আজ ১ মে ২০২১ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন ঢাকা জেলা শাখার উদ্যোগে সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় মিছিল এবং মিছিল শেষে সংগঠনের কার্যালয় চত্বরে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি রাজু আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জহিরুল ইসলাম, সহসভাপতি মানস নন্দী, সদস্য ফখ্রুদ্দিন কবির আতিক, বাসদ (মার্কসবাদী) ঢাকা নগর শাখার ইনচার্জ নাঈমা খালেদ মনিকা, শ্রমিকনেতা মানিক হোসেন, ভজন বিশ্বাস প্রমুখ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, “শ্রমিকদের রক্তে অর্জিত বিশ্বব্যাপী শ্রমিক সংহতির দিন আজ। শাসকরা এই ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার নানা চক্রান্ত করছে। ফলে সত্যিকার ইতিহাস আমাদেরকে জানতে হবে। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার হে মার্কেটে আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটে ১ মে থেকে ৩ মে পর্যন্ত গড়ে ওঠা আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালিয়ে শ্রমিকদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। পুলিশের সাজানো মিথ্যা মামলায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল শ্রমিক নেতৃবৃন্দদের। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে শ্রমিক-মেহনতিদের মহান নেতা ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সভায় ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা ১৮৯০ সাল থেকে কার্যকর হয়ে এখনো পৃথিবীর সকল দেশে চলমান রয়েছে। এই আন্দোলনের ফলেই পরবর্তীতে দুনিয়ার দেশে দেশে আট ঘণ্টার শ্রম দিবস চালু হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশের শাসকেরা এই ৮ ঘণ্টার অধিকারটুকুও শ্রমিকদেরকে দেয় না। প্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোতে এমন ন্যূনতম জাতীয় মজুরী নির্ধারণ করা হয়েছে যাতে শ্রমিকরা বেঁচে থাকার তাগিদে ওভারটাইম করতে বাধ্য হয়। তবুও ন্যায্য বেতন দেয় না। ন্যায্য বেতনের দাবি তুললেই সরকারি দলের মাস্তান বা পুলিশ বাহিনী দিয়ে নির্যাতন চালায়, হত্যা করে। বাঁশখালীতে পুলিশের গুলিতে ৭ জন শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে, এই দাবিতে আন্দোলন করার কারণে। আর হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার না করে উল্টো শ্রমিকদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এই হলো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবস্থা।”
নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, “এক শতাব্দির বেশি সময় পার হলেও আমাদের দেশে গার্মেন্টস শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, গ্রহশ্রমিক, চা শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক-কেউই আট ঘণ্টা কর্মদিবসের অধিকার পায় না। সম্প্রতি শ্রম আইনে কর্ম ঘণ্টা, বেতন-ওভারটাইম সম্পর্কিত ধারা ১০০, ১০২, ১০৫ স্থগিতের প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সরকার শ্রমিকদের উপর চাপ তৈরি করে যতক্ষণ খুশি কাজ করিয়ে নেওয়ার অধিকার মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশে শ্রমিকদের কর্মস্থলে জীবনের নিরাপত্তা নেই।
ফলে হাজারো শ্রমিক ভবন ধসে, আগুনে পুড়ে, যৌন হয়রানিতে বা পুলিশের গুলিতে মারা যায়। স্পেকটার্মে ভবন ধসে ৪০০ জন, তাজরিনে আগুনে পুড়ে ১২৪ জন এবং ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় ভবন ধসে ১১৩৫ জন শ্রমিকের মৃত্যু মূলত মালিকশ্রেণির মুনাফার স্বার্থে এক একটি বৃহৎ হত্যাকাণ্ড। এখনও হাজার হাজার শ্রমিককে পঙ্গু, অসহায় অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে।”
করোনা মহামারিতে শ্রমিকদের দুর্দশার কথা জানিয়ে নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, “শ্রমজীবী মানুষ যারা প্রতিদিন আয় না করলে সংসার চলে না, তাদের খাদ্যের কোনো ব্যবস্থা না করে লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। অথচ, বিশে^র ইতিহাসে দেখা যায় এই ব্যবস্থা না করে লকডাউন কার্যকর করা সম্ভব নয়। ফলে পেটের ক্ষুধার জ্বালায় হকার, রিক্সাচালকসহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকরা কাজ করতে বাধ্য হয়। আর তাদের উপর চলছে চরম মাত্রায় পুলিশি হয়রানী। এমতাবস্থায় দেশের শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পারে এই সংকটগুলো থেকে মুক্তি দিতে। মহান মে দিবস আমাদের এই শিক্ষাই দিয়ে থাকে। তাই আসুন, মে দিবসের চেতনাকে বুকে নিয়ে লড়াই-সংগ্রামে সামিল হই।”
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ নিম্নোক্ত দাবিসমূহ তুলে ধরেন:
১। ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস, কাজ, ন্যায্য মজুরি ও অবাধ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত কর। গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন কর।
২। বাঁশখালীতে শ্রমিক হত্যার বিচার কর। নিহতদের পরিবারকে এক জীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দাও। আহতদের সুচিকিৎসা ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাও। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নাও।
৩। গার্মেন্টস’সহ সকল শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-বোনাস পরিশোধ, ছাঁটাই-নির্যাতন, লে-অফ বন্ধ কর।
৪। করোনাকালে সকল শ্রমিককে খাদ্য, নগদ অর্থ, রেশন ও বিনামূল্যে চিকিৎসা দাও।
৫। বন্ধ ঘোষিত পাটকল-চিনিকল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আধুনিকায়ন করে চালু কর। স্থায়ী-বদলিসহ সকল শ্রমিকের বকেয়া বেতন-বোনাস অবিলম্বে পরিশোধ কর।