Sunday, April 28, 2024
Homeসাম্যবাদবাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উৎস-সন্ধান

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উৎস-সন্ধান

সাম্যবাদ প্রতিবেদন
বর্তমান বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ মহীরুহ আকারে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দাপট এবং বড় রাজনৈতিক দলগুলোর উপর তাদের প্রভাব জনমনে আতঙ্ক হিসাবে বিরাজ করছে। বিশেষত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, মুক্তবুদ্ধি চেতনাসম্পন্ন জনতা, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী – যারা সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের আক্রমণের লক্ষ্য – তাঁরা অত্যন্ত উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। যদিও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির তুলনায় অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু তাঁরা তাঁদের শক্তি সম্পর্কে অসচেতন ও অসংগঠিত। অপরদিকে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো বর্তমানে অত্যন্ত সংগঠিত এবং সাম্রাজ্যবাদের সহায়তা ও মদতপুষ্ট।
বাংলাদেশের ঘৃণিত সাম্প্রদায়িক দলগুলো সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের লেজুড় পেট্রোডলারের দেশগুলো আস্থাভাজন শক্তি হিসাবে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় থেকেই প্রতীয়মান হয়েছে। বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় স্বাধীনতা যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা স্যেকুলার গণতান্ত্রিক চেতনা বিসর্জন দিয়ে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোকে কাজে লাগানোর উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এ পরিস্থিতিতে একাত্তরের পরাজিত শক্তি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিসমূহের সমর্থন কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকাপোক্ত আসন গেঁড়ে বসেছে। আর সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে একটি উগ্র মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দল বাংলাদেশের সংবিধান এবং নারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরা কোমলমতী মাদ্রাসার ছাত্রদের কাজে লাগিয়ে রাজধানীর বুকে সমাবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলো পদদলিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এখন দেখা যাক্, সাম্প্রদায়িকতা বলতে আমরা কি বুঝি? সাম্প্রদায়িকতা কি কেবল ধর্মান্ধতা নাকি তা শোষণমূলক অবক্ষয়ী পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদেরই একটি উপসর্গ? একটু লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, প্রাচীন সমাজব্যবস্থায় অর্থাৎ দাস অথবা সামন্তীয় সমাজব্যবস্থায় ধর্ম প্রধানত বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের রূপে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোই সেসময়ে ন্যায়যুদ্ধে মূল মন্ত্রণা এবং প্রেরণার উৎস ছিল। সময়ের আবর্তনে পুরাতন উৎপাদন সম্পর্কের আধারে উৎপাদিকা শক্তি যখন আর বিকশিত হতে পারছিল না তখন উৎপাদন সম্পর্কগুলো জগদ্দল পাথরের মতো উৎপাদিকা শক্তি বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। সে সময়ে পুরাতন সমাজের মূল্যবোধগুলোও সমাজ প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে অচলায়তন সৃষ্টি করল। এ কারণেই, ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা হয়ে উঠেছিল রেনেসাঁ আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাই ধর্মনিরপেক্ষতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল এবং সেখানে ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ – এই নীতি স্বীকৃত হল।
বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিতাড়িত হল। এটি এমন একটি সময়ে ঘটল যখন বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ পুঁজিবাদ আর তার অবাধ বিকাশের স্তরে নেই। বড় পুঁজি ছোট পুঁজিকে গ্রাস করে একচেটিয়া রূপ নিয়েছে; ফলে একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ইতোমধ্যে, জনগণ ক্রমাগত ক্রয় ক্ষমতা হারানোর ফলে তীব্র বাজার সংকোচন আর অতি উৎপাদনের সংকটজনিত কারণে বিশ্বব্যাপী মহামন্দার সৃষ্টির হয়েছে। ফলে বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা দুটি সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে ভারতবর্ষে ইতোমধ্যেই ইংরেজদের অধীনে সীমিত পুঁজি বিকাশের সাথে সাথে একটি বিকাশমান শ্রেণী হিসাবে শ্রমিকশ্রেণীর জন্ম হয়েছে।
বিশ্ব পরিস্থিতি এবং জাতীয় পরিস্থিতির এই ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণেই ভারতবর্ষের বুর্জোয়াশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখতো না। ফলে জাতীয় সীমানার মধ্যেও ইংরেজ এবং ভারতীয় উঠতি পুঁজির মালিকরা পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের কায়েমী স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিক্রিয়ার নানা উপাদান জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ প্রভৃতি উসকে দিয়ে জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের এই প্রতিক্রিয়ার যুগে ব্রিটিশরাজ ভারতবর্ষ পরিত্যাগের পূর্বে ভারতবর্ষে ‘ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি’ কার্যকর করে দেশটিকে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রে বিভক্ত করতে উদ্যত হল। এ অবস্থায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে রক্তের প্লাবন বইয়ে দিয়ে ‘দ্বি-জাতি তত্ত্বের’ ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক নতুন একটি রাষ্ট্র্রের অভ্যুদয় ঘটাল। কিন্তু যে কারণে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো সম্ভব হয়েছিল তা হল ভারতবর্ষে রেনেসাঁ আন্দোলনের মধ্যে সামন্তীয় ধ্যান-ধারণার সাথে পরিপূর্ণ ছেদ ঘটানো সম্ভব হয়নি। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবোধের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। বিদ্যাসাগর-শরৎ-নজরুল প্রমুখ মনীষীরা ভারতবর্ষে যে স্যেকুলার গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা এবং আপোসহীন যৌবনোদ্দীপ্ত মানবতাবাদের ঝান্ডা উড়িয়েছিলেন, সে ধারাটি মার খেয়ে গেল। রাজনীতির অঙ্গনেও নেতাজী সুভাষ-মাস্টারদা-ভগৎ সিংদের আপোসহীন বিপ্লববাদী ধারা পরাস্ত হয়ে গেল। ভারতবর্ষের রেনেসাঁস আন্দোলনকে সেকারণে বলা হয় ‘half baked, truncated……’, অর্থাৎ ভারতবর্ষের রেনেসাঁস আন্দোলনে সামন্তীয় ধ্যানধারণা মিশ্রিত হয়ে ছিল। যার ফলে ভারতবর্ষে জাতিগঠনের ক্ষেত্রে একটি অখণ্ড জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে ধর্ম, আঞ্চলিকতা, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতিগত বিভক্তি বাধা হিসেবে কাজ করেছে। বর্তমানেও ভারত নানাপ্রকার জাতপাত, ধর্ম ও আঞ্চলিক গোষ্ঠিতে বিভক্ত হয়ে রয়েছে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসানের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার কৃত্রিম রূপটি ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হতে শুরু করে। প্রথমেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী কায়দায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা দেয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে উত্তাল ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। বাঙালি জাতি শহীদী বলিদানের মধ্য দিয়ে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে। কিছুদিন পরেই দেখা গেল পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানকে প্রায় ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষণ করছে। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাষাণী পশ্চিম পাকিস্তানীদের ‘আস্সালামালাইকুম’ বলে বিদায় সম্ভাষণ জানান। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালি জাতিকে যদিও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল তারপরও তা ছিল মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্যের তথা প্রায়-ঔপেনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ এসময়ে একেবারেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তৎকালীন বুর্জোয়াশ্রেণী সে লড়াইয়ে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার ধারণাকে পাশ কাটিয়ে গেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ধর্মীয় ভাবধারা মিশ্রিত দক্ষিণপন্থী ধারাকে শক্তিশালী করার কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরবর্তীকালে বিপর্যয় নেমে আসে। সেদিনকার সেই বিষবৃক্ষের বীজ আজ মহীরুহ রূপে দেখা দিয়েছে।
এযুগে বুর্জোয়াদের ধর্মনিরপেক্ষ, সেক্যুলার চিন্তা নিয়ে চলা প্রায় অসম্ভব এ কারণে যে, বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় এবং কায়েমী স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে মানুষে মানুষে বিভেদ ঘটানোর লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা, জাতিগত বিরোধ একটি বড় অস্ত্র। বাংলাদেশে এখন যেন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু বাংলাদেশ কেন, সমগ্র পৃথিবীতে কায়েমী স্বার্থবাদীরা সাম্প্রদয়িক অনুভূতি উস্কে দিয়েছে। সমগ্র পৃথিবীই সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষে জেরবার হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে বর্তমানে প্রতিটি মহাদেশ আজ সাম্প্রদায়িক সমস্যায় আক্রান্ত। বলকান, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া মাইনর, প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকার দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী ও কায়েমী স্বার্থবাদীরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দিচ্ছে। সে কারণে প্রতিটি মহাদেশ আজ সাম্প্রদায়িক সমস্যায় আক্রান্ত।
গণতান্ত্রিক বোধের সাথে ধর্মনিরপেক্ষ সেক্যুলার চিন্তা-চেতনা যে কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা বোঝা যায় হিটলারের নাৎসীবাদ থেকে। নাৎসীবাদ অনুসরণ করে কুখ্যাত হিটলার গ্যাসচেম্বারে ইহুদীসহ ভিন্ন ধর্মালম্বীদের হত্যা করেছে। একইভাবে ১৯৭১ সালে পাকসেনা এবং তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরসহ ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের হত্যা করেছে। অর্থাৎ ধর্ম যখন সাম্প্রদায়িকতারূপে চর্চা হয় তখন তা কতখানি বিভৎস ও নিষ্ঠুর রূপ লাভ করে তার অজস্র উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। কাজেই ধর্মের সাম্প্রদায়িকতার রূপ কঠোরভাবে উপড়ে ফেলা দরকার। যেহেতু আজকের যুগের বুর্জোয়াদের হাতে সাম্প্রদায়িকতা শোষণের একটি হাতিয়ার সেকারণে বুর্জোয়াদের মাধ্যমে এ অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ সোনার পাথরবাটির মত। আজ সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের লক্ষ্যেই কেবলমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ সেক্যুলার রাজনীতির অস্তিত্ব মেলে।
কিন্তু সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বেগবান না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চয়ই দেশের মাটিতে এ বর্বরতা আমরা চলতে দিতে পারি না। ফলে দেশের প্রতিটি বিবেকবান গণতন্ত্রমনা মানুষের দায়িত্ব হল সাম্প্রদায়িকতা মোকাবেলায় একদিকে স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধের শক্তি গড়ে তোলা, অন্যদিকে দেশব্যাপী কার্যকর সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। আমাদের প্রত্যাশা, দেশের গণতন্ত্রমনা মানুষ সে লক্ষ্যে এগিয়ে আসবেন।

ভুল সংশোধন: প্রিন্ট এডিশনে এই লেখায় দুটো ভুল রয়েছে।

১. বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিতাড়িত হল। এখানে বলা হয়েছে ‘উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিতাড়িত হল।’

২. বড় পুঁজি ছোট পুঁজিকে গ্রাস করে একচেটিয়া রূপ নিয়েছে; এখানে  ছাপা হয়েছে ‘ছোট পুঁজি বড় পুঁজিকে গ্রাস করে একচেটিয়া রূপ নিয়েছে;’

উপরোক্ত ভুল দু’টির জন্য আমরা দুঃখিত।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments