দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে মানুষ বসবাস করছে। একদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সকল পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধির কারণে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, অন্যদিকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়া–এই পরিস্থিতিতে এ দেশের মানুষ আজ একেকটা দিন অতিক্রম করছে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে দেশের শ্রমিক-কৃষকসহ মেহনতি মানুষ যারা প্রকৃতপক্ষে নিজের শ্রম দিয়ে এই উৎপাদন করে। তাদের সস্তা শ্রম শোষণ করে ব্যবসায়ী-পুঁজিপতিশ্রেণি সম্পদের পাহাড় গড়েছে। কোটিপতি, অতিধনীদের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। অপরদিকে বেঁচে থাকার মতো মুজুরির জন্য শ্রমিকরা রাস্তায় নামছে, পুলিশের মার খাচ্ছে। এই তীব্র মূল্যবৃদ্ধির বাজারে শ্রমিকদের আয় একটুও বাড়েনি। তারা মজুরি কম পাচ্ছে, অভুক্ত থাকছে। তাদের কাজের নিশ্চয়তা নেই, চিকিৎসা নেবার সামর্থ্য নেই। অগ্নিকাণ্ডে, ভবন ধ্বসে, সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে তারাই। তাদের শ্রমে দেশ চলে, অর্থনীতির চাকা ঘুরে। অথচ দেশের মধ্যে তারাই সবচেয়ে অনিরাপদ, তাদের ভবিষ্যতই সবচেয়ে অনিশ্চিত, তাদের জীবনই সবচেয়ে সস্তা।
এর বিপরীতে বড় বড় কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী গোটা দেশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের মুনাফার স্বার্থেই দেশের সমস্ত নীতি নির্ধারণ করা হচ্ছে। এই ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে, তাদের সমর্থনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, কিন্তু এই ক্ষুব্ধতাকে আন্দোলনের ভাষা দেয়ার মতো সঠিক রাজনৈতিক শক্তি যথেষ্ট পরিমাণ সাংগঠনিক সামর্থ্য নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেই।
ফলে জনমনে একটা হতাশা আছে। দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি। কিন্তু শ্রেণিগতভাবে বিএনপিও বৃহৎ ব্যবসায়ী শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্বকারী দল। আওয়ামী লীগের সাথে তাদের নীতিগত প্রভেদ নেই, কিন্তু ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে তারা জুলুমের শিকার হচ্ছে। বিএনপি’র নেতাকর্মীরা ব্যাপকভাবে নির্যাতিত হওয়ার কারণে মানুষ খানিকটা তাদের ব্যাপারে সংবেদনশীল। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও মূল্যবৃদ্ধিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক সংকট দূর হওয়ার কোন আশা নেই, দেশের মেহনতি মানুষের জীবন পরিবর্তনেরও কোন সম্ভাবনা নেই।
এ সত্ত্বেও, ক্ষমতায় যে-ই আসুক না কেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ত্যাগ ও দ্রুত একটি আপেক্ষিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এখন সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক দাবি। কারণ পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার মধ্যেও জনগণের যতটুকু প্রতিনিধিত্ব থাকে সেটা থেকেও তাকে বঞ্চিত করার কারণে মানুষের মর্যাদা আহত হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক প্রশ্ন অর্থনৈতিক প্রশ্নের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই দেখা যাচ্ছে এই মুহূর্তে সরকারবিরোধী যত জোট কিংবা দলই থাকুক না কেন, প্রধান দাবি সকলেরই এক, সেটি হলো–নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
আওয়ামী লীগের দিক থেকে একটি সাজানো নির্বাচনেরই পাঁয়তারা চলছে। এটা ঠেকাতে হলে ও নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হলে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করতে হবে। বাধ্য করা যায় আন্দোলনের মাধ্যমে। কিন্তু বাধ্য করার মতো সেই পরিমাণ তীব্রতা নিয়ে গণআন্দোলন দেশে অনুপস্থিত।
গণতান্ত্রিক আন্দোলন কাঙ্ক্ষিত তীব্রতা নিয়ে গড়ে না উঠায় আন্দোলনে যুক্ত দলসমূহের উপর তার লক্ষণীয় প্রভাব দেখা যায়। বিরোধী প্রায় সকল দলের দাবি এক হওয়ায় জোটগত আন্দোলনের ক্ষেত্রে জোটকে বিস্তৃত কিংবা পুনর্বিন্যাস করা কিংবা অপরাপর আন্দোলনরত জোটগুলোর সাথে যুগপৎ আন্দোলন করা যায় কিনা সেই প্রশ্ন আন্দোলনের সামনে আসে এবং সেটা আসাই স্বাভাবিক। সকলেরই আশু দাবি যেহেতু আওয়ামী লীগের পতন ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন–সেহেতু এই প্রশ্ন আসে যে, প্রশাসনিক দমন-পীড়ন যখন এত তীব্র, তখন সকল আন্দোলনরত সকল শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত নয় কি?
বিএনপি বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দল এবং আওয়ামী লীগের সাথে তাদের নীতিগত প্রভেদ নেই। আবার বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে একইভাবে বিচার করা চলে না। আওয়ামী লীগ এক যুগের বেশি সময় ধরে ফ্যাসিবাদী শোষণ চালাচ্ছে, আর বিএনপি বিরোধী দল। তাদের নেতাকর্মীরা নির্যাতিত, নিপীড়িত। ফলে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে কোন রাজনৈতিক বক্তব্যের লক্ষ্যবস্তু থাকবে আওয়ামী লীগ। কারণ পুঁজিবাদী শোষণ পুঁজিপতি-ব্যবসায়ী শ্রেণি চালাচ্ছে রাষ্ট্রের মাধ্যমে। আর সেই রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। ফলে গণতন্ত্রের কথা যখন বলা হয়, তখন এই মুহূর্তে গণতন্ত্রকে কারা হরণ করছে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়। বিএনপি’র কথা উল্লেখ করা যায় গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ভবিষ্যৎ সতর্কতা হিসেবে। অর্থাৎ যখন এই ফ্যাসিবাদী শাসনের সমাধানের প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে হাজির হয়, তখন বিএনপি যে সমাধান নয়, বরং সে এই গোষ্ঠীরই সহযোগী শক্তি–এই সত্য মানুষের সামনে স্পষ্ট করার প্রয়োজনে বিএনপি’র কথা আসে। কিন্তু আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে প্রধান লক্ষ্য না করে কেবল দ্বিদলীয় বৃত্ত ভাঙার বক্তব্য দেয়া মানে সুনির্দিষ্ট যে দলের নেতৃত্বে চলমান দুঃশাসন চলছে তাকে আড়াল করা। আবার ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের মধ্যে লড়াইরত শক্তির মধ্যে কারা আপাত অর্থে গণতান্ত্রিক শক্তি, কারা ফ্যাসিবাদেরই আরেক অংশ–তা চিহ্নিত করা দরকার। লড়াইয়ের ময়দানে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করার কাজ বামপন্থী শক্তির। অন্যরা এই কাজ করবে না। কারণ তারা কোন না কোনভাবে ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়। আগে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ হঠাও, পরে আলোচনা হবে–এই তাদের মূল বক্তব্য। এই কাজ করে বামপন্থীদের চলে না। কারণ সে জানে যে শুধু ক্ষমতার হাতবদল করে সমাধান আসবে না। জনগণ আরও গভীরতর সংকটে নিমজ্জিত হবে। ফলে আজ একে হটাও, কাল তাকে হটাও–এই হটানোর রাজনীতিতে মুক্তি আসবে না। কিন্তু এও ঠিক ফ্যাসিবাদকে পাকাপোক্ত করছে যে দল, যে দল দেশের প্রত্যেকটি স্তরে ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে–তাকে হটালে রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রগত কোন পরিবর্তন না হলেও কর্তৃত্বটা দুর্বল হয়, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এই সময়ে একটু বিকাশের রাস্তা পায়। ফলে হটানোর স্লোগান বামপন্থী শক্তিকেও দিতে হয়, কিন্তু অবশ্যই কাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে সেটা উল্লেখ করে।
এই সময়ে নিরপেক্ষ সরকারের দাবির সাথে সাথে আরও কিছু দাবি তোলা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইতিমধ্যেই শাসকশ্রেণি সংবিধানকে বারবার কাটাছেঁড়া করেছে। সংবিধানের ভূমিকা হওয়ার কথা ছিলো গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর রক্ষাকবচ হিসেবে। অর্থাৎ কোন শাসকদল জনগণের ম্যান্ডেট পেলেও যা ইচ্ছা তাই যাতে না করতে পারে সেজন্য সংবিধান। কিন্তু এখন সংবিধান সংশোধন করে এর মাধ্যমেই সকল অন্যায়কে বৈধতা দেয়ার কাজ চলছে। ফলে অন্যন্য যেসকল দাবি বিভিন্ন সময়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিভিন্ন দল থেকেও তোলা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারেও জনমত সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ। এরমধ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার করে সকল রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার দেয়া, নির্বাচনে অর্থ ও পেশীশক্তির ব্যবহার বন্ধ করা, নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ পর্যাপ্ত ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মক্ষম সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন, নির্বাচনে ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা ও আঞ্চলিকতার ব্যবহার বন্ধ করা ইত্যাদি সংস্কার নির্বাচনী ব্যবস্থায় আনা দরকার। তা না হলে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই সেটি সুষ্ঠু হবে না।
এই দাবিগুলো নিয়ে রাজপথে লড়াই গড়ে তোলা উচিত। আবার এটাও বলা দরকার, যত সুষ্ঠু নির্বাচনই হউক না কেন, তা দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবনের কোন পরিবর্তন ঘটাবে না। নির্বাচন এই পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এরজন্য দরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন। এই মুনাফাভিত্তিক, শোষণমূলক, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া শ্রমজীবী মানুষের অবস্থার কোন পরিবর্তন আসবে না। এজন্য লড়াই তাদেরকে করতেই হবে। আপেক্ষিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়ে সরকার পরিবর্তনই হউক আর বিদ্যমান শাসন দীর্ঘস্থায়ীই হোক–লড়াই ছাড়া তাদের মুক্তি নেই। এই পরিবর্তনগুলো লড়াইয়ের উপর আক্রমণের তীব্রতার কিছুটা পরিবর্তন করতে পারে, লড়াইয়ের গতিকে তীব্র ও শ্লথ করতে পারে–এটুকুই। ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নির্বাচনসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে লড়াই চালাতে হবে, পাশাপাশি এই ব্যবস্থার শোষণের সবচেয়ে বেশি শিকার যে শ্রেণি, তাকে সুশিক্ষিত করে এই ব্যবস্থা ভেঙে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত। এই শ্রেণির মুক্তির মধ্য দিয়েই সমস্ত রকম শোষণ ও পরাধীনতার অবসান ঘটবে।