Sunday, April 28, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - নভেম্বর ২০১৩৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির আন্দোলন এগিয়ে নিন

৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির আন্দোলন এগিয়ে নিন

মালিক-সরকারের চক্রান্ত প্রতিহত করুন

গার্মেন্ট শ্রমিকরা ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে। শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করতে একদিকে পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি এবং মালিকের পোষা সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হচ্ছে, অন্যদিকে শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করতে সরকার ও মালিকশ্রেণীর দালাল সংগঠনগুলো নানা আপসকামী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নিম্নতম মজুরি বোর্ড কর্তৃক ৫৩০০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠন প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু মালিকরা কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে শ্রমিকদের ভয় দেখাতে চাইছে, সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে চাইছে। এ পরিস্থিতিতে গার্মেন্ট শ্রমিক এবং শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে লড়াকু শ্রমিক সংগঠনগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে চলমান আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া।

বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের পক্ষ থেকে ৫৩০০ টাকা নিম্নতম মজুরি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করার পাশাপাশি গত ১৪ নভেম্বর সকালে তোপখানা রোডে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ে আপত্তিপত্র পেশ এবং ৮ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণের দাবি পেশ করা হয়। ওই আপত্তিপত্রের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হল :
“দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে গার্মেন্ট শিল্পখাতকে শক্তিশালী করেছে। শ্রমিকের শ্রমের বিনিময়ে গার্মেন্ট বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান খাত। এই বঞ্চিত শ্রমিকরা একদিকে দেশের সম্পদ তৈরি করে; অন্যদিকে হরহামেশাই আগুনে পুড়ে মরে, ভবন ধসে মরে, বেশিরভাগ কারখানায় নেই নিরাপদ কর্ম পরিবেশ। এ শ্রমিকরা মাসের ঠিক সময়ে মজুরি পায় না, নিয়মানুযায়ী ওভারটাইম সুদূরপরাহত বিষয়। মাস শেষে যে মজুরি পায় তাতে জীবন চালানোই দায়, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে স্বাভাবিক মানবিক জীবন বলে তাদের কিছু নেই। সর্বোচ্চ মুনাফার কাঁটছাঁট হবে তাই মজুরি বাড়ানোতে মালিকদের আপত্তি। নিজেদের বিলাসব্যসনের শেষ নেই কিন্তু শ্রমিক বাঁচবে কি করে তার জবাব নেই তাদের কাছে। শ্রমিকের খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান নিশ্চিত করা মানে প্রকারান্তরে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা। শিল্পের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য শ্রমিকের সক্ষমতা বাড়ানো অপরিহার্য্য যা নিশ্চিত করতে পারে ন্যায্য মজুরি। কিন্তু আমাদের দেশের মালিকরা নগদ বোঝে।

নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মজুরি বোর্ড ‘শ্রমিকদের জীবনযাপন ব্যয়, জীবনযাপনের মান, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, কাজের ধরন-ঝুঁকি ও মান, ব্যবসায়িক সামর্থ্য, দেশের এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা’ বিবেচনা করার দাবি করেছেন। তাঁরা অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম সফর করেছেন। আমাদের মনে রাখা দরকার যে ২০১০ সালের মজুরি কাঠামো ন্যায্য ছিল না এবং তৎকালীন জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। শ্রমিকরা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। পুলিশি দমন-পীড়নের মাধ্যমে শ্রমিক বিক্ষোভ দমন করে তা শ্রমিকদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলে ২০১০ সালের মজুরিকাঠামোর সাথে তুলনা করে নয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে মনুষ্যোচিত মজুরি কত হওয়া উচিত তা বিবেচনা করে এবং গার্মেন্টস শিল্পের মুনাফা ও অগ্রগতির নিরিখে নিম্নতম মজুরি নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। এমতাবস্থায় নিম্নতম মজুরি বোর্ড ৫৩০০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করে যে প্রস্তাব শ্রম মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। জীবনযাত্রার ব্যয়, মূল্যস্ফীতি, বিশ্বব্যাংক ঘোষিত দারিদ্র্যসীমার আয়ের ওপরে মজুরি, অন্যান্য গার্মেন্ট রপ্তানিকারক দেশের মজুরিকাঠামোর সাথে তুলনামূলক বিবেচনা, গার্মেন্টস শিল্পের মুনাফার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মজুরি, গার্মেন্ট শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি কোনো মাপকাঠিতেই প্রস্তাবিত মজুরি যৌক্তিক নয়, শ্রমিকদের প্রত্যাশার সাথেও তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অর্থনীতিবিদ এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন হিসাব করে দেখিয়েছেন বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী একজন গার্মেন্ট শ্রমিকের বেতন ১৮০০০ টাকা হওয়া উচিত, সেখানে ৮০০০ টাকা মূল মজুরি দাবি তো সামান্যই।

মজুরি বোর্ডের বর্তমান প্রস্তাবে মূল মজুরি খুব অল্প ধরা হয়েছে। এর ফলে বাড়ি ভাড়া ভাতা (মূল মজুরির ৪০%) এবং ওভার টাইম ডিউটি বাবদ শ্রমিকদের পাওনা (ঘণ্টাপ্রতি মূল মজুরির দ্বিগুণ হারে) আনুপাতিক হারে কম হবে। এছাড়া এই প্রস্তাবে মূল মজুরি কম রেখে মোট মজুরির পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানোর উদ্দেশ্যে খাদ্য ভর্তুকি ৩০০ টাকা এবং যাতায়াত ভাতা ২০০ টাকা মোট মজুরির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ এখনই বহু কারখানায় মজুরির অতিরিক্ত হিসেবে শ্রমিকরা খাদ্য ভাতা বাবদ ৫০০-৭০০ টাকা এবং যাতায়াত ভাতা বাবদ ৩০০-৪০০ টাকা পায়।

ন্যূনতম প্রস্তাবিত ৫৩০০ টাকা মজুরি নিয়ে মালিকরা প্রত্যাখ্যানের নাটক করছেন, যাতে শ্রমিকরা জোর কণ্ঠে দাবি না তোলে এবং এর মধ্য দিয়ে সরকারের সাথে যেন দরকষাকষি করতে পারে। গার্মেন্ট মালিকরা প্রত্যক্ষ পরোক্ষ নানা সহযোগিতা সরকারের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। প্রয়োজনে তারা সংগঠিতভাবে সরকারকে চাপ দিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করে নিতেও সচেষ্ট হয়। কিন্তু গার্মেন্ট শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া, দাবি-দাওয়া পেশ করার পর্যন্ত উপায় নেই। এরকম একটি অবস্থায়, মজুরি বোর্ড কি শোষিত শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসবে না? আমরা মজুরি বোর্ডের বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রত্যাশা করি। আমরা মনে করি, শ্রমিকের বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনেই বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী ন্যূনতম মূল মজুরি ৮০০০ টাকা নির্ধারণ করা উচিত। মজুরি বোর্ড আমাদের আপত্তিপত্রের নিরিখে মজুরি পুনর্বিবেচনা করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”

গত ১৪ নভেম্বর সকাল ১১টায় বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিলসহ নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ে চেয়ারম্যান বরাবর আপত্তিপত্র পেশের পূর্বে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি জহিরুল ইসলাম, ঢাকা নগর শাখার সংগঠক ফখরুদ্দিন কবির আতিক ও কল্যাণ দত্ত। এসময় নেতৃবৃন্দ ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নিয়ে মালিক-সরকারের টালবাহানা, কারখানা বন্ধ করে দেয়া, বিক্ষোভরত গার্মেন্ট শ্রমিকদের পুলিশি নির্যাতনসহ মালিকগোষ্ঠীর স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের তীব্র নিন্দা জানান।

ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা ঘোষণার দাবিতে সিইপিজেড শ্রমিকদের বিক্ষোভ

Ctg_Garmentsঅবিলম্বে ইপিজেডে ন্যায্য মজুরি কাঠামো ঘোষণা করে সকল ধরনের কারখানায় হেলপারের মজুরি ন্যূনতম ৮০০০ টাকা, গার্মেন্টস অপারেটরের মজুরি ১০৫০০ টাকা এবং নিটিং অপারেটর ও টেক্সটাইল তাঁতীর মজুরি ১২০০০ টাকা ঘোষণার দাবিতে ৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম সিইপিজেড মোড়ে শ্রমিক অধিকার রক্ষা সামাজিক কমিটির উদ্যোগে শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি বাসদ নেতা রফিকুল হাসান। গার্মেন্টস শ্রমিক মণি চক্রবর্তীর পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন কমিটির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন, প্রচার সম্পাদক নিখিল কুমার,গার্মেন্টস শ্রমিক সাদিয়া, ইমরান, রুমেল, জাহিদুন্নবী, চন্দনা, জাহাঙ্গীর প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, ইপিজেডের বাইরের কারখানার জন্য সরকার ছয় মাস আগে মজুরি বোর্ড গঠন করেছে। অথচ ইপিজেড শ্রমিকদের জন্য আলাদা মজুরি কাঠামো ঘোষণার দায়িত্বে থাকা বেপজা এখনও নীরব। ইপিজেড শ্রমিকদের জন্য ২০১০ সালে সর্বশেষ মজুরি কাঠামো ঘোষিত হয়েছিল। ইতোমধ্যে ৩ বছর কেটে গেছে। দ্রব্যমূল্য, বাড়িভাড়া, পরিবহন ব্যয় সবকিছুই বেড়ে গেছে। ১২/১৪ ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম করেও মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।ctg_garments2

নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ইপিজেডকে আধুনিক কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। এখানে শ্রমিকদের ট্রেডইউনিয়ন করার, প্রতিবাদ করার, দাবি জানানোর কোনো অধিকার নেই। সমাবেশ থেকে বেপজা কর্তৃপক্ষের বরাবর স্মারকলিপি পেশের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল সিইপিজেডের আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে।

৬ মাস পার হলেও রানা প্লাজায় শ্রমিক গণহত্যার বিচার হয়নি

বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি জহিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক উজ্জল রায় এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, রানা প্লাজায় শ্রমিক গণহত্যার ৬ মাস পার হওয়ার পরও আজ অবধি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। নিহত-আহত শ্রমিকদের সারাজীবনের আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহতদের চিকিৎসা এবং নিহত-আহত শ্রমিকদের পরিবারকে পুনর্বাসনের দায়িত্ব পালনে সরকার চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, রানা প্লাজায় ভবনধসের মধ্য দিয়ে ১২ শতাধিক শ্রমিক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্বরতম গণহত্যার একটি। এই গণহত্যার জন্য দায়ী ভবন মালিক ও গার্মেন্ট মালিকদের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়নি, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে তাদের অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়নি। একইসাথে মালিকদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের জন্য অর্থ আদায় করতেও সরকার উদ্যোগ নেয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার নগ্নভাবে মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করেছে।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments