সাম্যবাদ প্রতিবেদন
৫ জানুয়ারির একতরফা সাজানো নির্বাচন বাংলাদেশের বুর্জোয়াশ্রেণীর শাসনব্যবস্থার সংকটকে জটিলতর করেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই এদেশে সত্যিকার গণতান্ত্রিক শাসন কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চূড়ান্ত লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে এবং নিজেদের দেশের একচ্ছত্র মালিক মনে করতে থাকে। নিজেদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে তারা স্বেচ্ছাচারী শাসন ও বিরোধীদের ওপর চরম দমন-নিপীড়ন চালায়। একপর্যায়ে একদলীয় স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ কায়েম করে। এভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবের হাতে জন্মলগ্নেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র পঙ্গু হয়ে পড়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এরপর আসে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সামরিক শাসন। এরা উভয়েই অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী লুণ্ঠনের অবাধ সুযোগ করে দেন এবং নীতিহীন পন্থায় সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদদের জড়ো করে নতুন দল তৈরি করেন। এর ধারাবাহিকতায় এরশাদের স্বৈরশাসন দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বৃত্তায়িত করে তোলে। যে বেপরোয়া ও ধারাবাহিক লুণ্ঠনের মাধ্যমে দেশে আজ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক ২৫/৩০টি শক্তিশালী পুঁজিপতিগোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্য লক্ষ করছি, এ পর্বেই তার সূত্রপাত।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের পথে ভোটাধিকারের অর্থে হলেও লোক দেখানো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন বিএনপি লুটপাট-দুর্নীতি-দলীয়করণের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে এবং মাগুরাসহ কয়েকটি উপনির্বাচনে ক্ষমতার জোরে কারচুপি ও জালিয়াতি করে জেতার চেষ্টা করে। ফলে আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তারাও একই কায়দায় গণবিরোধী শাসন চালায় এবং ক্ষমতা ধরে রাখতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে প্রশাসনের চূড়ান্ত দলীয়করণ ঘটায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে তাদের সাজানো প্রশাসন রদবদল ও অন্যান্য পদক্ষেপের মাধ্যমে সেই পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামাতের চারদলীয় জোট সরকার নিজেদের পছন্দমতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়োগ দিয়ে এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নীলনকশার নির্বাচন আয়োজন করতে চেয়েছিল। আন্দোলনের মুখে ও সেনা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তাদের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। আর এবার অনেক আগে থেকেই আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে বাইরে রেখে, জাতীয় পার্টিকে অনুগত বিরোধী দল বানিয়ে সাজানো নির্বাচনের ছক কষেছে। জবরদস্তি ও কূটকৌশলের মাধ্যমে সেই ছক বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত তারা অনেকটা সফল। কিন্তু এই অপকৌশল করে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং দেশে আরো বেশি দমনমূলক স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্রের নামে আওয়ামী লীগ-বিএনপির লুটপাটের শাসন এতদিন নির্বাচনের মাধ্যমে পালাক্রমে চললেও উভয়েরই প্রবণতা ছিল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা। এবার আওয়ামী লীগ লোকদেখানো গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকতাটুকুও ছুঁড়ে ফেলে পুরোপুরি ফ্যাসিস্ট চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে।
জবরদস্তি ও কূটকৌশলের মাধ্যমে আপাতত ‘জয়ী’ আওয়ামী লীগ যতদিন সম্ভব ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। এই লক্ষ্যে তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং যেকোনো গণবিক্ষোভ দমনে নিপীড়ন চালাবে। দেশের শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের প্রধান অংশের স্বার্থ রক্ষায় ইতোমধ্যে প্রশাসন-সেনাবাহিনী-বিচারবিভাগসহ বিভিন্ন অংশ প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছে। ব্যবসায়ী মহলকে নানা সুবিধা ও ছাড় দেবে, তাদের অবাধ শ্রম শোষণ ও লুণ্ঠনের লাইসেন্স করে দেবে। কারণ সস্তা শ্রমের ক্ষেত্র আরো প্রসারিত করা, বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে যৌথবিনিয়োগ গড়ে তোলাসহ ব্যাপক আউটসোর্সিং বৃদ্ধির মাধ্যমে যে লুটপাটের অর্থনীতির সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে তা এদেশে গত ৪২ বছরে গড়ে ওঠা বুর্জোয়াশ্রেণীর সামগ্রীক স্বার্থে তার পক্ষে প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা ও পুলিশ-মিলিটারি শক্তিকে কাজে লাগানো দরকার। ফলে বর্তমান সময়ে এইসব প্রতিষ্ঠানের সরকারের পক্ষে প্রত্যক্ষ ভূমিকা দলীয়করণের রূপে সামনে এসেছে। এটা বুর্জোয়াশ্রেণীর স্বার্থে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি নতুন লক্ষণ। এভাবে শোষকশ্রেণীর স্বার্থ সিদ্ধির এক অশুভ চক্র গড়ে উঠেছে। প্রচারমাধ্যমকে চাপ প্রয়োগ ও প্রলোভনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে। অন্যদিকে ভারতের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সাথে দেশের বুর্জোয়াশ্রেণীর স্বার্থের একটি অশুভ মেলবন্ধন গড়ে উঠেছে যার ফলে জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিপন্ন করতেও এরা দ্বিধা করবে না। অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রশ্নে ইতোমধ্যে অন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তার অংশ হিসাবে চীন-রাশিয়া এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। মার্কিন-ইউরোপও সরকারকে চাপে রেখে তাদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করবে। ফলে আগামীতে দেশে সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন ও হস্তক্ষেপ বাড়বে।
জনগণ আওয়ামী লীগের এই প্রহসনের নির্বাচন গ্রহণ করেনি, যেসব স্থানে নির্বাচন হয়েছে সেখানে ভোটার অনুপস্থিতি তার প্রমাণ। অন্যদিকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি সমর্থন থাকলেও জনগণ বিএনপি-জামাতের কর্মকাণ্ডেও সাড়া দেয়নি। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিরোধ মানুষের কাছে লুটেরাদের ক্ষমতা দখলের লড়াই ছাড়া অন্যকিছু মনে হয়নি। আন্দোলনের নামে বিএনপির গণবিচ্ছিন্ন বোমাবাজি-সহিংসতা-সাধারণ মানুষের ওপর হামলা পরিচালনা করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় জামাতের ধ্বংসাত্মক তৎপরতায়ও সমর্থন দিয়েছে। একই সাথে সরকারি দমন-নিপীড়ন মানুষকে নিরাপত্তাহীন ও আতঙ্কিত করেছে। ফলে জনগণ দুই জোটের কোনোটিকেই গ্রহণ করেনি। কিন্তু ভরসা করার মতো বিকল্প না পেয়ে অসহায় জিম্মিদশায় পতিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নতুন সরকার জনমতকে নিজের পক্ষে টানতে হয়তো পদ্মা সেতুর মত কিছু বড় বড় চটকদার ‘উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু জনজীবনের মূল সংকট মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, বৈষম্য, শ্রমিকের নিম্ন মজুরি, কৃষকের নিঃস্বকরণ, স্বাস্থ্য-শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, জ্বালানিতেল-বিদ্যুৎ-গ্যাস-বাড়িভাড়া-গাড়িভাড়াবাবদ ব্যয়বৃদ্ধি ইত্যাদির কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটবে না।
গত ৫ বছরে আওয়ামী লীগ যে নীতিতে দেশ চালিয়েছে তার ফলে লুটপাট-দুর্নীতি করে একদল শত-হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে, পুঁজিপতিরা মুনাফার পাহাড় গড়েছে আর অন্যদিকে সাধারণ মানুষের নিঃস্বকরণ দুর্দশা বেড়েছে। শোষণ-লুন্ঠনের এই প্রক্রিয়া আগামীতে আরো জোরালো হবে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মেই সাধারণ মানুষ ও ধনিকশ্রেণীর স্বার্থ পরস্পরবিরোধী। এদেশের ধনীকগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা হল একটি তথাকথিত স্থিতিশীল অবস্থা যেখানে শ্রমিক আন্দোলন থাকবে না, গণবিক্ষোভ থাকবে না, কোনো ধরনের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ থাকবে না। ফলে সুবিধাভোগী শোষক-লুটেরা ধনীরা যদি দেখে আওয়ামী লীগ শক্তহাতে দেশ চালাচ্ছে, তাদের বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে, শ্রমিক আন্দোলন ও গণবিক্ষোভ দমন করে তথাকথিত স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারছে তাহলে অগণতান্ত্রিক হলেও বর্তমান সরকারকে তারা সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা দেবে।
বাস্তবে বিশ্বব্যাপী বুর্জোয়ারা আজ আর গণতন্ত্র, সমানাধিকার, মানবাধিকার, অবাধ প্রতিযোগিতার নীতিতে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না, চর্চা তো দূরের কথা। পুঁজিবাদের অবক্ষয়, সংকট ও সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান যুগে বুর্জোয়ারা প্রতিদ্বন্দ্বিদের নিশ্চিহ্ন করে বাজারে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েমের মাধ্যমে সর্বোচ্চ মুনাফা করতে চায়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অবাধ প্রতিযোগিতার যুগে গড়ে ওঠা বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার মর্মবস্তু গণতান্ত্রিক চেতনা ধ্বংস হয়ে খোলসটুকু কেবল অবশিষ্ট আছে। বাস্তবে সব পুঁজিবাদী দেশেই শাসনক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ তথা ফ্যাসিবাদ ক্রমাগত প্রকট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার শ্লোগান তুলে ফ্যাসিবাদী শাসনকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের এই পরিকল্পনার পেছনে এদেশের বুর্জোয়াদের শক্তিশালী এক অংশ এবং সেনাবাহিনী-পুলিশ-প্রশাসন-বিচারবিভাগের সমর্থন আছে।
বিপজ্জনক বিষয় হল – আওয়ামী লীগ তাদের এইসব অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ মোকাবেলার ধুয়ো তুলছে। শুধু প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। এর মাধ্যমে তারা এসব যথার্থ শ্লোগানকে বিতর্কিত করে তুলছেন। আওয়ামী লীগসহ দেশের শাসকগোষ্ঠী কি কখনো মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার ধারায় দেশ পরিচালনা করেছে? যদি তা করা হত তাহলে তো আমাদের দেশ একটি স্যেকুলার গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ হিসাবে গড়ে উঠত। কিন্তু তা যে হয়নি, সেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেকোনো দেশপ্রেমিক মানুষই চান – স্বাধীনতা সংগ্রামের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। একই সাথে সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের ক্রমবর্ধমান বিপদের বিরুদ্ধে সংগ্রামও জরুরি। একথাও সত্য যে, ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে জামাত-হেফাজতের সাথে বিএনপির আঁতাত দেশে প্রবলভাবে মৌলবাদের উত্থানের বিপদ বাড়াচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বকারী দল হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে তারা কখনো দেশ পরিচালনা করেনি। বরং নিজেদের দুর্নীতি-লুটপাট, সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব-দলীয়করণ ও গণবিরোধী শাসনকে আড়াল করতে মানুষের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক আবেগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের বিরুদ্ধেও কোনো আদর্শিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রাম আওয়ামী লীগ কখনো করেনি। গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শ-মূল্যবোধ ধ্বংস করে সাম্প্রদায়িক মনন গড়ে তুলতে ভূমিকা পালন করেছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বজায় রেখে, শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ করে এবং নিজেরাও রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করে জনগণের পশ্চাদপদ চেতনায় সুড়সুড়ি দিয়েছে। আর ১৯৯৫-’৯৬ সালে জামাতের সাথে ঐক্যের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত হতে সাহায্য করেছে। সাম্প্রতিক হেফাজতে ইসলামের উত্থানের কারণও কিন্তু সরকারি প্রশ্রয় – জামাত-বিরোধী ইসলামী জোট দাঁড় করানোর বিপজ্জনক কৌশল হিসাবেই সরকার এ কাজ করেছে। পরবর্তীতে নিজেদের পরিকল্পনার বাইরে চলে যাওয়ায় দফায় দফায় বৈঠক করে আপস করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়াকেও দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে ফেলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা না থাকার সাথে সম্পর্কিত করে দেখাতে চেয়েছে।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বিএনপি-জামাতের ভূমিকার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ইন্ধন তাকে আরও ব্যাপক রূপ দিয়েছে। সরকার একতরফা নির্বাচন করার জন্যে জবরদস্তির শক্তি দেখালো অথচ বিপুল ক্ষমতাশালী প্রশাসনের এক্ষেত্রে এত নির্বিকারত্ব কেন? এমনকি বিভিন্ন সরকার দলীয় লোকজনের জড়িত থাকার খবর এসেছে। যে হিন্দু সম্প্রদায় স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষের এতবড় একটি শক্তি তাদের রক্ষায় আওয়ামী লীগ শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ কেন? সবচেয়ে বড় কথা, নিজেদের অপশাসনের জন্য গণবিচ্ছিন্ন সরকার যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার শ্লোগান তোলে তখন মূল্যবৃদ্ধি-দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-দলীয়করণ ও অগণতান্ত্রিক শাসনে বিপর্যস্ত মানুষ তার সাথে একাত্ম হতে পারে না।
প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ ‘ছলে-বলে-কৌশলে’ ক্ষমতা ধরে রাখতে চায় লুটপাটের সুযোগ অব্যাহত রাখতে এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন বিরোধী দমনের প্রতিক্রিয়ায় তাদের প্রতিহিংসা থেকে বাঁচতে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামাত এসব বুর্জোয়া দলগুলো শুধু লোক ঠকানোর জন্যই গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয়তাবাদ বা ইসলামী মূল্যবোধ ইত্যাদি কথা বলে, এসব কোনো চেতনাই এরা ধারণ বা চর্চা করে না। জনগণের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় বসে ধনিকশ্রেণীর স্বার্থে শোষণ-বৈষম্যমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সেবা করতে গিয়ে এবং নিজেদের বেপরোয়া লুটপাট ও অগণতান্ত্রিক শাসনের কারণে এরা দ্রুতই গণবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। এ কারণে জনগণের ম্যান্ডেটকে তারা ভয় পায় এবং নির্বাচনকে প্রভাবিত করে ক্ষমতায় থাকতে চায়। আর এবার নির্বাচনী ব্যবস্থার আইনি রূপ পর্যন্ত ধসিয়ে দিয়েছে। ফলে এ সরকারের অধীনে পরবর্তী যে-কোনো নির্বাচনই বৈধতা পেতে পারে না। বিশ্বজুড়েই বুর্জোয়াদের পক্ষে আজ আর সত্যিকার গণতান্ত্রিক শাসন পরিচালনা করা সম্ভব নয়, বাংলাদেশের বুর্জোয়া দলগুলো এমনকি নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থাকেও অকার্যকর করে ফেলেছে। প্রকৃত অর্থে কখনোই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।
দেশের মধ্যে এই রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতপার্থক্যের কথা সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় এসেছে। দেশের মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে ভারত যেভাবে সরাসরি সমর্থন দিয়েছে এবং ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে এরশাদকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে যেভাবে তৎপরতা চালিয়েছেন তা নজিরবিহীন। শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশের স্বার্থ বিপন্ন করে ভারতের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে সহায়তা করা, ট্রানজিট দেয়া, রামপালে সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করা, টিপাইমুখ বাঁধ-তিস্তার পানিবণ্টন-সীমানা চিহ্নিতকরণ-ছিটমহল বিনিময়-সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি বিষয়ে ভারতের স্বার্থকেই রক্ষা করা হচ্ছে। এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য মার্কিন-ভারত-চীন ত্রিমুখী প্রতিযেগিতার কারণে ভারত নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা এবং আধিপত্য বজায় রাখার জন্য তার পাশের রাষ্ট্রে একটি অনুগত সরকার চায়। শেখ হাসিনাকে কংগ্রেস সরকারের বেপরোয়া সমর্থনের পেছনে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ভোটের হিসাব-নিকাশও কাজ করেছে।
চীনকে মোকাবেলার জন্য এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সহযোগিতামূলক অবস্থানে থাকলেও ভারতের সামগ্রীক স্বার্থের নিরিখে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মোকাবেলার প্রশ্নে তাদের মধ্যে আপাতত মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কিছুটা তিক্ততা সৃষ্টি হলেও মার্কিন স্বার্থে টিক্ফা চুক্তি স্বাক্ষর বা কনোকো ফিলিপসকে সাগরের গ্যাসব্লক বরাদ্দ তাতে আটকে থাকেনি। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতিগত কোনো অবস্থান নেয়নি বা মার্কিন স্বার্থের বিপক্ষে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি। শেখ হাসিনা সরকারের ওপর ভারতের অতিমাত্রায় প্রভাবের কারণে বিএনপিকে মার্কিন স্বার্থের পক্ষে অধিকতর অনুকূল মনে করছে আমেরিকা। এছাড়া জামাতকে তথাকথিত ‘মডারেট’ ধর্মীয় দল হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করার কাজেই ব্যবহার করতে চায়। আর এটা সবাই জানে যে একেবারে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই জামাত আমেরিকার বিশ্বস্ত মিত্রের ভূমিকা পালন করে আসছে। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কথা বললেও এই আমেরিকা-ই মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বজুড়ে অগণতান্ত্রিক শাসনকে মদত দিয়ে আসছে, জঙ্গীবাদী আল কায়েদাকেও একসময় তারাই তৈরি করেছিল। সাম্রাজ্যবাদীরা অন্য পক্ষকে মোকাবেলার জন্য মদদ দিয়ে এ ধরনের উগ্র সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরি করে, কখনো কখনো যা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যায়। আসলে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক নীতিভিত্তিক নয়, নিজেদের স্বার্থে যে কারো সাথে তারা সাময়িকভাবে আঁতাত ও বিরোধ দুই-ই করতে পারে। বুর্জোয়া শিবিরের দুই জোটের ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তারের লড়াই – কোনোটাতেই শেষবিচারে জনগণের স্বার্থ রক্ষা হবে না, কারণ এরা সবাই শোষক শ্রেণীভুক্ত।
এই অবস্থায় বামপন্থী নামধারী কিছু দল সুবিধাবাদীতার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় নেমে সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে তথাকথিত জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে যা বাম আন্দোলন সম্পর্কে জনমনে সন্দেহ-সংশয় বাড়িয়ে তুলছে। এবং বিরোধী অবস্থানে থেকেও কোনো কোনো বামপন্থী সরকারের নীতি ও কৌশলের পক্ষেই জনমত গড়ে তোলার চাতুর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ ও দেশের অভ্যন্তরে ফ্যাসিবাদী শাসন মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম জরুরি। জনগণের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় আশু দাবি হিসেবে বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটি ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা ৫ জানুয়ারির প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে সকল গণতান্ত্রিক শক্তি, দল ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দাবি করেছে। পাশাপাশি এ কথা মনে রাখতে হবে, বুর্জোয়া ব্যবস্থার সংস্কার কিংবা বিবদমান দলগুলোর শুভবুদ্ধি উদয়ের আবেদন করে রাজনৈতিক সংকটের প্রকৃত সমাধান সম্ভব নয়। সঠিক বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে গণতন্ত্রমনা মানুষের সংঘবদ্ধ, সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমেই অধিকার রক্ষা ও বিকল্প রাজনীতির উত্থান ঘটাতে হবে। দুই জোটের অগণতান্ত্রিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক হানাহানির রাজনীতি এবং লুটপাটের শাসনের বিপরীতে বামপন্থীরাই একমাত্র ধারাবাহিকভাবে জনগণের অধিকার ও গণতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে লড়াই করার চেষ্টা করছে। দেশের বাম-গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন প্রতিটি শক্তি ও মানুষকে আমরা আহ্বান জানাই, আসুন, এই ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আমরা প্রত্যেকে যার যার অবস্থা থেকে দলগতভাবে ও সম্মিলিতভাবে গণআন্দোলনের ধারা গড়ে তুলি, স্তরে স্তরে গণআন্দোলনের গণকমিটি গড়ে তুলি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বামপন্থীদের নেতৃত্বে পরিবর্তনকামী মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই গণবিরোধী অপরাজনীতি থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে।