় আনবে। মুক্তি আসবে না।

একইসাথে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের দেশের বুর্জোয়া দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন। কখনও মার্কিন, কখনও ভারতীয়, কখনও রুশ, কখনও চীনা সাম্রাজ্যবাদের কাছে যাচ্ছেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কখনও মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদ চায় বাজারের দখল। এজন্য সে দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত করেছে। যুদ্ধ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদের টিকে থাকার আর কোন উপায় নেই। তাই সে দেশে দেশে যুদ্ধ বাধাচ্ছে, সম্পদ লুট করছে। সাম্রাজ্যবাদ কখনও গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে পারেনা। তাদের কাছে ধর্ণা দিয়ে এদেশে মুক্তির লড়াই দাঁড়াতে পারে না। মুক্তির লড়াই গড়ে উঠতে পারে একমাত্র বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক ধারাকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়েই এদেশে সমস্ত শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার লড়াই গড়ে উঠতে পারে। চূড়ান্তমুক্তি অর্জিত হবে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। যদি আজ গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোও রক্ষা করতে চাই, তবে বামপন্থাকে শক্তিশালী করা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। বামপন্থী শক্তিকে এজন্য একটা উন্নত নৈতিকতার ভিত্তিতে গণআন্দোলনের জোয়ার তৈরি করতে হবে। যে জোয়ার এদেশের মানুষ দেখেছিলো মুক্তিযুদ্ধে, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। সেই জোয়ার তৈরি করতে হবে। বুর্জোয়া দলগুলো এদেশের যুবক-তরুণদের ভাড়াটিয়া গুন্ডা বাহিনীতে পরিণত করেছে। মাদকের বিস্তার, জুয়ার বিস্তার, পর্নোগ্রাফির বিস্তার ঘটিয়েছে। এর বিরুদ্ধে নৈতিক জাগরণ ঘটাতে হবে, আদর্শের ভিত্তিতে লড়াই গড়ে তুলতে হবে। বামপন্থীদের এই জাগরণ ঘটাতে হবে। আসুন আমরা সেই লড়াই গড়ে তুলি। এ ছাড়া আমাদের মর্যাদা নিয়ে বাঁচবার অন্য কোন পথ নেই।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments