গাজার শিশুরা কালি দিয়ে হাতে নিজের নাম লিখে রাখছে, যাতে মৃত্যুর পর বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যেতে না হয়। কোন গোপনীয়তা রাখার উপায় নেই, পানি নেই- তাই পিল খাচ্ছেন নারীরা, ঋতুস্রাব বন্ধ রাখার জন্য।
যুদ্ধের সমস্ত নিয়ম ভেঙে হাসপাতালে মিসাইল ছুুঁড়েছে ইসরায়েল, ছুঁড়েছে জাতিসংঘ শরণার্থী শিবিরে। উত্তর গাজার ১১ লক্ষ বাসিন্দাকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল ইসরায়েল। প্রাণভয়ে তারা যখন দক্ষিণের দিকে পালাচ্ছিলেন, তখন তাদের উপর বোমা ফেলা হলো। নিহত হলেন ৭০ জন মানুষ, যার মধ্যে ১২ জন শিশু।
প্রতি মুহূর্তে আহত মানুষ আসছেন হাসপাতালে। এসে কাতরাচ্ছেন, কিন্তু চিকিৎসা পাচ্ছেন না। চিকিৎসার সরঞ্জাম নেই, ওষুধ নেই। গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, পানির লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তৃষ্ণায় নর্দমার নোংরা পানি, সাগরের লোনা পানি খাচ্ছেন তারা। বড়রা খাচ্ছেন, খাচ্ছে শিশুরা। গর্ভবতী নারীরা জানেন না, তার সন্তান জন্মাবে কি না, জন্মালেও বাঁচবে কি না, তার সন্তানকে তিনি কোলে নিতে পারবেন কি না।
গাজায় যুদ্ধ নয়, চলছে গণহত্যা। নির্বিচারে, নির্বিবাদে সুপরিকল্পিত গণহত্যা। বিশ্বের মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিনকে মুছে দেয়ার চেষ্টা চলছে। গোটা বিশ্ব মানবতার তথাকথিত কন্ঠস্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। মানব ইতিহাসে এত ভয়ঙ্কর ও আগ্রাসী আত্মরক্ষা কেউ কখনও দেখেনি।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম
ফিলিস্তিনে অনেক আগে থেকে ইহুদিরা বাস করতেন। জেরুজালেমে তাদের মন্দির ছিল। আনুমানিক ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা জেরুজালেমে মন্দির ধ্বংস করে তাদের তাড়িয়ে দেয়। ইহুদিরা এরপর মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুণ্যভূমিতে ফিরে আসার ভাবনা তাদের অনেকের মধ্যে থেকে যায়। ১৮৯৭ সালে অস্ট্রিয়ান ইহুদি থিওডর হার্জেলের উদ্যোগে সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেলে প্রথম বিশ্ব জায়নবাদী কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় থেকে জায়নবাদ সংগঠিতভাবে মাথা তুলতে থাকে।
জায়নবাদ চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল একটি মতবাদ। হার্জেল ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্য একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে ধর্ণা দিতে থাকেন। সেই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হবে ফিলিস্তিনে, তাদের পুণ্যভূমিতে। অটোমান সাম্রাজ্যের হাতে থাকা ফিলিস্তিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশদের হাতে আসে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার ব্যালফোর জায়নবাদী নেতা ব্যারন রথসচাইল্ডকে চিঠি লিখে জানান, ফিলিস্তিনে ইহুদি আবাসভূমি গড়ে তুলতে যা প্রয়োজন তাই করবে ব্রিটিশ সরকার। ব্যালফোর ঘোষণার পর ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি বাড়তে থাকে। এই ভূ-খণ্ডে আগে থেকে যে আরব ইহুদিরা বাস করতেন তারা মিজরাহি নামে পরিচিত ছিলেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপ থেকে ইহুদিদের আসা বাড়তে থাকে, বেলফোর ঘোষণার পর তা আরও বৃদ্ধি পায়। এই বাইরে থেকে আসা ইহুদিরা স্থানীয় আরবদের কাছ থেকে প্রথমে জায়গা কিনে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীতে তাদের সাথে স্থানীয় ফিলিস্তিনদের সাথে সংঘাত শুরু হয়। সংঘাত ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদতে আরও বাড়তে থাকে। ১৯২১ সাল ইহুদিরা ‘হাগনাহ’ নামে একটি আধাসমরিক বাহিনী তৈরি করে। এটি তৈরিতেও ব্রিটিশদের সায় ছিল।
১৯৩৩ সালে স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা এই দখলদারি প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বড় আকারের প্রতিবাদ আন্দোলন করেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তা কঠোর হাতে দমন করে। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত পিল কমিশন ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে ভাগ করে তিন চতুর্থাংশে আরব এবং বাকি অংশে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেয়। সেই প্রস্তাবে জেরুজালেম এবং বেথলেহেমকে দুই দেশের মধ্যবর্তী একটি ছিটমহল হিসাবে রাখার কথা বলা হয়। আরবরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও জায়নবাদীরা সমর্থন করে।
এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪২ সালে, যুদ্ধ চলাকালেই, জায়নবাদীদের বাল্টিমোর সম্মেলনে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব পাশ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ও যুদ্ধের পরে, হিটলারের শাসনকালে, জার্মানিতে ইহুদিদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার সংঘটিত হয়। প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে সে সময় হত্যা করা হয়। যুদ্ধে হিটলারের পরাজয়ের পর একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জায়নবাদী দাবি জোরদার হয়। বিশ্বজনমতও এর পক্ষে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত হয় জাতিসংঘ। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর সদ্যগঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইহুদি এবং আরবদের মধ্যে দুই ভাগ করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এটা মেনে নেয়নি। আরব লীগের সাতটি দেশ (লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ট্রান্স জর্ডন, সৌদি আরব, ইয়েমেন ও মিশর) ১৯৪৭ সালে কায়রোতে বসে সিদ্ধান্ত নেয় করে যে তারা ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করবে। ফিলিস্তিনের ইহুদিরা ১৯৪৭ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।
ইসরায়েলের দখলদারিত্বের শুরু
জাতিসংঘের অনুমোদনের আগে থেকেই ফিলিস্তিনের জায়নবাদী নেতা ডেভিড বেন গুরিয়ান ফিলিস্তিন ভূখণ্ড থেকে আরব মুসলমানদের উচ্ছেদ করার তৎপরতা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাস থেকেই এই ভূখণ্ডে শুরু হয় হিংস্র জায়নবাদী হামলা। হামলা করে ইহুদি সন্ত্রাসী সংগঠন হাগনাহ ও স্টার্ন গ্যাং। আরবদের নিশ্চিহ্ন করার এই পরিকল্পনার নাম ছিল ‘প্ল্যান দালেত’ বা ‘প্ল্যান ডি’। এরমধ্যে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং সাথে সাথে ১৪ মে ইসরায়েলের ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। জরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন ডেভিড বেন গুরিয়ান। ফিলিস্তিনের আরব অধিবাসীদের উপর মার্চ থেকে শুরু করে অক্টোবর পর্যন্ত চলে হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটতরাজ। ফলাফলে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ ফিলিস্তিনি আশেপাশের আরব দেশগুলিতে উদ্বাস্তু হিসাবে আশ্রয় নেন। এই ঘটনাকে আরবী ভাষায় ‘আল নকবা’ অর্থাৎ বিপর্যয় হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এই পরিস্থিতিতে নভেম্বরে আরব লীগের দেশগুলো সম্মিলিতভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়। আরবরা সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়। পশ্চিমা শক্তিগুলো, যারা বস্তাবে ইসরায়েলকে সহযোগিতা করে জয়ী করেছিল, তারা ওই অঞ্চলটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করে- ইহুদিদের ইসরায়েল, আরবের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজা স্ট্রিপ। কিন্তু তাতে কোনো সমাধান হয়নি। শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। সংঘাত বাড়তে থাকে।
এরপর আরও তিনটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়েছে। প্রতিটিতে আরবরা পরাজিত হয়েছে। আর সাথে বেড়েছে জায়নবাদী দখলদারিত্ব। প্রতিটি যুদ্ধের পর ইসরায়েল তার দখলকৃত এলাকা বাড়িয়েছে। ১৯৬৭ সালে গোলান উপত্যকা, পূর্ব জেরুজালেম এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইসরায়েল তার কর্তৃত্ব স্থাপন করে। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে অবৈধভাবে জমি দখল, বসতি নির্মাণ, তাদের নাগরিক অধিকার হরণ- সবই করেছে ইসরায়েলের জায়নবাদী সরকার। আজ তাদেরই ভূমিতে ফিলিস্তিনিরা উদ্বাস্তুর মতো জীবন কাটাচ্ছে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলন
ইজরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে পাঁচের দশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ‘ফাতাহ’ সৃষ্টি হয়। ১৯৬৭ সালে ইয়াসির আরাফাত এর নেতা হন। ১৯৬৪ সালে ফাতাহসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক শক্তি যৌথভাবে গড়ে তোলে ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ বা ‘পিএলও’। তারাই হয়ে ওঠে ফিলিস্তিনি জনতার প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। পিএলও‘’ এর মধ্যে একাধিক বামপন্থী সংগঠন ছিল। তাদের অন্যতম হলো ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন’ বা ‘পিএফএলপি’। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী এই সংগঠনের গেরিলারা সাত এবং আটের দশকে বেশ সাড়া ফেলেছিলেন। বিমান হাইজ্যাক করার মত অপারেশনও তাঁরা সফলভাবে করেছিলেন। শক্তি কমলেও এখনো লড়াইয়ের ময়দানে আছে পিএফএলপি।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পিএলওর প্রতিরোধের ধরণ ছিল দুই রকম। একদিকে বড় বড় গণজমায়েত, আবার তার সঙ্গে গেরিলা পদ্ধতিতে প্রতিরোধ। দুটোই তারা পাশাপাশি চালাতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে লড়ার কোনো সুযোগ কারও ছিল না। এই প্রতিরোধে পিএলও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সমর্থন পায়। বলে রাখা উচিত সমাজতান্ত্রিক শিবির শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের প্রতিরোধযুদ্ধ সমর্থন করেছে ও সহযোগিতা করেছে। এমনকি ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে ইসরায়েল গঠনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা বলেছিল, আলাদা রাষ্ট্র না করে এক রাষ্ট্র থাকুক। কিন্তু জাতিসংঘে তখন বেশিরভাগই দুই রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে ছিলেন এবং সংঘাত এতো তীব্র ছিল যে, একরাষ্ট্রের মধ্যে তাদের অবস্থান সম্ভব নয় বলে বেশিরভাগই মত দিয়েছিলেন। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেয়।
ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরোধ সংগ্রামে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পাশাপাশি বিশ্বের বিরাট অংশের সমর্থন পেয়েছিল পিএলও। এমনকি বাংলাদেশ থেকেও একঝাঁক বামপন্থী যুবক ফিলিস্তিনে যান আরব গেরিলাদের হয়ে লড়তে। আশির দশকে পিএলওর নেতৃত্বে ঘটে প্রথম ‘ইন্তিফাদা’ বা ‘গণজাগরণ’। টানা ছয় বছর ধরে এই অসম প্রতিরোধ সংগ্রাম চলে। ইন্তিফাদার সময়েই ইসরায়েলি সেনাদের দিকে ফিলিস্তিনি যুবকদের পাথর ছোঁড়ার দৃশ্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইন্তিফাদার সমর্থনে, ইসরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে দেশে দেশে মিছিল ও প্রতিবাদ সংঘটিত হয়।
প্রথম ইন্তিফাদার অবসান ঘটে ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে। এই চুক্তি করা ছিলো পিএলওর একটা ঐতিহাসিক ভুল। তারা নরওয়ের রাজধানীতে অত্যন্ত গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে এই চুক্তিতে স¦াক্ষর করে এবং ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। অসলো চুক্তির মাধ্যমে স্থির হয়, ইজরায়েল গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে সরে আসবে। কিন্তু ফিলিস্তিনি শরণার্থী, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ইহুদি বসতি ও জেরুজালেম প্রসঙ্গে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য এতে ছিল না।
চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল রাষ্ট্রের স¦ীকৃতি আদায় করলো, কিন্তু ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজার দখল ছাড়লো না। ইহুদি বসতি আরও বাড়লো। চুক্তির মধ্য দিয়ে প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল অথরিটি (পিএনএ) গঠিত হয় এবং স্থির হয়, পরবর্তী পাঁচ বছর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ অস্থায়ী সরকার হিসাবে সংঘাত নিরসনে আলেচনা চালিয়ে যাবে। কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়।
দখলদারের কাছে চুক্তি কত একটা কাগজ ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু এই চুক্তির কারণে ফিলিস্তিনিরা পিএলওর উপর সকল আস্থা হারালো। চুক্তির অসম্পূর্ণতা শুধু নয়, চুক্তি করার এই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমেই পিএলও তার ঐতিহাসিক ভূমিকাকে কালিমালিপ্ত করলো। চুক্তি করার আগে পিএলও নেতৃত্ব ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যারা এতদিন লড়েছেন তাদের মতামত পর্যন্ত নেননি। চুক্তিটাও করেছেন গোপনে। অসলো চুক্তি পিএলওকে নৈতিকভাবেও দুর্বল করে দেয়। এই চুক্তির প্রতিবাদে বামপন্থী পিএফএলপি গেরিলারা পিএলও ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। এই গেরিলারা বর্তমান যুদ্ধে হামাসের সাথে আছেন।
হামাসের আবির্ভাব
আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে ‘মুজামা আল ইসলামিয়া’ নামে একটি সামাজিক জনকল্যাণমূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ আহমেদ ইয়াসিন। ১৯৮৭ সালে এই সংগঠনটিই ‘হামাস’ প্রতিষ্ঠা করে। মুজামা আল ইসলামিয়া ও পরবর্তীতে হামাস ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পায়। কারণ হামাস ছিলো পিএলওর বিরুদ্ধে। অসলো চুক্তির পর পিএলওর গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে, হামাসের বাড়তে থাকে। আবার হামাস ও পিএলওর মধ্যে সংঘাতও শুরু হয়।
হামাস রক্ষণশীল ধর্মীয় গোষ্ঠী, আর পিএলও একটি উদার, ধর্মনিরপেক্ষ প্লাটফর্ম। ইসরায়েল সরকার চেয়েছিল এই দুই শক্তির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হউক, তাতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রাম দ্বিধাবিভক্ত হবে। ফলে তারা পিএলওর বিরুদ্ধে হামাসকে সমর্থন দিতে থাকে। ইয়াসির আরাফাত মারা যাওয়ার পর পিএলওর অবস্থা আরও খারাপ হয়। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের সরকারে থাকা পিএলও নেতারা নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এদিকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ছিল। ইসরায়েলি সেনারা গাজার দখল ছাড়লে সেখানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে হামাস জয়লাভ করে। হামাস ক্ষমতায় আসার পর ২০০৮, ২০১২, ২০১৪, ২০২১ সালে গাজায় নৃশংস হামলান চালিয়েছে ইসরায়েল। হামাসও পাল্টা হামলা করেছে ইসরায়েলে।
বর্তমান পরিস্থিতির সূত্রপাত
এবার হামাস নিজেরাই প্রথমে হামলা করেছে। তাদের হামলায় অনেক ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন, অনেকে বন্দী হয়েছেন। হামাস এই সময়ে কেন এ হামলা করতে গেল এ নিয়ে বিভিন্নরকম মতামত আছে। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে তা হলো, যে আরব দেশগুলোর বেশিরভাগই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিত না, তারা ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা উদ্যোাগ নিচ্ছে। এটা যদি সফল হয় তাহলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রাম অনেকখানি পিছিয়ে পড়বে। এটাকে আটকাতেই হামাসের এই হামলা। আবার সাম্প্রতিক সময়ে আল আকসা মসজিদে নৃশংস হামলারও জবাব দেয়ার প্রয়োজন ছিল হামাসের।
হামাসের এই আক্রমণে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত যে রূপকথা বিশ্বমিডিয়াতে ভাসছিল- সেটা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। আকাশপথে তাদের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে গেছে হামাসের রকেট। আর ইসরায়েল এর বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ নিয়েছে সেটা সকলরকম যুদ্ধের নিয়মের ঊর্ধ্বে এবং ভয়াবহ নির্মম, নিষ্ঠুর। তারা সাধারণ গাজাবাসীর উপর আক্রমণ করেছে। গাজার গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করেছে। শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ আসার রাস্তাও বন্ধ করে দিয়েছে। হাসপাতালে, শরণার্থী শিবিরে বোমা হামলা করছে। রুগী পরিবহনের অ্যাম্বুলেন্সে বোমা ফেলছে।
ইসরায়েলের সকল জনগণ কি তাদের সরকারের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করে
ইসরায়েলের কমিউনিস্ট পার্টি (মাকি) ইসরায়েল সরকারের এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করেছে। নিন্দা করেছে বামপন্থী দলগুলোর জোট ‘হাদাশ’। তারা বলছে এই হামলার দায় ইসরায়েলের সরকারের। ইসরায়েল যেভাবে বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিন দখল করে আছে, নিপীড়ণ চালাচ্ছে- তার ফলশ্রুতিতে এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবাদ করায় ইসরায়েলের কমিউনিস্ট পার্টির (মাকি) সাংসদ ওফের কাসিফকে ৪৫ দিনের জন্য সাসপেন্ড করেছে সংসদীয় এথিক্স কমিটি। প্রতিবাদের কারণে শতাধিক ইসরায়েলিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এক হতে হবে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের উপর নির্মম অত্যাচার হয়েছিল। হিটলার সেটা করতে পেরেছিলেন উগ্র জাত্যাভিমান অর্থাৎ নাৎসিবাদ সৃষ্টি করে। আজ সেই ইহুদিদের উগ্র জাত্যাভিমান জায়নবাদের প্রসার ঘটিয়ে একটা জনগোষ্ঠীকে বিলীন করে দিতে চাইছে ইসরায়েলি শাসকরা। এটা কেবল মুসলমানদের লড়াই নয়। এটা বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের লড়াই। ইসরায়েলের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ দখলের জন্য সেখানকার দেশে দেশে সে এই সংঘাত বাঁধিয়ে রেখেছে, নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে। ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাহারাদার। ইসরায়েলকে তাই সে কখনও হাতছাড়া করতে দেবে না। তাই এটিকে শুধু মুসলিমবিদ্বেষ হিসেবে ভাবলে চলবে না। তেল ব্যবসায়ী কর্পোরেট টাইকুনদের কাছে ধর্ম বলে কিছু নেই। তাদের ধর্ম মুনাফা। মুনাফাই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের একমাত্র ধর্ম। তাই ইহুদিবিদ্বেষ ছড়িয়ে, ইসলামী রক্ষণশীল মৌলাবাদী স্লোগান তুলে এই লড়াইয়ে জেতা যাবে না।
ইহুদি ধর্ম আর জায়নবাদ এক জিনিস নয়। তাই তো খোদ আমেরিকায় হাজার হাজার ইহুদি রাস্তায় নেমেছেন, মেট্রো স্টেশনে বিক্ষোভ করেছেন, ক্যাপিটেল হিলে বিক্ষোভ করেছেন। ইহুদি যাজকরাও (যাদের রাব্বি বলা হয়) ছিলেন সেখানে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ইউরোপে। জার্মানীতে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়িয়ে তাদের সমর্থনে মিছিল বের করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর লক্ষ লক্ষ লোক সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাস্তায় নামছেন প্রতি সপ্তাহে। সর্বশেষ সমাবেশে সেখানে পাঁচ লক্ষ লোকের জমায়েত ঘটেছে। গত ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে হাজার হাজার মানুষ ফিলিস্তিনের পক্ষে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন। তারা স্লোগান তুলেছেন, “বাইডেন, তুমি লুকাতে পারবেনা।” প্রতিবাদ হয়েছে ইউরোপের দেশে দেশে। এই প্রতিবাদীদের সবাই ফিলিস্তিনের উপর এই অন্যায় বন্ধ হউক সেটা চান। চান তাদের ভূমির অধিকার। এই সংগ্রামী পৃথিবীটাই আসল পৃথিবী। এটাই ভবিষ্যতের যুদ্ধবিহীন সাম্যের সমাজ গড়ে তুলবে।