Wednesday, November 20, 2024
Homeছাত্র ফ্রন্টপ্রশ্নপত্র ফাঁস : ছাত্রদের ক্রিমিনাল বানাচ্ছে কে?

প্রশ্নপত্র ফাঁস : ছাত্রদের ক্রিমিনাল বানাচ্ছে কে?

SAM_3668এবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়। এর আগেও অনেকগুলো পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো ছিল বিসিএস, মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার। এবার ফাঁস হলো ক্লাস ফাইভের পাবলিক পরীক্ষার। এই ঘটনায় যে শঙ্কা তৈরি হলো তা আগের যেকোন ঘটনার চেয়ে বেশি, কারণ অতটুকু ছেলে-মেয়েদের দিয়ে এ কান্ড কিভাবে করা সম্ভব!

এরপর যেন আর কোনো আব্রু থাকল না। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর আসতে লাগলো একের পর এক। সারাদেশে অধঃপতনের যেন এক জোয়ার বয়ে গেল। যারা এই ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ এর যুগেও নীতি-নৈতিকতা, বিবেক ইত্যাদির কথা ভাবেন তারা আজ দিশেহারা। নষ্ট হয়ে যাওয়ার এই বাঁধভাঙ্গা জোয়ার ঠেকানো যাবে কিভাবে? এভাবে চলতে থাকলে সততা টিকবে তো?

সরকারি প্রশাসন বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, ছাপা, বিতরণের সাথে জড়িত কিছু লোক এই ব্যবসা করেন, এর সাথে জড়িত সরকারের উপর মহলও। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। অথচ কাউকেই সরকার ধরতে পারছে না। কারণ তারা নিজেরাই এর সাথে জড়িত। ফলে বিসিএস-ভর্তি পরীক্ষা-উচ্চ মাধ্যমিক ছাপিয়ে এখন স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। দেশের সরকার দেশের মানুষকে রক্ষা করবে কোথায় বরং ৫/১০ টাকার জন্য তারা যেকোন কাজ করতে পারবে, গায়ের চামড়া পর্যন্ত রাখবে না— এ অবস্থায় পৌঁছেছে। এটা হলো এ ঘটনার একটা দিক। এর আরেকটি দিক আছে, যা সমাজের যেকোন সচেতন মানুষকেই ভীষণ ভাবনায় ফেলে দেয়। পঞ্চম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর প্রশ্নপত্র কেনার জন্য টাকা থাকার কথা নয়, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র যোগাড় করার জন্য সে বিভিন্ন জায়গায় ধর্ণা দিচ্ছে এটাও কোনো বাস্তবসম্মত চিন্তা নয়। তাহলে তাদের প্রশ্নপত্র কারা কিনছে? কারা পরীক্ষার আগে এগুলো তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে? পত্রিকার খবরে প্রকাশ, এ কাজ করছেন ওই শিশুদের শিক্ষক ও অভিভাবকরা।

একটি শিশুর নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধের প্রথম পাঠ হয় তার পরিবারে পিতামাতার কাছে। তারপর হয় স্কুলে —শিক্ষকদের কাছে। মিথ্যা বলা উচিত নয়, অন্যকে ঠকানো উচিত নয়, বিপদগ্রস্ত লোককে সাহায্য করা উচিত, অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো উচিত — এই শিক্ষাগুলো তো পরিবার ও বিদ্যালয়েই শিশুরা শেখে। তার কোমল মন, সহযোগিতা করার মন, সৌন্দর্য্য গ্রহণ করার মন গড়ে উঠে এই দুই জায়গায়।

আজ কি কথা শোনা যাচ্ছে এই অভিভাবক-শিক্ষকদের সম্পর্কে? এও কি ভাবা গিয়েছিল কখনও যে বাবা-মারা তাদের সন্তানদের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দিয়ে বলবেন এটা পড়ে যা, কাল পরীক্ষায় আসবে? কিংবা পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক পরীক্ষার আগের দিন ছাত্রকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দিয়ে প্রস্তুত করে দেবেন? ছাত্র ভালো রেজাল্ট করেছে, চারিদিকে তার জয়জয়কার পড়ছে, শিক্ষকও সেই ভাগ নিচ্ছেন। অথচ এই সাফল্যের পিছনে আছে গ্লানিময় ঘটনা। এই ঘটনা বিস্ময়কর, এই ঘটনা ঘৃণ্য! ভীতিকরও। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কিভাবে গড়ে তুলছি? দেশের একজন জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষাবিদ যিনি নীতিগত প্রশ্নে এই সরকারের সমর্থক, তাকে বিভিন্ন ছাত্র-ছাত্রী ই-মেইল করেছে, ফোন করেছে, বাস্তব ঘটনা জানিয়েছে। তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন ‘আমাদের শিশুদের লেখাপড়ার দরকার নেই। দোহাই তাদের ক্রিমিনাল করে বড় করবেন না।’

হ্যাঁ, এভাবে চলতে থাকলে গোটা প্রজন্মটাই ক্রিমিনাল হয়ে বড় হয়ে উঠবে। পত্রিকায়, ফেসবুকে অনেক লেখা এসেছে, অনেক ঘটনা এসেছে। সবাই প্রথমেই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সংগ্রহ করতে চায়নি। নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিতে চায়নি। কিন্তু একটার পর একটা পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়া দেখে আর সৎ থাকতে পারেনি। কারণ তাতে সবার ভালো হচ্ছে! বাবা-মা সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য প্রশ্ন হাতে তুলে দিচ্ছেন। প্রতিষ্ঠার জন্য এই বয়সে হাতে ধরে যে কুকর্ম শেখানো হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে ওই একই প্রশ্নে ‘প্রতিষ্ঠার’ জন্য বাবা-মাকে ফেলে দিতে হলেও দেবে।

শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে নৈতিক জোর লাগে। এই অভিভাবকদের তা আছে কি? অনেক ছেলেমেয়ে অসম্ভব মানসিক কষ্টের মধ্যে থেকেও শেষপর্যন্ত ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখেনি। অনেকে বাবা-মা প্রশ্ন সামনে দেবার পরও দেখেনি। তাদের কিছু অভিজ্ঞতার কথাও পত্রিকায় এসেছে। এ ধরনের নৈতিক জোরের ছেলে-মেয়েরাই শেষ পর্যন্ত সমাজকে পথ দেখায়। সততার সংগ্রাম টিকিয়ে রাখে। আগে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে মূল্যহীন হয়ে গেল যে পরীক্ষা, সেটাতে উচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য আফসোস করা কি সাজে? নষ্ট জিনিস ছুড়ে ফেলার শিক্ষা যার হয়নি, ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করলেই কি সে শিক্ষিত হয়? বিষয়গুলো আমরা সমাজের সকল সচেতন মানুষকে ভেবে দেখতে বলব।

‘একটু না দেখলে তো আমি পুরো প্রতিযোগিতা থেকেই পিছিয়ে পড়ে যাব’— ফলে জীবনে প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় জয়ী হবার জন্য, বিবেকের এত বড় পরাজয় মেনে নিতে হচ্ছে। এটা তো যাদের ভাববার জ্ঞান আছে তাদের জন্য- এসএসসি, এইচএসসি কিংবা তার উপরের স্তরের পরীক্ষার্থীদের। কিন্তু ক্লাস ফাইভের ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে? তাদের তো এখনও সে জ্ঞানও হয়নি। ভালোমন্দ বোঝার জ্ঞান হবার আগেই সে এতবড় অপরাধে যুক্ত হয়ে গেল। বিশাল বিস্তৃত যে জীবন সামনে আছে তার বাঁকে বাঁকে এরা নিজেদের পতন থেকে রক্ষা করতে পারবে? যে শিক্ষা নিয়ে তারা বড় হচ্ছে, তাতে ভালো-মন্দের পার্থক্য তাদের সামনে থাকবে তো? আমাদের শিশু-কিশোররা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ Ñ এটি কথায় কথায় বলা হয়। এরা বড় হয়ে দেশ চালাবে, বড় বড় জায়গায় যাবে। তাহলে নীতিহীন-মূল্যবোধহীন একদল ক্রিমিনাল তৈরি করে তাদের হাতেই আমরা আমাদের দেশকে তুলে দেব?

আমাদের সমাজব্যবস্থায় সরকার মাত্রই ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের ব্যাকিং-এর সরকার। তাদের টাকায়, তাদের মতামতে তাদের সুবিধার জন্য এখানে সরকার গঠিত হয়। বাস্তবে সরকার হলো তাদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার। এরকম ব্যবস্থায় ব্যবসায়ীদের মুনাফার স্বার্থেই সবকিছু পরিচালিত হয়। নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ সবকিছুই তাদের কাছে অর্থহীন। ফলে সমাজের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত এ ধারণাই সঞ্চারিত। এ হেন সরকার পুরোপুরি দুর্নীতিগ্রস্ত। তার প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। ফলে টাকার জন্য প্রশ্নফাঁস করে দিতে তাদের এতটুকু বাধে নি। এর সাথে শুধু কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়— সরকারের উপরের মহলও জড়িত। তাই এত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষামন্ত্রী-সচিব সবাই প্রশ্নফাঁস হয়নি বলে বাস্তবে এই দুষ্কর্মের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন। সরকারের এই জঘন্য কামর্ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জরুরি। কিন্তু দেশের শিক্ষক-অভিভাবক, যারা একটা সামান্য ভালো রেজাল্টের জন্য নীতি-নৈতিকতা সব বিসর্জন দিচ্ছেন, তাদের তো এইটুকু ভাবা উচিত— তাদের এই সন্তান বড় হয়ে মন্যুষত্বের চিহ্নটুকু তার চিন্তার মধ্যে রাখবে না।

অনুশীলন : এপ্রিল ২০১৫

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments