Sunday, April 28, 2024
Homeফিচারআওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ কর; নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন দাও

আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ কর; নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন দাও

সাধারণ মানুষ মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়েছে অনেকদিন, ডিম আর ব্রয়লার মুরগী ছিল মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের প্রোটিনের উৎস- তার দাম এখন আকাশ ছুঁয়েছে। গরীবের ডাল-ভাতও গরীবের স্তর পার হয়ে মধ্যবিত্ত হয়েছে। সম্বল ছিল আলু, তার দাম এখন চালের চেয়ে বেশি। অথচ এই কোন একটা জিনিসেরই অভাব দেশে নেই, উৎপাদনে কোন ঘাটতি নেই।

জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, কিন্তু বাড়নি মানুষের আয়। দেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পখাত গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। শুধু গার্মেন্টস নয়, দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে দেশের বেশিরভাগ মানুষের। গার্মেন্টসের শ্রমিকরা রাস্তায় নেমেছেন, গুলি খেয়েছেন। তারা মরার মতো বেঁচে থাকার চেয়ে প্রতিবাদ করে মৃত্যুবরণকে শ্রেয় মনে করেছেন।

এই যখন দেশের পরিস্থিতি, মানুষ যখন সকল দিক থেকে বঞ্চিত, নিপীড়িত, লাঞ্চিত; এই সময়ে দেশের রাজনীতি এক সংকটকাল অতিক্রম করছে। রাজনৈতিক মতামত নির্ভয়ে ব্যক্ত করার মতো কোন পরিবেশ দেশে নেই। গত ২৮ অক্টোবর স্বেচ্ছাচারী আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির মহাসমাবেশের উপর নির্মম পুলিশী অত্যাচার নামিয়ে এনেছে। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বিরোধীদের ডাকা হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতেও আওয়ামী লীগ গ্রেফতার-নির্যাতন চালায়। এই কয়েকদিনে বিএনপির শীর্ষ প্রায় সকল নেতাকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশিরভাগ নেতাকর্মী ঘরছাড়া, এলাকাছাড়া। তাদের পরিবার-পরিজনরা উদ্বিগ্নতায় ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। গণআন্দোলনের উপর এই জঘন্য অত্যাচার অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ২৮ অক্টোবর ও তার পরবর্তী নয়দিনে নয় হাজারেরও বেশী বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে, ৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। মজুরিবৃদ্ধির দাবিতে নিরপরাধ ২ জন শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে, আহত হয়েছেন শত শত শ্রমিক। এসকল বরর্বোচিত আক্রমণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার নজিরবিহীনভাবে আন্দোলনের উপর নিদারুণ আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। বাংলাদেশে ৬৮টি কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার। সেপ্টেম্বর মাসেই ৭৭ হাজার অর্থাৎ ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ বন্দী ছিলেন। এই নভেম্বরে সেটা হয়তো তিনগুণ ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন- এই দাবি আজ আর কোনো নির্দিষ্ট দলের দাবি নয়, গণদাবিতে পরিণত হয়েছে।

দেশের এই অস্থিরতার মধ্যে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হস্তক্ষেপ করছে। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দলগুলো শক্তিসমাবেশ ঘটাচ্ছে ও অধিক সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দেশে যে রাজনৈতিক শূণ্যতা চলছে তার ফলশ্রুতিতেই এই ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীনতার পর ৫২ বছরে যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, কেউ-ই জনগণের কথা চিন্তা করেনি। জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি হয়েছে, দলীয় নেতাকর্মীদের সুবিধা দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি হয়েছেÑ কিন্তু জনগণের রাজনীতি আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি, ক্ষমতায় থাকা এই দলগুলোর কেউ-ই করেননি। জনগণের কথা কেউ-ই ভাবেননি। রাজনীতি একটা হৃদয়বৃত্তি, একটা উচ্চ নীতি-মূল্যবোধসম্পন্ন সামাজিক ক্রিয়াÑ সেটা এদেশের মানুষ ভুলতে বসেছে। পরাধীন দেশে পাকিস্তানি প্রায় উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলনের সময় রাজনীতি ত্যাগ শিখিয়েছিল, মূল্যবোধ শিখিয়েছিল। এখনও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে সাধারণ মানুষ প্রাণ দেন, ভাবেন পরিবর্তন হবে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে কেউ-ই ক্ষমতা ছাড়ার কথা ভাবতে পারেন না। ক্ষমতায় থাকলে যে পরিমাণ লুটপাট, দুর্নীতি, অর্থ ও প্রভাব উপভোগ করেনÑ এসবের কারণে ক্ষমতাবিহীন রাজনীতি তাদের কাছে অস্তিত্ব হারানোর মতো। প্রশ্ন উঠে, জনগণের জন্য রাজনীতি যদি বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশের ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদরা না করে থাকেন, তাহলে তাদের কাদের জন্য রাজনীতি করেন? কাদের স্বার্থ দেখেন?
এই বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, আওয়ামী সরকার জনগণের কাছে ভীষণভাবে ধিকৃত। একদিকে সরকারের ঔদ্ধত্য, একটার পর একটা আইন প্রয়োগ করে জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ; অন্যদিকে অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বিপর্যয়Ñ এসবকিছু সমস্ত স্তরের জনগণ, বিশেষ করে শ্রমজীবী জনগণকে আওয়ামী সরকারের উপর বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি বড় বড় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। সরকারের এদের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই কথাটা ঠিক নয়, বাস্তবে এরাই সরকার। এরাই আওয়ামী লীগের তহবিলে অর্থের জোগান দেয়।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি। প্রতিমাসে গড়ে দেশ থেকে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। দেশের ব্যাংকগুলো থেকে টাকা লুটপাট করে পুঁজিপতিদের সম্পদ বাড়ছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা, বর্তমানে সেটি দেড় লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে যথেচ্ছা ব্যবহার করে এদেশের বৃহৎ ব্যবসায়ী শ্রেণি আরও বড় হয়েছে, দলীয় নেতাকর্মী ও আমলাদের একটি অংশ বিরাট সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাদেরকে সরকারিভাবে লুটের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।

এই ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই দেশ পরিচালিত হচ্ছে, দেশের সকলরকম নীতি প্রনয়ণ করা হচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে সবাই এই পুঁজিপতিদের স্বার্থেই কাজ করেছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সাথে অসম চুক্তি করছে, দেশী-বিদেশী কর্পোরেটদের নানারকম সুবিধা দিচ্ছে। ভারতের আদানি গ্রুপের সাথে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, কী শর্তে ভারত সরকার শেখ হাসিনাকে সমর্থন করছে। নির্বাচন নিয়ে বিদেশী দূতাবাসগুলোর ভূমিকাও আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। আওয়ামী লীগের অবৈধ, অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী প্রক্রিয়ায় দেশ শাসনের কারণে এদেশে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গত ১০ বছর ধরে গোটা দেশের জনগণের সাথে প্রতারণা করে, গায়ের জোরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। জনগণের রাজনৈতিক অধিকার বলে আজ কিছু নেই। কারণ আওয়ামী লীগ জনগণকে তার রাজনৈতিক অধিকার দিতে ভয় পায়। নির্দলীয়, তদারকি সরকারের অধীনে একটি আপেক্ষিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন সংঘটিত হলে আওয়ামী লীগ তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে না। রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ার কারণে সে ক্রমাগত পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীকে ব্যবহার করছে। এটি প্রতিনিয়ত তাকে আরও জনবিচ্ছিন্ন এবং প্রশাসনের উপর নির্ভরশীল করে তুলছে। ফলে পুলিশ এবং বিভিন্ন বাহিনীর অত্যাচার ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে নির্বিচার হামলা, মামলা ও গ্রেফতার।

বাম গণতান্ত্রিক জোট ও আমাদের দল ‘বাসদ (মার্কসবাদী)’- এর পক্ষ থেকে নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারসহ দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। আমরা নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই, আপেক্ষিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। তদারকি সরকারের অধীনে একটি আপেক্ষিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণ যাকে নির্বাচিত করবে- সেই ক্ষমতায় আসবে। এই আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দেশে চালু থাকা দরকার। আজ দেশে দেশে বুর্জোয়া দলগুলোর নেতৃত্বে গঠিত সরকারগুলো, তারা একসময় যে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তার কোনটারই অস্তিত্ব রাখছেনা। বামপন্থীরা এই গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখার জন্য লড়াই করে। কিন্তু সাথে সাথে আমরা এও বলতে চাই যে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসা সরকার জনগণের সমস্যার কোন সমাধান করবে না। করতে পারবে না। কারণ যে বৃহৎ ব্যবসায়ীরা বাস্তবে সরকার চালায়, যে সিন্ডিকেট বাস্তবে সকল সিদ্ধান্ত নেয়- তারা একই থাকবে, পোশাক পরিবর্তন করবে মাত্র। সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই পরিবর্তন করতে হবে। এজন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাম গণতান্ত্রিক জোটকে শক্তিশালী করা দরকার।

দেশের এই পরিস্থিতিতে, সার্বিক ঘটনার প্রেক্ষিতে আমরা নিম্নোক্ত দাবিগুলো উত্থাপন করছি:
১. অবিলম্বে সরকারকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে নির্দলীয় তদারকি সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে।
২. পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর যে সকল সদস্যকে আাইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে আন্দোলন দমনের জন্য রাস্তায় নামানো হয়েছে, তাদেরকে প্রত্যাহার করতে হবে। জেলে মিথ্যা মামলায় আটক সকল বিরোধী নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে হবে, তাদের উপর দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
২. শ্রমিকদের উপর সকল দমন-পীড়ন বন্ধ করতে হবে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরির ন্যায্য দাবি মেনে নিতে হবে। শিল্প এলাকা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করতে হবে। নিহত শ্রমিক পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং শ্রমিক হত্যার বিচার করতে হবে।
৩. সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিম্নবিত্ত-খেটে খাওয়া-শ্রমজীবী মানুষের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

এই দাবিগুলো অগ্রাহ্য করে যদি আওয়ামী লীগ সরকার আরেকটি সাজানো নির্বাচনের দিকে যান, তবে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। দমন-নির্যাতন-নিপীড়ণ করে কেউ-ই ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি, আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও সেই ঐতিহাসিক সত্যের ব্যতিক্রম ঘটবে না।

 

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments