দেশে দেশে অর্থনৈতিক সংস্কারের ফল
নরেদ্র মোদি ক্ষমতায় বসেই যে সব পদক্ষেপ নিয়েছেন তা দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের দ্বারা খুবই প্রশংসিত হচ্ছে। বাজেটে প্রতিরক্ষা ও বিমাক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ এফডিআই, ব্যাংক ও সরকারি সংস্থার ঢালাও শেয়ার বিক্রি, রেল সহ নানা ক্ষেত্রে পিপিপি, ‘সেজ’ পুনরুজ্জীবিত করা প্রভৃতি পদক্ষেপগুলি তাঁদের উচ্ছ্বসিত করে তুলেছে। পুঁজিপতিদের একটি অংশ এবং তাদের তল্পিবাহক অর্থনীতিবিদ ও সংবাদপত্রগুলি বলছে, মোদি সরকারের কাছ থেকে আরও অনেক বেশি সংস্কার তারা আশা করেছিল। আনন্দবাজার পত্রিকা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অরবিন্দ পানাগাড়িয়াকে উদ্ধৃত করে বলেছে – তিনি আশা করেছিলেন ব্যাংক ও সরকারি সম্পত্তির শেয়ার বিক্রি করে সরকার অন্তত এক লক্ষ কোটি টাকা তুলবে। কিন্তু বাজেটে মাত্র ৫৮ হাজার কোটি টাকা তোলার কথা বলায় তিনি খুশি হতে পারেননি। পত্রিকাটি এটাও আবিষ্কার করেছে যে ইচ্ছা থাকলেও অভিজ্ঞতার অভাবে সরকার সংস্কারে আরও গতি আনতে পারেনি। অন্যান্য পত্র-পত্রিকাতেও আশা-নিরাশার প্রকাশ ঘটেছে আর্থিক সংস্কারে বিশ্বাসী প্রখ্যাত কিছু অর্থনীতিবিদের।
বাজেটের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই এই সমস্ত পণ্ডিতরা বলে এসেছেন, সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পূণর্ না হলে জনসাধারণ তার সুফল পাবে না। তাঁদের বক্তব্য – এই সংস্কার প্রক্রিয়া ভর্তুকি ছাঁটাই, সার-গ্যাস-তেল প্রভৃতির দাম বি-নিয়ন্ত্রণ করে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া, কর্মী ও কর্ম সংকোচন, শ্রম আইনের পরির্বতন, সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও পরিষেবার বেসরকারিকরণ প্রভৃতি পদক্ষেপ, তাই এতদিনের ভর্তুকি-সংস্কৃতির সুবিধাপ্রাপ্তদের সাময়িক অসুবিধায় পড়তেই হবে। তাঁদের ভাষায়, এই ‘কড়া দাওয়াই’ বা ‘তেতো ওষুধ’ না দিলে নাকি অর্থনীতির বেহাল দশার রোগ সারবে না। তাই রোগ সারাতে চাইলে আপস না করে সরকারকে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। তাঁদের আরও পর্যবেক্ষণ, ভারতে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর নরসিমা রাও, বাজপেয়ী বা মনমোহন সিংরা তাঁদের জোট সরকারের বাধ্যবাধকতার জন্য এই সাহসী পদক্ষেপগুলি নিতে পারেননি। ফলে দেশকে তার ফল ভুগতে হচ্ছে। তাঁদের আশা, এবার নরেন্দ্র মোদি একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছেন এবং কংগ্রেস বা মনমোহন সিংরাও সংস্কার বিরোধী নন, তাই সংস্কারের গতিকে এবার কেউ রুখতে পারবে না। এবং তার পরেই আসবে সুদিন।
অর্থনৈতিক সংস্কারে সুফলের যে স্বপ্ন এই পণ্ডিতেরা দেখাচ্ছেন তা যদি টিক হয়, তাহলে কোন মূর্খ তার বিরোধীতা করবে? তাহলে এই সংস্কারের বিরুদ্ধে দেশে দেশে এত বিক্ষোভ কেন? তা কি পণ্ডিতরা যা বলেন তা ঐ বিক্ষোভকারীরা না বোঝার জন্য? নাকি জীবন তাদের দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তার জন্য? অর্থনীতির এই বিজ্ঞজনেরা কি বলতে পারবেন, সংস্কারের এই কড়া দাওয়াই অর্থনীতির কোন ল্যাবরোটরির তৈরি? কোনও ওষুধ আবিষ্কারের পর তো সুফল প্রমাণিত হলে অন্যত্র তা প্রয়োগ করা হয়। সংস্কারের এই ওষুধ প্রয়োগ করে কোন দেশে সুফল প্রমাণিত হয়েছে? যে সব দেশ এই সংস্কারের প্রথম সারির প্রবক্তা এবং সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে ফেলেছে, সেই সব দেশে কি অর্থনীতিতে রোগ সেরেছে? যদি না কমে তাহলে সেই ব্যর্থ ওষুধ ভারতে প্রয়োগ করার এত জোরালো সুপারিশ কেন?
এখন সংস্কারে অগ্রণী দেশগুলির দিকে একটু লক্ষ করা যাক। ১৯৮০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যে দেশে যত বেশি সংস্কার হয়েছে, সে সব দেশে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বেড়েছে তত বেশি। আর সাধারণ মানুষের দুর্দশা যত বেড়েছে, পুঁজিপতিদের পুঁজির পরিমাণও তত লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হল, সংস্কারের এই পর্বে যে দেশে পুঁজিপতিদের পুঁজি যত বেড়েছে, সেই দেশে সরকারের ঋণ বেড়েছে তত বেশি।
যে আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি পুঁজির মালিকের বাস, সেই দেশের সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণগ্রস্ত। সে দেশে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বিল গেটস-এর সম্পত্তি ১৯৯৫ সালের ১২.৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৪ সালে হয়েছে ৮০ বিলিয়ন ডলার বা ৮০ শত কোটি ডলার। এক ডলারের মূল্য (ভারতীয়) ৬০ টাকা ধরে টাকায় তার সম্পত্তির হিসাব দেখালে আমাদের অনেকের চক্ষু চড়কগাছ হবে। সেদেশের প্রথম ২৫ জন পুঁজিপতির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৮৪২.৬ বিলিয়ন ডলার। ৪৪২ জন ১ বিলিয়ন থেকে ৮০ বিলিয়ন ডলারের মালিক। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে যদি সরকারি ঋণ ভাগ করে দেওয়া যায় তাহলে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ কত হবে তা আমাদের কাছে অকল্পনীয়। সাধারণ মানুষের অবস্থা একটাই তলানিতে পৌঁছেছে যে সেই দেশের মানুষকে গত দু’বছর আগে রাস্তায় নেমে বলতে হয়েছে ‘আমরা ৯৯ শতাংশ, ওরা ১ শতাংশ’, আওয়াজ তুলেছে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’। তারপর সরকারের আর্থিক অবস্থা হয়েছে আরও খারাপ। সরকারের ঋণ গ্রহণের সর্বোচ্চ পরিমাণ মার্কিন কংগ্রেস যা বেঁধে দিয়েছিল, গত বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সেই সীমাকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় সরকারের আর ঋণ নেওয়ার আইনগত কোন উপায় ছিল না। কিন্তু আর্থিক সংকট এমনই তীব্র ছিল যে, ঋণ না নিলে সরকারের আর চলছিলই না। ফলে আর্থিক অনটনে ৭২ ঘন্টা সরকারের প্রায় প্রতিটি দপ্তরের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শেষে তড়িঘড়ি মার্কিন কংগ্রেস ঋণ গ্রহণের সীমা আরও বাড়িয়ে সে যাত্রায় সরকারকে বাঁচিয়েছিল।
গ্রিসের অবস্থা আরও শোচনীয়। সে দেশে মোট জনসংখ্যা ১.২ কোটি। সব কিছুই বেসরকারিকরণ করার ফলে এখন সরকারের আয় বলতে শুধু জনসাধারণের উপর চাপানো কর। সরকার চালাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের কল্যাণ প্রকল্পগুলিতে যেমন বরাদ্দ কমাতে হয়েছে, সেই নির্ভর করতে হয়েছে ঋণের উপর। সেই দেশে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৪২ লক্ষ কোটি ইউরো। আর মোট ঋণের পরিমাণ ৩৪২.২৯ লক্ষ কোটি ইউরো। ১৯৮০ সালে যেখানে গ্রিসে জিডিপি-র ২২.৬ শতাংশ ছিল সরকারি ঋণ, সেখানে সংস্কার প্রক্রিয়া চালিয়ে ২০১৩ সালে সরকারি ঋণ হয়েছে জিডিপি-র ১৮৯ শতাংশ। ২০১২ সালে অর্থের অভাবে সরকারি কর্মীদের মাইনে দেওয়া, সরকার চালানো যখন অসম্ভব হয়ে উঠেছিল, তখন দেশের মানুষ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল, ধর্মঘটে স্তব্ধ করে দিয়েছিল দেশ। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, শুধু সে দেশের সরকার নয়, প্রমাদ গুনল পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গ্রিস সরকারের ত্রাহি ত্রাহি রব। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আবার ঋণের ব্যবস্থা করে সরকারকে সাময়িকভাবে সচল করল।
একই অবস্থা চলছে পর্তুগাল এবং স্পেনেও। যে স্পেনের সরকার প্রায় দেউলিয়া, সে দেশের সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি আমানসিও ওর্তেগোর ২০১৪ সালে সম্পত্তির পরিমাণ ভারতের ধনকুবের মুকেশ আম্বানির সম্পত্তির প্রায় তিন গুন অর্থাৎ ৬৬.৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১২ সালে ছিল ৪৭.৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও এই ব্যক্তিটির বিশ্বের ৫০টি দেশে ব্যবসা আছে। ২০০৪ সালে স্পেন সরকারের যেখানে ঋণ ছিল ৩৮৯.১ বিলিয়ন ইউরো, ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১০৮১.৫ বিলিয়ন ইউরো। সরকারি ভাষ্যে ‘অবস্থা নিয়ন্ত্রণে’ থাকলেও ফ্রান্সও হাবুডুবু খাচ্ছে। মাঝে মাঝে ধর্মঘটে দেশ স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে দেশে সরকারি ঋণ জিডিপি-র ৯৩.৪ শতাংশ। পশ্চিম জার্মানির পুঁজিপতিরা পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি এক হওয়ার পর নতুন বাজার পেয়ে ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে খানিকটা ভালো অবস্থায় আছে। সেই জার্মানিতে ১৯৯১ সালে সরকারি ঋণ ছিল জিডিপি-র ৩৯.৫৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৭৮.৬ শতাংশ। ইংল্যান্ডে সরকারি ঋণ জিডিপি-র ৯০ শতাংশ। যে জাপানের শিল্পপতিরা বাজার দখলে প্রতিযোগিতায় আমেরিকাকেও মাঝে মাঝে পাল্লা দেয়, তাদের দেশে সরকারি ঋণ ১০.৫ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১০.৫ লক্ষ কোটি ডলার যা তাদের দেশের জিপিপি-র ২০০ শতাংশ। মাথাপিছু ঋণে জাপান আমেরিকাকেও বহুদূর ছাড়িয়ে গিয়েছে।
এ বছর ব্রাজিলে বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা সংগঠিত করতে গিয়ে সরকার এত টাকা ব্যয় করছে যে, জনকল্যাণ খাতে ব্যাপক বরাদ্দ ছাঁটাই করতে হয়েছে। তার ফলে মানুষ এতটাই ক্ষিপ্ত হয়েছিল যে ফুটবল পাগল ব্রাজিলিয়ানরা পর্যন্ত প্রবল বিক্ষোভ দেখিয়ে বলেছে, ফুটবল নয় রুটি চাই, কাজ চাই। মানুষের আর্থিক অবস্থা এত খারাপ হলেও এবং জনসংখ্যা ভারতের ছয় ভাগের এক ভাগ হলেও (২০ কোটি) সে দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি জর্জ পাওলো লোমানের সম্পত্তি ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটির প্রায় সমান।
এবার ভারতের আর্থিক সংস্কারের ফলে সরকারের ঋণের হাল কী দাঁড়িয়েছে দেখা যাক ঃ কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রকের অধীন ডিপার্টমেন্ট অব ইকনমিক অ্যাফেয়ার্সের ‘এক্সটারনাল পেট ম্যানেজমেন্ট ইউনিট’ প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২০০০ সালে যেখানে বৈদেশিক ঋণ ছিল ১০০.৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৬১.৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৪ সালে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৪২৬.৬ বিলিয়ন ডলার। আর মোট ঋণের পরিমাণ ১৩১৫.৭ বিলিয়ন ডলার। জিডিপি-র হিসাবে ৬৫.৬ শতাংশ।
একদা রাশিয়া এবং চীন দেশ দু’টি সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল বলে দেশি-বিদেশি ঋণ না নিয়েই সকলকে কাজ দিয়ে, সকলকে খাইয়ে পরিয়ে শিক্ষা স্বাস্থ্য দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে পেরেছিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তি না থাকলেও প্রতিটি নাগরিকের জীবনযাত্রার মান ছিল খুবই উন্নত। সেই দেশ দু’টিতে পুঁজিবাদ ফিরে আসার পর অতি দ্রুত কিছু লোকোর হাতে প্রচুর সম্পত্তি জমা হচ্ছে, আয়ের বৈষম্য বাড়ছে, আর সাধারণ মানুষের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। সরকারগুলিও দেশ চালাতে ঋণ নেওয়া শুরু করেছে। উল্লেখ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে আলাদা দেশ হওয়ার পর সেই দেশগুলির সরকারের ঋণ এখনও জিডিপি-র হারে বিশ্বের অন্যান্য যে কোনও পুঁজিবাদী দেশের তুলনায় খুব কম। সেগুলি এই রকম — উজবেকিস্তান – ৮.৫৮ শতাংশ, এস্তোনিয়া – ৯.২৭ শতাংশ, রাশিয়া – ১০.৮২ শতাংশ, আজারবাইজান – ১০.৯২ শতাংশ, তুর্কমেনিস্তান – ১১.৯১ শতাংশ, কাজাখস্তান – ১২.২১ শতাংশ। এর কারণ এসব দেশে পুঁজিবাদ ফিরে আসার পর এখনও পুঁজির একচেটিয়াকরণ দানবীয় রূপ নেয়নি এবং দেশের সম্পত্তিগুলি পুঁজিপতিরা এখনও সব গ্রাস করতে পারেনি। তবে সেই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গিয়েছে। পুঁজিবাদ ফিরে আসার এই অল্প দিনের মধ্যেই চীনে ডলারের হিসেবে ১২২ জন বিলিওনেয়ার হয়ে উঠেছে, যার মধ্যে ৪ জন ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সম্পত্তির মালিক।
২০১২ সালে সারা বিশ্বের বিলিওনেয়ারদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৪.৬ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৪.৬ লক্ষ কোটি ডলার। ঠিক এক বছরেই তা বেড়ে হয়েছে ৫.৪ টি্রলিয়ন ডলার ৫.৪ লক্ষ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরেই তাদের সম্পত্তি বেড়েছে ০.৮ লক্ষ কোটি ডলার।
এখানে কোন গরিব দেশ নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। দীর্ঘদিন সাম্রাজ্যবাদী শোষণে সেই সব দেশ এবং সরকার পিছিয়েই আছে। এসব দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা ধনী দেশগুলোর তুলনায় খুবই খারাপ, বিশ্বায়ন ও উদারিকরণের ধাক্কায় তা আরও খারাপ হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতির কোন নিয়মে ধনী দেশগুলির সরকার দ্রুত এত বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে জনসাধারণকে আর কোনও পরিষেবা দিতে পারছে না? অর্থনীতির সংস্কারের কোনও দাওয়াই-ই কেন দেশের আর্থিক হাল ফেরাতে পারছে না?
উত্তরটা খুবই কঠিন না হলেও অর্থনীতির সেইসব বাঘা বাঘা পণ্ডিতদের কাছে তা বোধহয় বোধগম্য হবে না। কারণ তাঁরা সমাজতান্ত্রকে গালাগালি দিয়ে শুরু করবেন এবং ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বাইরে আর কিছু অনুসন্ধান করবেন না। সংস্কারের প্রবক্তাদের নিজেদের দেশে সাধারণ মানুষের জীবনের এমন অনিশ্চয়তা ও দৈন্যদশা দেখেও সংস্কারে পিছিয়ে থাকা দেশগুলিকে তাঁরা তা ত্বরান্বিত করার ‘সুপরামর্শ’ দেবেন।
অথচ বিশ্বায়ন, উদারিকরণ, বেসরকারিকরণ, সেজ, শিল্পকে উৎসাহিত করার নামে করছাড় প্রভৃতি হলে এমন অবস্থা যে হবে, সেই আগাম হুঁশিয়ারি কি দেওয়া হয়নি? দেশে দেশে কি মানুষ এ সবের বিরুদ্ধে ১৯৮০-র দশক থেকে প্রতিবাদ করছে না?
সংস্কারের এই পর্বের আগে রাষ্ট্রায়ত্ত খনি, ব্যাংক, বিমা, রেল, টেলিফোন সহ সমস্ত লাভজনক সংস্থা থেকে সরকারের প্রচুর আয় হত। যে সব দেশে বেসরকারি মালিকদেরই এসবে প্রাধান্য ছিল, সেখানেও উৎপাদন, বিক্রি, আমদানি-রপ্তানিতে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর আদায় করে সরকারের তহবিল পূর্ণ হত। এই আয় থেকেই সরকার জনসারণের কল্যাণে এবং অন্যান্য খাতে বরাদ্দ করত।
শিল্পকে উৎসাহিত করার নামে, আর্থিক বৃদ্ধিতে গতি আনার নামে সংস্কার পর্ব যখন শুরু হল তখন দেশের সম্পত্তি ব্যাপকভাবে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিয়ে সরকার বড় আয়ের উৎসগুলি হারালো। তার ওপর, মালিকদের আবদার মেটাতে শিল্পায়নের পরিকাঠামো তৈরি করে দেওয়া, সস্তায় বা বিনা পয়সায় জমির ব্যবস্থা করে দেওয়া, সেজ তৈরি করে পুরোপুরি কর ছাড় ও ইচ্ছে মতো মারিকদের চলতে দেওয়া, শিল্পপতিদের ব্যাংক ঋণে নানা সুবিধা দেওয়া, আমদানি-রপ্তানিতে ভর্তুকি দেওয়া, শিল্পে মন্দাজনিত ক্ষতি মেটাতে ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’ তৈরি করে পুঁজিপতিদের পকেটে সরাসরি টাকা ঢুকিয়ে দেওয়া ইত্যাদি চলতে লাগল। এসবের টাকা জোগাতে গিয়ে যখন সরকার হিমশিম খাচ্ছে তখন জনকল্যাণের বরাদ্দে কোপ তো পড়বেই! সাধারণ মানুষের জীবন তো বিপর্যস্ত হবেই! ঋণ তো নিতে হবেই! মানুষের জন্য কিছু করতে না পারলেও সমর-শিল্পের মালিকদের স্বার্থে বিপুল সামরিক বরাদ্দ বৃদ্ধি ও পুঁজিপতিদের নানা রকম সুবিধা দিতে গিয়ে সরকারকে বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীণ ঋণ নিতে হচ্ছে আরও বেশি বেশি করে। আবার সেই ঋণের সুদ মেটাতে আরও ঋণ নিতে হচ্ছে। এভাবেই বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের সরকার ঋণের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছে।
নরেন্দ্র মোদী সরকার এবার যে বাজেট পেশ করেছে, সেখানে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ সুদ গুনতে চলে যাবে। আর আয়ের খাতে ধরা হয়েছে মোট বাজেটের ২৫ শতাংশ ঋণকে। সামরিক খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি। ব্যাংকের ও অন্যান্য শেয়ার বিক্রি করে ৫৮ হাজার কোটি টাকা বিলগ্নিকরণ করে টাকা জোগাড় করা হবে। অর্থাৎ ৫৮ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দেওয়া হবে এবং এর থেকে যে আয় এতদিন হত, সেই আয়ও এবার হাতছাড়া হবে। এর পরও থাকবে ৪ শতাংশ ঘাটতি বাজেট, যার পরিমাণ প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা। হয় নতুন করে কর বসিয়ে অথবা ফাঁপাই নোট ছাপিয়ে যা পূরণ করা হবে। শুধুমাত্র চালু থাকা গ্রামীণ নানা প্রকল্পে এবারের বাজেটে ৯২ হাজার কোটি টাকা গত বছরের চাইতে কম বরাদ্দ করা হয়েছে। আর গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন, ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও প্রকল্প’ সহ ২৯টি প্রকল্পে ছেলের হাতে ললিপপ ধরিয়ে দেওয়ার মতো ১০০ কোটি করে মোট ২৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে প্রকল্পের চমক দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। চরম ধিক্কৃত ‘সেজ’-কে আবার পূনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। এত সর্বনাশা পরিকল্পনার পরেও দেশি-বিদেশি শিল্পপতি, কর্পোরেটদের নানা সংগঠন, তাদের অর্থনীতিবিদ এবং প্রচারমাধ্যম খুশিতে বিগলিত। কারণ, হোক না সরকার আরও বেশি ঋণগ্রস্থ, হোক না জনজীবন আরও বিপর্যস্ত, তাদের পুঁজি ও প্রসাদের পরিমাণ তো বাড়বেই।
পুঁজিপতিরা তাদের কথা ভাববে। আর শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে নিজেদের সমস্যা, ভাবতে হবে তার সমাধানের কথা।
[গণদাবী, ৬৭ বষর্ ১০ সংখ্যা ঃ ১৭ – ২৩ অক্টোবর, ২০১৪]