ক্ষমতা ও ভোটের রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিচ্ছে
গত ১৫ নভেম্বর বরিশালের চর কাউয়ায়, ৫ নভেম্বর লালমনিরহাটে, ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়ায় বনগ্রামে এবং ইতোপূর্বে গাজীপুরের শ্রীপুর, নোয়াখালী, রংপুরের মিঠাপুকুর, খুলনার দৌলতপুর, বগুড়ার শেরপুর, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন স্থানে হিন্দুসম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে, নওগাঁ, জয়পুরহাট সহ বিভিন্ন স্থানে সাওতাল জনগোষ্ঠীর ওপর এবং কক্সবাজার, টেকনাফ-উখিয়া খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বর হামলা পরিচালিত হয়েছে।
বুর্জোয়া বড় দুই দল এবং তাদের সহযোগিদের ক্ষমতা ও ভোটের রাজনীতির নীতিহীন চর্চা সমস্ত রকমের অগণতান্ত্রিক পশ্চাদপদ ধ্যান-ধারণা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদী চিন্তার প্রসার ঘটিয়ে চলেছে। এই দলগুলোর ছত্রছায়ায় কায়েমী স্বার্থবাদী ও সন্ত্রাসীরা নানা সময়ে হিন্দু-বৌদ্ধসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, গারো-সাওতালসহ পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, তাদের সম্পদ দখল ও লুট করে চলেছে। এরই অংশ হিসেবে এসব হামলা ও লুটপাট চলছে। নির্বাচনকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক হামলাও নতুন মাত্রা নিয়েছে।
ধর্মীয় গুজব ছড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সমগ্র বিষয়টি সরেজমিনে পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের প্রতিনিধি দল গত ১৭ নভেম্বর বরিশালের কাউয়ার চর এবং ৭ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়ায় সাম্প্রদায়িক হামলায় আক্রান্ত বনগ্রাম সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পাবনার প্রতিনিধি দলে ছিলেন বাম মোর্চার সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ও জুলহাসনাইন বাবু, বাম মোর্চার স্থানীয় কর্মী-সংগঠকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনকালে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যুক্ত হন। নেতৃবৃন্দ বনগ্রামে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাবলু সাহা, সুকুমার বিশ্বাসের বাড়ীসহ এলাকায় আক্রান্ত বাড়িঘর, মন্দির ও স্থানীয় বাজার পরিদর্শন করেন এবং আক্রান্ত পরিবারসমূহের সদস্যসহ এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে কথা বলেন। ঢাকায় ফেরার পথে সন্ধ্যায় বেড়ায় স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথেও নেতৃবৃন্দ মতবিনিময় করেন।
নেতৃবৃন্দ তাদের পর্যবেক্ষণসমূহ তুলে ধরতে ঢাকায় ফিরে গত ৯ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে মিলিত হন। সাম্প্রদায়িক হামলা ও লুটপাট সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা পেতে পাঠকদের সাহায্য করবে বিবেচনায় এখানে তা তুলে ধরা হল।
সাঁথিয়ায় সাম্প্রদায়িক হামলা সম্পর্কে বাম মোর্চার সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য
ক) ধর্মীয় অবমাননার পুরোপুরি মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে এই হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। বনগ্রামসহ আশেপাশের গ্রামের ১৫ থেকে ২৫ বছরের তরুণ যুবকরাই প্রধানত এই হামলায় অংশগ্রহণ করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের তুলনামূলকভাবে ধনাঢ্য পরিবারসমূহের বাড়িঘর ও তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দির ছিল আক্রমণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের প্রধান লক্ষ্য।
খ) সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা চারটা পর্যন্ত এই হামলা অব্যাহত থাকে। পাবনা শহর থেকে বনগ্রাম আধাঘণ্টার রাস্তা হলেও ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছায় দুই ঘণ্টা পর। পুলিশ পৌঁছানোর দুই/তিন ঘণ্টা পরও দুর্বৃত্তদের লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত থাকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালনে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর নিজের নির্বাচনী এলাকার যদি এই পরিণতি হয় তাহলে গোটা দেশের মানুষ কতটা নিরাপত্তাহীন তা সহজেই অনুমেয়। এই ঘটনার নৈতিক দায়দায়িত্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার সরকারের।
গ) আক্রান্ত পরিবারসমূহের সদস্যরা জানিয়েছেন হামলাকারীদের মূল পান্ডারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দল অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্কিত। স্থানীয় বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের কর্মী-সমর্থকেরাও হামলা ও লুটপাটে অংশগ্রহণ করে। আক্রান্তরা হামলায় ইন্ধনদাতা ও নেতৃত্বদানকারী হিসাবে যাদেরকে চিহ্নিত করেছেন এই পর্যন্ত তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়নি। আই-ওয়াশ হিসাবে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার মধ্যে সাধারণ মানুষই বেশী। সরকারী ছত্রছায়ায় মূল অপরাধীরা এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঘ) হামলা-আক্রমণের পিছনে চাঁদাবাজি, লুটপাট ও দখলের মতো বিষয়সমূহ কাজ করলেও আগামী ভোটকে সামনে রেখে নানামুখী রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিও কাজ করছে বলে এলাকার মানুষের ধারণা।
ঙ) রামুর ঘটনার সাথে সাঁথিয়ার ঘটনার মিল দেখা যায়। রামুর ঘটনার হোতাদের গ্রেফতার ও বিচার না হওয়ায় সাঁথিয়ায় ও হামলাকারী দুর্বৃত্তরা উৎসাহিত হয়েছে। লালমনিরহাটের মাঝিপাড়া, কালীগঞ্জ, পাটগ্রাম, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি, ফরিদপুরের ভাঙ্গাবাজার, দিনাজপুর, রাজশাহী মহানগরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পরিকল্পিতবাবেই আক্রমন চালানো হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিরোধ জোরদার করতে না পারলে এই ধরনের ঘটনা আরো বিস্তৃত হবার আশংকা রয়েছে। শাসকশ্রেণীর দলগুলো কেউ ক্ষমতায় থাকা আর কেউ ক্ষমতায় যেতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই সমস্ত ঘটনাকে নানাভাবে কাজে লাগাতে তৎপর রয়েছে।
চ) সাঁথিয়ায় আক্রান্ত পরিবারসমূহ এখনও মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। এলাকায় র্যাব ও পুলিশ মোতায়ন করা হলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে এখনও ভয় ও আতংক কাজ করছে।
জরুরি দাবিসমূহ
(১) সাঁথিয়ায় হামলাকারীদের যে রাজনৈতিক পরিচয়ই থাকুক না কেন- চিহ্নিত সকল অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুকে এখুনি পদত্যাগ করতে হবে।
(২) উসকানিদাতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান ও তাদের প্রয়োজনীয় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৩) সাঁথিয়াসহ আক্রান্ত অঞ্চলসমূহে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সাঁথিয়ার বনগ্রামে স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনকে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণে প্রস্তুত থাকতে হবে।
(৪) এই ধরনের ঘটনায় রাজনৈতিক ইন্ধনদাতা চক্রকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(৫) সাম্প্রদায়িক হামলা-আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশের সকল গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক ও বিবেকবান শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ জোরদার করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাম মোর্চার সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এবং উপস্থিত ছিলেন মোর্চার কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্দিকুর রহমান, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, আব্দুস সাত্তার, সহিদুল ইসলাম সবুজ, মহিনউদ্দিন চৌধুরী লিটন, এড. আবদুস সালাম, বহ্নিশিখা জামালী, শামীম ইমাম, মানস নন্দী প্রমুখ।
সাঁথিয়া ও মহেন্দ্রনগরে সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করুন
সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী এক বিবৃতিতে বলেন, “দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের সুযোগে এবং ভোটের রাজনীতির প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়েছে এবং এর সুযোগ নেয়ার জন্য মহাজোট ও ১৮ দল – এ দুই জোটই তৎপর। পাবনার সাঁথিয়ায় ও লালমনিরহাটের মহেন্দ্রনগরে যা ঘটে গেল তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একদল গুজব ছড়িয়ে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকে দিচ্ছে, আর একদল এই ভয় ও আতঙ্ককে কাজে লাগাচ্ছে – দুদলই তা করছে ভোট পাওয়ার জন্য। এর অসহায় শিকার হচ্ছে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তা না হলে এত বড় বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে দেশে, সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই, এরকম একটা সংঘাত আশঙ্কা করার পরও সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, ঘটনা ঘটার পরও পুলিশের উপস্থিতি চোখে পড়ে না কেন? আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি কেউ এর দায় এড়াতে পারে না। আসলে বাস্তবতা হলো এই যে, এই সহিংসতাকে কেন্দ্র করে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো যে যার যার মতো করে ফায়দা তুলতে ব্যস্ত। ফলে এই দলগুলোকে দিয়ে এ ধরনের জঘন্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মোকাবেলা করা যাবে না। কারণ এটাই তাদের রাজনীতি । দেশের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষকে তাই কালক্ষেপণ না করে নিজেদের স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে হবে এবং এই ধরনের সহিংসতা রুখে দাঁড়াতে হবে। বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে একে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। জনগণের নিজস্ব শক্তিই একমাত্র সাম্প্রদায়িকতার এই ভয়াবহ সংকট থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে।”
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী সাম্প্রদায়িক আক্রমণ প্রতিরোধে দলের সমস্ত নেতাকর্মীদের সারাদেশের এলাকায় এলাকায় গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষকে যুক্ত করে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার আহ্বান জানান।
রংপুরে বাসদের মানববন্ধন ও সমাবেশ
পাবনার সাঁথিয়া, মহেন্দ্রনগর, রংপুর মিঠাপুকুরের চৌধুরী গোপালপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর ও মন্দিরে হামলার প্রতিবাদে গত ৭ নভেম্বর বাসদ রংপুর জেলা শাখার উদ্যোগে প্রেসক্লাব চত্বরে বিকেল ৪ টায় মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বাসদ জেলা শাখার সমন্বয়ক আনোয়ার হোসেন বাবলুর সভাপতিত্বে সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মলয় কিশোর ভট্রাচার্য, বাসদ নেতা পলাশ কান্তি নাগ, ছাত্রনেতা আহসানুল আরেফিন তিতু।