Friday, April 26, 2024
Homeঅনুশীলনপ্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০১৬ : একটি পর্যালোচনা

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০১৬ : একটি পর্যালোচনা

cover onnushilon copyএকটি গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজের কথা মানুষ ভুলতে বসেছে। গভীর অন্ধকার গহ্বর যেন দিনের আলোকে গ্রাস করছে। হত্যা, গুম, ধর্ষণ, চরম নিরাপত্তাহীনতায় এক একটি দিন পার হচ্ছে। প্রতিবাদ যদিও হচ্ছে, প্রতিকার নেই কোথাও। তবুও শাসকেরা বলছে, সব কিছু স্বাভাবিক আছে। মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে চাপিয়ে দিচ্ছে একের পর এক বিধি-বিধান, সিদ্ধান্ত। গত ৩ এপ্রিল ’১৬ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে শিক্ষা আইনের খসড়া উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু মতামতের জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে মাত্র ৭ দিন। তাও আবার ই-মেইল করে মতামত জানাতে হবে। শিক্ষা নিয়ে আইন প্রণয়নে এই তাড়াহুড়ার উদ্দেশ্য কী? আর এমন একপাক্ষিক মতামত দেয়ার কার্যকারিতাই বা কী? ফলে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট এমন ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-রাজনৈতিক কর্মী-অভিভাবক তো নয়ই দেশের ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি গণতান্ত্রিক ধারার ছাত্র সংগঠনগুলো কেউই তাদের মতামত জানাতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নেই। চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রণীত হচ্ছে শিক্ষা আইন ২০১৬।

শাসকশ্রেণীর বাগাড়ম্বর আর ঢাক-ঢোলের বাদনে চাপা পড়েছে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং আকাক্সক্ষার কথা। সরকার প্রায়শই বলে আমরা বেশ এগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষার হার বেড়েছে, বাড়ছে ডিগ্রিধারীর সংখ্যা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। কিন্তু শিক্ষার এত বিস্তৃতির পরও পুরো সমাজ অমানবিক হয়ে উঠছে কেন? স্বার্থপরতা, ধর্মান্ধতা ক্রমশ বাড়ছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে সমাজ, রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থার রোগ নির্ণয় জরুরি।

স্বাধীন দেশে যত শিক্ষানীতি-আইন-বিধিবিধান প্রণীত হয়েছে কোনোটিতেই শিক্ষার সর্বজনীন অধিকারের কথা স্বীকৃত হয়নি। বরং দিনের পর দিন শিক্ষার বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণ-রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংকোচনের ধারা ত্বরাণ্বিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ গত ৩ এপ্রিল শিক্ষা আইন ২০১৬-এর খসড়া উপস্থাপিত হয়েছে। শিক্ষা আইনের খসড়া উপস্থাপিত হবার পর হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি ইসলামী সংগঠন এই আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছে। তাদের দাবি এই আইন নাস্তিকতাকে উস্কে দেবে, এখানে ধর্মশিক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি ইত্যাদি। অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’ নামের একটি সংগঠন শিক্ষা আইনে কয়েকটি ধারার সংশোধন চেয়েছে। ধারাগুলোতে নোট-গাইড বইয়ের সংজ্ঞা এবং এই বইগুলো প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে বলা আছে। উক্ত বিষয়সমূহে আমাদের বক্তব্য প্রবন্ধের পরবর্তীতে আলোচিত হয়েছে।

এখানে আরেকটি বিষয় বলা প্রয়োজন- নীতি ও আইনের মধ্যে পার্থক্য। নীতি হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে সরকারের লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনে প্রণীত কর্মপন্থা। নীতির আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। আর আইন হলো সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার বাধ্যতামূলকভাবে যে পদ্ধতি, করণীয়, নির্দেশনা স্থির করে। আবার আইনের মধ্যেও পার্থক্য আছে। শিক্ষা আইনের ছত্রে ছত্রে শাস্তির বিধান পড়লে মনে হবে এটি কেবল শাস্তির উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছে। অথচ এটি একটি নীতি নির্ধারণী আইন হতে পারতো। যেখানে শিক্ষাসংকটের উৎস ও তার প্রতিকারের বিষয়গুলো প্রধানভাবে বিবেচনার বিষয় হতো।

অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক ও বাণিজ্যিকীকরণের শিক্ষানীতির ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে শিক্ষা আইন ২০১৬

গত ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সভাপতিত্বে একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। কমিটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন (১৯৭৪), শামসুল হক কমিটির প্রতিবেদন (১৯৯৭) এবং ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০’ কে বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়ে ৩ সেপ্টেম্বর ’০৯ তারিখে সরকারের কাছে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া)’ পেশ করেছিল। যা পরবর্তীতে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ নামে সংসদে পাশ হয়। সেই সময়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে শিক্ষানীতির বিভিন্ন অসঙ্গতির দিক তুলে ধরে আমরা শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করে আমাদের মতামত তুলে ধরি।

শিক্ষানীতিতে বাস্তবে দেশের গণমানুষের কোনো আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। একটি সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার, একই পদ্ধতির, গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতির জন্য এ দেশের ছাত্রসমাজের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ তৈরির জন্য শিক্ষানীতিকে ঢেলে সাজানো হয়েছিলো, মানবিক-গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের পরিপূরক নীতি সেখানে গৃহীত হয়নি। বহুধারায় বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। নানা মুখরোচক কথার আড়ালে শিক্ষার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। শিক্ষানীতির ৬ বছর পার হওয়ার পর আমরা দেখছি, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণের জোয়ার বইছে। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ এবং ২০১৮ সালের মধ্যে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হবে। বাস্তবে এসব অঙ্গীকার পূরণের ধারে কাছেও সরকার যেতে পারেনি। ১৩ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষাকে বহাল রেখে এবং তিনধারার শিক্ষাব্যবস্থা (ইংরেজি, মাদ্রাসা, সাধারণ মাধ্যম) বজায় রেখে কিছু অভিন্ন পাঠ্যপুস্তুক সংযোজন করে বলা হয়েছিল শিক্ষা ব্যবস্থাকে একমুখী করা হয়েছে। বাস্তবে এ ধরনের সমন্বয় শিক্ষাক্ষেত্রে একমুখীনতা তো নয়ই একটা জগাখিচুরি ছাড়া আর কোনো ফল তৈরি করেনি। কমিশন নতুন নতুন কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য পর্যায়ক্রমে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ব্যবস্থা অনুসরণ করার প্রস্তাব করেছিল। (পৃষ্ঠা-১৭, অধ্যায়-৫) অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হলেও (যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য) বেসরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ‘উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যয় নির্বাহের জন্য শিক্ষার্থীর বেতন ব্যবহার করতে হবে’ কেননা ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ভর্তি ফি ও বেতন খুবই সামান্য।’ (অধ্যায়-৮ উচ্চশিক্ষা, পৃষ্ঠা- ২৪) কারিগরি-বৃত্তিমূলক শিক্ষা আর চাকুরিমুখী শিক্ষার কথা বলে সুপারিশ করেছিল তথ্য ও প্রযুক্তি শিক্ষা প্রসারের। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও সুপারিশ করা হয়েছিল। শিক্ষায় সরকারি-বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র অবারিত করার কথা বলা হয়েছে। যদিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যা- ক্লাসরুম-শিক্ষক সংকট কিংবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট ঘাটতি, সরকারি নিয়ন্ত্রণ, গবেষণা খাতের বেহাল অবস্থা নিয়ে কোনো বক্তব্য শিক্ষানীতিতে ছিলো না। এভাবে শিক্ষার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে ক্রমাগত সংকুচিত করে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার সমস্ত সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এমনই একটি শিক্ষানীতির আইনি বৈধতা দেয়া ছাড়া শিক্ষা আইন ২০১৬ বর্তমান নৈরাজ্যকর শিক্ষাব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না।

বৈষম্যহীন অবৈতনিক ‘নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত শিক্ষা’ আবারও প্রহসনে পরিণত হতে যাচ্ছে

এই আইনটি প্রণীত হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, “…নিরক্ষরতা দূরীকরণ, আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান, একীভূত ও জীবনব্যাপি শিক্ষা এবং একই পদ্ধতির সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রহিয়াছে।” সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা কতটুকু রক্ষা করেছে সরকার? প্রথমত ‘আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক’ শিক্ষাদানের কথা বলে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছিলো। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে অগ্রগতি কতটুকু? যদিও জ্ঞান বিজ্ঞানের এ বিপুল অগ্রগতির যুগে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। বাধ্যতামূলক শিক্ষা কোন স্তর পর্যন্ত হবে তা নির্ধারিত হয় একটা সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিমন্ডল ও সামাজিক প্রয়োজনের নিরিখে।

’৯০ সালে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের উত্থাপিত ১০ দফায় ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার দাবি উঠেছিলো। এরপর ২৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বর্তমান দেশের অগ্রগতির প্রয়োজনের নিরিখে স্নাতক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষার স্তর হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। অথচ এখনো প্রাথমিক স্তরে সরকারি হিসেবে ড্রপ আউটের হার ২৩ শতাংশ। দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনো অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। সরকারি হিসাব মতে, দেশে শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ।  প্রকৃতপক্ষে এ হার আরও কম। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ৪৫ লাখ শিশুর মধ্যে প্রায় অর্ধেক প্রতিবছর পঞ্চম শ্রেণিতেই ঝরে যায়। এই ঝরে পড়া রোধে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোতে শিক্ষক নেই, প্রায় ২০ হাজার সরকারি স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ খালি পড়ে আছে, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। আইনে বলা হয়েছে- ‘সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় প্রাক প্রাথমিক স্তর থাকিতে হইবে এবং সকল শিশুর জন্য তা বাধ্যতামূলক হইবে এবং ইহা শিশুর অধিকার বলে গণ্য হইবে।’ (ধারা-৫/১) কথাগুলি একবারে হাস্যকর এবং অস্পষ্টতায় ভরা। বাধ্যতামূলক করার দায়িত্ব কে নেবে? সরকার নাকি অভিভাবক? দায়িত্ব না নিলে কাকে শাস্তি পেতে হবে? আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও ভর্তিযোগ্য যেকোনো শিশুকে প্রতিষ্ঠানগুলো ভর্তি করাতে বাধ্য থাকবে?  যদি তা না হয়, ‘আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত’ বাধ্যতামূলক শিক্ষা কীভাবে নিশ্চিত হবে?

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বহু ধারায় বিভক্ত। ইংরেজি মাধ্যম, মাদ্রাসা, সাধারণ ধারা তো বটেই প্রত্যেক ধারার মধ্যে আবার বহু উপধারা আছে। শিক্ষাব্যবস্থায় এই বহুধা বিভক্তির কারণে পরস্পর বিরোধী মনোভাবের মানুষ তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু তাই নয়, আর্থিক সঙ্গতির উপর নির্ভর করছে কে কোন ধারায় পড়াশুনা করবে। এখানে ধনীর জন্য এক আর গরীবের জন্য আরেক ধারার শিক্ষা। পড়াশুনা করতে এসে খুব ছোট বয়সেই একটি শিশু বুঝে নেয় তার সামাজিক-আর্থিক অবস্থান। শিক্ষা আইনে বলা হয়েছে, “সকল শিশুর জন্য বৈষম্যহীন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করিবে; যাহাতে লিঙ্গ, ভাষা, বর্ণ, ধর্ম, নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীতা অথবা অন্য কোন কারণে শিশুর প্রতি কোনরূপ বৈষম্য সৃষ্টি না হয়।” (৫/৪ নং ধারা) বৈষম্য আছে এটা সরকারও স্বীকার করছে। সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম, এনজিও পরিচালিত স্কুল ইত্যাদি প্রত্যেকটি ধারার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতি আছে। বিভিন্ন ধরনের এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুযোগ সুবিধার প্রকট বৈষম্যও রয়েছে। কিন্তু তা দূর করবার যে আশাবাদ আছে তা গত ৪৫ বছরেও সফল হয়নি। বরং প্রতিনিয়ত ধনী-গরীব পার্থক্য তীব্রতর হয়েছে। একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। ধনীর সন্তানরা যেসব স্কুুলে পড়ে তার মধ্যে বারিধারায় অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ভর্তি ফি ১০ লাখ ৩ হাজার টাকা। বাৎসরিক টিউশন ফি ছাড়া অন্যান্য ফি বাবদ লাগে ১৭ লাখ ২১ হাজার টাকা। প্রাথমিক শিক্ষাতেই এমন বৈষম্যের কথা সরকার জানে। কিন্তু শিক্ষা আইনে অর্থহীন আশাবাদ ছাড়া, কার্যকর কোনো ব্যবস্থার কথা কি বলা হয়েছে?

গত ৩ মে অনুষ্ঠিত প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের উপর প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের উপর গোলটেবিল বৈঠক
গত ৩ মে অনুষ্ঠিত প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের উপর প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের উপর গোলটেবিল বৈঠক

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণের বৈধতা শিক্ষার মর্মবস্তুকে ধ্বংস করবে

মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। ১৮,৭৯৫টি মাধ্যমিক স্কুলের মধ্যে মাত্র ৩২৩টি সরকারি। এই পরিস্থিতিতে নতুন করে জনসংখ্যার অনুপাতে সরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের কথা শিক্ষা আইনে থাকতে পারতো। ১২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৩৭টি সরকারি। ধারা ৪০(৬) এ বলা হয়েছে, “সরকার বিধি দ্বারা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফিসসমূহ যৌক্তিকহারে নির্ধারণ করিবার জন্য একটি রেগুলেটরী কমিশন গঠন করিবে।” এখানে  ‘যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ’ কথাটির কী মানে থাকতে পারে? আমরা যদি বিগত সময়গুলোর দিকে তাকাই দেখবো প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সকল ক্ষেত্রে লাগামহীনভাবে ফি বেড়েছে। সরকার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফি বাড়ানোর পক্ষে যুক্তিও (আসলে কুযুক্তি) করেছে। এর বিপরীতে ছাত্রসমাজের আন্দোলনও ছিল। তাই সরকারের কাছে যেটি যৌক্তিকতা, ছাত্র-জনতার কাছে তা নয়। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, দেশের তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ নিয়ে মূল্য নির্ধারণের জন্যও রেগুলেটরি কমিশন আছে। এই কমিশনের কাজ হলো মতামত নেয়ার অভিনীত আয়োজন সেরে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো। এমন জাতের রেগুলেটরি কমিশন গঠন করে কতটুকু যৌক্তিক ফি নির্ধারণ সম্ভব? তবে সরকারের শিক্ষাব্যবসার আকাক্সক্ষা সরাসরি বেরিয়ে পড়ে ধারা ৪০(৭) পড়লে। যেখানে বলা হয়েছে, “পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত টিউশন ফি-এর বিনিময়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স/এক্সিকিউটিভ কোর্স চালু রাখিতে পারিবে।” এবং ৪১(৫) এ বলা হয়েছে, “উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপকে উৎসাহিত করিবে।” সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সান্ধ্যকালীন কোর্স বা এক্সিকিউটিভ কোর্সের ফলাফল কি তা আমরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের বক্তব্যে দেখিয়েছি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার এ ধরনের কোর্স চালু হবার পর দিনের বেলা রেগুলার কোর্সগুলোতেও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সন্ধ্যা বেলার কোর্সের অনুপাতে দিনের বেলায় যারা মেধার ভিত্তিতে পড়ছে তাদেরও অনেক বেশি ফি দিয়ে পড়তে হচ্ছে। বেশি টাকা পাচ্ছেন বলে শিক্ষকরাও সন্ধ্যায় পড়াতে আগ্রহী হচ্ছেন। এই প্রক্রিয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধীরে ধীরে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগের পথ অবারিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন বিভাগে ল্যাব, লাইব্রেরি, ক্লাসরুম সংস্কার, টিএসসি সংস্কার, র‌্যাগ ডে-তে স্পন্সর ইত্যাদির মাধ্যমে বেসরকারি পুঁজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। সিলেবাস-কারিকুলামও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি করা হচ্ছে। শিক্ষানীতিতে যার সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল।

জাতীয়  বিশ্ববিদ্যালয়ে পাহাড় সমান সংকট নিরসনে কোনো নির্দেশনা শিক্ষা আইনে নেই। প্রচ- শিক্ষক স্বল্পতা (এক তৃতীয়াংশ শিক্ষক আছেন), প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, আবাসন-পরিবহন সংকট, হল-সেমিনার ইত্যাদি সংকট এখানে বিদ্যমান। জ্ঞান বিতরণ নয়, কেবল পরীক্ষা নেয়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে কলেজগুলো। বছর বছর নিয়ম পরিবর্তন, নামে-বেনামে নিত্যনতুন ফি নির্ধারণের মাধ্যমে ছাত্রদের গিনিপিগে পরিণত করা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা আইনে একটি বাক্যও ব্যয় করা হয়নি।

রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে অস্বীকার করে বেসরকারিকরণ, পিপিপি-র প্রস্তাব করা হয়েছে

দেশের সিংহভাগ মানুষ যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, সেখানে দরিদ্র মানুষের সন্তানরা শিক্ষার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটাতে না পেরে স্তরে স্তরে ছিটকে পড়ে। এই অবস্থায় শিক্ষার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার রাষ্ট্র না নিলে সর্বজনীন শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব নয়। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার বর্তমান সংকটের মূল কারণ হলো এই খাতে ক্রমাগত রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংকোচন। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়।’ শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের সরকারি ব্যয় জিডিপি’র মাত্র ২.২৩ শতাংশ যা নেপালের চাইতেও কম। ভারতে যা ৪ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় ৬ শতাংশের বেশি। এমতাবস্থায় শিক্ষার অর্থায়নের প্রসঙ্গটি শিক্ষা আইনেও আড়াল করা হয়েছে। যেমন প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাকে বর্ধিত করতে বিদ্যমান স্কুলগুলোতে কি পরিমাণ কক্ষ লাগবে, তার আনুমানিক ব্যয় কত এবং তা বাস্তবায়ন করতে অর্থসংস্থান কোথা থেকে হবে — এসব বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। শিক্ষানীতিতে প্রস্তাব করা হয়েছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত হবে ৩০:১। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এ বিষয়টি কথার কথাতেই থেকে গেছে। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজসমূহে রয়েছে প্রকট শিক্ষক স্বল্পতা। পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগের জন্য জনবল কাঠামোর পরিবর্তন করে যে ধরনের আইনি নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের নামে বাণিজ্যিকীকরণের পথকে প্রশস্ত করার বৈধতা দিয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে “সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত নিজ নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনা করার” অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে শুধু শাস্তি দিয়ে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা যাবে না

সারাদেশে কোচিং বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা। তাই কোচিং সেন্টার বন্ধে এবারের হুঙ্কারও আসলে বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই নয়। কোচিং বন্ধে সরকারের এত বড় বড় কথা বলার প্রয়োজন ছিলো না। যদি তারা স্কুলেই শিক্ষাদান করতো, যদি শিক্ষক বাড়াতো, শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতো, অন্যান্য আয়োজন নিশ্চিত করতো তাহলে শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারে যাওয়ার আর কোনো প্রয়োজন হতো না। শিক্ষা আইনে বলা হয়েছে, “সরকার প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।” (ধারা ৫৪/১) আবার সরকারের কোচিং নীতিমালা স্কুলে কোচিং ব্যবসাকে একেবারে বৈধ করে দিয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সব স্কুলগুলোতে বাধ্যতামূলক কোচিং করতে হয়।

বর্তমানে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে শিক্ষক স্বল্পতা ২০ শতাংশ, ২৯ শতাংশ স্কুলে পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই, ৭৮ শতাংশ স্কুলে নেই ল্যাবরেটরি। পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালুর পর অধিকাংশ ছাত্র আগে যেখানে বিজ্ঞান, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে কোচিং করতো এখন বাংলা বা সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোর জন্যও তাকে কোচিং এ যেতে হচ্ছে। ‘স্কুলে  সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়ন সাধন করিবে এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ প্রাপ্র্যতা নিশ্চিত করিবে’ বলা হলেও কীভবে এটি নিশ্চিত হবে তা অস্পষ্ট। প্রকট শিক্ষক সংকটের বর্তমান পরিস্থিতিতে সৃজনশীলতার পাঠ দেবে কারা? পত্রিকায় এসেছে ৩২৩টি সরকারি স্কুলের ২১৩টিতেই প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। আবার ১৫৩২টি সহকারি শিক্ষকের পদ ফাঁকা পড়ে আছে। ফলে শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক স্বল্পতা প্রায় প্রতিটি স্কুলে। স্কুলগুলোতে এক সেকশনের জন্য বিষয়ভিত্তিক একজনের বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার নিয়ম নেই। ফলে দেখা যাচ্ছে একজন শিক্ষককেই একাধিক বিষয়ের উপর ছয়টি শ্রেণিতে ক্ষেত্র বিশেষে ৮ ঘন্টা করে ক্লাস নিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ৪৫ মিনিট সময়ে একজন শিক্ষকের পক্ষে ক্লাস ভর্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিন্তা, বুদ্ধি আর কল্পনা শক্তির বিস্তার ঘটানো সম্ভব নয়। ফলে প্রাইভেট বা কোচিংই যেন শেষ ভরসা।

সৃজনশীল পদ্ধতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে আর একটি বড় সমস্যা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আনুষঙ্গিক আয়োজনের অভাব। এ কারণে বিজ্ঞান শিক্ষায় ছাত্র কমছে দিন-দিন। বিজ্ঞানাগার এবং বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাবের কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সিলেবাস শেষ করাও তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ অবস্থা বজায় রেখে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির সফলতা কীভাবে আশা করা যাবে? এছাড়া প্রায় প্রত্যেক স্কুলের লাইব্রেরি অকার্যকর। নেই কোনো সাংস্কৃতিক আয়োজন ও ললিত কলা শিক্ষা। অবস্থার মূল্যায়ন ছাড়াই শিক্ষা আইনের ৫৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, “মুখস্থবিদ্যাকে নিরুৎসাহিত করিবার লক্ষ্যে সকল পরীক্ষা সৃজনশীল পদ্ধতিতে গ্রহণ করিতে হইবে।” বলা হয়েছিল, মুখস্থ বিদ্যা, গাইড বই এবং কোচিং বন্ধ করার জন্য সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বাস্তবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ ছাড়া কোচিং, গাইড বই বা মুখস্থ বিদ্যা বন্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগের নীতি ও আইনগত বাধ্যবাধকতা কোনোটাই নিশ্চিত করা হয়নি।

সহায়ক পুস্তিকার নামে গাইড বইয়ের অনুমোদন

অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় গাইড বইয়ের এখন বিপুল দৌরাত্ম্য। আজ দেখা যাচ্ছে, গাইড বই কেবল যে শিক্ষার্থীরা কিনছে তা নয়, শিক্ষকরা পর্যন্ত তা দেখে ক্লাসে পাঠদান করছেন। এখন পঞ্চম শ্রেণীর জন্য বাজারে ৩৫ রকমের গাইড বই পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির জন্যও গাইড বই-নোট বইয়ের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে অহরহ সমালোচনা হচ্ছে। সরকারও চতুরতার সাথে বিষয়টিকে আমলে নিয়েছে! ধারা ৭(৬) এ বলা হয়েছে, “জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক পান্ডুলিপিঅনুমোদন গ্রহণ করিয়া কেবলমাত্র কোন প্রকাশক/প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তি সহায়ক শিক্ষা উপকরণ বা সহায়ক পুস্তক বা ডিজিটাল শিখন-শেখানো সামগ্রী প্রকাশ করিতে পারিবে। কিন্তু কোন প্রকার নোটবই বা গাইডবই প্রকাশ করিতে পারিবে না।” এখানে নোটবই-গাইডবই প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সহায়ক পুস্তিকা প্রকাশে কোনো বাধা নেই। এক্ষেত্রে এনসিটিবি’র অনুমোদন সাপেক্ষে পুস্তিকা-শিক্ষাউপকরণ বের করতে পারবে যেকোনো প্রকাশক, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত শিক্ষাপ্রশাসন ঘুষ খেয়ে বই বের করার অনুমোদন দেবে না তার গ্যারান্টি কী? আমাদের আশঙ্কা, নোট-গাইড বইয়ের মতোই তথাকথিত সহায়ক পুস্তিকা পাঠ্যপুস্তকের বিকল্প হবে, নোট বই-গাইড বইয়ের মতোই বাজারে চলবে। ফলে এখনকার এই পরিস্থিতির ইতর বিশেষ পরিবর্তন হবে না। আমাদের আশঙ্কার আরও একটি কারণ হলো- ২০১০’র শিক্ষানীতিতেও বলা হয়েছিল, “গাইড বই, নোট বই… প্রভৃতির ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া ও শিক্ষার মান অর্জন বিশেষভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। … একদিকে যারা গাইড বই ও নোট বই তৈরি ও সরবরাহ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। … তাছাড়া গাইড বই, নোট বই ও কোচিং-এর অপকারিতা সম্বন্ধে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা হবে।” কিন্তু গত ৬ বছরে এর বিপরীত ঘটনাই ঘটেছে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো মারাত্মক অপরাধকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে

১৯৮০ সালে পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি আইন হয়েছিলো। তৎকালীন সরকার ‘পাবলিক পরীক্ষা আইন’ প্রণয়ন করেছিলো। যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ১০ বছরের কারাদন্ডের বিধান ছিলো। এরপরও ধারাবাহিকভাবে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রায় কেউই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় আসেনি। গত ৫/৬ বছরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি মহামারী আকার নিয়েছে। এমন কোনো পাবলিক পরীক্ষা নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়না। এমনকি প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাতেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই অস্বীকার করা হয়েছে, গুজব বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কখনো ফাঁসের তথ্য প্রকাশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবার হুমকিও দেয়া হয়েছে। অথচ ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র কেনা-বেচার খবর ছাত্র-অভিভাবকদের মুখে মুখে। র‌্যাব-পুলিশ চাইলেই এসব অপরাধীদের ধরতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করেনি। সর্বশেষ মেডিকেল পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সরকার প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায় তো স্বীকার করেইনি উপরন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া ইউজিসি’র এক কর্মকর্তা পুলিশি হেফাজতে মারা গেছেন। এটা সহজেই বোধগম্য, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনা রাজনৈতিক মদতপুষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতা ছাড়া দিনের পর দিন এভাবে চলতে পারে না। এটি আমাদের দেশের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিরই ফলাফল। এমন একটি মারাত্মক অপরাধের ব্যাপারে সরকার শিক্ষা আইনে একটি শব্দও উল্লেখ করেনি। প্রথমবার যখন এই আইনের খসড়া উপস্থাপিত হয়েছিল তখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের শাস্তি ১০ বছর থেকে কমিয়ে ৪ বছর করা হলো। এবারের খসড়ায় সেই ন্যূনতম শাস্তিটুকুও রাখা হয়নি। ফলে এ নিয়ে সরকারের মনোভাব বুঝতে আর কিছু বাকী থাকে না।

শিক্ষকের বেতন ভাতা ও সামাজিক মর্যাদা নিয়ে অস্পষ্ট বক্তব্য

শিক্ষা আইনের শুরুতে ‘সংজ্ঞা’ অধ্যায়ে শিক্ষকের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে- “শিক্ষক অর্থ প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং ডিপ্লোমাসহ উচ্চশিক্ষার সকল স্তরে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ও স্বীকৃত আনুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত কোন ব্যক্তি”। আর ৫৭ নং ধারায় বলা হলো, “সরকার সকল শিক্ষকগণের যথাযথ মর্যাদা প্রদান করিবে।” কিন্তু শিক্ষকের মর্যাদা এবং অধিকার কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে তা গোটা শিক্ষা আইনে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে শিক্ষকরা জ্ঞানের আলো জ্বালাবেন, মনুষ্যত্বের দীক্ষা দিবেন, তারা যদি আর্থিক দুরবস্থায় জীবন যাপন করেন, তাহলে মানুষ গড়ে তুলবেন কীভাবে? একদিকে কম বেতন, অন্যদিকে সামাজিক অনিশ্চয়তার কারণে শিক্ষকরা যেকোনোভাবে অর্থ উর্পাজনে মরিয়া হয়ে ওঠেন। আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত না করে কেবল মুখের কথায় ‘যথাযথ মর্যাদা’ প্রতিষ্ঠা করা যাবে?

বৈষম্যপূর্ণ অষ্টম বেতন কাঠামো বাতিলের দাবিতে যখন আন্দোলন চলছিল তখন তা নিয়ে মন্ত্রী এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীও কটাক্ষ করেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘জ্ঞানের অভাবে শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছেন’। শিক্ষকদের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করলেও কিছুদিন পরেই প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত কঠোর ভাষায় শিক্ষকদের শাসিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি মনে হয় একটু বেশি দিয়ে ফেলেছি। কমিয়ে দেয়া বোধ হয় ভালো ছিল।’ যেন প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত তহবিল থেকে শিক্ষকদের অর্থ দিচ্ছেন, দয়া দেখাচ্ছেন! রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন কর্তাব্যক্তিরা যখন শিক্ষকসমাজকে এভাবে অপমানিত করেন তখন তাদের প্রণীত শিক্ষা আইনে শিক্ষকসমাজের স্বার্থে কী থাকতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কিছুদিন আগে নন-এমপিও শিক্ষকরা বেতনের দাবিতে দিনের পর দিন রাস্তায় অবস্থানের পর শেষপর্যন্ত পুলিশের অত্যাচার-নিপীড়ন সয়ে ফিরে গেছেন। আমরা মনে করি, শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতি ঘটাতে হলে শিক্ষকসমাজকে সর্বোচ্চ বেতন কাঠামোর আওতায় আনতে হবে এবং সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। তাই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতির পরেই শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধার বিধান থাকা দরকার।

শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণের সুপারিশ আছে শিক্ষা আইনে

ইউরোপে রাজার শাসন তথা সামন্ততন্ত্রকে পরাস্ত করে গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা সমাজে এসেছিলো। সেই সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক চর্চার মধ্য দিয়ে সমাজের মধ্যকার কূপমন্ডূকতা, নানা ধরনের কুসংস্কার ও অশিক্ষা থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য তৈরি হয়েছিল সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক শিক্ষার আকাক্সক্ষা। গণতান্ত্রিক মানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জন্য শিক্ষার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করা। হাজার বছর ধরে মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান সাধারণীকৃত ও সংযোজিত করে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। পূর্ব পুরুষদের সৃষ্ট এই সমস্ত কিছুর উপর অধিকার আমাদের প্রত্যেকেরই আছে। এখানে জাতি-ধর্ম বলে কিছু থাকতে পারেনা। তাই শিক্ষার অধিকার গণতান্ত্রিক। আর সেক্যুলার শিক্ষা মানে পার্থিব শিক্ষা। বস্তুর অভ্যন্তরে যে নিহিত নিয়ম থাকে তাকে যথাযথভাবে জানবার শিক্ষা। বিজ্ঞানের হাতিয়ার ছাড়া এভাবে জানা সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা। একটি সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক চিন্তা ও দর্শনের দিক থেকে ধর্ম হলো নাগরিকদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ ধর্মে বিশ্বাস করলে তার অনুভূতি বা বিশ্বাসের উপর কোনো অপমান-অবমাননা করার ব্যাপার নেই। রাষ্ট্র নাগরিকের ধর্ম পালনে সহায়তা কিংবা বিরোধিতা কোনোটাই করে না। রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে ধর্ম নিরপেক্ষ হবে এবং ইহজাগতিক-পার্থিব যে ক্রিয়াকলাপ সে সংক্রান্ত ব্যাপারে নীতি-নৈতিকতা ঠিক করবে। অর্থাৎ সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে কার্যকরীভাবে ভূমিকা পালন করবার জন্যই যেহেতু বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা, সেহেতু রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করবে। ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে উৎপাদন ব্যবস্থায় ভূমিকা রাখা এবং দক্ষতা অর্জনের কোনো ব্যাপার নেই। সেটি ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও অনুভূতির ব্যাপার। তাই ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে রাষ্ট্র কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনা। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসকে উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত কোনোটাই করেনা।

এই শিক্ষা আইনের ৪৯, ২০ (খ) (২), ৩৪ (২) নং ধারার মাধ্যমে ধর্মশিক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যায় যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে এ ধরনের বিধান রেখে কোনো গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা।

বৃত্তিমূলক এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষা শুরু হবে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই

পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় অভাবগ্রস্ত নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ভবিষ্যতে কিছু করার একমাত্র উপায় হলো শিক্ষা অর্জন করা। কিন্তু রাষ্ট্র সকলের শিক্ষার দায়িত্ব যেমন নেয়নি, তেমনি শিক্ষাকে করেছে ব্যয়বহুল। একটু ভালো ভবিষ্যতের আশায় অভিভাবকরা নিজেদের শেষ সম্বল বিক্রি করে হলেও সন্তানদের পড়াচ্ছেন। শিক্ষার প্রতি মানুষের এই আগ্রহকে কাজে লাগাচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণী। তারা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য দক্ষ শ্রমিক, টেকনিশিয়ান তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করছে। ব্যাপকভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে যে- কর্মমুখী, কারিগরি শিক্ষা, বিবিএ, এমবিএ, হোটেল ট্যুরিজম, ফ্যাশন ডিজাইনিং ইত্যাদি বিষয়ে ডিগ্রি নিলে নিশ্চিত ভালো চাকরি মিলবে। আর যারা একান্তই পড়াশুনা করতে পারবে না তাদের কিশোর বয়সেই নানা ধরনের টেকনিশিয়ান, মিস্ত্রি হবার শিক্ষা থাকবে। সংকট জর্জরিত পুঁজিবাদ আজ শ্রমনির্ভর শিল্পোদ্যোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এবং পুঁজিনির্ভর শিল্পোদ্যোগের দিকে ঝুঁকছে। এর ফলে দেশে এবং দেশের বাইরে সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ ব্যাপকভাবে কমলেও এই শিল্পগুলিতে কিছু তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন আছে। এসব কারণে সরকার তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষা ও ব্যবসায় শিক্ষার প্রসার ঘটাচ্ছে। শিক্ষা আইনে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই এই ধরনের শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। (ধারা ৯(১))।

পুঁজিপতি শ্রেণী জ্ঞান অর্জনকে কেবল চাকুরি, অর্থ উপার্জন আর ক্যারিয়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। অথচ সত্যিকারের শিক্ষা মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দের বোধ তৈরি করে, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা শেখায়। ইতিহাসের সমস্ত বড় মানুষ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক- নিউটন, গ্যালিলিও, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলরা এভাবেই বড় হয়েছেন। তাদেরকে আজ ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাস্তবে আজ দেশে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দুর্নীতি, দারিদ্র্যের মতো কোনো সমস্যাই পুঁজিবাদী শাসকরা সমাধান করতে পারছে না। ফলে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ যত তীব্র হচ্ছে শাসকরা তত বেশি যুক্তি বিজ্ঞান ও চিন্তা করার ক্ষমতাকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। তারা চায় না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে চিন্তাবিদ, দার্শনিক বা সাহিত্যিক গড়ে উঠুক। বরং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো একদল দক্ষ-প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী হলেই তাদের চলবে।

প্রাথমিক শিক্ষায় পাবলিক পরীক্ষার বিধান বহাল থাকবে

গত ২০১০ সাল থেকে বর্তমান সরকার প্রাথমিক সমাপনী শিক্ষা (পিইসি) এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) নামে দুটি পরীক্ষা চালু করেছিল। এর বাইরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নামে আরও দুটি পাবলিক পরীক্ষা আছে। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত এরকম চারটি পাবলিক পরীক্ষা দেবার নজির পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কিনা আমাদের জানা নেই।

পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা চালু হবার পর থেকে আমাদের সংগঠন এবং কয়েকটি অভিভাবকদের সংগঠন থেকে বারবার পরীক্ষা বাতিলের দাবি তোলা হয়েছে। কেননা শিশুমনস্তত্বের উপর পরীক্ষাগুলো মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। শুধু তাই নয়, এর ফলে শিক্ষাব্যবসা শুরু হয়েছে একদম স্কুল পর্যায় থেকে। স্কুলে চালু হয়েছে বাধ্যতামূলক কোচিং। অব্যাহত পরীক্ষার চাপ সামাল দিতে শিশুরা গাইড বই ও প্রাইভেট টিউশনির দিকে আরো বেশি ঝুঁকে পড়েছে। এছাড়াও আরও অনেকগুলো অনিয়মের কথা জানা গেছে যেমন- পরীক্ষাহলে আসন বিন্যাসে অনিয়ম, নকল, শিক্ষকের দ্বারা প্রশ্নের উত্তর মুখে ও ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দেয়া, পরিদর্শকের সহায়তায় একজনের সাথে অন্যজনের উত্তর মেলানো, উদারভাবে খাতা দেখা, অর্থের বিনিময়ে উত্তরপত্রের গোপন কোড নম্বর ফাঁস করে দেয়া, গাইড ও সাজেশনের নামে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা ইত্যাদি। পরীক্ষার চাপ থাকার কারণে খেলাধুলা বা অবকাশের সুযোগও নেই। সম্প্রতি এডুকেশন ওয়াচের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রায় ৮৬ শতাংশ স্কুলে সাধারণ শ্রেণী কার্যক্রম বাদ দিয়ে কোচিং করানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। বাধ্যতামূলক কোচিংয়ের হার শহরের চেয়ে গ্রামে আরও বেশি। এরকম পরিস্থিতিতে গত ৬ বছর ধরে অব্যাহত প্রতিবাদের মুখে সরকার শিক্ষা আইনের ১২(২) নং ধারায় বলল, “তৃতীয় হইতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অর্ধ-বার্ষিক ও বার্ষিক বা সমাপনী পরীক্ষার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হইবে।” আর ১২(৩) নং ধারায় বলা হলো, “প্রথম শ্রেণী হইতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষার পদ্ধতি, সংখ্যা ও স্তর সরকার কর্তৃক প্রণীত বিধিমালা বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নির্ধারিত হইবে। তবে অষ্টম শ্রেণী শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষা হইবে।” অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষাকে সম্প্রসারণ করা হবে তাই এর শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। গত ৩১ মে এক ঘোষণায় বলা হয়েছে- এই পরীক্ষাটির নাম হবে প্রাথমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষায় এমন একটি পাবলিক পরীক্ষা থাকার প্রয়োজনীয়তা কী তা তুলে ধরা হয়নি।

শিক্ষা আইন শিক্ষাব্যবস্থার নানাবিধ সংকটের কোনো সমাধান আনবে না

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার হবার কথা যে, শিক্ষা আইন-২০১৬ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূলগত কোনো সংকটেরই সমাধান আনতে পারবে না। বরং বিদ্যমান শিক্ষাপরিস্থিতি আরও ভগ্নদশার দিকে যাবে। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের যে নীতি, বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণ-সাম্প্রদায়িকীকরণের নীতি, তা এবার আইনগত বৈধতা পাবে! শুধু শিক্ষাকে পণ্য করা নয়, শিক্ষার মর্মবস্তুকে ধ্বংস করা, শিক্ষাকে বাজারমুখী-চাকুরিমুখী করার প্রক্রিয়াও আরও বেশি ত্বরাণি¦ত করবে এই আইন। কিন্তু সরকারি মহল উচ্ছ্বসিত, স্বাধীনতার পর এই প্রথম একটি শিক্ষানীতি কার্যকর করা গেছে এবং শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি আইনও হচ্ছে। তথাকথিত সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ও এই আইনের প্রশংসা করছেন, দ্রুত বাস্তবায়ন চাইছেন। এর বিপরীতে মৌলবাদী দলগুলো উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে শিক্ষা আইন বাতিলের দাবি তুলছে। আর কিছু গাইড বই প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান দাবি করছে নোট-গাইড বই প্রণয়ন ও বিক্রির অনুমতি। এর বাইরে যে কোটি কোটি মানুষের জন্য এই আইন তারা এর কিছুই জানে না। অথচ তাদের জীবনকে প্রভাবিত করবে এই আইন। সঙ্গত কারণেই আমরা শিক্ষা আইনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। মহান সাহিত্যিক লিও টলস্টয় বহুদিন আগে বলেছিলেন, “জনসাধারণের অজ্ঞতাই সরকারের শক্তির উৎস। সরকার এটা জানে বলেই প্রকৃত জ্ঞানের উন্মেষকে সবসময় বাধা দেবে। আমাদের এটা বোঝার সময় এসেছে। সরকার একদিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি করছে আবার অন্যদিকে জনগণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার নিয়ে ব্যস্ততার ভান করছে। এটা কখনই চলতে দেওয়া যায় না।”

একটা শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শিক্ষাও শ্রেণীগত প্রয়োজনের নিরিখে নির্ধারিত হয়। উপনিবেশবাদী ইংরেজ এবং পাকিস্তানিরা শাসন-শোষণ টিকিয়ে রাখার জন্য শিক্ষার অধিকারকে সংকুচিত করা এবং তার মর্মবস্তুকে ধ্বংস করার যে নীতি গ্রহণ করেছিল, স্বাধীন দেশে আজও তা বহাল আছে। কিন্তু লড়াইও থেমে থাকেনি। পরাধীন ভারতবর্ষে উপনিবেশিক শাসকদের শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষার সূচনা হয়েছে। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার আশুতোষ মুখার্জী, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া প্রমুখ মনীষীদের চিন্তা ও কর্মের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এই ভূখ-ের সর্বজনীন শিক্ষার আকাক্সক্ষা। পাকিস্তান আমলেও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার সাথে শিক্ষার দাবি মিশে গিয়েছিল। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতেন; ছাত্ররাও তেমনি শিক্ষার নানা সমস্যার পাশাপাশি সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এর প্রেক্ষিতে জন্ম নেয় ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছিল শিক্ষার অধিকার রক্ষায় তেমনি এক ঐতিহাসিক দিন। কুখ্যাত শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের দিনটিকে আজও আমরা ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করি। ১৯৬৯ সালে ঐতিহাসিক ১১ দফার আন্দোলন, স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে কুখ্যাত মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রণীত ১০ দফা সহ ছোট-বড় অসংখ্য আন্দোলন এদেশের নিপীড়িত সাধারণ মানুষ, ছাত্রসমাজের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়। এভাবে শিক্ষা ও সমাজের আকুতিকে ধারণ করে সেদিন শিক্ষক হিসেবে যেমন প্রাতঃস্মরণীয় হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, গোবিন্দচন্দ্র দেব, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. শামসুজ্জোহা প্রমুখ তেমনি শিক্ষা আন্দোলনের শহীদ মোস্তফা, বাবুল, ওয়াজিউল্লাহ, জাফর, জয়নাল, কাঞ্জন, দীপালি সাহা হয়েছিলেন একেকটি উজ্জ্বল নাম।

কিন্তু স্বাধীনতার আগে তো বটেই তার পরবর্তীতেও যত শিক্ষা বিষয়ক নীতি, আইন, পদ্ধতি নিরূপিত হয়েছে সবই হয়েছে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনে এবং তাকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে। সেই ১৯৭৪ সালে যখন সদ্য স্বাধীন দেশে মানুষ অতীতের সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম থেকে মুক্ত হয়ে নতুনভাবে বাঁচবার স্বপ্ন দেখছিল সেদিনও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের শ্রেণীস্বার্থের কথা বিবেচনা করে কুদরত-ই-খুদার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল। সকল মানুষের যে শিক্ষার অধিকার আছে এই ন্যূনতম সত্যটুকুও সেদিন তারা স্বীকার করেনি। পরবর্তীতে সকল নীতি, বিধি-ব্যবস্থাতে শ্রেণীগত এই দৃষ্টিভঙ্গির ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছে।

প্রশ্ন আসে, সরকার শিক্ষা নিয়ে এমন পরিকল্পনা কেন করে? আসলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকার সমস্যা, জনজীবনের মূলগত কোনো সমস্যাই আজ আর সমাধান করতে পারে না। মানুষও তাই কিছুদিন পর পর অন্যায়-অসঙ্গতি- বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের এই বিক্ষোভকে শাসকরা ভয় পায়। তারা আরও বেশি ভয় পায় মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা, যুক্তিবাদী মনন, সচেতনতাকে। এই সবই গড়ে তোলে শিক্ষা। তাই শিক্ষা নিয়ে শাসকরা অত্যন্ত সচেতন থাকে। তারা একদিকে সকলের শিক্ষা পাবার পথকে সংকুচিত করে, অন্যদিকে যতটুকু শিক্ষা দেয়, তারও বিষয়বস্তু ও মর্মবস্তুকে বিকৃত করে। এমন শিক্ষা তারা দিতে চায় যাতে মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী মন গড়ে না উঠে, গণতান্ত্রিক চেতনা-মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে এ যুগের বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, “ন্যায়নীতিবোধের ন্যূনতম ধারণা গড়ে না ওঠার দরুন ছাত্র-যুবক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সামাজিক যে কোনও সমস্যার প্রতি চরম অনীহা ও ঔদাসীন্য ক্রমাগত বাড়ছে। ছাত্রদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও সুশৃঙ্খল যুক্তিধারা গড়ে তোলার পরিবর্তে অধ্যাত্মবোধ ও কারিগরি বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটানোর প্রবণতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের শিক্ষাজীবনে এই ঝোঁকটি বাস্তবিকপক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ এ হচ্ছে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের কারিগরি দিকটির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি গড়ে তোলা ও তাকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানের করিগরি দিকটিকে কাজে লাগায়, কিন্তু ন্যায়নীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে সমস্ত রকম বিজ্ঞানবিরোধী বস্তাপচাঁ ধর্মীয় সংস্কার মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেয়, যাতে কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে বিজ্ঞানসম্মত বিচার বিশ্লেষণের মানসিকতা গড়ে ওঠার পরিবর্তে তমসাচ্ছন্ন ভাবধারা, অন্ধবিশ্বাস ও মনগড়া ধ্যানধারণা তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এবং শেষপর্যন্ত মানুষের মধ্যে সামাজিক বিষয় সম্পর্কে চূড়ান্ত অনীহার মনোভাব সৃষ্টি হয় ও মানুষ তার সামাজিক ভূমিকা হারায়। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে এই সমস্ত লক্ষণগুলি সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।”

ঐক্যবদ্ধ, ধারাবাহিক ও দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনই কেবল পথ দেখাতে পারে

আমরা জানি, সভ্যতার প্রতিটি সংকটজনক সন্ধিক্ষণে প্রগতি ও সমাজ পরিবর্তনের পথে মানবতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মহৎ দায়িত্ব ইতিহাস সবসময় ছাত্রসমাজের উপরই ন্যস্ত করে। সেই ছাত্রসমাজকে আজ সমস্ত হতাশা-দোদুল্যমানতা ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের পথ রচনা করতে হবে। এটা আজ স্পষ্ট যে, ক্ষমতায় যারা আসীন এবং ক্ষমতায় যারা যেতে চায় প্রত্যেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বহুদূরে অবস্থান করে। ফলে শিক্ষাসহ অন্য সকল মৌলক দাবি পূরণ করা দূরে থাকুক, প্রতিটি মৌলিক অধিকারকে তারা ব্যবসায় পরিণত করছে। কারণ আমাদের সমাজ যে নিয়মে চলছে সেই পুঁজিবাদী নিয়ম দিন দিন আরও সংহত হচ্ছে। সেই নিয়মের ধারক বাহক রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষাকে আর সর্বজনীন মানবিক অধিকার মনে করে না। পুঁজিবাদী শোষণের নিয়মেই তারা শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে তৎপর।

এ শুধু আমাদের দেশে নয়, গোটা পুঁজিবাদী দুনিয়ায় একই অবস্থা। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির ধ্বজাধারী উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে জনগণের অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে। ফ্রান্স, ইটালি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে বিশাল ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। তবে কেবল স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার সমস্যাকে সমাধান করা যাবে না। প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালনার দর্শন। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট সমাজ প্রগতির আদর্শ ও নৈতিক অবস্থান থেকে সামগ্রিক শিক্ষা আন্দোলনকে সংগঠিত করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments