হঠাৎ করেই ভর্তি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার অসমতা দূর করতে এবং প্রত্যেকটি সিটের সদ্ব্যবহার করতে তৎপর হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অনেক ভেবে প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রত্যাহারই হতে পারে এর একমাত্র সমাধান। আগে পরপর দুই সেশনের শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারত। এখন ভর্তি পরীক্ষা দেবার সুযোগ পাবে কেবল সদ্য এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা। একইভাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থানকারী শিক্ষকদের যুক্তি হচ্ছে, দুই ব্যাচের পরীক্ষার সুযোগ থাকলে চলমান সেশনের ছাত্ররা পূর্ববর্তী সেশনের ছাত্রদের তুলনায় প্রস্তুতির সুযোগ কম পায়। এই অসম প্রতিযোগিতা দূর করতে চেয়েছেন তারা। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে তথাকথিত খারাপ বিভাগে চান্সপ্রাপ্ত ছাত্ররাও বিভাগ পরিবর্তনের জন্য দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভাগ পরিবর্তনের ফলে পূর্ববর্তী বিভাগে সিট খালি থেকে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সিটের দামও কি কম? সিটের এমন অপচয় রোধ করতে চায় প্রশাসন। কোচিং ব্যবসায়ীদের লাভ কমানোও প্রশাসনের আরেকটি বড় যুক্তি। যারা প্রথমবার পরীক্ষা দেবে তারা কোচিং বাণিজ্যের শিকার হয় তো হোক। তাই বলে, দ্বিতীয় বছর একই ছাত্রদের কাছ থেকে মুনাফা লুটবে কোচিং সেন্টারগুলো? কোচিং ব্যবসায়ীদের এতটা সুযোগ দিতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই জনহিতকর (!) সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থী-শিক্ষক-ছাত্র সংগঠনগুলোর পরামর্শ ছাড়াই গ্রহণ করেছে। অগণতান্ত্রিক উপায়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত কতটা ছাত্রস্বার্থপন্থী তাতে সন্দেহ থেকেই যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা কি হবে? বয়স, সেশন নাকি বিশেষ discipline এ পড়বার সামর্থ্য? বিশ্ববিদ্যালয় যদি হয় উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের প্রতিষ্ঠান তাহলে কোন যুক্তিতে বয়সের বিবেচনাকে একজন শিক্ষার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা হিসেবে যাচাই করা হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য সম্প্রতি এক টেলিভিশন টক শো-তে বলেছেন, দুই বার ভর্তির সুযোগ রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিলাসিতা হবে। একজন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা প্রতিষ্ঠানে পড়ার জন্য আবেদন করবে, পড়তে চাইবেÑএটা তার জন্য বিলাসিতা? শিক্ষাগ্রহণের সুযোগকে এভাবে বাধা প্রধান করার কোনো এখতিয়ার কি কারও আছে? এটা একজন মানুষের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার। বুয়েট ছাড়া অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যাঠয়ের শিক্ষার্থীরা পরপর দুই বার ভর্তি পরীক্ষা দেবার সুযোগ পায়। এখানে বয়সের ব্যবধান থাকে মাত্র একবছর। এই পার্থক্য কি কখনও ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে? বাইরের দেশে অনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির ক্ষেত্রে বয়স কোনো বিষয় নয়। সেখানে শিক্ষার্থীর মেধাগত যোগ্যতার দিকটিই প্রধান।
নতুন নতুন মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি না হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতা খুবই তীব্র। প্রতিবছর মাত্র প্রায় ৬০০০ আসনের বিপরীতে ভর্তি পরীক্ষা দেয় প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ পরীক্ষার্থী। ভর্তি পরীক্ষা তাই বাছাই নয়, ছাটাই প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেয়া যাবে না, এমন সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে গ্রাম ও মফস্বলের ছেলে- মেয়েরা। সকলেই জানেন, শিক্ষার ব্যয়ভার প্রবলভাবে বেড়ে যাওয়ায় গ্রাম ও শহরে পড়াশুনার পার্থক্য ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। তাই গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়াতেই আসতে পারে না। যারাও আসে তাদের বেশিরভাগেরই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পদ্ধতি, শহরে এসে কোচিং প্রভৃতির সাথে তাল মেলাতেই একটা বড় সময় লেগে যায়। এদের কেউ কেউ দ্বিতীয়বার টেকে প্রচ- অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের জোরে। দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ না থাকলে এদের মতো ছেলে মেয়েদের হয় ভিটেমাটি সব বিক্রি করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে, নয়তো সেশনজটের অভিশাপ নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে।
বলা হচ্ছে, প্রতিবছর সিট ফাঁকা থাকছে। তাই দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ দেয়া যাবে না। একটু গভীরে তাকালেই আমরা দেখতে পারব, কেন আসন ফাঁকা থাকে? সাধারণত তথাকথিত ‘বাজারমূল্যের’ অনুপোযোগী বিষয়গুলোতে পড়তে না চাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা দেয়। এই প্রবণতার কারণ কি? বিশ্ববিদ্যালয় যখন গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান হবার বদলে কেবলমাত্র বাজার উপযোগী বিষয়বস্তুর সার্টিফিকেট বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, তখন তার পরিণতি এই হয়। শিক্ষার্থীরা শিখতে যায় না, চাকুরির জন্য ডিগ্রি নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তাই চাকুরির জন্য সবচেয়ে উপযোগী বিষয়ে সে পড়তে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর না করলে এ থেকে পরিত্রাণ নেই।
যুক্তি করা হচ্ছে, সুযোগের সমতা আনতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই যুক্তি হাস্যকর, কেননা দুই বার ভর্তির সুযোগ থাকলেও দুই সেশনের দুই জন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দেবার সুযোগ দুইবারই পাবে। ফলে এখানে অসমতার কোনো সুযোগ নেই। আর উচ্চশিক্ষায় আসার আগেই একজন ছাত্রের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বৈষম্য আছে, সেগুলো দূর না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই টোটকা ব্যবস্থায় কোনো লাভ হবে না। কোচিং সেন্টার বন্ধের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। কোচিং বন্ধের নীতিমালা করেও সরকারের নাকের ডগায় কোচিং ব্যবসা চলে, সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় না। কোচিং বন্ধ হবে কি হবে না – এটা সম্পূর্ণ সরকারের দায়। ফলে যে দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের বা সরকারের পালন করার কথা, তার ব্যর্থতা কেন সাধারণ শিক্ষার্থীর ঘাড়ে এসে পড়বে?
আমরা এমন এক সমাজব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি, যেখানে জীবনের প্রতি পদে পদে বঞ্চনা। কারণে অকারণে মানুষের অধিকার সংকোচিত করা হয়। অনেক সময় এর যথার্থ কারণ না বুঝে নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হই। এখন যেমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটা সিদ্ধান্তের কারণে ২০১৪ এবং ২০১৫ সেশনের শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ নিয়ে পরস্পর প্রতিযোগী। আসলে পায়ের মাপে জুতো না বানিয়ে জুতোর মাপে পা বানালে যে বিপত্তি ঘটে, আমাদের হয়েছে তাই। শাসকরা আমাদের শিক্ষা গ্রহণের প্রবল আকাক্সক্ষাকে অধিকার হিসেবে না দেখে, সুযোগ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। ফলে সীমিত সুযোগের মধ্যে নানা শর্তারোপ করে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। একটা মুনাফাভিত্তিক সমাজে শাসকের সমস্ত পরিকল্পনার মূল কেন্দ্র থাকে মুনাফাকে সর্বোচ্চ করা। এখন যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ বাতিল করা হচ্ছে, তা অনিবার্যভাবেই দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সুদিন ঢেকে আনবে, পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ার সুযোগ সীমিত হলে শিক্ষা বাণিজ্যের পথকে সুগম করা যাবে। এরকম দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শাসকরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে এমন পরিকল্পনা করছে।
অনুশীলন : অক্টেবর ২০১৪ || সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট