Friday, April 19, 2024
Homeঅনুশীলনজাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : প্রধানমন্ত্রীর নতুন ঘোষণা ও আমাদের কথা

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : প্রধানমন্ত্রীর নতুন ঘোষণা ও আমাদের কথা

1904091_798852270137987_5111700854465372079_n-2সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে কিছু নির্দেশনা জারি করেছেন। নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা সচিব ৯ দফার আন-অফিসিয়াল নোট জারি করেন। নির্দেশনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ২৭৯টি সরকারি কলেজকে বিভাগীয় পর্যায়ের পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়। বাকী প্রায় ২৩০০টি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বেসরকারি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকবে। এর ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সীমিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারি এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের মধ্যে এই ঘোষণা আলোচনার খোরাক যোগাবে, সন্দেহ নেই। যদিও তাতে আশাবাদী হবার সুযোগ খুব কমই। কেননা প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা সমস্যার গভীরে দৃষ্টি দেবার বদলে অনেকটুকুই উপর উপর ও দায়সারা। অতীতেও  রোগ সারার এমন দাওয়াই দেয়া হয়েছে। তাতে অবশ্য পরিস্থিতি পাল্টেছে, সংকট পূর্বের তুলনায় তীব্রতর হয়েছে! তবে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় আর একবার প্রমাণিত হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটা অকার্যকর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে কিছু নির্দেশনা জারি করেছেন। নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা সচিব ৯ দফার আন-অফিসিয়াল নোট জারি করেন। নির্দেশনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ২৭৯টি সরকারি কলেজকে বিভাগীয় পর্যায়ের পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়। বাকী প্রায় ২৩০০টি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বেসরকারি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকবে। এর ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সীমিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারি এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের মধ্যে এই ঘোষণা আলোচনার খোরাক যোগাবে, সন্দেহ নেই। যদিও তাতে আশাবাদী হবার সুযোগ খুব কমই। কেননা প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা সমস্যার গভীরে দৃষ্টি দেবার বদলে অনেকটুকুই উপর উপর ও দায়সারা। অতীতেও  রোগ সারার এমন দাওয়াই দেয়া হয়েছে। তাতে অবশ্য পরিস্থিতি পাল্টেছে, সংকট পূর্বের তুলনায় তীব্রতর হয়েছে! তবে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় আর একবার প্রমাণিত হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটা অকার্যকর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিনের সমস্যা নিয়ে দেশের ছাত্র সংগঠন, শিক্ষাবিদসহ নানা মহলের মতামত রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক, সরকার মতামতগুলো কখনও আমলে নেয়নি, সমাধানের উদ্যোগ তো পরের কথা। এবারো আগের মতো অগণতান্ত্রিকভাবে এ সিদ্ধান্ত ছাত্রদের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হলো। সিদ্ধান্ত গ্রহণেই যখন এই অবস্থা তখন  জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান সংকট সমাধানে সরকারের কতটুকু আন্তরিক চেষ্টা থাকবে – তাতে সন্দেহ থেকেই যায়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে কলেজগুলো চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় – ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। ভয়াবহ সেশনজট নিরসন, মানসম্মত শিক্ষা প্রদান ও গবেষণার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার সময়ই প্রশ্ন উঠেছিল, চারটি বিশ্ববিদ্যালয় যখন এসব কলেজকে পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সেটা কিভাবে সম্ভব হবে? বরং সমাধান হিসেবে জেলায় জেলায় পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় করে তার অধীনে কলেজগুলোকে আনা যেতে পারে। আপাতত দেশের ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোকে (প্রায় ১৯টি) বিশ্ববিদ্যালয় করে বিভাগ ও জেলার অন্য কলেজগুলো এর অধীভুক্ত করা যায়। তখন এসব কথায় কর্ণপাত করা হয়নি। কিন্তু আজ ২২ বছর পর এসে সরকারের শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটা ‘ফেইলার’ প্রতিষ্ঠান। একটা সত্য কথা বুঝতে সরকার বাহাদুরের এত বছর লেগে গেল!

বলা হচ্ছে, সরকারি কলেজগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত হবে। অধীভুক্ত হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কী হবে? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তো সিলেবাস-প্রশ্নপত্র তৈরি আর ফলাফল প্রকাশ অর্থাৎ ‘শিক্ষাবোর্ড’র চেয়ে বেশিকিছু ভূমিকা পালন করেনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও কী অতটুকু ভূমিকা রাখবে? যদি তাই হয়, তবে এই ‘অধীভুক্তি’ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা কি? কলেজগুলোর প্রধান সমস্যা সেশনজট, ক্লাসরুম-শিক্ষক সংকট সর্বোপরি মানসম্মত শিক্ষার অপ্রতুল আয়োজন – এসব সমস্যা সমাধানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কি ভূমিকা থাকবে?

finial coverদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রত্যেকটি তাদের নিজ নিজ অধ্যাদেশ অনুযায়ী একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। সরকারি কলেজগুলো অধীভুক্ত হলে সমন্বয় কিভাবে করা হবে? কোনো কোনো বিভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে নতুন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, স্বল্প পরিসরে বহু ঘাটতি নিয়ে। যেমন, রংপুর বিভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দুটি – বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে হাবিপ্রবি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর তার অনেক কিছুই পূরণ হয়নি। তাহলে রংপুর বিভাগে কারমাইকেল কলেজসহ অন্যান্য কলেজগুলোকে কিভাবে পরিচালনা করা হবে? যেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেরাই অপূর্ণাঙ্গ? বরিশাল বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয় আছে- বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হয়েছে বরিশাল সরকারি স্কুলে পর্যন্ত। আর কিছু না বললেও বোঝা যায়, একাডেমিক ও প্রশাসনিক শত সীমাবদ্ধতা নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে বিএম কলেজসহ অন্যান্য সরকারি কলেজকে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সিলেট বিভাগে একটিই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-শাহজাহাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সেটিও আবার বিশেষায়িত। এমসি কলেজের অনেক বিভাগই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। তাহলে কিভাবে পরিচালনা করবে?

আবার বলা হচ্ছে, বেসরকারি কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় থাকবে। মোট প্রায় ২৬ শ কলেজের মধ্যে ২৭৯টি সরকারি কলেজ। তার মানে প্রায় ২৩০০ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত হবে। কলেজের সংখ্যা খুব কমলো কি? প্রধানত যে কারণে, পরিচালনার ক্ষেত্রে সামর্থ্যরে তুলনায় অতিরিক্ত কলেজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তার ইতর বিশেষ পরিবর্তন হবে কি? অর্থাৎ বিদ্যমান সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। সরকার যদি মনেই করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা দানে ব্যর্থ হয়েছে তবে এই ব্যর্থতার দায় বেসরকারি কলেজের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীকে বহন করতে হবে কেন?

বেসরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষার আয়োজনের অপ্রতুলতা আরো প্রকট। প্রায় সব কলেজই চলে খ-কালীন শিক্ষক দিয়ে। এখানে শিক্ষকের বেতনের ৮০ ভাগ প্রদান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাকি ২০ ভাগসহ কলেজের অন্যান্য সমস্ত খরচ আদায় করা হয় শিক্ষার্থীর কাছ থেকে। এসব বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালাও নেই। এসব কলেজে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাড়া বাকিরা নিষিদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে আমাদের প্রবল আশঙ্কা, নতুন ঘোষণা বাস্তবায়ন হলে এসব কলেজে প্রকৃত সমস্যার সমাধান তো হবেই না বরং শিক্ষা বাণিজ্যের পথ আরও অবারিত হবে।

অতীতেও এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে নানা ‘টোটকা’ সমাধানের কথা বলা হয়েছিল। গত ২০০৯ সালে তৎকালীন ইউজিসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি কমিটি শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষাবিদ কারো কোনো মতামত না নিয়েই চার মাস সময় নিয়ে ছয়টি আঞ্চলিক কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিচালনাসহ ১৬ দফা সুপারিশ করেছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে আঞ্চলিক কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়। আমরা তখনও বলেছিলাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সমস্যায় হাত না দিয়ে এভাবে বিকেন্দ্রীকরণ কেবল মাথা ভারি প্রশাসন ও দুর্নীতি-আমলাতান্ত্রিকতাই বাড়বে। ২০১০ সালে চালু করা হলো গ্রেডিং পরীক্ষা পদ্ধতি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তীব্র সংকটের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক ফলাফল বিপর্যয় ঘটালো। ছাত্রদের প্রচণ্ড অসন্তোষ ঠেকাতে প্রশাসন এক বিষয়ে পাশ করা শিক্ষার্থীকেও অটোপ্রমোশন দিতে বাধ্য হলো। ঘোষণানুযায়ী আজও ২১০ দিন ক্লাস আর ৮৫ দিন পর ফল প্রকাশের কথা শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ আছে।

ফলে প্রধানমন্ত্রীকে বলব, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে খেয়াল খুশি মতো সিদ্ধান্ত নিলে সমস্যার সমাধান হবে না। শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করে- প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসমূহ, শিক্ষাবিদ, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গদের কথা আমলে নিতে হবে। নয়তো বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সর্ববৃহৎ ক্ষেত্র যে তিমিরে ছিল, সেখানেই থেকে যাবে। আমাদের সংগঠনসহ নানা মহল থেকে উচ্চারিত যে দাবি, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করে তার অধীনে কলেজগুলোকে যুক্ত করা এবং দ্রুততম সময়ে ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করে কলেজগুলোকে তার অধিভুক্ত করা, এটাই হতে পারে যথোপযুক্ত সমাধান। সরকার যদি এই কলেজগুলোর শিক্ষা আয়োজনের সমস্ত দায়িত্ব না নেয়, তবে কেবল পরিচালনা করার দায়িত্ব পাল্টিয়ে কিংবা বিকেন্দ্রীকরণ করে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর উচ্চতর শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।

অনুশীলন : অক্টোবর ২০১৪ || সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments