Wednesday, December 25, 2024
Homeসংবাদ ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিপার্টি ও সংগঠন সংবাদচট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার নামে চিকিৎসার বাণিজ্যিকরণ রুখে দাঁড়ান

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার নামে চিকিৎসার বাণিজ্যিকরণ রুখে দাঁড়ান

জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সংবাদ সম্মেলন

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার নামে চিকিৎসার বাণিজ্যিকরণ রুখে দাঁড়ান

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ডা. মাহফুজুর রহমান
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ডা. মাহফুজুর রহমান

গতকাল ১২ মে সোমবার বেলা ১২টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ডা.মাহফুজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া, ডা. সুশান্ত বড়ুয়া, রাজা মিয়া, কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস পপি, হাসান মারুফ রুমি, মহিনউদ্দিন, নিজামউদ্দিন, এড. বিশুময় দেব প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হলে চট্টগ্রামও আশে পাশের জেলার গরিব রোগীরা বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে যে স্বাস্থ্যসেবা এখন পায় তা থেকে বঞ্চিত হবে। হাসপাতালটি একটি বাণিজ্যিক হাসপাতালে পরিণত হবে। প্রতি ক্ষেত্রে রোগীদের ফি দিতে হবে। অপারেশনের জন্য দিতে হবে ৮ হাজার টাকা, আইসিইউ সেবার জন্য দিতে হবে ১১ হাজার টাকা। টেস্ট চার্জ বাড়বে ৫ গুণ। রেডিওথেরাপিসহ প্রতি খাতের সেবার জন্য রোগীদের উচ্চমূল্যের ফি গুণতে হবে। সরকার বছরে যে ৫০-৬০ কোটি টাকা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে বরাদ্দ দেয় তা বন্ধ করার লক্ষ্যে সস্তা স্লোগানের আড়ালে এই বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রক্রিয়া বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে সরকারি উদ্যোগে ভিন্ন স্থাপনায় চট্টগ্রামে একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট বা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানানো হয়। সম্মেলনে দাবি করা হয়, আন্তরিকতা থাকলে সরকার মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত না করে প্রায় একহাজার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীকে নিয়ে এখনই ভিন্নভাবে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনের পুরো বক্তব্য

সুপ্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ

আপনারা জানেন মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী চট্টগ্রামের এক জনসভায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণা দেয়ার পর গত ১৫ এপ্রিল সরকার এক প্রজ্ঞাপন জারি করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং এর পরিপেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন আইনের খসড়া প্রণয়নের জন্য ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিতে চট্টগ্রামের কাউকে রাখা হয়নি।

আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয় কোনো মাননীয় মন্ত্রী বা এমপি বা রাজনৈতিক নেতার ডিও লেটারে হয় না। এর জন্য একটি পূর্ণ প্রকল্প সরকারের কাছে থাকতে হয়। মেডিকেল কলেজকে কেন বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় হলে এর আর্থিক সংস্থান কোন কোন খাত থেকে হবে, এর প্রশাসনিক- একাডেমিক কাঠামো কি হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল নিশ্চয়ই কোনো প্রকল্প তৈরী করেছিলেন। সরকার এই প্রকল্পের উপর তুষ্ট হয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধারণা করা যায়। বর্তমানে এই প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। প্রশ্ন হলো, সরকার কোন প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে?

আমাদের হাতে ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার প্রস্তাবনা’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা রয়েছে। এই প্রকল্প প্রস্তাবনাটি ৩১/১২/১১ তারিখে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। এটি তৈরী করেছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারি অধ্যাপক পদমর্যাদার ৬ জন শিক্ষক। তাই এই প্রস্তাবকে সরকারি একটি মহলের প্রস্তাব বলেই বিবেচনা করতে হবে। এরপর কোনো প্রস্তাবনা তৈরী করা হয়েছিল বলে আমাদের জানা নেই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সংশ্লিষ্ট মহলের সাথে যোগাযোগ করেও আমরা বিকল্প কোনো প্রস্তাবনার কথা জানতে পারিনি। এর দীর্ঘ দিন পর ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল সরকার যে প্রজ্ঞাপন জারি করে তার শিরোনাম ছিল, ‘সরকার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-এ রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।’ তাই এতে সন্দেহ থাকার কথা নয় যে সরকার ২০১১ সালের প্রকল্পকে সামনে রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়টি করতে যাচ্ছেন। ৩১/১২/১১ তারিখে পাঠানো প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যেহেতু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র সরকারি বৃহত্তম চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান; যেহেতু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ৮০ একর জায়গা আছে; নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট আছে; চট্টগ্রাম ও আশেপাশের সব জেলার সকল হাসপাতালের জটিল ও মরণাপন্ন যে রোগীদের এই হাসপাতালে রেফার করা হয় সবাই বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে সেবা পায়; যেহেতু এখানে এমডি, এমএস, এমপিএইচ ও ডিপ্লোমাসহ ৩৪টি কোর্স চালু আছে; কলেজ ভবন, হাসপাতাল মর্গ, শিক্ষকদের সুবিধা, হোস্টেল ইত্যাদি সব কিছু আছে; এই কলেজে ৩০ জন বিদেশিসহ প্রতিবছর ২০০ জন ছাত্র ভর্তি হয়; এই কলেজে পর্যাপ্ত সংখ্যক ক্লাস রুম, গ্যালারিসহ শিক্ষার শক্তিশালী অবকাঠামো আছে; এই হাসপাতালে ৫৭টি গবেষণা প্রজেক্ট পরিচালিত হয়ে থাকে; মৌলিক গবেষণা পরিচালিত হয়; যেহেতু মেডিকেল এডুকেশন ইউনিট ১৯৯৯ সালে WHO, UNICEF কর্তৃক প্রথম পুরস্কার লাভ করেছে; যেহেতু এই মেডিকেল কলেজে প্রচুর ডাক্তার, নার্স, কলেজ মিউজিয়াম, ডিএনএ ল্যাব, লাইব্রেরি, অডিটোরিয়াম, মেডিকেল এডুকেশনাল ইউনিট ইত্যাদি সবই আছে; যেহেতু বিএমএ নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি ছিল এই মেডিকেল কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে — তাই একে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে। এবার আপনারাই বলুন, এহেন একটি প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার যে যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে তাতে নতুন কোনো প্রাপ্তির কথা আছে কি?

প্রাপ্তির কোনো কথা না থাকলেও জনগণের সর্বনাশের সব কথা এতে আছে। সরকারের কাছে দেয়া প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সরকার ২০১০-’১১ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও চমেক হাসপাতালের জন্য মোট ব্যয় করেছে ৫৩ কোট ৯৩ লক্ষ ৬২ হাজার ৩ শত ৯ টাকা। ২০২০-’১১ সালে মেডিকেল কলেজ ও চমেক হাসপাতাল থেকে সরকার আয় করেছে মাত্র ৪ কোটি ৫৬ লক্ষ ৩৮ হাজার ১৪২ টাকা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ও চমেক হাসপাতালের বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা যদি বন্ধ করে পিজির মতো সবক্ষেত্রে সেবা চার্জ ও টেস্টের মুল্য নির্ধারণ করে তা আদায় করা হয় তবে চমেক হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের আয় দাঁড়াবে ৩০ কোটি টাকা। এর সাথে বর্তমানের বিনা মূল্যের অপারেশন, আইসিইউ সেবা, রেডিওথেরাপি, এচেঞ্জ ট্র্যান্সফিউসন সেবাসহ সকল সেবার উপর ফি ধার্য করলে আয় দাঁড়াবে ৬০ কোটি টাকা। বলা প্রয়োজন, পিজিতে প্রতি অপারেশনের জন্য রোগীদের দিতে হয় ৮ হাজার, আইসিইউসেবার জন্য দিতে হয় প্রতিদিন ১১ হাজার টাকা যা এখানেও দিতে হবে। প্রস্তাবনায় রোগীর সকল চার্জ নির্ধারণ ও আদায়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যাবতীয় ফি নির্ধারণ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র ও রোগীদের চার্জ নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের থাকবে না। এই ক্ষেত্রে এমবিবিএস ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের ফি বেড়ে যাবে। রোগীদের সেবা মূল্যতো বাড়বেই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় হলে সরকারকে প্রাথমিক দিকে কিছু টাকা বরাদ্ধ দিতে হলেও পরে আর কোনো টাকা দিতে হবে না। এককথায় বলা যায় বর্তমান প্রস্তাব অনুযায়ী মেডিকেল কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি আর বিনা পয়সায় বা স্বল্প মূল্যে রোগীদের কোনো সেবা দিতে পারবে না। এটি বাণিজ্যিক হাসপাতালে পরিণত হবে। চট্টগ্রাম মেডিকেলকে প্রতিবছর সরকার যে ৫০-৬০ কোটি টাকা রাজস্ব খাত দেয় তা বন্ধ করার জন্যই একটি সস্তা জনপ্রিয় স্লোগানের আড়ালে মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দিয়ে তা বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।

বিভিন্নমুখী প্রতিবাদের মুখে ইদানিং দায়িত্বশীল মহল অবশ্য বলছেন, সরকার ২০১১ সালের প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাতিল করেছেন। কিন্তু তাদের বক্তব্যের সমর্থনে কোনো সরকারি দলিল দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। কোন প্রকল্প প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাও বলা হচ্ছে না। সরকারের প্রজ্ঞাপনে শুধুমাত্র মেডিকেল কলেজের কথা উল্লেখ থাকার সুবাদে তারা বলতে চেষ্টা করছেন, সরকার শুধুমাত্র কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করবেন, হাসপাতালকে নয়। হাসপাতালটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নিজস্ব হাসপাতাল। যেখানে কলেজ যাবে, হাসপাতাল স্বাভাবিকভাবেই সেখানে যাবে। কারণ মেডিকেল কলেজ থেকে হাসপাতালকে আলাদা করলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ তার স্বীকৃতি হারাবে। সরকার তা জানে বলেই প্রজ্ঞাপনে ভিন্নভাবে হাসপাতালের উল্লেখ করেনি। আর হাসপাতালকে তো বিশ্ববিদ্যালয় করা যায় না। তাই এটা স্বতসিদ্ধ ব্যাপার যে মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হলে হাসপাতালটিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যাবে। এর বিপরীতে যারা বক্তব্য দিচ্ছেন তারা যুক্তিগ্রাহ্য কোনো বক্তব্য দিচ্ছেন না।

চট্টগ্রামে একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তবে এর যৌক্তিকতা ভিন্ন। বর্তমানে মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নিয়মিত/অনিয়মিত, নতুন ব্যাচ/পুরাতন ব্যাচ মিলিয়ে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি হবে। ছাত্রদের দৈনিক নিয়মিত ক্লাস, দৈনিক-সাপ্তাহিক-মাসিক পরীক্ষা, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস/টিউটরিয়েল ক্লাস, নিয়মিত পরীক্ষা হতেই থাকে। এছাড়া এই ছাত্রদের বহুমুখী সমস্যা থাকে। সব কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এই কলেজের শিক্ষকদের। শিক্ষকদের এই কর্মযজ্ঞের মাঝে আরো প্রায় এক হাজার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্র যোগ হয়েছে। অবাক করা ব্যাপার হলো এই অতিরিক্ত এক হাজার পোস্ট গ্যাজুয়েট ছাত্রদের জন্য কোনো অতিরিক্ত জনবল নেই। সরকারি বেতন নিয়ে কলেজের শিক্ষকমন্ডলী এই অতিরিক্ত চাপ বহন করে চলেছেন, এর জন্য আলাদা কোনো সম্মানীও পান না। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের ক্লাস করতে হয় এমবিবিএস ছাত্রদের সাথে। ক্লাসের পর একসময় শিক্ষক সেই ছাত্রদের নিয়ে বসেন কিছু উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দেন। ছাত্ররা নিজে নিজে পড়ে যা জ্ঞান অর্জন করেন তা দিয়েই তাদের পরীক্ষা দিতে হয়। অথচ এমডি, এমএসসহ বিশেষায়িত কোর্সের শিক্ষাথীদের জন্য এমন দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা কাম্য হতে পারে না। একই অবস্থা কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও। মেডিকেল কলেজের জনবল দিয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটানো হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা, চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হয় ঢাকায় গিয়ে। এটা দারুণ এক বিড়ম্বনার ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয় করার আরো একটি যুক্তিসংগত কারণ আছে যা অধ্যক্ষ মহোদয় কর্তৃক প্রেরিত প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে। এমডি এমএস ইত্যাদি কোর্সের শিক্ষার্থীদের থিসিস বা গবেষণাপত্র জমা দিতে হয়। এই থিসিস শিক্ষার্থীরা সম্পন্ন করেন একজন অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপকের তত্বাবধানে। থিসিস করার মধ্যখানে হঠাৎ করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক অন্যত্র বদলী হয়ে গেলে শিক্ষার্থী দারুণ এক সংকটে পড়েন।

পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের এই সব সমস্যা উচ্চমানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সৃষ্টির প্রতিবন্ধক। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে একটি স্বতন্ত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি উদ্যোগে একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট স্থাপনের মাধ্যমে। মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করে এই সমস্যার সম্ভব নয়। কারণ একই শিক্ষকমণ্ডলী দিয়ে এমবিবিএস ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট কোর্স চালালে শিক্ষকদের পাঠদানে আপোষ করতে হয়। পিজিতে এই কারণে ’৮০-’৮১ সালে এমবিবিএস কোর্স চালু করেও পরে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। পিজিতে বেডের অতিরিক্ত কোনো রোগী ভর্তি করা হয় না। ফলে শিক্ষাদানের একটি পরিবেশ বজায় থাকে। পিজিতে বিসিপিএস এর সাথে সহযোগিতায় এফসিপিএস কোর্স ছাত্রদের পড়ানো হয়, এমসিপিএস ছাত্রদের ওরিয়েনটেশন দেয়া হয়। পিজিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করতে গিয়ে গরীব রোগীদের কোন অসুবিধা হয়নি। কারণ ঢাকায় ৪/৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে, ১০/১২টি বড় ধরনের বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। চট্টগ্রামে জেনারেল হাসপাতাল ছাড়া আর কিছু নেই। চট্টগ্রাম ও আশেপাশের জেলার ৫ কোটি জনগণকে নির্ভর করতে হবে জেনারেল হাসপাতালে উপর। তাই রূপান্তরের নামে চট্টগ্রাম ও আশেপাশের জেলার গরীব রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করে নয়, চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে ভিন্নভাবে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যুক্তিসংগত। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক উদ্যোগ নিতে সরকারেরই অর্থ ব্যয় করতে হবে।

চট্টগ্রামবাসীর এখন একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুনভাবে প্রকল্প প্রস্তাবনা দেয়ার। হাসপাতাল থাকবে কি থাকবে না, গরীব চিকিৎসা পাবে কি পাবেনা এই বিতর্ককে পিছনে ফেলে ২০১১ সালের প্রস্তাবনাকে বাতিল করে নতুন প্রস্তাবনার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুযোগ এসেছে। আমাদের আশা থাকবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রশাসন, বিএমএ নেতৃবৃন্দ গরীব রোগীদের ক্ষতি না করে বিশ্ববিদ্যালয় করার নতুন প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরী করে তা নিয়ে সরকার গঠিত কমিটির সাথে আলোচনা করবেন।Ctg_Jonoshastho-3a

সচেতন সাংবাদিক ভাইয়েরা,

এই ব্যাপারে সবচাইতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারেন আপনারা। সরকার ঘোষিত কমিটির কাছ থেকে সর্বশেষ তথ্য জেনে চট্টগ্রামের জনগণের স্বাস্থ্যসেবাকে অক্ষুণ্ন রেখে ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরীর আইন করতে সফল চাপ প্রয়োগ করতে পারেন আপনারা। সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের হত্যাকাণ্ডকে জাতির সামনে এনেছেন আপনারা এবং আপনাদের কারণেই সরকার এর সুষ্টু তদন্তের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করার নামে গরীবদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেয়ার যে প্রস্তাবনা তার ক্ষতিকারক দিকগুলো কমিটি ও জনগণের সামনে তুলে ধরে ভিন্ন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করতে সরকারকে অনুপ্রাণিত করতে আপনাদের ভূমিকা আমরা কামনা করছি।

আপনাদের সামনে সংক্ষিপ্ত আকারে আমাদের দাবিগুলো তুলে ধরছি :

১. চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেকে সরকারের অধীনে আগের মতই বহাল রাখা হোক। বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে রেখে হাসপাতালের আসন সংখ্যা আরো বাড়িয়ে তা ৩০০০ বেডে উন্নিত করা হোক। চট্টগ্রামে আরো দুইটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হোক। প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিয়ে হাসপাতালের পরিবেশ উন্নত করা হোক। আমলাতান্ত্রিক ব্রিটিশ পাকিস্তানি প্রশাসনিক নিয়ম থেকে মুক্তি দিয়ে একই কলেজে ডাক্তারদের চাকরি স্থায়ীকরণের নিয়ম চালু করা হোক।

২. উচ্চমানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রায় একহাজার পোস্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী নিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে আলাদা একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হোক। বিসিপিএস এর সাথে সংযুক্ত হয়ে এফসিপিএস কোর্সের পাঠদান ও এমসিপিএস কোর্সের ওরিয়েনটেশন ক্লাস চালু করা হোক। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী এখনই যদি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চালু করতে হয় তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা চলে। প্রতিটি কোর্সের জন্য একজন করে কোঅর্ডিনেটর নিয়োগ দেয়া চলে। নতুন উন্নতমানের হাসপাতাল চালু ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে তার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহার করতে পারে। মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের সম্মানীর বিনিময়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের শিক্ষাদানের জন্য নেয়া যায়। এতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ১০০ একর জায়গা রয়েছে যার মাঝে ২০ একর রয়েছে বেদখলে। এছাড়াও ফৌজদারহাটে সরকারের প্রচুর জায়গা রয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় নিমার্ণে জায়গার অভাব হওয়ার কথা নয়।

৩. বিকল্প একটি প্রস্তাব : চট্টগ্রাম সরকারি মেডিকেল কলেজকে সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করা হোক। ডাক্তার, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারী বলে বিবেচিত হবে। রোগীদের সেবা ফি, ছাত্রদের সব ফি নির্ধারণ করবে সরকার। যেহেতু এটা বিশ্ববিদ্যালয় হবে তাই বদলির ব্যাপারটি আর থাকতে পারবে না। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী ও গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য ভিন্ন শিক্ষক মন্ডলী নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন তারাও সম্ভবত এটাই চাইছেন বলে মনে হয়। এটা হলে সবাই একমত হবেন। ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সর্বোপরি রোগীদের স্বার্থ এতে অক্ষুণ্ন থাকবে। অনেকে বলবেন এই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়তো পৃথিবীর কোথাও নেই। আবার এটাওতো সত্য গরীবের স্বাস্থ্য সেবা বন্ধ করে কোন সরকারি মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার নজিরও তো নেই। আমরা তবে ভাল নজির স্থাপন করি না কেন?

২০১১ সালের প্রকল্প প্রস্তাবনায় বর্তমানের চমেক প্রশাসন ও বিএমএ কর্মকর্তারা কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাদের প্রকল্পে এই আদর্শ বা চেতনার প্রতিফলন ঘটাননি। বঙ্গবন্ধু গরীবদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে কোনো প্রকল্প কখনো নেননি। তিনিই প্রথম ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ পিজি হাসপাতাল তৈরী করে উচ্চশিক্ষার দ্বার উম্মোচন করেছিলেন। পিজি হাসপাতাল তৈরী করতে কোনো সরকারি হাসপাতালের ক্ষতি করেননি। পরে সেটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে গরীবদের স্বাস্থ্যসেবার দ্বার বন্ধ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করে গরীবদের চিকিৎসার দ্বার বন্ধ করে দিলে তা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী একটি কাজ।

চলুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারের কাছে উপরে উল্লিখিত ১ ও ২ নং অথবা ৩ নং প্রস্তাব বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাই।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments