ইরাকে ব্যবসা জমে উঠেছে আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ী আর ঠিকাদারদের। আল কায়দা সন্ত্রাসবাদীদের হামলায় ইরাক এখন বিধ্বস্ত। প্রতিদিন সেখানে প্রাণ হারাচ্ছেন গড়ে ৭০-৮০ জন মানুষ। জঙ্গিদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ইরাক সরকারের প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন হচ্ছে। এবং ইরাকের নুরি আল মালিকি সরকার এসব কিনছে আমেরিকা থেকে। মার্কিন ঠিকাদার আর ভাড়াটে সেনাদেরও তারা নিয়োগ করছে বিরাট সংখ্যায়। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের হিসাবে, ইরাকে নিযুক্ত ৫ হাজার যুদ্ধ সংত্রান্ত তথ্য বিশ্লেষক, সামরিক প্রশিক্ষক, অনুবাদক, নিরাপত্তা রক্ষক কিংবা রাঁধুনির মধ্যে হাজার দুয়েকই মার্কিনি। অর্থাৎ ইরাক সরকার এখন জঙ্গি হানাদারি ঠেকাতে আমেরিকার ওপরেই নির্ভর করে রয়েছে।
অথচ এই সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকাই, প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র মজুত করেছেন, এই মিথ্যা অজুহাতে ব্রিটেনসহ বেশ কয়েকটি স্যাঙাৎ দেশকে সঙ্গে নিয়ে ২০০৩ সালে বর্বর আগ্রাসন চালিয়েছিল সার্বভৌম ইরাকের ওপর। নারী-শিশুসহ ইরাকের হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে হত্যা করে গোটা দেশটাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে একটা পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছে এরা। একেই মার্কিন-ব্রিটেন জোট গণতন্ত্রের জয় বলে দেখিয়েছে। কিন্তু ইরাকে আজ বাস্তবে চলছে চরম নৈরাজ্য। শিয়া-সুন্নি বিরোধ উসকে দিয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী আল কায়দা এখন ইরাকে তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করছে। নির্বিচারে হত্যা করছে সাধারণ নাগরিক থেকে বিরুদ্ধবাদীদের। একে রুখতে পারে এমন ক্ষমতা মালিকি সরকারের নেই। ক্রমাগত আরও বেশি করে এই সরকার নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সাহায্যের ওপর।
ফলে পোয়া বারো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের। ইরাকে হানাদারির পিছনে সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে খনিজ তেলের ওপর দখলদারি কায়েম করার পাশাপাশি মার্কিন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করাও ছিল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার অন্যতম উদ্দেশ্য। এবার যুদ্ধবিধ্বস্ত ও প্রশাসনিক ভাবে দুর্বল ইরাককে তারা ব্যবহার করছে মার্কিন যুদ্ধ-ব্যবসার লোভনীয় খরিদ্দার হিসেবে।
ইরাক যুদ্ধ নানাভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। অস্ত্রশস্ত্রের বিক্রি বাড়িয়ে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মুনাফার ভাণ্ডার ভরিয়েছে, সেখানে মার্কিন সরকার নিয়োজিত ঠিকাদারদের ব্যবসা বাড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে, ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে কাজ পেয়েছে বহু কর্মহীন মার্কিন যুবক। দেশের সাধারণ মানুষের থেকে আদায় করা ট্যাক্সের বিপুল টাকা এভাবে যুদ্ধ ব্যবসায় ঢেলে নিজের দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা কাটানোর চেষ্টা চালিয়েছিল মার্কিন সরকার। কিন্তু এই নৃশংস হানাদারির বিরুদ্ধে পৃথিবী জুড়ে প্রবল বিক্ষোভ হয়। বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে আমেরিকার মানুষও। তারা দাবি তোলে, যুদ্ধের পেছনে সরকারি অর্থ ব্যয় করা চলবে না। ২০১১ সাল থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে আমেরিকা। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরও বেসরকারি প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর ইরাকে নিয়োগ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। বন্ধ হয়ে যায় ইরাকের পেছনে মার্কিন বাজেটের টাকা খরচ। কিন্তু তাতে মার্কিন যুদ্ধ ব্যবসায় এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। ব্যবস্থাটা শুধু উল্টে গেছে। এতদিন মার্কিন নাগরিকদের থেকে আদায় করা টাকা আমেরিকার সরকার খরচ করত ইরাকে যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ করতো, এখন ইরাক সরকার নিজের দেশের টাকা ঢালছে সেই সব মার্কিন যুদ্ধ সরঞ্জামের পেছনেই। পাশাপাশি আমেরিকার বেসরকারি সামরিক ঠিকাদাররাও ইরাক থেকে প্রচুর মুনাফ কামাচ্ছে। ট্রিপস ক্যানোপি, ডাইনকর্প ইন্টারন্যাশনালের মতো বেসরকারি মার্কিন সামরিক কোম্পানিগুলোর সাথে ইরাক সরকারের কয়েকশো কোটি ডলারের চুক্তি হয়েছে আগামী কয়েক বছরের জন্য। ইরাক সরকার ৬০০ কোটি ডলারের সামরিক সরঞ্জাম কিনছে আমেরিকার কাছ থেকে। আবার সেইসব সামরিক সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইরাক সরকারের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে খুব শিগগিরই দুশোরও বেশি মার্কিন ঠিকাদারের সে দেশে হাজির হওয়ার কথা।
আমেরিকারই বিদেশ-নীতি সংক্রান্ত একটি পত্রিকা বিশাল মাপের বেসরকারি প্রতিরক্ষা কোম্পানি ট্রিপল ক্যানোপির সাথে কথা বলে জানিয়েছে, মার্কিন ঠিকাদাররা নিজেদের উদ্যোগেই আপাতত বেশ কিছুদিন ইরাকে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাবে। কি করবে ঠিকাদারী কোম্পানিগুলো? ইরাক সরকার আমেরিকা থেকে আগে যেসব যুদ্ধ সরঞ্জাম, যানবাহন কিনেছিল, মূলত সেগুলোর রক্ষনাবেক্ষণ করাই এদের কাজ। অর্থাৎ মার্কিন সেনা ইরাক থেকে দেশে ফিরে গেলেও মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র ও ঠিকাদারদের সে দেশ থেকে মুনাফা লোটার কাজ আপাতত চলতেই থাকবে।
প্রথমে হানাদারি চালিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশের সম্পদ যতটা পারা যায় লুটপাট করা এবং তারপর সে দেশটিকে নানা ভাবে নিজের ওপর নির্ভরশীল করে তুলে সেখান থেকে দেদার মুনাফা লুটতে থাকা – মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই চেনা ষড়যন্ত্র ইরাকের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সফল। যুদ্ধ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদীদের বাঁচার উপায় নেই – মহান লেনিনের এই উক্তির প্রতিটি অক্ষরকে সত্য প্রমাণ করে এভাবেই দেশে দেশে যুদ্ধ বাধিয়ে তা থেকে ফায়দা লুটে নিজের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখে আমেরিকার মতো সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো। তাই আমেরিকার সামরিক শিল্প এবং বেসরকারি প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলির জিভ এখন লকলক করছে ইরাক থেকে বিপুল মুনাফা লোটার লোভে। যুদ্ধ যে একটা ব্যবসা, সে কথা হাড়ে হাড়ে বুঝতে হচ্ছে ইরাকের মানুষকে। [সাপ্তাহিক গণদাবী, ১৮ এপ্রিল ২০১৪]