Sunday, April 28, 2024
Homeফিচারগার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা কেন চাই

গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা কেন চাই

(গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন কাঠামো ঠিক করার জন্য একটি মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। আমরা জানি, এই মজুরি বোর্ডে মালিক, শ্রমিক ও সরকার তিনটি পক্ষ কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে একটি পক্ষই থাকে- সেটি মালিকপক্ষ। মালিকরা যা চান সেটাই হয়। এবারেও মজুরি বোর্ড গঠনের পর গড়িমসি চলেছে অনেকদিন। সর্বশেষ শ্রমিক ও মালিকদের পক্ষ থেকে দুটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। শ্রমিকপক্ষ দাবি করেছে ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা আর মালিকপক্ষ বলেছেন ১০ হাজার ৪০০ টাকা। এই প্রস্তাবে শ্রমিকরা ফুঁসে উঠেছে। গত কয়েকদিন ধরে গার্মেন্টস শিল্প এলাকাগুলোতে প্রবল শ্রমিক বিক্ষোভ চলছে, সাথে চলছে পুলিশের অত্যাচার। ইতিমধ্যে পুলিশের গুলিতে দুইজন গার্মেন্টস শ্রমিক নিহত হয়েছেন। গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি তোলা হয়েছে।
গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি সম্পর্কিত একটি লেখা বাংলাদেশ ‘শ্রমিক-কর্মচারি ফেডারেশন’ এর মুখপ্রত্র ‘শ্রমিক বার্তা’ পত্রিকার অক্টোবর ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। আমরা সাম্যবাদের পাঠকদের জন্য লেখাটি প্রকাশ করলাম।)

একজন শ্রমিক নির্দিষ্ট সময় বা নির্দিষ্ট পরিমাণ কাজ করার বিনিময়ে যে অর্থ পায় সহজ কথায় তা-ই মজুরি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) ঘোষণা মতে, সর্বনিম্ন মজুরি আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিক ও তার পরিবারের ভরণপোষণ, আবাসন, চিকিৎসা সর্বোপরি মনুষ্যোচিত জীবনযাপন ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা ইত্যাদিকে বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে (১৩১ অনুচ্ছেদ)। দেশের সংবিধানের ১৫  অনুচ্ছেদে নাগরিকদের যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার বিষয়টি রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমান বাস্তবতায় একজন শ্রমিকের যুক্তিসংগত ন্যূনতম মজুরি কত হতে হবে?

২০১৮ সালে শ্রমিকদের আন্দোলনের চাপে সরকার মজুরি বোর্ড গঠন করে গার্মেন্টস সেক্টরে নতুন মজুরি ঘোষণা করে। যা কার্যকর হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে। মৌলিক চাহিদা, ক্যালরির হিসাব, দেশের পরিস্থিতি, বাজার মূল্য, মালিকদের সামর্থ্য বিবেচনায় শ্রমিকরা এবং আন্দোলনরত শ্রমিক সংগঠনগুলো গার্মেন্টসসহ সকল সেক্টরে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা দাবি করে। কিন্তু এসব দাবি ও যুক্তির পথে না গিয়ে মালিক-সরকার নির্ধারণ করে মাত্র ৮ হাজার টাকা, যা সেই সময়ের বিবেচনায় ছিল অপ্রতুল। তবুও বেতন বৃদ্ধির অজুহাতে বাড়তে থাকে কাজের চাপ। শ্রমিক প্রতি উৎপাদন টার্গেট বাড়ানো হয় দ্বিগুণ-তিনগুণ। হু হু করে বেড়ে যায় বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। টাকার অংকে ৫,৩০০ থেকে ৮ হাজার হলেও শ্রমিকদের জীবনে এর কোন সুফল আসেনি। ২০১৯ সালে অক্সফামের এক জরিপে দেখা যায়- ‘প্রতি ১০ জন গার্মেন্টস শ্রমিকের মধ্যে ৯ জনই প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে পারেন না।’ ২০১৮-২০১৯ সালের তুলনায় গত ৪-৫ বছরে দফায় দফায় সমস্ত জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ২০১৮ সালের তুলনায় বর্তমানে ডালে ৯৬%, আটায় ৭২%, তেলে ৭৮%, ডিমের ৫০% পর্যন্ত মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ১০ টাকার পাউরুটি ১৫ টাকা হয়েছে। চা, পাউরুটি, বিস্কিট, কলা ইত্যাদি যেগুলো নাস্তা হিসাবে শ্রমিকরা খেতেন দাম বৃদ্ধির কারণে এখন সেটুকুও খেতে পারছেন না। গত ৪ থেকে ৭ জুন মিরপুরের পোশাক শ্রমিকরা যে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল, তাদের কণ্ঠে একটা কথাই প্রধানত ধ্বনিত হয়েছে-‘দ্রব্যমূল্য কমাও, মজুরি বাড়াও।’ যেন শুধুই বাঁচবার করুণ আকুতি! মালিকরা সেখানেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজেছে মূল সমস্যাকে আড়াল করে। এরপর সরকার ৫ আগস্ট ২০২২ এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে লিটার প্রতি ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করল। এ যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা!’

রাতারাতি গাড়ি ভাড়া হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ, ওষুধসহ বাজারের সমস্ত পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, বর্তমান বেতনে একটি শ্রমিক পরিবারের কোনো রকমে জীবন বাঁচানোও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গবেষকরা বলছেন, একজন ব্যক্তির মাসিক খাবার খরচ লাগে ৫ হাজার ৩৩৯ টাকা। ৪ সদস্যের একটি পরিবারের শুধুমাত্র খাবার খরচ হচ্ছে ২১ হাজার ৩৫৮ টাকা। খাবারের সঙ্গে এক কক্ষের ঘর ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, চিকিৎসা ব্যয়, যাতায়াত, মোবাইল ফোন, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ইত্যাদি সর্বনিম্নভাবে হিসাব করলেও ৩৩ হাজার ৮৪১ টাকা দাঁড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে, নর-নারী নির্বিশেষে গড়ে (পুরুষ ৩৩৬৪ +নারী ২৪০৬/২) ২৮৮৫ কিলোক্যালোরি তাপ উৎপাদনক্ষম খাদ্য প্রয়োজন। হিসাব অনুযায়ী জনপ্রতি প্রতিদিন ২৮০০ কিলোক্যালোরি তাপ উৎপাদন করতে পারে এমন খাদ্যের সর্বনিম্ন বাজার মূল্য ১৭৯ টাকা। মাসে ৫ সদস্যের পরিবারের ২৬,৮৫০ টাকা লাগে। অর্থাৎ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে একটা শ্রমিক পরিবারের মাসিক ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ২৭ হাজার টাকা। সরকারি কর্মচারীদের জন্য পে-স্কেলে সর্বনিম্ন বেতন ১৮,১০০ টাকা। (বেসিক ৮,২৫০ + ৬৫% বাড়ি ভাড়া ৫,৩৬২ টাকা + চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ টাকা + যাতায়াত ভাতা ৩০০ +শিক্ষা ভাতা ১৫০০ টাকা + টিফিন ভাতা ৩০০ টাকা + ধোলাই ভাতা ১৫০ টাকা)। তাছাড়া সরকারি কর্মচারীরা রেশন পায়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়-একজন পুলিশ কনস্টেবল ১৮ হজার ১০০ টাকা গড় বেতন পেয়েও ১১৫ টাকায় ৩০ কেজি চাল, ৩০ কেজি আটা, ৫ কেজি চিনি, ৮ লিটার তেল, ৮ কেজি ডাল, ১ কেজি পোলাও চাল পেয়ে থাকে। এগুলোর বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা।
শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিল্পের সক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বিগত ২০২১-২২ অর্থ বছরে রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশই এসেছে গার্মেন্টস শিল্প থেকে। গত অর্থ বছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪২.৬১ বিলিয়ন ডলার। যা তার আগের অর্থ বছরের তুলনায় ৩৫.৪৭ শতাংশ বেশি। রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ২৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপে ৪৬% পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাজারের সীমানা সম্প্রসারণ হয়েছে। বিস্তৃতি ঘটেছে চিলি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, তুরস্ক ও রাশিয়ার বাজার পর্যন্ত।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী আশাবাদ ব্যক্ত করছেন-‘চলতি অর্থ বছর এ খাত ৫২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে একটি মাইলফলক সৃষ্টি করবে।’ এমনকি ২০৩০ সাল নাগাদ ৫০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যে পরিণত করার ভাবনা চলছে। বলার অপেক্ষা রাখে না দেশের গার্মেন্টস মালিকরা যথেষ্ট পুঁজি সঞ্চয় করে বিশ্ব বাজারেও বেশ শক্তিধর প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য করোনাকালে গার্মেন্টস মাালিকরা মাত্র ২% সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে ৯ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনাসহ নামমাত্র সুদে ৩০ হাজার কোটি টাকার শিল্প ঋণের সুবিধা পেয়েছে সরকারের কাছ থেকে। যা আসলে পাবলিক মানি। সরকার গার্মেন্টস মালিকদের জন্য রপ্তানিতে উৎস কর কমিয়ে ০.২৫ করে দিয়েছে। অথচ এই উন্নয়নের অভিযানে করোনাকালে শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদন করেছে। উন্নয়নের আঁচ তাদের জীবনে পড়েনি। বরং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির তীব্র কষাঘাতে দিন দিন দুর্বিষহ জীবনের পাকে বন্দি হচ্ছে। এর কারণ সমস্ত গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশে শ্রমিকদের বেতন সবচেয়ে কম। ‘আইএলও’-এর ‘Minimum wages in the global garment industry : Update for 2020’ প্রতিবেদন অনুসারে, গার্মেন্টস শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মূল মজুরি বাংলাদেশে ৬৩ ডলার, ভারতে ১৬৮ ডলার, পাকিস্তানে ১১১ ডলার, বেলজিয়ামে ১৭৬৪ ডলার, ব্রিটেনে ১৭৩৪ ডলার, ফ্রান্সে ১৫৫৪ ডলার।
জীবনযাত্রার মানের তারতম্য সত্ত্বেও এই মজুরি বৈষম্য কোনোভাবে যৌক্তিক হতে পারে? বেলজিয়াম, ব্রিটেন, ফ্রান্স শ্রমিকদের এই পরিমাণ মজুরি দিয়েও যে বাজারে যে দামে বিক্রি করে, বাংলাদেশের পোশাকও তো সেই বাজারে একই দামে বিক্রি হয়। তাহলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি হবে না কোন যুক্তিতে? তা ছাড়া সিপিডি গবেষণা বলছে-‘লাইন প্রতি শ্রমিকের ব্যবহার কমেছে। মেশিন-শ্রমিক অনুপাত কমেছে। কাঁচামাল বিশেষত কাপড় ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া গেছে। … সার্বিকভাবে পোশাক কারখানায় দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’ বাংলাদেশের উন্নয়ন অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠানের (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-বিআইডিএস) গবেষণা থেকে পাওয়া যায়Ñ‘প্রতি ১০০ টাকার পোশাক উৎপাদনে কমপক্ষে ৩১ টাকা শ্রমিক তার শ্রমের মাধ্যমে যোগ করে, কিন্তু শ্রমিক পায় মাত্র ৭ টাকা।’ মজুরি বাড়লে হয়তো শুধু শ্রমিকের অংশ থেকে সামান্য কম মুনাফা নিতে হবে মালিকদের, এই-তো!
ফলে বর্তমান বাস্তবতায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে জীবনযাত্রার খরচ, শ্রমিক ও তার পরিবারের চাহিদা, উৎপাদনের খরচ, উৎপাদনশীলতা, পণ্যের দাম, নিয়োগকারীদের সক্ষমতা, দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা ও মুদ্রাস্ফীতি-মূল্যস্ফীতির হার ইত্যাদি বিবেচনায় সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকার কম হলে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সেক্ষেত্র বেসিক বা মূল মজুরি দিতে হবে ১৪,০০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ৭,০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ১৫০০ টাকা, টিফিন ভাতা ১০০০ টাকা।
যদিও ২৫ হাজার টাকা মজুরিও বর্তমান বাজার মূল্যের সাপেক্ষে অপ্রতুল। এই মজুরি দিয়েও সন্তানের জন্য পুষ্টিকর খাবার, লেখাপড়া, সপ্তাহে দুই-এক বেলা বেলা মাছ/মাংস, অসুস্থ মা-বাবার চিকিৎসা, কারও বড় অসুখ হলে চিকিৎসা, ছেলেমেয়ে/ছোট ভাই-বোনদের বিয়ে দেয়া, অতিথি আপ্যায়ন, বিনোদন-মানবিক চাহিদা ইত্যাদি কোনো কিছু করার বাস্তবতাই থাকবে না। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে এই নিম্নতম দাবিটুকু বাস্তবায়ন বিনা আন্দোলনে হয়ে যাবে এই ভরসা করা যায় না। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত যে ৫ বার মজুরি বোর্ড গঠিত হয়েছে এবং নতুন মজুরি নির্ধারিত হয়েছে, প্রতিবার শ্রমিকদের আন্দোলনের মাধ্যমেই হয়েছে। তাই শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ-নীতিনিষ্ঠ আন্দোলনই দাবি আদায় ও মুক্তির পথকে প্রশস্ত করবে।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments