Monday, December 23, 2024
Homeছাত্র ফ্রন্টচতুর্থ কেন্দ্রীয় সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট থেকে — শিক্ষা আন্দোলন

চতুর্থ কেন্দ্রীয় সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট থেকে — শিক্ষা আন্দোলন

 

1794558_1083514838380991_2056310407809235605_nজাতীয় জীবনে আমরা এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। দেশে একদিকে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণী তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকা-সম্পদ হারিয়ে অন্তহীন স্রোতের মতো নিঃস্বের কাতারে নেমে যাচ্ছে। এই একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণীর অনুকূলে অর্থনীতি রাজনীতির কাঠামো নির্ধারিত হচ্ছে। অর্থনীতিতে যেমন তেমনি রাজনীতির ক্ষেত্রেও একদলীয় কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে— যা এদেশে ফ্যাসিবাদী শাসনকে আরও পাকাপোক্ত করছে। আশির দশকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো মুক্তবাজার অথনীতি চালু করেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান আওয়ামী সরকার অর্থনীতিতে উদারীকরণের পালে জোর হাওয়া দিচ্ছে। স্বাস্থ্য-বিদ্যুৎ-যোগাযোগসহ পরিষেবাখাতগুলোতে ভর্তুকি কমিয়ে ক্রমাগত বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে। অন্যান্য খাতের মতোই শিক্ষাক্ষেত্রেও বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণের তীব্র আক্রমণ নামিয়ে আনছে। শিক্ষানীতি ২০১০ সরকারের এই নীতিরই সপ্রমাণ দলিল।

এরই ফলাফল হিসেবে, প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত— সমস্ত ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুপাতে সরকারি বরাদ্দ কমছে। কিন্তু ফি বেড়েছে বহুগুণ। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না বাড়লেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ছে। অথচ নব্বইয়ে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের দশ দফায় বলা হয়েছিল, ‘…শিক্ষাকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ব্যবহার করা চলবে না। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বন্ধ করতে হবে।’ কিন্তু বিগত দিনে কোনো সরকারই ছাত্রসমাজের এই দাবির প্রতি কর্ণপাত করেনি। ফলে দরিদ্র মানুষের সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের পথ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। শাসক বুর্জোয়া শ্রেণী তার শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতার কারণেই আজকের দিনে সর্বজনীন শিক্ষার চেতনা ধারণ করতে পারে না। সেই কারণে সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থাও তারা করেনা।

প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষা: প্রাথমিক শিক্ষা কাগজে-কলমে বাধ্যতামূলক হলেও সরকার এখনো সবার জন্য শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। দেশের বিপুল মানুষ এখনো অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। সরকারি হিসাব মতে, দেশে শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে এই হার আরও অনেক কম। পরাধীন দেশে দাবি উঠেছিল দশম শ্রেণী পর্যন্ত সবার জন্য অবৈতনিক শিক্ষার। পাকিস্তানিরা বলেছিল, ‘অবৈতনিক শিক্ষা বস্তুত অবাস্তব কল্পনা‘। অথচ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও এ দেশের শাসকশ্রেণী ৫ম শ্রেণী পর্যন্তই সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রাথমিক স্তরে সরকারি হিসেবেই ড্রপ আউটের হার ২৩ শতাংশ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিবেচনায় একজন মানুষকে সময়ের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে ন্যূনতম স্নাতক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক স্তর হওয়া উচিত।  আমাদের সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি করে আসছে। সরকার সে দাবির প্রতি কর্ণপাত করেনি। শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, তাকে বাস্তবায়ন করতে পর্যাপ্ত কøাসরুম নির্মাণ ও শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। অপ্রয়োজনীয়ভাবে চালু হওয়া পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা শিক্ষার আনন্দ হরণ করে কোমলমতি শিশু ও অভিভাবকদের হয়রানি বাড়িয়েছে। ৮৬ শতাংশ স্কুলে সাধারণ শ্রেণী কার্যক্রম সংকুচিত করে কোচিংয়ে বাধ্য করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। নিছক ভাল ফলাফলের পেছনে ছোটানোর কৃত্রিম চাপ শিশুদের জীবনটাকেও আনন্দহীন করে তুলছে। পাশাপাশি পাশের হার বাড়িয়ে দেখানোর জন্যে উদারভাবে খাতা দেখা, উত্তরপত্র সরবরাহ, প্রশ্ন ফাঁস ইত্যাদি অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্ম দিয়েছে।

chhatra front_153বর্তমানে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় ২০ শতাংশ শিক্ষক নেই, ২৯ শতাংশ স্কুলে পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই, ৭৮ শতাংশ স্কুলে নেই ল্যাবরেটরি। আয়োজনগত এসব অসম্পূর্ণতা রেখে চালু হওয়া সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি সৃজনশীলতা বাড়ায়নি, বহুগুণে বাড়িয়েছে কোচিং ও গাইড বইয়ের ব্যবসা। ৫৫ ভাগ শিক্ষক জানেন না সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন কিভাবে করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে স্কুলস্তরে ফি বৃদ্ধিসহ শিক্ষার সামগ্রিক ব্যয় বহুগুণে বেড়েছে। এই কারণে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে আশঙ্কাজনক হারে কমছে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ড্রপ আউটের হার বাড়ছে।

লাগামহীন বেসরকারিকরণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমন এক স্বেচ্ছাচারিতা তৈরি করেছে, ফি বৃদ্ধির সরকারি নীতিমালাকেও তারা কোনো তোয়াক্কা করছেনা। এ বছরের শুরুতে ফি বৃদ্ধির অরাজকতার বিরুদ্ধে অভিভাবকেরা পথে নেমেছেন। আন্দোলনের মুখে আদায়কৃত ফি ফেরত দেয়ার সরকারি নির্দেশনা কেবল ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এক পাঠ্য বই বিতরণের কৃতিত্বকে ফলাও প্রচার দিয়ে গোটা ধ্বংসন্মুখ শিক্ষাব্যবস্থার সকল অরাজকতাকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে, অথচ শিক্ষাব্যবস্থার এতটা ভঙ্গুর দশা পূর্বে কখনই ছিলনা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : এক সময় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, এমসি কলেজ, বিএল কলেজ, কারমাইকেল কলেজের মতো অনেক কলেজেরই সুখ্যাতি ছিল, আজ তা অনেকটাই মøান। শিক্ষক স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, হল-সেমিনারসহ সামগ্রিক আয়োজন তৈরিতে অবহেলা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। জ্ঞান বিতরণ নয়, কেবল পরীক্ষা নেবার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে কলেজগুলো। ভেতরের মূল সংকট না কাটিয়ে সিলেবাস পরিবর্তন, গ্রেডিং পদ্ধতি ও নতুন প্রশ্নপত্র চালু, সেশনজট নিরসনের লক্ষ্যে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম ইত্যাদি নানা পদক্ষেপ সমস্যাকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সিলেবাস অনুযায়ী ৩০ সপ্তাহ পাঠদান, ৪ সপ্তাহ পরীক্ষা প্রস্তুতি এবং ৬ সপ্তাহ বার্ষিক পরীক্ষা কর্যক্রম চলবে। ৪ বছরে গড়ে ১৮৬০ ক্লাসঘন্টা পাঠদান ছাড়া উপরোক্ত ক্রেডিট পূরণ করা সম্ভব নয়। এই হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর শুধু তত্ত্বীয় কোর্সের জন্য গড়ে ৩৫০টি ক্লাস হওয়া প্রয়োজন। সুপারিশে এই ক্রেডিট পূরণ করার জন্য ২১০ দিন ক্লাস আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। অথচ সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি এবং পরীক্ষা আয়োজনের কারণে বছরে ৩ মাসের বেশি কলেজ খোলা থাকে না।

আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির অংশ হিসেবে নম্বর বন্টনের ১০টি গ্রেড নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বনিম্ন পাশের গ্রেড ডি (৪০%-৪৫%) এবং সর্বোচ্চ এ প্লাস (৮০% নম্বর বা তারও বেশি)। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে প্রমোশন পেতে হলে জিপিএ ২.০০ এবং তৃতীয় বর্ষ থেকে ৪র্থ বর্ষে উন্নীত হতে হলে জিপিএ ২.২৫ (৪৫%-৫০%) নম্বর পেতে হবে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ক্রমান্বয়ে পরীক্ষার ফলাফলের উন্নতি আশা করা হয়েছে অথচ সারাবছর ক্লাস নিশ্চিত করাসহ নানামূখী আয়োজনের বিষয়ে কোনো কথা বলা হয়নি।

কলেজগুলোর ক্লাস কার্যক্রমের পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ। ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষে কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ৭৫ দিনে ক্লাস হয়েছে ১১৫টি, গণিত বিভাগে ৫২ দিনে ১০২টি, উদ্ভিদবিদ্যায় ৮৫ দিনে ১০৪টি। অন্যান্য বিভাগেও একই অবস্থা। পরবর্তী বছরগুলোতেও এর বেশি ক্লাস হয়নি। কারণ এই সময়ের মধ্যে নতুন কোনো শিক্ষক নিয়োগ, ক্লাসরুম নির্মাণসহ পাঠদানের সার্বিক আয়োজনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারমাইকেল কলেজের এই পরিসংখ্যান থেকে দেশের অন্যান্য কলেজের পরিস্থিতি সহজেই বোধগম্য।

সেশনজটের প্রকৃত কারণকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তথাকথিত যে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে, তার ফলে পূর্বে যে ৭০-৭৫ দিন ক্লাশ হতো, এখন আর তাও হচ্ছে না। ২০১৩-১৪ সেশনে কারমাইকেল কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে ক্লাশ হয়েছে ৩০ দিন, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ২১ দিন ক্লাশ হয়েছে। এভাবে নতুন নিয়মের ফলে পাঠদান প্রক্রিয়া একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। কলেজে ছাত্র উপস্থিতি দিন দিন কমে যাচ্ছে। পরীক্ষার প্রস্তুতি তথা সিলেবাস শেষ করার জন্য ছুটতে হচ্ছে প্রাইভেট টিউটরের কাছে। ফলে বেড়েছে শিক্ষাব্যয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় : দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮৩টি। পর্যাপ্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার সুযোগে সাধারণ  মানুষের শিক্ষা গ্রহণের আকাক্সক্ষাকে পুঁজি করে বিপুল মুনাফার লোভে গড়ে উঠেছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগের নীতিকে উৎসাহিত করায় প্রতিবছরই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে এখানে প্রায় ৩ লক্ষ ৬০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। একসময় ধারণা ছিল, উচ্চবিত্তের সন্তানেরাই এখানে পড়াশোনা করে। বর্তমানে অনেক সাধারণ মানুষও একটু ভালো ভবিষ্যতের আশায় ঋণ করে, জমি বন্ধক রেখে সন্তানকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। এমনিতেই এখানে দু’লাখ থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত টিউশন ফি নেয়া হয়। তারপরও প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিউশন ফি বাড়ছে। যেমন ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে গত বছর আইন বিভাগের মোট টিউশন ফি ছিল ৪ লক্ষ টাকা। এবছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লক্ষ ৬০ হাজার টাকায়। শুধু টিউশন ফি বৃদ্ধিই নয়, নানা রকমের অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫টি বাদে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই। ভাড়া বাড়িতে, শপিং মলের উপরে কোনো রকমে চলছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ নেই। স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগও দেয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শর্তসমূহ উপেক্ষা করে এভাবেই পরিচালিত হচ্ছে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়।সম্প্রতি ভ্যাট আরোপের মধ্য দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে আরও ব্যয়বহুল করার যে পরিকল্পনা সরকার নিয়েছিল, ছাত্রদের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারেনি। এই আন্দোলন ছাত্র আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় : উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য সরকার যত কমিশন ও প্রকল্প গ্রহণ করেছে, শিক্ষার মান তত অধঃগামী হচ্ছে। এবছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক ২০০৬ সালে প্রণীত কৌশলপত্রের দশ বছর পূর্ণ হয়েছে। গত ১০ বছরে কৌশলপত্রের সুপারিশ অনুসারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি ফি, সেমিস্টার ফি, বিভাগ উন্নয়ন ফিসহ নানাখাতে কয়েকগুণ ফি বেড়েছে। নতুন নতুন খাতে ফি আরোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রয়োজন অনুপাতে বরাদ্দ কমেছে। এভাবে কৌশলপত্রের আলোকে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকার সেলফ ফিন্যান্সিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে চায়। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভর্তুকি, বরাদ্দ কমিয়ে ধীরে ধীরে সেদিকেই এগুচ্ছে। সম্প্রতি শিক্ষকদের আন্দোলনেও প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসনের ধারণা কোনো কিছুই সরকার তোয়াক্কা করেনা। ফলে আগামী দিনে বাণিজ্যিকীকরণের প্রচেষ্টা আরও ত্বরাণি¦ত হবে- এ কথা সহজেই অনুমেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল সধহ সধশরহম, পযধৎধপঃবৎ নঁরষফরহম-এর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠা। কিন্তু সেটা না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে গেছে বাজারের উপযোগী দক্ষ মানুষ তৈরি করা। এজন্য সিলেবাস সংস্কার করা এবং ক্লাশ-এ্যাসাইনমেন্ট-বাধ্যতামূলক পার্সেন্টেজের চাপ ছাত্রদের উপর আরোপ করা হচ্ছে। অপরদিকে পাঠদান পদ্ধতিতে গতানুগতিকতা ও সৃজনশীলতার অভাবে ছাত্রদের পড়াশুনায় আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে জ্ঞান চর্চা।

সরকারি বরাদ্দ না বাড়িয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে পরিচালিত গবেষণা প্রকল্প (হেক্যাপ) বিশ্ববিদ্যালয়কে ধীরে ধীরে বহুজাতিক ও দেশীয় পুঁজিপতিদের উপর নির্ভরশীল করার অপচেষ্টা মাত্র। এই প্রকল্পের অধীন গবেষণাও জনকল্যাণে নয়, পুঁজিপতিদের চাহিদা ও স্বার্থের নিরিখেই পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্পের বরাদ্দ পেতে শিক্ষকদের মধ্যে হীন প্রতিযোগিতা চলছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ধারণাকে প্রতিনিয়ত সংকোচিত করা হচ্ছে। ভিসি নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ সবই দলীয় বিবেচনায় করা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষাকে পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার পরিপূরক করার প্রয়োজনে এখন সিলেবাস-কারিকুলাম প্রণয়ন তথা একাডেমিক স্বায়ত্তশাসনেও হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। এই কমিশন গঠিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশিষ্ট স্বাধীনতাও আর থাকবে না।

আবাসন সংকটের সুযোগে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা বারান্দা, মসজিদ, ক্যান্টিন, গেমসরুমে অবস্থান করে অমানবিক জীবনযাপন করছে। হলগুলোতে নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে ‘গেস্টরুম’ নামের টর্চারসেল এক মূর্তিমান আতঙ্ক। প্রথমবর্ষের ছাত্রদের উপর চলে র‌্যাগিং নামের মানসিক নির্যাতন। হলে থাকা ছাত্রদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের রিক্রুটমেন্ট হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রশাসনেরও অনুমোদন আছে। গত ২৫ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে আছে। সরকারি ছাত্র সংগঠনের নিরঙ্কুশ দখলদারিত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে নানা কথার চাতুরিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংসদ নির্বাচনের দায়িত্বকে আড়াল করছে।

এভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিকল্পিত উপায়ে শাসকশ্রেণীর অনুগামী-সহযোগী দক্ষ মানুষ তৈরির ক্ষেত্র হিসেবে প্রস্তুত করছে সরকার। অথচ এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয় জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পয়সায়। ফলে জনগণের টাকায় পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়কে জনগণের কল্যাণে পরিচালিত করার দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments