এবারের বাজেটও আকারে বিরাট এবং একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ সংকটের এই সময়ে এ ধরনের বাজেট নিয়ে বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরাও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। যখন দেশের সাধারণ মানুষ জীবন যাপনের উচ্চ ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে জেরবার হচ্ছে, যখন দেশের কোটি কোটি বেকার যুবক কাজ পাচ্ছেনা- তখন বাজেটে এই জনগণকে সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার মতো কোন পরিকল্পনাই তুলে ধরা হয়নি। প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকাই এ বাজেট সাধারণ জনগণের উপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে বলে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যসহ কলাম প্রকাশ করেছে, অপরদিকে ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বাজেটকে উন্নয়ন ও গণমুখী বলে অভিহিত করেছেন।
এই বাজেটের যেসকল দিক তাৎক্ষণিক আমাদের নজরে এসেছে তা আমরা তুলে ধরছি।
গণমুখী খাতগুলোতে বরাদ্দ কমেছে, লুটপাটে বরাদ্দ বেশি
শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য ও জ্বালানীখাতের মতো গণমুখী খাতগুলোতে বরাদ্দ কমেছে। অন্যান্যবারের মতো এবারও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই বরাদ্দ আনুপাতিক হিসেবে ধরলে গতবারের চেয়ে কম। গত অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল মোট জিডিপির ১.৮৩ শতাংশ, বর্তমান অর্থবছরে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৭৬ শতাংশ। কৃষিখাতে গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৪.৯৭ শতাংশ, এ বছর সেটা কমে হয়েছে ৪.৬৪ শতাংশ। একইভাবে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ গত বছর ছিল ৫.৪ শতাংশ, এ বছর তা ৫ শতাংশ করা হয়েছে। জ্বালানীখাতে বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় ৪৯ শতাংশ কমানো হয়েছে। অপরদিকে বিদ্যুত খাতে বরাদ্দ ৪০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুত খাতে এই বরাদ্দ সাধারণ মানুষের জন্য কোন স্বস্তি নিয়ে আসবে না; রেন্টাল, কুইক রেন্টাল কোম্পানির মালিকদের পকেট ভারি করবে।
বাজেটে দফায় দফায় ‘অতিমারি পরবর্তীসময়ে’ এই কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে, অতিমারি মোকাবেলার ক্রেডিট নেয়া হয়েছে। অথচ সেখান থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করা হয়নি। অতিমারি স্বাস্থ্যখাতের সীমাহীন দুর্বলতা উন্মোচিত করেছিল, অথচ জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও চিকিৎসা কাঠামোকে শক্তিশালী করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি, সে লক্ষ্যে কোন বরাদ্দও দেয়া হয়নি। দেখানো বরাদ্দ যা আছে সেগুলো বিশেষায়িত হাসপাতালের জন্য, প্রত্যন্ত অঞ্চলের চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করার কোন পরিকল্পনা নেই।
সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। অথচ এই মূল্যস্ফীতির বাজারে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত ছিল। লজ্জার ব্যাপার হলো, মাসিক বয়স্ক ভাতা ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহিতার মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা, প্রতিবন্ধীদের মাসিক শিক্ষা ভাতা বিভিন্ন স্তরে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ মাসিক ৯৫০ টাকা করা হয়েছে। এই টাকা তুলে আনার জন্য যাতায়তের খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে, সেটাকে সহযোগিতা না বলে অপমান বলাই শ্রেয়।
যোগাযোগখাতে গত বাজেট থেকে এবারে বরাদ্দ বেড়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। অত্যাবশ্যকীয় ও গণমুখী খাতগুলোতে বরাদ্দ মূল্যস্ফীতির তুলনায় তেমন না বাড়লেও .প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ইত্যাদি খাতগুলোতে বেড়েছে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা করে। যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এ বরাদ্দ বাস্তবে লুটপাটের কাজেই লাগবে। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচে রাস্তা, ব্রিজ, ফ্লাইওভার নির্মাণ হয় বাংলাদেশে। যারা এসব নির্মাণ করে লাভবান হন, জনগণের করের টাকা তাদের পকেটেই যায়। সরকারি বরাদ্দ বাড়ছে আবার বাস, রেল, নৌযান- সকল ক্ষেত্রেই ভাড়া দফায় দফায় বাড়ছে- বাড়ছে না সেবা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার দাম কমেনি, বরং নিম্নমধ্যবিত্তদের উপর কর চাপানো হয়েছে
এলপিজি সিলিন্ডারের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা সরাসরি সাধারণ জনগণকে আরও চাপে ফেলবে। মূল্যবৃদ্ধি থেকে জনগণকে স্বস্তি দিতে সর্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবি গণদাবিতে পরিণত হলেও, এ বিষয়ে কোন কথা বাজেটে নেই।
করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ মাসে প্রায় ২৯ হাজার ২০০ টাকার বেশি রোজগার করলেই কর দিতে হবে। বর্তমান মূল্যস্ফীতির বাজারে একজন নিম্নবিত্তের জীবন-যাপন করতে মাসে ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকা লাগে, ঢাকা শহরে যা আরও বেশি। তাদের উপর কর বসানো হচ্ছে অথচ কর্পোরেট কর বাড়ানো হয়নি। মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তদের শোষে নিয়ে কর আদায় বাড়ানো হচ্ছে, অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা উপার্জনকারীদের স্পর্শই করা হচ্ছে না।
এই মূহুর্তে যাদের করযোগ্য আয় নেই- সরকারি সেবা গ্রহণে তাদের উপর ২ হাজার টাকা ন্যূনতম কর আরোপের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যার করযোগ্য আয় নেই, তার ক্ষেত্রে আবার ন্যূনতম কর ধার্য করা শুধু অযৌক্তিক নয়, অনৈতিকও।
বিদেশগামী বিমান যাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। দেশের প্রায় এক কোটি শ্রমিক বিভিন্ন দেশে কাজ করেন। তাদের উপর এটি একটি বিরাট চাপ। যারা ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বিদেশে যাবেন বা যাচ্ছেন তাদের যাওয়ার খরচ বাড়বে অনেকগুণ।
রাজস্ব আদায় ও মূল্যস্ফীতি
রাজস্ব আদায়ের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লক্ষ কোটি টাকা, গত বছরের সংশোধিত বাজেটে যা ছিল ৪ লক্ষ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। দেশের জনগোষ্ঠীকে তাদের উপার্জন ও সম্পদের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে অতি ধনীদের উপর প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো উচিত ছিল। অপরদিকে অর্থনৈতিক ও জীবনযাত্রার সূচকে নিচের দিকে অবস্থান করা জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। অথচ সরকারের এ ধরনের কোন পরিকল্পনাই নেই। তারা অতি ধনীদের অতি সুরক্ষা দিচ্ছে, গরীব-নিম্নবিত্তের সংখ্যা ও তথ্য তাদের কাছে নেই। উপরন্তু বাজেটের উচ্চ কর আদায়ের লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক ইত্যাদি পরোক্ষ কর বাড়ানো হবে, তাতে সাধারণ জনগণই দুর্ভোগ পোহাবে।
মূল্যস্ফীতি ভবিষ্যতে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার ফাঁকা বুলি আছে, কিন্তু পরিকল্পনা নেই। এবারের বিপুল পরিমাণ ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য অভ্যন্তরীণ ব্যাংক খাত থেকে ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। ব্যাংক খাতে এখনই তারল্য সংকট চলছে। চলতি অর্থবছরে সরকারকে ঋণ দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছে। আগামী অর্থবছরে ঋণ দিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাড়তি অর্থ ছাপতে হবে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে।
আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণগ্রহণের বিপরীতে এবারের বাজেটে আইএমএফের বহু শর্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, অথচ বাজেট বক্তৃতায় সে বিষয়ে জনগণকে অন্ধকারে রাখা হলো। সামগ্রিকভাবে এ বাজেট স্পষ্টভাবে নিজের জনবিরোধী অবস্থান তুলে ধরেছে। বাস্তবায়ন না হলেও কিছু পরিমাণ সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মসংস্থানের উল্লেখ যতখানি বাজেটে থাকতো, সেটাও তারা আর রাখেননি। ফলে এই বাজেট সকল দিক থেকেই ব্যর্থ ও প্রত্যাখ্যাত।