সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট আগামী ১৮ মে বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত এক কনভেনশন আয়োজন করছে। এই কনভেনশনের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন সংগঠনের সভাপতি না্ঈমা খালেদ মনিকা ৭ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে।
সংবাদ সম্মেলনে পঠিত লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমুহ আজ এক ধরণের ধীর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র আমাদের চোখের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি। গত ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে মঞ্জুরি কমিশন ‘উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্র : ২০০৬-২০২৬’ গ্রহণ করে। আমাদের সংগঠন সেসময় এর বিরোধিতা করেছে। বর্তমানে এই পরিকল্পনার ১০ বছর অতিক্রান্ত হল। এর প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন? বিশ্ববিদ্যালয় তার ধারণা ও মর্মবস্তু স্বায়ত্তশাসন নিয়ে চলছে কিনা? – সে সব বিষয়ে পর্যালোচনা করার জন্য আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশনের উদ্যোগ নিয়েছি।
সম্প্রতি আমরা দেখেছি বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উচ্চশিক্ষায় ৫ গুণ বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রীর এ ঘোষণা বাস্তবায়িত হলে উচ্চশিক্ষার ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে, ফলে দেশের মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার অধিকার বলে আর কিছু থাকবে না। আমরা সকলেই জানি, বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশ্বের তাবৎ জ্ঞান চর্চার প্রতিষ্ঠান। এর তিনটি কাজ- জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান সংরক্ষণ ও জ্ঞান বিতরণ। বিশ্ববিদ্যালয় তাই প্রগতিকে উৎসাহিত করে ও যুগের প্রয়োজনকে ধারণ করে। সমাজকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন মুক্ত জ্ঞান চর্চার পরিবেশ; যা নিশ্চিত করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে অন্যায়, অন্যায্যতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শাসকেরা কখনো এ পরিবেশ দিতে চায় না। আর্থিক, প্রশাসনিক নানা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে হরণ করে এর স্বাধীনতা। যেমনটি করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। করা হয়েছিল স্বাধীন দেশে স্বৈরাচারী বা তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ে। এমনকি এখন ছাত্রসমাজের মত প্রকাশের অধিকার ছাত্র সংসদ নির্বাচনও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা এবং ছাত্রসমাজকে আরও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছে এক সর্বনাশা নীলনকশা। ২০০৬ সালে ‘Strategic Plan for Higher Education: ২০০৬-২০২৬’ নামে নকশা এঁকে ছিল বিশ্বব্যাংক। দশ বছর ধরে সব সরকারই এ নীতির ভিত্তিতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিচালনা করেছে। এর মূল প্রস্তাবগুলো ছিল- বাজেটে সরকারের বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া, ব্যাপকভাবে ছাত্রদের বেতন-ফি বাড়ানো, বাণিজ্যিক নাইটকোর্স চালু করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা ভাড়া দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কেই আয়ের পথ করা। এছাড়া গবেষণার জন্য বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেবার প্রস্তাব দেয়া হয়, আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে একেবারে আজ্ঞাবাহী করে তোলার জন্য নানা চাতুর্যপূর্ণ সুপারিশ করা হয়। সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদের বেঁচে থাকার জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সকল সেবাখাতকে বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মুনাফার ক্ষেত্র হিসেবে দাঁড় করানো দরকার। এজন্যই বিশ্বব্যাংক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এমন প্রস্তাব হাজির করেছে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি ধাপে ধাপে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৪-০৫ সেশনে কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, বাণিজ্য অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ ও আইইআর-এ প্রথম বর্ষে ভর্তি ফি ছিল যথাক্রমে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা। এখন এসে তা দাঁড়িয়েছে বিভাগ ও হল ভেদে ১০-১৯ হাজার টাকা পর্যন্ত। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮২৫ টাকা। ২০১২ সালে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬২১৪ টাকা। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮ সালে ভর্তি ফি ছিল ৪৫০০ টাকা; বর্তমানে তা ৯৫০০ টাকা করা হয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর বছর নামে বেনামে বাড়ানো হচ্ছে বেতন ফি। কিন্তু কমছে ছাত্রদের নানা সুযোগ সুবিধা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ৩২ ভাগ শিক্ষার্থী আবাসিক সুবিধা পায়। কৌশলপত্রের প্রস্তাব অনুসারে প্রয়োজন থাকা স্বত্ত্বেও হল বাড়ছে না বরং নতুন হলের ফি-চার্জ আকাশ ছোঁয়া। ঢাবি’র হল বিজয় একাত্তর আইডি কার্ড নবায়ন ফি বাবদ প্রশাসন নেয় ৩,৩০০ টাকা, যেখানে অন্য হলগুলো নেয় ৪৫০-৭০০ টাকা। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিকভিত্তিতে নাইটকোর্স চালু করা হয়েছে। যার কোর্স ফি কয়েক লক্ষ টাকা। গবেষণাকে বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। অথচ বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ ১ শতাংশেরও কম। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় হেকেপ (HEQEP-Higher Education Quality Enhancement Project) এর নামে পাঠদান ও তথাকথিত গবেষণা চলছে। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, হেকেপের নামে ল্যাব-এর কিছু কেমিক্যালস, চেয়ার-টেবিল ক্রয়, রুম এসি করা, পর্দা লাগানোর জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু গবেষণার কোনো উন্নতি হয়নি। যদিও এ ঋণের টাকা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে আমাদেরই! এর বাইরে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব, দুর্নীতি, স্বায়ত্তশাসন খর্ব, গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব আজ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চিত্র।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সংকটময় সময়ে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের মতামতের ভিত্তিতে আমরা করণীয় নির্ধারণ করতে চাই। এ লক্ষ্যে আগামী ১৮ মে’১৭ বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায় ঐতিহাসিক বটতলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে। সংবাদ সম্মেলন থেকে কনভেনশন সফল করে তোলার লক্ষ্যে সর্বস্তরের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীসহ গণতন্ত্রমনা শিক্ষানুরাগীদের সাহায্য ও সমর্থন প্রত্যাশা করা হয়।