Monday, December 23, 2024
Homeছাত্র ফ্রন্টপেশা নির্বাচন সম্পর্কে একজন তরুণের চিন্তা — কার্ল মার্কস

পেশা নির্বাচন সম্পর্কে একজন তরুণের চিন্তা — কার্ল মার্কস

0324_p15-karl-marx_398x320বেছে নেবার ক্ষমতা অন্য সকল সৃষ্টির তুলনায় মানুষের একটা বড় রকমের সুবিধা, কিন্তু সেই সঙ্গে এ হচ্ছে এমন এক বিধি যা তার সমস্ত জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে, পারে তার সমস্ত পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতে এবং তাকে অসুখী করে তুলতে। কাজেই যারা সবে বৈষয়িক জীবন আরম্ভ করতে যাচ্ছেন, যারা তাদের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি দৈবের হাতে ছেড়ে দিতে চান না সেই তরুণদের প্রথম কর্তব্য হলো এই বেছে নেয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে গুরুত্ব ও গভীর আন্তরিকতা সহকারে বিচার-বিবেচনা করে দেখা।

মানুষ মাত্ররই মনে একটা উদ্দেশ্য থাকে যা অন্তত তার নিজের কাছে মহৎ বলে প্রতীত হয়। আপনার গভীরতম বিশ্বাস, অন্তরের অন্তস্থল থেকে নিসৃত উচ্চারণ এই উদ্দেশ্যকে মহৎ বলে ঘোষণা করে তবে তা যথার্থই মহৎ। ….

কিন্তু এই উচ্চারণ সহজেই স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে এবং আমরা এক মুহূর্তে যাকে অনুপ্রেরণা বলে ধরে নেই তা’ নিমেষের ব্যাপারে পরিণত হয়ে পর মুহূর্তেই হয়ে যেতে পারে নিশ্চিহ্ন। …

গভীর আগ্রহের সাথে আমরা যাকে আলিঙ্গণ করে নেই অচিরেই তা আমাদের কাছে হয়ে ওঠে বিরক্তিকর এবং আমরা আমাদের গোটা অস্তিত্বকেই দেখতে পাই ধ্বংসের মুখোমুখি। …

সুতরাং আমাদের অবশ্যই গভীর আন্তরিকতা ও গুরুত্বের সাথে পরীক্ষা করে দেখা উচিত, আমরা আমাদের বৃত্তি নির্বাচনের ব্যাপারে সত্যিই অনুপ্রাণিত হয়েছি কিনা, এতে আমাদের অন্তস্থিত কণ্ঠস্বরের সায় আছে কিনা। …

কিন্তু এই প্রেরণার উৎস কোথায় তা খুঁজে বের না করে এর স্বরূপকে আমরা চিনব কি করে?…

যা মহৎ তার একটা চমৎকারিত্ব আছে, এই চমৎকারিত্ব উদ্রেক করে উচ্চাকাঙ্খার এবং উচ্চাকাঙ্খা সহজেই জন্ম দিতে পারে অনুপ্রেরণার কিংবা তার যাকে আমরা অনুপ্রেরণা বলে ভ্রম করি। উচ্চাকাঙ্খার ভূত যার ঘাড়ে চেপে বসে যুক্তি তাকে সংযত করতে পারে না আর এবং সে বেপরোয়াভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে সহজাত প্রবৃত্তির তাড়নায়। তখন সে অবিমৃষ্যকারী আর জীবনের ক্ষেত্রে বাছ-বিচার করে না। পক্ষান্তরে তা নির্ধারিত হয়ে দৈব কিংবা মোহান্ধ বিভ্রমের বশে। …

যে ক্ষেত্র আমাদেরকে সবচে’ সুন্দর সুযোগ দান করে তা অধিকার করার আহ্বান আমরা শুনি না। যে ক্ষেত্রে বহু বৎসর অবস্থান করেও আমরা ক্লান্তি বোধ করব না, আমাদের উদ্দীপনা স্তিমিত হবে না আমাদের উৎসাহ নিষ্প্রভ হবে না, সে ক্ষেত্রে এটা নয়। বরং এ হচ্ছে এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে অবস্থান করে অচিরেই আমরা দেখব আমাদের ইচ্ছাসমূহ অপূর্ণ, ধারণাসমূহ অতৃপ্ত, এবং আমরা তার জন্য বিধাতাকে অভিযুক্ত করব এবং মনুষ্য-সমাজকে অভিশাপ দেব।

বিশেষ কোনো পেশার প্রতি আমাদের মনে হঠাৎ যে উৎসাহ জেগে উঠে তার কারণ শুধু উচ্চাকাক্সক্ষা নয়, অনেক সময় আমরা তাকে কল্পনার রঙ্গে এমনভাবে অতিরঞ্জিত করে তুলি যে তাকেই জীবনের সর্বোচ্চ দান বলে মনে হয়। আমরা তাকে বিশ্লেষণ করে দেখি না, যে বিরাট বোঝা ও দায়িত্বের ভার তার সঙ্গে আমাদের ওপর অর্পিত হয় সে সম্পর্কে কোনো সামগ্রিক চিন্তা আমরা করি না, তাকে আমরা শুধু দূর থেকেই দেখি আর এখানে দূরত্ব মাত্রই প্রতারক।

আমাদের নিজেদের যুক্তি এখানেও আমাদের পরামর্শদাতা হতে পারে না কারণ, এর পেছনে সমর্থন আছে, না কেনো অভিজ্ঞতার না কোনো গভীর পর্যবেক্ষণের। আমাদের নিজেদের যুক্তি আবেগের দ্বারা প্রতারিত ও উদ্ভট কল্পনার দ্বারা অন্ধ। তাহলে কার দিকেই বা আমরা তাকাব? আমাদের যুক্তিই যেখানে আমাদের ত্যাগ করে সেখানে আমরা নির্ভর করব কার ওপর?

হৃদয় আমাদেরকে বলে দিচ্ছে যে আমাদের নির্ভর করতে হবে পিতামাতার ওপর যারা জীবনের দীর্ঘপথ পরিক্রম করেছেন এবং ভাগ্যের নিষ্ঠুরতার আস্বাদন লাভ করেছেন।

আমাদের আগ্রহ এর পরও যদি অবিচল থাকে, কোনো পেশার প্রতি আমাদের ভালবাসা যদি তারপরও অব্যাহত থাকে এবং ঠান্ডা মাথায় বিচার বিবেচনা করার পরও এবং দায়িত্বভার ও যাবতীয় সুবিধা ও অসুবিধাগুলো অনুধাবন করার পরও যদি এর প্রতি আমাদের আকর্ষণ অটুট থাকে, তাহলে তা আমাদের গ্রহণ করা উচিত সে অবস্থায় আমাদের আবেগ আমাদেরকে প্রতারিত করে না এবং তাড়াহুড়োর আধিক্যও আমাদেরকে বিপথগামী করে না। …..

কিন্তু যে পেশা গ্রহণের জন্য আমরা অন্তরের আহ্বান শুনতে পাই তা সব সময় লাভ করতে পারি না। সমাজের মধ্যে আমাদের সম্পর্কাদি নিরূপিত করার মতো অবস্থায় আমরা নিজেরা উপনীত হবার আগেই সেগুলো অনেকাংশেই নির্ধারিত হতে শুরু করে। ……..

এ সবকিছু যদি আমরা বিবেচনা করি এবং ইচ্ছেমত পেশা বেছে নেয়ার অবস্থা যদি আমাদের জীবনে আসে, তাহলে আমাদের এমন পেশা বেছে নেয়া উচিত যা থেকে আমরা সবচে বেশি উপকৃত হবার নিশ্চয়তা পাই, যে পেশা আমাদের সন্দেহাতীত সত্য ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যে পেশা মনুষ্য সমাজের সেবায় আত্মনিয়োগ করার এবং নিজেদের জন্য সাধারণ লক্ষ্যের নিকটবর্তী হওয়ার সর্বাধিক সুযোগ আমাদের দান করে। প্রত্যেক পেশাই হচ্ছে সাধারণ লক্ষ্যে পৌঁছার উপায় মাত্র সে লক্ষ্য হলো পরিপূর্ণতা অর্জন। ….

মূল্যবান হলো তা ই যা মানুষকে সবচে বেশি উন্নত করে, যা তার সকল কর্মপ্রচেষ্টাকে করে তোলে সমুচ্চ মহত্বম-িত, যা তাকে করে অপরাজেয়, জনসমাজের প্রশংসাভাজন এবং সমাজের শিরোমণি। .. মানবজাতির কল্যাণ সাধন এবং আমাদের নিজেদের পরোৎকর্ষ অর্জন পেশা নির্বাচনের কালে এ দুটোই হওয়া উচিত আমাদের অবশ্যম্ভাবী মুখ্য পথ নির্দেশক। …..

এ দুটি বিষয়ের মধ্যে এমন কোনো বিরোধের কথা ভাবা যায় না, যার পরিণামে উভয়ই পিষ্ট হয়, বিপরীত পক্ষে মানুষের স্বভাবই এমন যে সে তার সহযাত্রী মানুষদের উৎকর্ষের জন্যে, মঙ্গলের জন্যে কাজ করেই নিজের পরোৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হয়। ….

কেউ যদি নিছক নিজের জন্যেই কাজ করেন তবে হয়তো তিনি বিখ্যাত জ্ঞানী বলে নাম কুড়োতে পারেন, মহাকায় সন্তু বা উঁচু দরের কবি হতে পারেন কিন্তু কখনও পরিপূর্ণ প্রকৃত মহৎ মানুষ হয়ে ওঠতে পারেন না।

ইতিহাস সেই সব ব্যক্তিদেরই মহত্তম বলে স্বীকার করে যারা সর্বজনীন মঙ্গলের জন্যে কাজ করে নিজেদেরকে মহত্ত্বমন্ডিত করেছেন। অভিজ্ঞতা সজোরেই বলে যে, তারাই সবচে সুখি, সম্পন্ন যারা সর্বাধিক সংখ্যক লোকের সুখ বিধান করেন। ….

জীবনে যদি আমরা এমন স্থান বেছে নেই যেখান থেকে আমরা মানবজাতির জন্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করতে পারব, তাহলে কোনো বোঝার ভারই আমাদেরকে নোয়াতে পারবে না। কেননা তা হবে সকলের মঙ্গলের জন্য আত্মোৎসর্গ তখন আমরা কোনো হীন, ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত সুখ উপভোগে বিভোর থাকব না, আমাদের সুখ হবে কোটি কোটি মানুষের সুখ, আমাদের কীর্তি নিঃশব্দে চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে কর্মের মধ্যে দিয়ে এবং আমাদের চিতাভষ্ম সিক্ত হবে মহৎ মানুষদের তপ্ত অশ্রু বর্ষণে।

[ ‘পেশা নির্বাচন সম্পর্কে একজন তরুণের চিন্তা’ এটি কার্ল মার্কসের প্রথম রচনা। সংক্ষেপে এখানে প্রকাশ করা হলো। লেখাটি কার্ল মার্কস- ফ্রেডরিক এঙ্গেল্স রচনা সংগ্রহ, প্রথম খন্ড (প্রগতি পাবলিসার্স, মস্কো ১৯৭৫) থেকে সংগৃহীত ] 

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের চতুর্থ কেন্দ্রীয় সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা 

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments