Wednesday, May 1, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জুন ২০২১ফিলিস্তিন সংকট: আর কত কাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়

ফিলিস্তিন সংকট: আর কত কাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়

আবার খবরের শিরোনাম হলো ফিলিস্তিন। ১০-২১ মে টানা ১১ দিন ইজরাইল বিমানহামলা চালালো তার দখলীকৃত এলাকা ছোট্ট ফিলিস্তিনি ভূ-খণ্ড গাজার ওপর। নিহত হলো ২৪৮ জন ফিলিস্তিনি, যার মধ্যে ৬৬ শিশু ও ৩৯ নারী। আহত হলো আরও ১৯৪৮ জন, এর মধ্যে ৫৬০ জনই শিশু। ১০০০ বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস ও ১৮০০ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্তত ৯০ হাজার ফিলিস্তিনি গৃহহীন হয়েছে। ৪০টি স্কুল ও ৪টি হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে শরণার্থী শিবিরে, গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা ও এপি-র অফিস। গাজায় আগ্রাসনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দমনে ইজরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় অপর অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখ- পশ্চিম তীরে আরও ২৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অপরদিকে ইজরাইল ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনিদের হাতে তৈরি রকেট হামলায় এক সৈন্য ও দুই শিশুসহ মোট ১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে, আহত হয়েছে ৭৯৬ জন।

অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররাহ মহল্লা থেকে ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে ইহুদি বসতি স্থাপনে গত ২৫ এপ্রিল ইজরাইলি আদালতের আদেশের জেরে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভে পরপর কয়েক দফা মসজিদুল আকসায় হামলা চালায় ইজরাইলি বাহিনী। ৭ মে থেকে ১০ মে পর্যন্ত এই সকল হামলায় ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। মসজিদুল আকসা চত্বরে মুসল্লিদের ওপর ইজরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ১০ মে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে মসজিদ থেকে  সৈন্য সরিয়ে নিতে ইজরাইলকে আলটিমেটাম দেয় গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। আলটিমেটাম শেষ হওয়ার পর গাজা থেকে ইজরাইলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামাস রকেট হামলা শুরু করে। ইজরাইল ভূ-খণ্ডে হামাসের রকেট হামলার অজুহাতে ১০ মে রাত থেকেই গাজায় বিমান হামলা শুরু করে ইজরাইল।

প্যালেস্টাইনের গাজা ভূ-খণ্ডে ইজরাইলি সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড- ন্যূনতম মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষকে প্রচণ্ডভাবে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। সারা দুনিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। অন্যদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শিবির, আরব দেশগুলোর দালাল শাসকবর্গ ও জাতিসংঘ গাজায় বেসামরিক জনগণকে রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া দূরের কথা, বরং ‘ইজরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের’ প্রতি সমর্থন দিয়েছে। ইজরাইল ফিলিস্তিনিদের দেশ দখল করেছে, লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তনিদের তাদের ভিটে-মাটি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানেও ফিলিস্তিনি প্রধান পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ করছে। এর বিরুদ্ধে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ দমন করতে ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। ইসরাইলের জায়নবাদী শাসকরা চায় ফিলিস্তিনিরা নীরবে দখলদারিত্ব ও আধিপত্য মেনে নিক।

গত ৭৩ বছর ধরে একদিকে জায়নবাদী ইজরায়েল ফিলিস্তিনকে নিশ্চিহ্ন করতে চাচ্ছে। তার বিপরীতে ফিলিস্তিনের বীর জনতা বুক চিতিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে। যারা ইসরায়েলের দখলদারিত্ব-উপনিবেশিকীকরণ-অবরোধ-নির্যাতনের অবসান দাবি না করে ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র প্রতিরোধের নিন্দা জানায় – তারা হয় সাম্রাজ্যবাদী মতলববাজ, নয় প্যালেস্টাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে চূড়ান্ত অজ্ঞ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মদতে ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। পরবর্তীতে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের অকুণ্ঠ সমর্থনে ক্রমাগত দানবে পরিণত হয়েছে ইজরায়েল। ইজরায়েলের স্বপক্ষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯ বার ভেটো প্রদানই ইজরায়েল-আমেরিকার সখ্য প্রমাণ করতে যথেষ্ট।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংকট উপলব্ধি করতে হলে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ভালো করে বোঝাটা জরুরি। জায়নবাদী ইজরায়েল যে ব্যাপারটা বারবার সামনে আনতে চায় সেটা হচ্ছে ফিলিস্তিন বলতে স্বাধীন দেশ কখনোই ছিল না। তারা অনেকটা শূন্য ভূমিতে তাদের জন্য প্রতিশ্রুত ভূমিতে রাষ্ট্র গঠন করেছে। অথচ ইতিহাসের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কীভাবে পরিকল্পিতভাবে জায়োনিস্টরা ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের সহায়তায় ফিলিস্তিনকে উচ্ছেদ করে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। দুই হাজার বছরেরও আগে রোমান সাম্রাজ্যের দ্বারা ফিলিস্তিন থেকে উচ্ছেদ হয়ে ইহুদি জনগোষ্ঠী সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে শত শত বছর ধরে তারা ধর্মীয় বিদ্বেষ ও নিপীড়নের শিকার হয়। ১৮৮০-এর দশকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে ইহুদিবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার ধারণা গড়ে উঠেছিল। হাজার বছর ধরে ইহুদিদের উপর ঘটা অন্যায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই জায়োনবাদের সূত্রপাত হয়েছিল।

১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ওয়ার্ল্ড জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের মিথের ওপর ভিত্তি করে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য তথাকথিত প্রতিশ্রুত ও স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি ইহুদিদের মধ্যে প্রচার ও জনপ্রিয় করে জায়োনিস্টরা। ১৯০২ সালে জায়োনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা থিয়োডর হার্জেলের লেখা ইউটোপিয়ান উপন্যাস ঞযব ড়ষফ হবি ষধহফ-এ হার্জেল প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্রের কল্পনা করেন। ঐ বইয়ে প্যালেস্টাইনিয়ান আরবদেরকে নোংরা, কিঞ্চিৎকর, অসভ্য, ডাকাত ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে তার বিপরীতে ইউরোপীয় ইহুদিদের তাদের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার কথা বলা আছে। একই কায়দায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সারা দুনিয়া বিশেষত ভারতবর্ষকে সভ্য ও শিক্ষিত করতে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এসে আমাদের শাসন করেছিল। শুরুর দিকে জায়োনিস্টরাও সে পথেই এগিয়ে ছিল। তার সাথে জড়িত ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব লর্ড বেলফোর জায়োনিস্টদের দাবি অনুযায়ী প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্যে রাষ্ট্র তৈরিতে ব্রিটিশের সহযোগিতার আভাস দেন। সে ঘোষণায় বেলফোর প্যালেস্টাইনে বিদ্যমান অ-ইহুদী জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষা নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা ছিল একপ্রকার তামাশা। কেননা, প্যালেস্টাইনে আরব মুসলমানরাই তখন ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্যালেস্টাইন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে চলে আসে। ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে আসার পর থেকেই ব্রিটিশরা ব্যাপকভাবে ইউরোপিয়ান ইহুদি সেটেলারদের ফিলিস্তিনে আসার সুযোগ করে দেয়। আগে থেকেই ইউরোপীয় ইহুদি সেটেলার যারা এসেছিল, তারা শিক্ষাক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্থানীয় প্যালেস্টাইন জনগণ থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। ব্রিটিশরা সেটেলার ইহুদিদের নানারকম সুবিধা দিতে থাকে। ইহুদিরা সামরিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবেও ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। তারা নিজেদের সুরক্ষার জন্যে সশস্ত্র বাহিনীও তৈরি করে। ব্রিটিশ শাসনে সেটেলারদের ক্রমাগত সুবিধা দেওয়া ও স্থানীয় ফিলিস্তিনি আরবদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করায় ১৯২৯-৩০ ও ১৯৩৬-৩৯ সালে দুইবার ফিলিস্তিনি জনগণ বিদ্রোহ করে। ১৯৩৬-৩৯ সালের ধর্মঘট ও গণবিদ্রোহ ছিল ফিলিস্তিনিদের যৌথ রাজনৈতিক চেতনার প্রথম সুস্পষ্ট প্রকাশ। বেলফোর ঘোষণার সূত্র ধরে ফিলিস্তিনি ভূ-খণ্ড ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার জন্য দুই দফা পরিকল্পনা দিয়েছিল দুটো ব্রিটিশ কমিশন। ১৯৩৭ সালের পিল কমিশনে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্যে শতকরা ৩০ ভাগ ভূমি বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়। আরবরা পিল কমিশন প্রত্যাখ্যান করলেও জায়োনিস্টরা গ্রহণ করে। কেননা এর মধ্য দিয়ে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটা ভিত্তি তারা পেয়ে যায়। পিল কমিশনে ছোট্ট ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ফিলিস্তিনের বাকি অংশকে মিশর ও জর্ডানের সাথে একীভূত হওয়া এবং বেথেলহাম ও জেরুজালেমকে ছিটমহল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

তার কিছুদিন পরেই চলে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টে প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে নির্মম ভাবে হত্যা করে ফ্যাসিস্ট হিটলার বাহিনী। বিশাল পরিমাণ ইহুদি জনগোষ্ঠী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ইহুদিদের রক্ষায় তাদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবির প্রতি বিশ্বব্যাপী সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। ব্রিটেনের অনুরোধে ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিন বিভাজন পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যেখানে ভূ-খণ্ডটির ‘৫৬% অংশ নিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র, ৪৪% এলাকা নিয়ে আরব রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে জেরুজালেম’- এই তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। ইসরাইলী বুদ্ধিজীবী আইলান পেপের মতে, ‘যদি জাতিসংঘ ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি বিবেচনায় নিয়ে তাদের ভবিষ্যত রাষ্ট্রের আয়তন নির্ধারণ করত, তাহলে তা ফিলিস্তিন ভূ-খণ্ডের ১০ শতাংশের বেশি হতো না। কিন্তু জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের ওপর জায়নবাদী আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী দাবি মেনে নেয় এবং আরেক ধাপ এগিয়ে ইউরোপে নাজি হোলোকাস্টের ক্ষতিপূরণ দিতে চায়।’

জাতিসংঘের প্রস্তাব ইহুদিরা মেনে নিলেও আরবরা মানেনি। জাতিসংঘে প্রস্তাব গ্রহণের পর থেকেই জায়নিস্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তৎপর ছিল আতঙ্ক সৃষ্টি করে প্রস্তাবিত ইহুদি ভূমি থেকে যতবেশি সম্ভব ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের জন্যে। ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ ডেভিড বেন গুরিয়ান ও অন্যান্য শীর্ষ জায়নবাদী নেতা গোপনে মিলিত হন ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নৃতাত্ত্বিক শুদ্ধি অভিযান প্ল্যান দালেত (প্ল্যান ডি) বাস্তবায়ন করতে। প্ল্যান দালেতকে জায়োনিস্টরা মনে করে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, অথচ সেটি ছিল আসলে ফিলিস্তিন নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া। প্ল্যান দালেতের অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনে আরব জনগোষ্ঠীকে ক্রমাগত শূন্যের দিকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়। সেজন্য ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহরগুলোয় বোমা হামলা ও লুটতরাজ চালিয়ে মানবশূন্য করে ফেলা হয়। যেন নবগঠিত ইহুদি রাষ্ট্রে আরব জনগোষ্ঠী ন্যূনতম হয়।

১৯৪৮ সালের ১৪ মার্চ ব্রিটিশরা তাদের শাসনের অবসান ঘোষণা করে ফিলিস্তিন ত্যাগ করলে ১৫ মার্চ ইজরাইল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সে ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্র জর্ডান, মিশর, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, সৌদি আরব ইজরাইলের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠায়। আমেরিকা-ব্রিটেনের আশীর্বাদপুষ্ট ইজরায়েলের সাথে শতধাবিভক্ত ও রাজতান্ত্রিক আরব বিশ্বের যুদ্ধে পেরে উঠা সম্ভব হয়নি। সে যুদ্ধে ইজরায়েল জয়ী হয়ে জাতিসংঘ প্রস্তাবিত ভূমির থেকে অনেক বেশি জায়গা, প্রায় ৭৭% এলাকা দখল করে নিয়েছিল। জর্ডান ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীর এবং মিশর গাজা এলাকা দখল করে। ইসরাইলের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনি পশ্চিম তীর, গাজাসহ পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রগুলোর শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।

জায়োনিস্টদের দাবি অনুযায়ী ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিরা স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু ‘দ্যা এথনিক ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন’ নামক বইয়ে আইলান পেপে দেখিয়েছেন এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত নিধনের কারণেই স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা চলে গিয়েছিল। ফিলিস্তিনিরা যেটাকে বলে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়। এর সত্যতা মেলে ইসরায়েলের সবচেয়ে বেশি সময়ের ও প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ান-এর লেখায়। তিনি ১৯৩৭ সালেই লিখেছিলেন ‘আরবদের অবশ্যই চলে যেতে হবে। এ জন্য একটা সুযোগময় মুহূর্ত সৃষ্টি করতে হবে। যেমন একটি যুদ্ধ।’ তিনি কঠোর নির্দেশনা জারি করেছিলেন এই বলে, ‘প্রতিটি আক্রমণ শেষ হতে হবে দখল, ধ্বংস ও বিতাড়ন দিয়ে। অন্যদিকে কীভাবে ফিলিস্তিনিদের বিতারণ করা হয়েছিল, তার প্রমাণ মেলে ইজরায়েলি যুদ্ধবীর মোশে দায়ান-এর লেখায়, ‘আরব গ্রামগুলোর স্থলে ইহুদিদের গ্রাম গড়ে উঠেছে। আপনি ওসব আরব গ্রামের নাম জানবেন না। কেননা, সেগুলোর আর কোনো অস্তিত্বই নেই। এই দেশে এমন একটি স্থানও নেই, যেখানে আগে আরবরা থাকত না।’ গত ৭৩ বছর ধরেই সে নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।

নিজ দেশে উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদেরও উচ্ছেদ করতে চায় ইজরাইল

১৯৬৭ সালে পুনরায় আরব-ইসরাইল ছয়দিনের যুদ্ধের পর ইজরায়েল মিশরের কাছে থেকে সিনাই ও গাজা, জর্ডানের কাছ থেকে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান উপত্যকা দখল করে নেয়। ক্যাম্প ডেভিড শান্তি চুক্তির পর মিশর সিনাই ফেরত পায়, বাকি অংশ ইজরায়েলের দখলে থেকে যায়। ১৯৬৭ সালের পর থেকে গাজা এবং পূর্ব জেরুসালেমসহ পশ্চিম তীর এলাকা ইজরায়েল দখল করে রেখেছে। ইজরায়েলের লক্ষ্য হচ্ছে গাজা ও পশ্চিম তীরকে ইজরায়েলে বিলীন করে দেওয়া। এইজন্য অধিকৃত এলাকায় ইজরায়েল জোরপূর্বক বা আইনি প্রক্রিয়ায় ইহুদি বসতি স্থাপন ও ফিলিস্তিনিদের জীবন দুর্বিষহ করা অব্যাহত রেখেছে। দখলকৃত ভূ-খ- ইজরায়েলে বিলীন করতে গেলে আন্তর্জাতিক নিন্দা ও চাপের মুখে পড়তে হয়। সেজন্যে তারা গ্রহণ করে গোপনে সংযোজন (ক্রিপিং এনেক্সেজেশন) নীতি। ১৯৭০-এর দশকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে দায়ান তাই ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা কুকুরের মতো বেঁচে থাকবে আর যখন ইচ্ছে চলে যেতে পারো। আমরা দেখব পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকে। … পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা হয়তো দুই লাখ মানুষ কম পাব, আর তা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ’।

গোপনে সংযোজন নীতি বাস্তবায়নও সহজ ছিল না। আন্তর্জাতিক আইন সে ক্ষেত্রে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৮ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক জোনাথন কুক ‘ডিজ্অ্যাপিয়ারিং প্যালেস্টাইন: ইসরায়েল’স এক্সপেরিমেন্ট ইন হিউম্যান ডিসপেয়ার’ নামে একটি বই লেখেন। এতে জোনাথন কুক লিখেছেন, “সামরিক দখলদারির ক্ষেত্রে অধিকৃত ভূ-খণ্ডের বেসামরিক জনগণের অধিকার হেগ রেজল্যুশন ও চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন দ্বারা সুরক্ষিত। এসব কনভেনশনের দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো: অধিকৃত ভূ-খণ্ডে দখলদার রাষ্ট্র নিজেদের জনগণকে স্থানান্তর করতে পারবে না এবং অধিকৃত ভূ-খণ্ডে বিদ্যমান আইন মানতে হবে। এর উদ্দেশ্য হলো দখলকৃত ভূ-খণ্ডের রাজনৈতিক, জনসংখ্যাগত ও ভৌত বাস্তবতা নিজেদের অনুকূলে পরিবর্তন করা থেকে দখলদারি শক্তিকে বিরত রাখা। কিন্তু ইসরায়েলের তো এসব কাজই করা দরকার। কেননা, পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে এই ভূ-খণ্ডগুলো বৃহত্তর ইসরায়েলে বিলীন করতে হবে। …” (পৃ. ৬১-৬২)। ইজরায়েল জেনেভা কনভেনশনের ব্যাখ্যা গ্রহণ করেনি, তারা নিজেদের মতো আইন তৈরি করে আইনি মারপ্যাঁচ দিয়ে ফিলিস্তিনি জমি, রাস্তাঘাট, জলাধারগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ১৯৪৮ সালে নাকবার সময় ফিলিস্তিনিদের ফেলে যাওয়া জমি পরিত্যক্ত দেখিয়ে অধিগ্রহণ করে ইজরায়েল। বলপূর্বক জমি দখল অপেক্ষা আইনি মারপ্যাঁচ কাজে লাগিয়ে জমি গ্রহণ কম নিন্দনীয়-এই নীতি কাজে লাগিয়ে ইজরাইয়ল আইন প্রণয়ন করে।

ইতোমধ্যে পশ্চিম তীরের প্রায় ৩০% এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে বসবাসরত ৩০ লাখ ফিলিস্তিনিদের মাঝে মাঝে প্রায় ৬ লাখ ইহুদি সেটেলার বসানো হয়েছে। ছিটমহলের মতো এসব ইহুদি বসতিগুলোর মধ্যে যোগাযোগের জন্য আলাদা সড়ক নেটওয়ার্ক ও নিরাপত্তার জন্য সামরিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা এইসব সড়ক অতিক্রম করতে হলে ইসরাইলি সামরিক চেকপোস্টের অনুমতি লাগে। এর ফলে ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহরগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।  এর ওপর জেরুজালেমসহ ইসরাইলি ভূ-খণ্ডও অধিকৃত পশ্চিম তীরের মাঝে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৭০০ কিমি দীর্ঘ ও ২৫ ফিট উঁচু সীমানা দেয়াল। আঁকাবাঁকা এই সীমানা দেয়াল পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি এলাকাগুলোকে আরও খণ্ড-বিখণ্ড করেছে এবং ফিলিস্তিনিদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত করে ফেলেছে। গাজায়ও ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু হামাসের সশস্ত্র তৎপরতায় নিরাপত্তহীনতার কারণে ও আন্তর্জাতিক চাপে ২০০৪ সালে সেখান থেকে ইহুদি বসতি ও ইজরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ফলে গাজার ভেতরে ফিলিস্তিনিরা অনেকটা ইজরাইলের নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবস্থায় বসবাস করছে। ২০০৬ সাল থেকে গাজাকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইজরাইল ও মিশর। ফলে গাজায় অর্থনৈতিক সংকট, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব ও বেকারত্ব তীব্র। তার সাথে কয়েকবছর পরপর সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ইজরাইল।

আসলে ইজরাইল ক্রমাগত অবরোধ-আক্রমণ-হত্যা চালিয়ে কী করতে চায়? ইজরাইলি সমাজবিজ্ঞানী বারুখ কিমমারলিংকে উদ্ধৃত করে জোনাথন কুক লিখেছেন,  ‘প্রথমত, ফিলিস্তিনের নেতাদের ও বস্তুগত অবকাঠামোসহ গণবলয় ধ্বংস করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিবলয় ও যেকোনো স্বাভাবিকতা ও স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা ধ্বংস করে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রাত্যহিক জীবন উপর্যুপরি অসহনীয় করে তোলা। … এ সবকিছুই নকশা করা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাশা নামিয়ে আনার, তাদের প্রতিরোধ গুড়িয়ে দেওয়ার, পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করার, ইজরাইলিদের কথামতো যেকোনো ব্যবস্থা মেনে নেওয়ার এবং সর্বোপরি এই ভূমি থেকে স্বেচ্ছায় গণহারে অভিবাসী হওয়ার জন্য’ (পৃ. ১৩৩)। সাম্প্রতিক সময়ে ইজরাইল-প্যালেস্টাইন সংকটের মূলেও ছিল ইজরাইলের দখলী মনোভাব ও এর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন।

ইহুদি-মুসলমান ধর্মযুদ্ধ নয়, চাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বৈশ্বিক সংগ্রাম ও সংহতি

প্যালেস্টাইন-ইজরাইল সংঘাতকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ হিসেবে দেখার প্রবণতা আমাদের দেশে ব্যাপকভাবেই আছে। আমেরিকা যখন ইরাকে বা আফগানিস্তানে হামলা চালায় তখন মৌলবাদীরা একে মুসলিমদের ওপর খ্রিস্টানদের হামলা হিসেবে দেখায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই ভুল। মধ্যপ্রাচ্যের তেল-সম্পদের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা ও এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়ায় হামলা, একই উদ্দেশ্যে ইসরাইলকে সমর্থন। অন্যদিকে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সারা দুনিয়ার বিবেকবান মানুষ ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করছে এবং ইজরাইলি বর্বরতা ও দখলদারিত্বের প্রতিবাদে রাস্তায় নামছে। ইসরাইলি শাসকদের প্রবল জাতিগত ও ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টার মধ্যেও ইহুদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মানুষেরা আছেন। সংখ্যায় কম হলেও খোদ ইজরাইলে গাজায় পরিচালিত গণহত্যার বিরুদ্ধে সেখানকার বামপন্থী দল, যুদ্ধবিরোধী সংগঠন, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক সংগঠন বিক্ষোভ করছে, বরং তথাকথিত ‘মুসলিম উম্মাহ’ এক্ষেত্রে প্রায় নীরব। ইজরাইলকে সাথে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারকে আড়াল করতে সংকটটাকে ধর্মের মোড়কে সামনে আনলে সাম্রাজ্যবাদীদের জন্যে সুবিধাজনক। ইহুদিদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনাকে কাজে লাগিয়ে ইজরাইলের বিরুদ্ধে তৎপরতাকে এন্টি-সেমিটিক লেবেল এটে দেওয়া সহজ।

মুখে আমাদের সরকার ফিলিস্তিনের সমর্থন ও ইজরাইলের বিরোধিতা করলেও প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশ সরকার ইজরাইলের বিরুদ্ধে যথাযথ অবস্থান নেয় না। সম্প্রতি পাসপোর্ট থেকে ইজরায়েল গমনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে ইজরাইলের প্রতি আমাদের সরকারের মনোভাব প্রকাশ পায়। আবার ইজরাইল যাদের শক্তিতে এত শক্তিশালী হয়েছে সে আমেরিকার বিরুদ্ধে আমাদের সরকার কোনো কথা বলতে রাজি না। উলটো আমেরিকার সুদৃষ্টি আশা করে আমাদের সরকারগুলো। আমাদের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে দীর্ঘদিনের ব্রিটিশ বিরোধী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের পর আমাদের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী লড়াই করে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। স্বভাবতই আমাদের দেশের জনগণ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা ধারণ করে। সেজন্যে এমনকি আমাদের সংবিধানেও ঘোষণা করা হয়েছিল – বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করবে। সেজন্যে বাংলাদেশ সবসময় ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং জায়োনিস্ট ইজরাইলের বিপক্ষে। কিন্তু শাসকশ্রেণি আর জনগণ এক বিষয় না।

সাম্রাজ্যবাদকে রুখে দিতে না পারলে ফিলিস্তিনের যেমন মুক্তি নাই, তেমনি আমাদের মতো সাম্রাজ্যবাদের শিকার দেশগুলোরও মুক্তি নেই। সেজন্যে আমাদের ইজরায়েল-আমেরিকার বিরুদ্ধে জোরালো জনমত তৈরি করতে হবে। ফিলিস্তিনের পক্ষে ও ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আমাদের সরকারকেও বাধ্য করতে হবে। ফিলিস্তিনের মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী ঘাসসান ফাইয়াজ কানাফানি বলেছিলেন, “The Palestinian cause is not a cause for Palestinians only, but a cause for every revolutionary, wherever he is, as a cause of the exploited and oppressed masses in our era …” সারা পৃথিবীর সংবেদনশীল মানুষ সেজন্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে। এমনকি ইজরায়েলের অনেক ইহুদিরাও জায়োনিজমকে ঘৃণা করেন। এবারের সংকটে ব্যাপকভাবে ইজরাইলি আরবদের আন্দোলনে নামাও আমাদের আশাবাদী করে।

স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র চাই

ইজরাইল রাষ্ট্র ঘোষণার সময় বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ করা সাড়ে ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনির নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকারকে সমর্থন করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাশ হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইজরাইল যুদ্ধের পর থেকে ইজরাইল কর্তৃক অধিকৃত এলাকা থেকে ইজরাইলি সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান সম্বলিত প্রস্তাব পাশ হয়। কিন্তু এর কোনোটিই মানতে ইজরাইলকে বাধ্য করা যায়নি নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন ভেটোর কারণে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের যুক্ত মোর্চা পিএলও-র নেতা ইয়াসির আরাফাত ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তি অনুসারে ইজরাইল রাষ্ট্রকে মেনে নেন, বিনিময়ে ইজরাইল ধাপে ধাপে পশ্চিম তীর ও গাজার সমন্বয়ে ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের ২২% ভূমি নিয়ে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেয়। এই চুক্তিতে বলা হয় প্রথম ধাপে দখলকৃত এলাকা থেকে ইজরাইলি সেনা ও ইহুদি বসতি প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু ইজরাইল নানা কৌশলে ভূমি দখল করছে ও ইজরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নামে প্যালেস্টাইনিদের ওপর দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে। ইজরাইলের পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠী ও ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো উগ্র জায়নবাদের ভিত্তিতে প্রবল জাতিগত ও ধর্মীয় উম্মাদনা-বিদ্বেষ সৃষ্টিকে ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।

গত ৭৩ বছর ধরেই বিশ্বরাজনীতিতে ফিলিস্তিন প্রশ্ন বারবার আলোচিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে বারবার ইজরাইলের পক্ষ নিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ পরাধীনতা, মানবেতর জীবন যাপন, জেলখানার জীবনের অবসানের জন্যে বহু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ওয়ান স্টেট সল্যুশন, টু স্টেট সল্যুশন, গাজাকে মিশরের সাথে-পশ্চিম তীরকে জর্ডানের সাথে একীভূত করে দেওয়া, পূর্বাঞ্চলীয় ফিলিস্তিন, পশ্চিমাঞ্চলীয় ফিলিস্তিন অনেক প্রস্তাবই আলোচনা হয়েছে। যতদিন জায়োনিস্টরা ইজরাইল-এ ক্ষমতায় থাকবে কোনো সমাধানই সত্যিকারের সমাধান হবে না। কেননা জায়োনিস্টরা তাত্ত্বিকভাবেই ইজরাইলকে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে বজায় রাখতে চায়। প্রাথমিক করণীয় হিসেবে জায়নবাদকে পরাস্ত করতে হবে এবং শেষবিচারে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদকে রুখে দিতে পারলেই কেবল ফিলিস্তিনিদের সত্যিকারের মুক্তি সম্ভব। বাংলাদেশসহ বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের আশু কর্তব্য – নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ-দখলদারিত্বমুক্ত ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধানের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হওয়া।

সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোর সমর্থনপুষ্ট এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান-অর্থনীতি-সামরিক শক্তিতে অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ার পরও একটি ক্ষেত্রে ইজরাইল সহায়-সম্বলহীন ফিলিস্তিনীদের কাছে পরাজিত হয়েছে। শত অত্যাচার ও কূটকৌশল করেও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার স্পৃহা ও প্রতিরোধের মনোবলকে তারা নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। ফিলিস্তিনি ভূমির জবরদখল বিশ্ববাসীর কাছে এখনো নৈতিক বৈধতা পায়নি। বিশ্বের যেখানে যারা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে ফিলিস্তিনি জনগণের অদম্য সংগ্রাম তাদের প্রেরণা।

সাম্যবাদ – জুন ২০২১

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments