হঠাৎ করে দেশে যেন ‘গণতন্ত্র’ ফিরে এসেছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সরকারের বক্তব্য — তারা চান জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেয়র-কাউন্সিলররা সিটি কর্পোরেশন চালাক, তাই নির্বাচন দেয়া হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। অনেকে মনে করছেন, দেশের মানুষ আবার ভোটের অধিকার ফিরে পাবে। অনেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন — যাক, গত ৩ মাস ধরে যে হানাহানি ও নিরাপত্তাহীন অবস্থা চলছিল তার অন্তত অবসান হল। নির্বাচন মেনে নেয়ার বিনিময়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস খুলে দিয়ে এবং খালেদা জিয়ার জামিন ও গৃহ প্রত্যাবর্তনে বাধা না দিয়ে বেশ ‘গণতান্ত্রিক’ ভাব দেখাচ্ছে সরকার। অনেকে বলছেন, এই নির্বাচন ঘোষণা করে সরকার বিএনপি-কে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছে। বিএনপির কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, তাদের আশা সরকার নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ দেবে। আসলেই কি দেশে গণতান্ত্রিক শাসন চলছে? শান্তি ও নিরাপত্তা কি স্থায়ীভাবে নিশ্চিত হয়েছে? অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার কি জনগণ ফিরে পাচ্ছে?
সবাই একমত হবেন, বর্তমান আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে সরকারি জোটভুক্তরা ছাড়া কোনো দল অংশগ্রহণ করেনি। বেশিরভাগ মানুষও ভোট দিতে যায়নি। ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে, বাকিদের লোকদেখানো নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতায় বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। ভোট প্রদানের হার বাড়িয়ে দেখানোর উদ্দেশ্যে জাল ভোটের মহোৎসব হয়েছে। জবরদস্তি ও কূটকৌশলের নানা নাটক করে পতিত স্বৈরাচারী এরশাদের দল জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে এনে প্রধান বিরোধী দল বানানো হয়েছে। এভাবে মহাজোট সরকার নিজেরাই নিজেদের ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা করেছে। নির্বাচনের সময় বলা হচ্ছিল, এটা ‘নিয়ম রক্ষার’ নির্বাচন। এখন বলা হচ্ছে, তারা বৈধ সরকার এবং ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন।
ক্ষমতায় বসেই তারা যে উপজেলা নির্বাচন করলেন, তাতে পুনর্বার প্রমাণিত হল জনগণের ভোট প্রদানের স্বাধীনতায় তারা বিশ্বাসী নন। প্রথম দুই দফা নির্বাচনে সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবি দেখে পরের ৩ দফায় ভোট কেন্দ্র দখল, সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভর্তি করা, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান, প্রশাসনিক কারসাজিসহ ভোটডাকাতির পুরনো সব কায়দা অনুসরণ করা হল। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পৌরসভা-উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত বিরোধী জনপ্রতিনিধিদের মামলার অজুহাতে বরখাস্ত বা সরিয়ে দিয়ে স্থানীয় সরকারও তার দখলে নিয়ে এসেছে। এইভাবে, যতটুকু নির্বাচনী ব্যবস্থা দেশে ছিল তারও বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। শুধু তাই নয়, গত কয়েক বছরে এবং বিশেষত পুনরায় ক্ষমতা দখল করে এই সরকার সভা-সমাবেশসহ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের অধিকার হরণ, প্রচারমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বিচারবিভাগ-প্রশাসন-নিরাপত্তা বাহিনীর দলীয়করণ, বিরোধী দলের কার্যালয় বন্ধ ও বিরোধী নেত্রীকে অবরুদ্ধ করে রাখা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলার পাহাড় রচনা, গণহারে ধরপাকড়, বিনা বিচারে হত্যা-গুমসহ নিপীড়নমূলক শাসনের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা নজিরবিহীন।
এহেন আওয়ামী লীগ সরকার যে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ঘোষণা করলো তা কি আসলেই স্থানীয় সরকারে গণতন্ত্র আনার জন্য? নাকি তার অগণতান্ত্রিক শাসনের বৈধতা নেয়া ও নিপীড়নমূলক শাসনের ভাবমূর্তি কাটিয়ে জনমনে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যে? বাস্তবে সরকারের স্বৈরাচারী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে মানুষের মনে যে বিক্ষোভ সঞ্চিত হয়েছে তাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে অগণতান্ত্রিক শাসনের গায়ে গণতন্ত্রের আলখাল্লা পরাতে চায় আওয়ামী মহাজোট।
গণতন্ত্রহীন পরিবেশে ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনের’ নাটক
গত আড়াই মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা, গুম-ক্রসফায়ার-পেট্রোলবোমা সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতা ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে হঠাৎ করে যেভাবে নির্বাচন ঘোষণা করা হল তা কোন্ উদ্দেশ্য থেকে? ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন গত ৭ বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারি দলের প্রার্থীরা জিততে পারবে না, এমন আশংকা থেকেই নানা অজুহাতে নির্বাচন করা হয়নি বলে জনমনে ধারণা। আমরা দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ করে মন্ত্রীসভার বৈঠকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলেন। সে অনুসারে তৎপর হয়ে নির্বাচন কমিশন জুন মাস নাগাদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো। এর মধ্যে পুলিশের আইজি বললেন, এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনও সেভাবেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলো। এইসব ঘটনা প্রমাণ করে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন আওয়ামী মহাজোট সরকারের অঙ্গুলি হেলনে চলে এবং সরকারের প্রয়োজনেই এসময় নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ণ এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা স্থানীয় সরকার প্রশাসন পরিচালনার জন-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এ নির্বাচন ঘোষিত হয়নি। এমনকি নগরবাসীর জীবনমান ও নাগরিক সুবিধা উন্নয়নের সাথেও এ নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। এবারের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ধরা হয়েছে ৫০ লক্ষ টাকা, জামানত এক লক্ষ টাকা। জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে এই বিপুল পরিমাণ টাকা যারা ব্যয় করে, তারা পরবর্তীতে এই টাকা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আদায় করে নেয়। এই নির্বাচনী বাণিজ্যে তাই বিভিন্ন ধরনের চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিসহ বৈধ-অবৈধ টাকার মালিকেরা, মিডিয়াসহ বিভিন্ন কায়েমী শক্তির তৎপরতায় জানগণও নির্বাচনে যুক্ত হয়ে যায়। টাকা ও পেশি শক্তির চক্রে জনগণের একটা অংশকে দুর্নীতিগ্রস্ত করা হয়। এ নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম হবে না।
আওয়ামী লীগের গত মেয়াদের শেষ সময়ে চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি ঘটেছিল। এরপর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে ৫ জানুয়ারি ’১৪ একতরফাভাবে ভোটারবিহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা বর্ধিত করেছে যা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার জন্য অর্থাৎ যে-কোনো পন্থায় ক্ষমতা টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে প্রশাসনিক সন্ত্রাস, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম, মতপ্রকাশের উপর হস্তক্ষেপসহ বিরোধী শক্তির উপর নিপীড়নের মাত্রা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। আওয়ামী লীগ আজ দেশের নাগরিকদের বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণরূপে পদদলিত করে যে-কোনো পন্থায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। ফলে খর্ব হচ্ছে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। এ সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে দেশবাসী সীমাহীন দুর্নীতি, দলীয়করণ, স্বেচ্ছাচারিতা প্রত্যক্ষ করে আসছে। বিরোধী পক্ষকে দমন-পীড়নের যে নজির তারা স্থাপন করেছে তাতে আওয়ামী মহাজোটের ফ্যাসিস্ট চেহারা আরও প্রকট হয়েছে, গণবিচ্ছিন্নতাও বেড়েছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ফলে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোসহ জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্য থেকে সরকারের বিরোধিতা অব্যাহত থেকেছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের দাবি জোরদার হয়েছে। সব মিলে এই সময়ে জনমতের হাওয়াও আওয়ামী লীগের পক্ষে নেই। এই গণবিচ্ছিন্নতা কাটাতে এবং জনগণের ক্ষোভকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত ও প্রশমিত করতে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার নানা ফন্দি আঁটছে। আর সে কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ রেখে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা হরণ করে, কালো আইনসমূহ যথেচ্ছ ব্যবহার অব্যাহত রেখেই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। এর মাধ্যমে চূড়ান্ত গণতন্ত্রহীন পরিবেশে ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনের’ তামাশার আয়োজন করা হয়েছে যা গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারের গণদাবির প্রতি চপেটাঘাত।
অনির্বাচিত সরকারের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টিই এ নির্বাচনের লক্ষ্য
আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় নির্বাচনের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। অগণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত এই সরকার তাই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সমস্ত রকম গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করছে, কোনোরকম বিরোধীমত সহ্য করছে না। সামান্য বিরোধিতার আভাস দেখা মাত্র খুন, গুম পর্যন্ত করতে দ্বিধা করছে না। আপাতদৃষ্টে মনে হবে এ সবই হচ্ছে শুধু বিএনপি-জামাতের বিরুদ্ধে। কোনো বাম নেতা-কর্মী জেলে নেই বা বাম দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে বাধা দেবার কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা নেই। কিন্তু বাস্তবে বিএনপি-জামাতের বিরোধ দমনের নামে যে ফ্যাসিবাদী বিধি-বিধান ও নজির আওয়ামী লীগ স্থাপন করছে তাতে শেষ বিচারে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকেই কবর দেয়া হচ্ছে। একটা বামপন্থী দল হিসেবে এই বিপদের ভয়াবহতা আমরা এতটুকু উপেক্ষা করতে পারি না।
এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতা দখলকে বৈধ করতে চায়। তার জবরদস্তির যৌক্তিক ও আইনগত ভিত্তি তৈরি করতে চায়। তারা যে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিকভাবে, গায়ের জোরে ক্ষমতায় এসেছে তার ন্যায্যতা সৃষ্টি করতে চায়। কারণ জনগণকে ঠকাতে হলেও তার একটা ন্যায্যতা দেখানো লাগে, আপাত ন্যায্যতা সৃষ্টি করতে হয়। তার এই অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় দখলের বিরুদ্ধে যে মনোভাব জনগণের মধ্যে আছে — ক্ষমতায় থাকলেও তাকে যে যৌক্তিক করা যাচ্ছিল না — তার ডাকে নির্বাচনে যদি সবাই অংশগ্রহণ করে তবে তার শাসন ন্যায্যতা পাবে। আসলে সে উদ্দেশ্যেই এই নির্বাচন। কেননা, ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সংসদ নির্বাচনের তুল্য না হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি।
ভোটের মাধ্যমে নিজেদের শাসক নির্বাচন করার যে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার জনগণ ভোগ করে সেটাও বর্তমান শাসকদল কেড়ে নিয়েছে। আর তাই এই সময়ে দেশের সবচেয়ে জরুরি ও প্রধান গণতান্ত্রিক দাবি কি? সেটি হল, দেশের সকল গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কি সে দাবিকে পাশ কাটানোর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে না? এই নির্বাচন কি আওয়ামী লীগের গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল ও ফ্যাসিবাদী শাসনকেই বৈধতা দিতে সহায়তা করবে না?
এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও শান্তি আসবে না
এই নির্বাচন কি আপাত নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবার কোনও সম্ভাবনা আছে? নির্বাচন কমিশন যে সরকারের সম্পূর্ণ বশংবদ এটাও সবার জানা কথা। সে কথা সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিও বলছে। এই নির্বাচন যে একটা তামাশার নির্বাচন হবে — এ কথাও তারা বলছে। তারপরও কেন তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে? প্রকৃত কারণ হল, এ মুহূর্তে বিএনপি-জামাত তাদের সহিংস কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে যাবার রাস্তা (এক্সিট রুট) খুঁজছে। জনগণকে সাথে নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কার্যকর কোনো গণআন্দোলন বিএনপি-জামাত জোট গড়ে তুলতে পারেনি। তারা সহিংসতার পথে হেঁটেছে এবং সরকারের কৌশল ও রাষ্ট্রশক্তির কাছে কার্যত পরাস্ত হয়েছে। একই সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে জামাতের পক্ষাবলম্বনও তাকে জনগণের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার তারা হচ্ছে, এটা সত্য। কিন্তু জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণআন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন মোকাবেলা করার উদ্দেশ্য এবং ক্ষমতা — কোনোটাই তাদের নেই। তাদের হরতাল-অবরোধ অর্থহীন হয়ে পড়েছে। তারা সহিংসতার দায়ে জনবিচ্ছিন্ন ও গণধিকৃত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বিএনপি-জামাত বেরিয়ে আসতে চাইছে।
যাই হোক, সংঘাত ও সহিংসতার রাজনীতির অবসানের যে সম্ভাবনার কথা অনেকে বলছেন তার কোনো সম্ভাবনা নেই। সাময়িক বিরতি হতে পারে মাত্র। এর কারণ, ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী — বুর্জোয়াদের কোনো অংশের কাছেই জনগণ, গণতন্ত্র এসব মুখ্য বিবেচ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় গদি দখল ও লুণ্ঠনবৃত্তি। সিটি কর্পোরেশনগুলোতে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে না গেলে বিএনপি-জামাত জোট আবারও সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে যাবে এবং সেক্ষেত্রে সহিংসতা নতুন করে ফিরে আসবে। কারণ প্রশ্নটা হল ক্ষমতা দখলের। কেউ রাষ্ট্রশক্তি হাতে নিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সহিংস, কেউ সহিংস ক্ষমতায় যেতে। এদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সহিংসতা চলতেই থাকবে, মাত্রার হেরফের হতে পারে। তবে, চক্রান্ত ও কূটকৌশল-পূর্ণ বুর্জোয়া রাজনীতির বিভিন্ন সম্ভাবনা সম্পর্কেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
নির্বাচনে আমরা কেন অংশগ্রহণ করি
একটি বিপ্লবী দল নির্বাচনে কেন যায়? প্রশ্নটা আবারও একটু ভালোভাবে ভেবে দেখা দরকার। বুর্জোয়ারা যখন তাদের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে তখন তারা এর একটা পদ্ধতি দাঁড় করায়। ব্যক্তি মালিকানার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে পুঁজিবাদ। সামন্ত স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে অবাধ প্রতিযোগিতার যুগে শাসন কাজ পরিচালনার জন্য পুঁজিপতিদের কোন অংশ দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে তা নির্ধারণের জন্য গড়ে উঠেছিল নির্বাচন ব্যবস্থা। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় এটাকেই বলা হয় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে শাসন। সামন্তসমাজ ভেঙে বুর্জোয়া ব্যবস্থা যখন পৃথিবীতে আসে সেসময় সেটি ছিল সবচেয়ে উন্নত পদ্ধতি। সেই সময় নির্বাচনগুলোও আজকের তুলনায় আপেক্ষিক অর্থে গণতান্ত্রিক ছিল। অবাধ প্রতিযোগিতার যুগ পার হয়ে সেই পুঁজিবাদ আজ একচেটিয়া রূপ নিয়েছে এবং তার ফলস্বরূপ রাজনৈতিক উপরি কাঠামোয় স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দিচ্ছে। এ কারণে অতীত দিনে যেভাবে গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতি সে মেনে চলত আজ সেভাবে চলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে ক্রমাগত জনগণের অধিকার সংকুচিত করছে। নির্বাচন শাসক পরিবর্তন ঘটালেও জনজীবনের ক্রমবর্ধমান সমস্যা-সংকটের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারছে না। এতে জনগণ ক্ষুব্ধ হচ্ছে, হতাশ হচ্ছে।
কিন্তু ক্ষুব্ধ বা হতাশ হলেই জনগণ এই নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। শাসনব্যবস্থার এই রীতিনীতির ফাঁকে তারাও আটকে গেছে। এর বিকল্প কিছু তারা জানে না। বুর্জোয়ারাও সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিভ্রান্তি তৈরি করে রেখেছে যে তাদের সমস্ত রকম আশা-আকাক্সক্ষার সমাধান এ ব্যবস্থার মধ্যেই সম্ভব। ফলে বুর্জোয়ারা যখন সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন দেয় তখন লক্ষ-কোটি মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। ক্ষুব্ধ এবং বিভ্রান্ত হয়েও অংশগ্রহণ করে। বিরাট সংখ্যক জনগণ যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, বিভ্রান্ত হয়েও অংশগ্রহণ করে, তখন আমরাও এতে অংশগ্রহণ করি। আমরা গণআন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে জনগণকে বোঝাতে চাই যে — নির্বাচনের মাধ্যমে, কিছু লোকের ক্ষমতায় যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে তাদের সমস্যার সমাধান হবে না। লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই তাদেরকে অধিকার আদায় করতে হবে। পাশাপাশি অনেক অপমান, ধোঁকাবাজির শিকার হওয়া সত্ত্বেও জনগণ যেহেতু এর বিকল্প কিছু ভাবতে পারছে না — এর সম্পূর্ণ অকার্যকারিতা তাদের কাছে যেহেতু তখনো স্পষ্ট নয় — তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও আমরা এই কথাগুলো বলি এবং নির্বাচন সম্পর্কে, এই ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের মোহ ভাঙার চেষ্টা করি। ‘এই যে এত সমস্যা সংকট, এত বৈষম্য — এসব কি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দূর হচ্ছে? একজন সৎ লোককে ভোট দিয়েই কি এই সমস্যার সমাধান হবে’ — জনগণের সামনে আমরা এই প্রশ্নগুলি নিয়ে আসার চেষ্টা করি।
নির্বাচনকে ঘিরে জনগণের মধ্যে কিছু আশা-ভরসা থাকে, অর্থাৎ ভোট এলেই তারা ভাবে যে, এইবার বুঝি একটা কিছু হবে, একটা পরিবর্তন হবে। কিন্তু অবধারিতভাবেই ভোটের পর তাদের সকল আশা-ভরসা ভেঙে যায়। আমাদের কথাগুলো তখন একটু-আধটু ভাবতে শুরু করে। এই যে জটিল ক্রিয়া-প্রক্রিয়া, এর মধ্য দিয়ে জনগণকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিটা ধরানোর জন্য আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি।
এখন বুর্জোয়া ব্যবস্থার এই নির্বাচন যদি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতি মেনে না চলে, কিছু কথা যদি এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা না যায় — তাহলে এতে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে একটি বামপন্থী-গণতান্ত্রিক শক্তি কি অর্জন করতে চায়? যে সব বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি এই ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেন, সেই সংগ্রামের অংশ হিসেবে এক্ষেত্রেও একটা ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেবেন — তাই হওয়া উচিত। নির্বাচনটা যদি শাসকদের ফ্যাসিবাদী শাসনকে পাকাপোক্ত করার উদ্যোগ হয় — তবে সেই বিপদের মাত্রা তো আরো বেশী করে ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের যৌক্তিকতাকে তুলে ধরে। আমাদের দল বাসদ (মার্কসবাদী) সহ গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা ভুক্ত বেশিরভাগ দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। অন্যান্য বামপন্থী দলগুলোর কাছেও সেই আহ্বান রেখেছে।
নির্বাচন করা ও বর্জন করা — এই দুই ইতিহাসই আমাদের আছে
আগে আমরা নির্বাচন করেছি, বর্জনও করেছি। এরশাদের স্বৈরশাসনের নয় বছর আমরা কোনো নির্বাচনে যাইনি। বিএনপির নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একদলীয় নির্বাচনেও আমরা যাইনি, যেমনিভাবে আওয়ামী লীগের গত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও আমরা যাইনি।
১৯৮৬ সালে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদ একটি নির্বাচন আয়োজন করে। বলাবাহুল্য তার স্বৈরশাসনের ন্যায্যতা দেয়ার লক্ষ্যেই সে এটি করেছিল। আওয়ামী লীগ, সিপিবি, ন্যাপ সহ কিছু বামপন্থী দল ও জামাতে ইসলাম এতে অংশগ্রহণ করে। আমাদের দলই সর্বপ্রথম এই নির্বাচন বর্জন করে। পরে আমাদের সাথে আরও কিছু বামপন্থী দল যুক্ত হয়। তাদের নিয়ে আমরা ৫ বাম দল গঠন করি। ৫ বাম দলের নির্বাচন বর্জন দেখে পরে বিএনপিও নির্বাচন বর্জন করে।
সে সময় আমরা জনগণের সামনে আমাদের অবস্থান তুলে ধরে বলেছিলাম, লক্ষ লক্ষ লোক এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তারা মারা যাচ্ছে, জেলে যাচ্ছে, রাস্তায় মার খাচ্ছে। এইসময় এরশাদেরই ডাকে নির্বাচনে যাওয়া মানে আন্দোলনের তেজকেই ধ্বংস করে দেয়া, আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা। সেইদিন নির্বাচন বয়কটের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের ধারাকে আমরাই রক্ষা করেছিলাম। ’৮৬ এর নির্বাচন একটি কলঙ্কিত নির্বাচন হিসেবেই ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে। এরশাদ স্থানীয় পর্যায়ে তার ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করতে উপজেলা নির্বাচনও করেছিল যা সকল গণতান্ত্রিক দল বর্জন করেছিল।
১৯৮৬ সালের সাথে বর্তমান সময়ের কিছু পার্থক্য আছে। এখন ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়াকে কেন্দ্র করে প্রধান বুর্জোয়া দলগুলো বিরোধে লিপ্ত। এই বিরোধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং আপাত সমঝোতা — দুটোরই বলি হচ্ছে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং কায়েম হচ্ছে ফ্যাসিবাদী শাসন। এই সিটি নির্বাচন সেই ফ্যাসিবাদী তৎপরতার অংশ।
কী করণীয়?
আওয়ামী লীগ সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় বলেছিল যে, সংবিধান রক্ষার জন্য তারা এই নির্বাচন করেছে। অচিরেই সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। কিন্তু দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের ব্যাপক সমর্থন থাকায় সে একাই গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করে আছে, নির্বাচনের কোনো প্রয়োজনীয়তাই সে দেখছে না। একচেটিয়া পুঁজিপতিদেরও আওয়ামী লীগের মতো দল দরকার যে কিনা একদিকে সমস্ত গণআন্দোলন কঠোরভাবে দমন করবে অপরদিকে জনগণকে বিভ্রান্ত করার ক্ষমতাও রাখে। একেই বলে ফ্যাসিবাদ।
এই ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের মনে প্রচন্ড বিক্ষোভ আছে। কিন্তু সঠিক বিপ্লবী ধারা ততটা শক্তিশালী না হওয়ায় তা ভাষা পাচ্ছে না। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ তার শাসনকে ন্যায্য ও যৌক্তিক করার জন্য এই নির্বাচন আয়োজন করল। যদিও এটা সিটি নির্বাচন, কিন্তু তার ডাকে সবাই এতে অংশগ্রহণ করলে তার শাসনেরই ন্যায্যতা তৈরি হবে। এভাবে চলতে থাকলে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি এবং জনগণ ভবিষ্যতে ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হবে। তাই জনগণকে আমরা আহ্বান করছি — এই নির্বাচন বর্জন করুন ও ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলুন। বামপন্থীদের প্রতিও আমরা ‘সর্বনিম্ন কর্মসূচি ও সর্বোচ্চ বোঝাপড়া’র ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণআন্দোলনে এগিয়ে আসার আবেদন তুলে ধরছি।