Tuesday, December 24, 2024
Homeফিচারউন্নয়নের এত ফিরিস্তি : জনগণ দুর্দশায় কেন?

উন্নয়নের এত ফিরিস্তি : জনগণ দুর্দশায় কেন?

গণআন্দোলনে এগিয়ে আসুন

oie_8223915cPQmhumqখবরগুলো শুনুন :
২০১৪ সালে ধান ও মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে অষ্টম, আম উৎপাদনে নবম, তৈরি পোষাক রপ্তানিতে চীনকে টপকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন প্রথম।

কি মনে হচ্ছে আপনার?

দেশ এত এগিয়ে গেছে তা আগে টের পাননি, তাই তো! এত উৎপাদন, এত খাদ্যসম্ভার, অথচ অভাব ঘুঁচছে না, স্বস্তি পাচ্ছেন না! স্থির হয়ে বসে একবার ভাবুন তো, এত উৎপাদন কাদের ভোগে লাগল!

আপনাকে আরও কিছু খবর শোনাই।

গত বছর (২০১৪) বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ, চালের দাম বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ, বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ, এবং এই ভাড়া বৃদ্ধির মধ্যে বস্তি এলাকায় ভাড়া বেড়েছে ১৬.৬৭ শতাংশ, আর ফ্ল্যাট বাসায় ভাড়া বেড়েছে ১৩ শতাংশ। ওয়াসা পানির দাম বাড়িয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েও সরকার শেষ পর্যন্ত আপাত পিছু হটেছে বামপন্থী দলগুলোর প্রতিবাদ আর ক্রমবর্ধমান জনঅসন্তোষ দেখে। কিন্তু সরকার তার সিদ্ধান্ত বাতিল করেনি। অর্থাৎ গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। মোট কথা উন্নয়নের জোয়ারের এই ধাক্কা সামলাতে মানুষের ধৈর্য্যরে বাঁধ ইতোমধ্যেই ভেঙে গেছে।

সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে পুনরায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আরোহণ – কার লাভ?
আপনার সারাদিনের রক্ত জল করা আয় দিয়ে সংসার চলছে না, ছেলেমেয়েদের পড়াবেন কি করে, হঠাৎ একটা রোগে-দুর্ঘটনায় পড়লে কীভাবে সামাল দেবেন – তা ভেবেই আপনার জীবন অস্থির। দিন দিন এ সমস্যা প্রকট হচ্ছে। বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় ২০১৪ সালে আরও প্রকট হয়েছে। অথচ দেশে নাকি উন্নয়নের জোয়ার বইছে। এ উন্নয়ন কাদের হচ্ছে? আপনার যত সমস্যাই হোক না কেন, ব্যবসায়ীদের জন্য ২০১৪ সাল ছিল সবচেয়ে সুবর্ণ সময়। ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেছেন, ‘২০১৪ সালে আমরা বড় কোনো রাজনৈতিক সহিংসতার মুখোমুখি হইনি। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এই ধরনের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার বছর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

একথা কেন তারা বলেন তা বুঝতে হলে আপনাকে আরও কিছু সংবাদ মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।

কিছুদিন আগে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার বেশি বলে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ডিসিসিআই (ঢাকা চেম্বার অব কমার্স) ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। অথচ বাস্তবতা কি দেখুন! ঋণ দেয়া যাচ্ছে না এই কথা বলে সাধারণ মানুষ যারা ব্যাংকে টাকা জমা রাখে তাদের ক্ষেত্রে সুদের হার কমাচ্ছে। অর্থাৎ তাদের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে সুদের হার বেশি রাখলেও তাদের জন্যে আছে অনেক পরোক্ষ ছাড়। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে ১২০ কোটি ডলার আছে যা বাড়িয়ে ১৫০ কোটি ডলার করা হচ্ছে। এখান থেকে ব্যবসায়ীরা ৩ শতাংশ হার সুদে ঋণ নিতে পারবে। আবার বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতে ৫ থেকে ৬ শতাংশ হার সুদে ঋণ আনা যায়। প্যাকিং ক্রেডিট নামে ৭ শতাংশ হার সুদেরও টাকা যোগান দেয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

তারপরও ঋণ ফেরত দেন না ব্যবসায়ীরা। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি ইত্যাদি বড় বড় কেলেঙ্কারির কথা এসেছে যা দেশের মানুষ জানে।

আবার ঠিকঠাক ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে ফেরত দিচ্ছে না কোম্পানিগুলো। বড় বড় ব্যবসায়ী তারা। হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক, তাদের ঋণের পরিমাণও হাজার হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের টাকা ব্যাংক তাদের দিয়েছে সাধারণ জনগণের আমানত থেকে। অথচ সময় বারবার পেরিয়ে যাচ্ছে তারা টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। এখানে আইন তাদের কিছু করতে পারে না। বরং তাদের সুবিধার দিকে লক্ষ্য রেখে আইন পরিবর্তিত হয়। যেমন দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো’র ব্যাংক ঋণ ৫ হাজার কোটি টাকা। ঠিক সময়ের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে না পারলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করে ঋণ পুনঃতফশিল করা যায়। কিন্তু পুনঃতফশিলেরও একটা সীমা আছে। সর্বোচ্চ তিনবার ঋণ পুনঃতফশিল করেও পরিশোধ করতে না পেরে নতুনভাবে অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধন করে ঋণ পুনঃতফশিল করে তারপরও না পেরে শেষ পর্যন্ত তাদের জন্যেই ঋণ পুনর্গঠন নাম দিয়ে তাদের সুবিধা করে দেয়া হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এ পথে অনেকেই হাঁটছেন।

অথচ গ্রামের কৃষকেরা সামান্য ঋণের দায়ে ভিটেমাটি সব বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। আরও শুনুন, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সদস্য সংখ্যা ১২০০। ২০৯টি কোম্পানির উপর অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে যে তাদের ১২ হাজার ১৮৫টি ফ্ল্যাট অবিক্রিত যার মূল্য ৮৮১১.৯৯ কোটি টাকা। বাকি কোম্পানিগুলির উপর অনুসন্ধান চালালে বিষয়টি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলাই বাহুল্য।

ব্যবসায়ীদের এ দুর্যোগে সরকার তো বসে থাকতে পারে না। ফলে তারা ২০ হাজার কোটি টাকার ফান্ড করেছে যেখান থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া যাবে ফ্ল্যাট কেনার জন্যে। এ বছর বাজেটে ঘোষণা এসেছে ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে আয়ের খাত দেখানোর প্রয়োজন নেই। এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ দেখানো যাবে যা দেখলে বোঝা যায় সরকারটা কার।

জনগণের ওপর শোষণ অব্যাহত রাখার জন্যই মৌলবাদ উস্কে দেয়া
বাড়ছে সরকারের চরম নিপীড়ন, ফ্যাসিবাদী শাসন। এ থেকে মুক্তির পথ কি? বিপরীতে যে জোট আছে তাকেও জনগণ বিশ্বাস করে না। ফলে এক নিরুদ্দেশ যাত্রায় আছে দেশের জনগণ। ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ মৌলবাদের হাতকে শক্তিশালী করছে। আবার এই মৌলবাদী জুজুর ভয় দেখিয়ে জনগণকে তাদের পক্ষে রাখতে চেষ্টা করছে সরকার। জনগণকে তারা বোঝাতে চায় যে তারা ছাড়া মৌলবাদের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার কেউ নেই। আবার জনগণকে ভয় দেখিয়ে পেছনে রাখার জন্যে তারা মৌলবাদকে পরোক্ষভাবে উসকে দেয়।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের সাথে একজোট হয়ে দেশে অবর্ণনীয় শোষণ চালাচ্ছে মহাজোট সরকার
ভারত তার সর্বোচ্চ সমর্থন নিয়ে এ সরকারের পেছনে আছে। চীন, রাশিয়াও তার সমর্থন দিয়েছে। এদেরকেও সবরকম সুবিধা দিচ্ছে সরকার। ভারত এত বন্ধুত্ব দেখালেও সীমান্ত, ছিটমহল, নদীর পানির হিস্যা ইত্যাদি ব্যাপারে কোনও রকম শব্দ করছে না। আমাদের ন্যায্য পাওনাটা পর্যন্ত দিচ্ছে না। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি চীন থেকেও বেশি। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পুরো কাজ করবে ভারত, রূপপুরে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করবে রাশিয়া, গোটা দেশের বড় বড় স্থাপনার কাজ করছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রকে টিকফাসহ বিভিন্ন সুবিধা করে দিয়েছে সরকার। দেশের গ্যাসব্লক নামেমাত্র অংশীদারিত্বে বিদেশী কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে দেশকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।

সন্ত্রাস-অরাজকতা ক্রমশ বাড়ছে কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কথিত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও গুলিবিনিময়ে মারা গেছে ১২৮ জন, গুম খুন হয়েছে ৮৮ জন, বিভিন্ন বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। গত বছর কারা হেফাজতে মারা যান ৬০ জন। ৭০৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অথচ ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হোসেন খালেদ বলেছেন, “দেশের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক হলেও মাদক, অবৈধ অস্ত্র, পণ্য চোরাচালান, চাঁদবাজি-ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। ব্যবসায়ীরা চান দেশে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বজায় থাকুক।”
অর্থাৎ তাদের কাছে সরকার অনৈতিক, অগণতান্ত্রিক, নিপীড়ক কিনা সেটা বড় প্রশ্ন নয়। ব্যবসাবান্ধব কিনা সেটাই মূল বিচার্য। ব্যবসার প্রয়োজনে অর্থাৎ পুঁজিপতিদের মুনাফার প্রয়োজনে এ সরকার আরও ২০ বছর থাকতে হলে তারা তা করবেন। সেজন্য যত কঠিন নিপীড়নই চালিয়ে যেতে হোক না কেন। ফলে এর বিরুদ্ধে সকল প্রকার মত প্রকাশের অধিকারকেও খর্ব করা হচ্ছে। সভা-সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে খুন করানো হচ্ছে, এসব খবর পত্রিকায় প্রকাশ বন্ধ করার জন্য তা নিয়ন্ত্রণের আইন করা হচ্ছে। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সেই বক্তব্যে আরও বলেছেন, আগামী দিনে নতুন কোনও রাজনৈতিক সংঘাত, হরতাল, অবরোধের মত ক্ষতিকর কোনও কর্মসূচি তারা দেখতে চান না। প্রয়োজনে আইন করে হরতাল-অবরোধ নিষিদ্ধ করা যায় কিনা সে প্রস্তাবও তারা তুলেছেন।

স্থিতিশীল শোষণের প্রয়োজনেই এ সরকার টিকিয়ে রাখতে চায় পুঁজিপতিরা
চরম শোষণ, নিপীড়নে অতিষ্ঠ দেশের মানুষ। ভেতরে ভেতরে অসন্তোষ চরমে পৌঁছেছে। লাগামহীন দুর্নীতি-লুটতরাজ চলছে। কিন্তু তারপরও কাক্সিক্ষত পরিবর্তন হবে না বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে গণআন্দোলন গড়ে না উঠলে। বিএনপি-জামাত জোট বুর্জোয়াদের দলে। পুঁজিপতিশ্রেণী না চাইলে এরা ক্ষমতায় আসতে পারবে না। কারণ এরা জনগণের উপর নির্ভর করে রাজনীতি করে না, দল পরিচালনা করে না। ফলে জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে সে আন্দোলনও করবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে বুর্জোয়াশ্রেণী চাইছে না বিএনপি-জামাত আসুক। আওয়ামী লীগের যে চরম শোষণ ও তার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণঅসন্তোষ – তার বিরুদ্ধে চরম ডানপন্থীরা ক্ষমতায় আসলে যে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে – এটা দেশের বুর্জোয়ারা চায় না। ফলে তাদের সামনে পথ একটাই – ফ্যাসিবাদী শাসন আরো পাকাপোক্ত করা। আর জনগণের সামনেও পথে একটাই বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তোলা।

জনগণের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও নাগরিক জীবনের সমস্যা নিয়ে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তুলুন
মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধবিত্ত, গরিব চাষী, শ্রমিক, ক্ষেতমজুর – সবার ঘরেই আজ ত্রাহি ত্রাহি রব। বেঁচে থাকাটাই আজ এক সংগ্রাম। এর মধ্যে চলছে ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়। মদ-জুয়া, অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফি ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে জনগণের প্রতিবাদের শক্তি ধ্বংস করার জন্যে। জনগণ এ অবস্থায় কি করবেন? পরাজয় বরণ করবেন? পুরো সমাজের ধ্বংস হওয়া চেয়ে চেয়ে দেখবেন? নাকি প্রতিবাদ করবেন? সারাদেশে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিও দুর্বল। আমাদের দল এখনও বিরাট শক্তি নিয়ে দাঁড়ায়নি। এ পরিস্থিতিতে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, নারীর প্রতি সহিসংতা, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, কৃষি ফসলের ন্যায্য মূল্য, বেকারত্ব, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার – সবগুলো বিষয়ে জনগণ নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামুন, পাড়া-মহল্লায় প্রতিবাদ গড়ে তুলুন, সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। এই লড়াই চালাতে চালাতেই সঠিক বিপ্লবী দল চিনে নিন। সেটাই পারে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটাতে।

সাম্যবাদ জানুয়ারি ২০১৫

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments