Sunday, April 28, 2024
Homeফিচারনভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে ঐকতান

নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে ঐকতান

Charon

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আমাদের দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরের এক দেশ মহান শৌর্য নিয়ে দাঁড়িয়েছিল পৃথিবীর বুকে। সেই শৌর্যের দ্বারা আলোড়িত হয়েছিল সারা দুনিয়া, আলোড়িত হয়েছিলেন দুনিয়ার মহান মানুষেরা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সে দেশে গিয়ে বলেছিলেন সেখানে না গেলে তাঁর এ জম্মের তীর্থ দর্শন হতোনা। মার্কিন সঙ্গীত শিল্পী পল রোবসন সে দেশকে বলেছিলেন নিজের দেশ। ফরাসি দার্শনিক রম্যা রঁল্যা সর্বহারার এই যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের বুকের উপর দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন। কবি জসিম উদ্দীন বলেছিলেন সে দেশের মানুষের বড়ত্বের কথা। এইচ জি ওয়েলস্, আইনস্টাইন, বার্নাড শ’, শরৎচন্দ্র, চ্যাপলিন, হ্যারল্ড লাস্কি, মেঘনাদ সাহা সহ প্রমুখ মনীষা শ্রদ্ধায় অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিলেন মনুষ্যত্বের ঝান্ডা তোলা দেশটিকে। মানুষকে উচ্চতম স্থানে পৌঁছিয়ে দেওয়া এই দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন। নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েতের মানুষ শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে যে অবিস্মরণীয় বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছিল তাতে বিশ্বের জ্ঞান তাপস মানুষ বিস্মিত, চমকিত হয়েছিলেন। মানুষের উপর মানুষের জবরদস্তির বিশ্বব্যবস্থাকে ভেঙে সোভিয়েতের এ বিপ্লব সচেষ্ট হয়েছিল সারা বিশ্বের মানুষকে মুক্ত করবার দৃষ্টান্ত স্থাপনে এবং পথপ্রদর্শনে।

বন্ধুগণ,
মধ্যযুগের ভাববাদ ও ধর্মের কুসংস্কারের জোয়াল কাঁধ থেকে নামিয়ে আধুনিক মানবতার অভ্যুদয় হয়। ইউরোপে নবজাগরণ ও শিল্পবিপ্লব তার অতুলনীয় নজির সৃষ্টি করেছিল। তার সুচনায় অসামান্য ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রমন্ডলীর আবির্ভাব ঘটেছিল। এ যুগ শুধুমাত্র অসামান্য পন্ডিত, শিল্পী ও কবিদেরই দেখেনি, সেই সঙ্গে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি জগতের মহাবিপ্লবীদেরও পেয়েছে। ভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জেলো, রঁদ্যা, ইস্কাইলাস, শেক্সপীয়র, গ্যাঁটে, মোঁপাসা, সুইফট, ডিফো, বালজাক, ইবসেন, রুশো, ভলতেয়ার, নিউটন, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, মোজার্ট, বিটোফেন প্রমুখ সমাজকে আলোকিত করেছিলেন। তাঁরা গেয়েছিলেন মানুষের মুক্তির জয়গান। রুশ দেশে জম্ম নিয়েছিলেন পুশকিন, গোগোল, দস্তয়ভস্কি, লিঁও টলস্টয়, লেরমন্টভ, চেখভ, তুর্কেনিভের মতো সাহিত্যিকেরা। সমাজের পট পরিবর্তনে আলোড়ন তুলেছিলেন তাঁরা। অর্থনীতির অবাধ যুগে তাঁরা ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তি চিন্তার ঝাণ্ডা তুলেছিলেন। কিন্তু মুষ্টিমেয় মানুষের কর্তৃত্বের সমাজ মানুষের চিন্তাকে যথার্থ মুক্তি দিতে পারে না। ফলে বিভেদের সমাজ তার টুঁটি চেপে ধরেছে, চিন্তার অগ্রগতিকে বাঁধাগ্রস্ত করেছে। পরবর্তীতে সোভিয়েত দেখাল মানুষের যথার্থ মুক্তি কোন পথে হতে পারে। একটা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পট পরিবর্তন মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের রাস্তাকেও অবারিত করলো।

বন্ধুগণ,
ইতিহাস ও বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে মহান চিন্তাবিদ কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস্ এমন এক দর্শন আবিষ্কার করলেন, যা মানব ইতিহাসে অভূতপুর্ব। সারা ইউরোপ তথা বিশ্বজুড়ে মজুরেরা মুক্তির পথ পেলো এ দর্শনে। কেবল মজুরেরা নয়, সকল শোষিত মানুষের সামনে এমন এক দৃশ্যকল্প হাজির হলো — যার মধ্য দিয়ে মানুষের উপর মানুষের শোষণের অবসান হবে। এ প্রথম মানুষ শিখলো মার্কসবাদ এক হাতিয়ার, যার মাধ্যমে মানুষ কেবল নিজের জন্য, পরিবারের জন্যই বাঁচবে না, বাঁচবে এক মানবমূখীন সমাজের জন্য। যা কেবল অর্থনৈতিক ভিত্তিটাকেই পাল্টে দিবেনা, পাল্টে দিবে মানুষগুলোকে। এর মাধ্যমে মানুষ চিনলো এক নতুন আদর্শকে, জাগরণ ঘটলো এক নতুন মূল্যবোধের। মার্কসের যে চিন্তা তাকে রুশ দেশে সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগের মাধ্যমে তার ভেতরকার সম্ভাবনাকে জাগ্রত ও বিকশিত করলেন লেনিন, পরবর্তীতে স্ট্যালিন। রুশ দেশে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যজ্ঞের অনুষ্ঠান দ্বারা সমাজ-সংস্কৃতি নতুন উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছালো। একইসাথে শিল্প-সাহিত্য তথা মানুষের মনন বিকাশের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাখলো সুস্পষ্ট ছাপ।

বন্ধুগণ,
রুশ দেশের সোভিয়েত বিপ্লব পৃথিবীকে কেবল কাঁপিয়ে দিয়েছে তা নয়, বদলেও দিয়েছে। এই বিপ্লব আশা দিয়েছে বিশ্বের বিবেকবান ও নিপীড়িত মানুষকে। এই আশা কেবল খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার আশা নয়। এই বিপ্লব মানুষকে যথার্থ স্বাধীন করেছে। প্রখ্যাত নাট্যকার ও চিন্তাবিদ বার্নাড শ’ সোভিয়েতের জনগণ সম্পর্কে বলছেন, “…প্রকৃতি তাদের যতটা স্বাধীনতা দিয়েছে ততটাই স্বাধীন আত্ম মর্যাদাসম্পন্ন জনতা…”। এই বিপ্লবের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিপ্লবের পক্ষে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন উচ্চসংস্কৃতির মানুষ। শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান তথা সংস্কৃতির প্রতি ক্ষেত্রে সোভিয়েত দেখাল শৌর্য। চলচ্চিত্র-নাটক-সঙ্গীত-নৃত্য-চিত্রকলা সহ শিল্পের প্রতিটি শাখাকে সোভিয়েত অন্যরকম উচ্চতায় হাজির করলো। সমস্ত পৃথিবীতে এমনকি তথাকথিত উন্নত দেশেও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ শিল্পকলার উন্নতরূপ থেকে বঞ্চিত, সোভিয়েত সেখানে সমস্ত মানুষকে এক নব উৎকর্ষতায় জাগিয়ে তুলে সমস্ত সৌন্দর্য তার সামনে হাজির করলো। বিপ্লবের ছোঁয়ায় শিল্প সাহিত্যের প্রতি শাখায় আবির্ভাব হল বড় বড় চরিত্রের। সাহিত্যে গোর্কী, আলেক্সী টলস্টয়, শলোকভ, মায়াকভোস্কি, মার্সাক; থিয়েটারে স্তানিস্লাভস্কি, মেয়ারহোল্ড, দানচেংকো চলচ্চিত্রে আইজেনস্টাইন, পুদভকিন, দভচেংকো, কজিন্টসেভ; সঙ্গীতে শস্টাকোভিচ, প্রকোভিয়েভ প্রমুখ সমাজে আলোক প্রজ্বলনে ভূমিকা নিলেন। জারের অন্ধকার যুগ থেকে সঙ্গীত, চিত্রকলা, নৃত্যকলা কে মুক্ত করলো সোভিয়েত। থিয়েটারে, চলচ্চিত্রে তত্ত্বগত ক্ষেত্রেও সোভিয়েত পুরো দুনিয়াকে পথ দেখালো। সমস্ত শিল্পেই সোভিয়েত মানুষের কথা হাজির করলো সৌন্দর্যের রূপেই। সোভিয়েতের লড়াকু শিল্পী-সাহিত্যিক-দার্শনিকেরা গোটা দেশের মানুষের সামনে যেমনি শিল্প-সাহিত্যের সৌন্দর্য হাজির করলেন তেমনি গোটা জাতিকে সব দিক থেকে এগিয়ে নিতে রাখলেন ভূমিকা। সোভিয়েত রাষ্ট্রকে জাগিয়ে তোলার কর্মযজ্ঞে যোগ দিলেন তাঁরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসী ফ্যাসিবাদী বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে তাঁদেরও ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা।

বন্ধুগণ,
শোষণ-অত্যাচার-বঞ্চনার অবসানে নতুন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে মানুষের জয়যাত্রা। অগণিত মানুষের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম, জীবনদানের মধ্য দিয়ে রচিত হয় ইতিহাসের গতিপথ। এই ইতিহাসে মহত্ত্বম লড়াইয়ের স্বাক্ষর রেখেছে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত বিপ্লব। এ বছর সোভিয়েত বিপ্লবের শতবর্ষ। শতবর্ষে এসেও বেঁচে আছেন লেনিন, বেঁচে আছে নভেম্বর বিপ্লব। সোভিয়েত ইউনিয়ন মানুষের উপর মানুষের জবরদখল রদ করেছিল। মানুষের প্রতিভা ও সৃজনীশক্তির স্ফুরণ ঘটিয়ে প্রকৃত সংস্কৃতির অধিষ্ঠান ঘটিয়েছিল সমাজে। অপমান-লাঞ্ছনা-হীনমন্যতার শিকড় উপড়ে সোনার সন্তান জন্ম দিয়েছে যে সমাজ, আমরা চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সে সমাজ স্মরণ করি। আমরা সে মহাবিপ্লব স্মরণ করি যার আগুন বিশ্বব্যাপী আজও মানুষের অন্তরে জাজ্বল্যমান। নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি সারা দুনিয়াজুড়ে মানুষের বিকাশের সমস্ত পথ আজ অবরুদ্ধ। মানুষের মানবিক চিন্তার মনকে সম্পূর্ণ গুড়িয়ে দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী মনন। মানুষকে নৈতিকভাবে অধপতিত করে তার পুরো জীবনি শক্তি নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র একটি সুস্থ সংস্কৃতিসম্পন্ন মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কাজ করে যাচ্ছে। তার অংশ হিসেবে শতবর্ষে নভেম্বর বিপ্লবের মহত্ত্বকে ধারণ করে আমাদের এই প্রয়াস।

নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে

ঐকতান

২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ শুক্রবার
দুপুর ২টা ৩০মি
স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর, টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments