“প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত
দেখো আজ তারা সবেগে সমুদ্যত
তাদের দলের পিছনে আমিও আছি
তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি বাঁচি”
– সুকান্ত ভট্টাচার্য
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর, ১৯১৭। ইউরোপে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান সংগঠিত হলো। কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ লেনিনের নেতৃত্বে রুশদেশের ‘ঘৃণিত ও পদানত’র দল মাথা তুলে দাঁড়ালো। দীর্ঘদিনের জবরদস্তির অবসান ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো শ্রমিকরাজ সোভিয়েত ইউনিয়ন। রুশ দেশে নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণির এ উত্থান দুনিয়াজুড়ে মেহনতি মানুষের সামনে এক অভূতপূর্ব সাফল্যের নজির স্থাপন করল। বছরের পর বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে শ্রমিকশ্রেণির নিরঙ্কুশ বিজয়ের নাম নভেম্বর বিপ্লব। এ বিপ্লবের রাজনৈতিক দিকটি যেমন পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল, তেমনি এর সাংস্কৃতিক দিকটিও আলোচিত হয়েছে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের লেখায়। বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ার সাহিত্যে আমরা এই অনাগত সংস্কৃতির প্রতিফলন দেখতে পাই। সামন্তবাদ-পুঁজিবাদে পিষ্ট সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের নির্মম পরিণতির দিকটি নিখুঁতভাবে সাহিত্যে তুলে ধরেছেন তুর্গেনেভ, টলস্টয় প্রমুখ সাহিত্যিকেরা। ম্যাক্সিম গোর্কির বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘মা’ এমন এক সমাজকে তুলে ধরেছে যেখানে শ্রমিকের ক্লেদাক্ত-অবমাননাকর জীবন থেকে মুক্তির সংগ্রামে সন্তান সহযাত্রী করেছে মা-কে। মুক্তির যাত্রাপথে অক্ষরজ্ঞানহীন, ভীরু মা হয়ে উঠেছিল শ্রেণিযুদ্ধে সাহসের প্রতীক। অতীতের অসহায় মাতৃত্ব রূপান্তরিত হয়ে বিকশিত হয়েছে সর্বজনীন মাতৃত্ব। আবার বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি কেবল ধনিক ও মুষ্টিমেয় অভিজাত শ্রেণির সম্পত্তি হয়ে থাকেনি। কেবল সোভিয়েত শিল্প-সাহিত্যই নয়, বিশ্ববিখ্যাত শিল্পের দুয়ার সাধারণ মানুষের সামনে অবারিত হয়েছে। বৈশ্বিক ভাবসম্পদের অধিকারী হয়েছে কুলি-মজুরের দল। নতুন সমাজের নতুন সংস্কৃতি নির্মাণে ব্রতী হয়েছেন শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা। এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে গড়ে ওঠা সোভিয়েতের নতুন সংস্কৃতিসম্পন্ন জনগণের সামনে পরাস্ত হয়েছে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর অন্যায় যুদ্ধ।
বিশ্ববরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা সোভিয়েত দেশ কেবল পর্যবেক্ষণই করেননি, তাঁরা সন্ধান পেয়েছিলেন এক নতুন সংস্কৃতির মানুষের। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন সোভিয়েত ছেলেমেয়েদের তুলনা করেছেন রাজকুমার-রাজকন্যার সাথে যাদের হদিস মেলে কেবল রূপকথায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নতুন দেশের কর্মযজ্ঞে উদ্বুদ্ধ হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিদর্শনকে তীর্থদর্শনের সমতুল্য বলে মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে আমাদের দেশের শিল্পসাহিত্যে নভেম্বর বিপ্লবের তরঙ্গ আছড়ে পড়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্যসহ অনেকেই সাহিত্যে সাম্যবাদের ভাবাদর্শ তুলে ধরেছেন। বাংলা সাহিত্য নভেম্বর বিপ্লবের আলোক রশ্মিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আমরা চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ইতিহাসের সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে স্মরণ করছি যে অধ্যায়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে সত্যিকারের মানুষের উত্থান ঘটেছিল। বিকশিত হয়েছিল এক নতুন সংস্কৃতি, যার অসামান্য সৃষ্টি সোভিয়েত নাটক-চলচ্চিত্র-ব্যালে-নৃত্য-সাহিত্যে প্রকাশিত হয়েছিলো। যে অধ্যায় শিল্প ও শিল্পীকে যথার্থ মূল্যায়ন করেছে। প্রতিভা-মেধার বিকাশকে উৎসাহিত করে মানুষকে বাঁচার পথ দেখিয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ আমরা ‘নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে ঐকতান’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে সম্মানিত আলোচকবৃন্দের বক্তব্য এবং সোভিয়েত সংস্কৃতি জগতের চিত্র খানিকটা আমরা তুলে ধরতে চেয়েছি এই প্রকাশনার মাধ্যমে। এই প্রয়াসে আপনাদের মতামত ও সহযোগিতা আমাদের ঋদ্ধ করবে।
ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য সোমা
ইন্চার্জ
চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
সূচীপত্র__________________________________________________
-
আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম জারি রাখা জরুরি – কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী
-
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম – সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
-
ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ – মানস নন্দী
-
রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষে রচিত গান
-
আইজেনস্টাইন ও তাঁর সৃষ্টি এবং ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’ – মেজবাহ উদ্দিন
-
সোভিয়েত শিশু সাহিত্য: সাহিত্যের সেই নতুন ধারা – সুজয় চৌধুরী সাম্য