(ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ, পরবর্তীতে ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এদেশের সমস্ত রাজনৈতিক সংগ্রামে ছাত্রসমাজের ছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা। ছাত্ররা একদিকে শিক্ষার দাবি নিয়ে লড়েছে, সাথে জনগণের মুক্তিসংগ্রামকে পথ দেখিয়েছে। আজ যখন সারাদেশের মানুষ অধঃপতিত বুর্জোয়া রাজনীতির প্রভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থসুবিধাসহ ভোগের নেশায় উন্মত্ত তখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে চরম ফ্যাসিবাদী কায়দায়। গণতান্ত্রিক অধিকার, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, অসাম্প্রদায়িক ভাবমানস সবই আছে অন্তঃসারশূন্য মোড়কী উপস্থাপনায়। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-সর্বক্ষেত্রে শিক্ষা পণ্য, তার বিষয়বস্তু যুক্তিহীন— অমানবিক মানুষ গড়ার উপযোগী। ফলাফল একদিকে মৌলবাদের আস্ফালন, অন্যদিকে কর্পোরেট অর্থনীতির বিক্রয়কর্মী উৎপাদন। সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরাও হয়ে পড়ছে সবচেয়ে স্বার্থপর, রাষ্ট্র-সমাজ নিয়ে উদাসীন। সংস্কৃতির উপরও নেমে এসেছে সর্বগ্রাসী আগ্রাসন।
জনগণকে কূপমন্ডুক-কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তায় আবদ্ধ রেখে উগ্র জাতীয়তাবাদের আবেগে তাতিয়ে রাখতে চায় শাসকরা। নিজেদের সমস্ত অগণতান্ত্রিক শাসন-শোষণকে এই ভাবাবেগ দিয়ে আড়াল করতে চায়। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা থেকে আমরা জানি, আজকের দিনে কোনো বুর্জোয়া ব্যবস্থাই ন্যূনতম গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করে না, ফ্যাসিবাদ-ই তার চরম নিয়তি।
তাই ফ্যাসিবাদের দর্শনগত ভিত্তি আলোচনা করা প্রয়োজন। উগ্র দেশপ্রেমের লোক দেখানো সংস্কৃতির বিপরীতে সত্যিকারের বিপ্লবী শিক্ষা তুলে ধরা আজ সময়ের দাবি। সেই লড়াইয়ে আমরা নেমেছি। এটি দেশ-দেশের জনগণ ও তাদের শিক্ষা- সংস্কৃতি-মনুষ্যত্ব রক্ষার সংগ্রাম। এই প্রয়োজনে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ফ্যাসিবাদ সম্পর্কিত একটি সংকলিত বক্তব্য আমরা আপনাদের সামনে দুই কিস্তিতে তুলে ধরবো। এ সংখ্যায় প্রথম কিস্তি ছাপা হলো। লেখাটি প্রকাশিত হয় ভারতের পথিকৃৎ পত্রিকায়। কমরেড শিবদাস ঘোষ বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শাসনের প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষে ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠার নানা প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ আলোচনাটি গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি বর্তমান শাসনব্যবস্থার স্বরূপ উদ্ঘাটনে লেখাটি আমাদের পথ দেখাবে। উপস্থাপনার ভাষারীতিতে মূল রচনা অক্ষুন্ন রাখা হয়েছে। মুদ্রণ এবং বানানের ত্রুটি-বিচ্যুতি আমাদের।)
ফ্যাসিবাদ কী — এটাকে ভাল করে বুঝতে হবে। ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে আমাদের একটা বক্তব্য আমরা সেই ১৯৪৯ সাল থেকে বারবার বলে আসছি। একদল লোক আছেন, যাঁরা প্রশাসনের উগ্র মূর্তিটাকেই ফ্যাসিবাদ বলেন, একনায়কত্বকেই ফ্যাসিবাদ বলেন। মনে রাখা দরকার একনায়কত্ব—মিলিটারি একনায়কত্ব হয়, একনায়কত্ব ‘ক্যু’র (আচমকা অভ্যুত্থানের) দ্বারাও তৈরি হয়। তাছাড়া, অত্যাচার সমস্ত জনস্বার্থবিরোধী প্রশাসন ব্যবস্থাতেই হয়, ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদীরা করে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ তার চেয়ে দুর্ধর্ষ। শুধু অত্যাচার একটা দেশের এত ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু ফ্যাসিবাদ হচ্ছে একটি সর্বাত্মক প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান। একদিকে সে মানুষের চিন্তাভাবনাগুলো মেরে দিয়ে তাকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে, মানুষের জ্ঞান-বিদ্যাবুদ্ধিকে কারিগরিমুখী করে তোলে, অর্থাৎ দেশে একদল টেকনোক্র্যাট (শিক্ষিত কারিগর) সৃষ্টি করে— যারা মানবিক লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত, মানুষের প্রতি এবং সমাজের প্রতি যাদের কোনও দায়িত্ববোধ নেই, যারা চাকরিকে এবং গোলামিকেই সর্বস্ব বলে মনে করে, পয়সার বিনিময়ে তারা যা কিছু করতে পারে এবং এইভাবে বিজ্ঞানের চর্চা ও বিদ্যাকে তারা প্রবাহিত করে। অপরদিকে যত অধ্যাত্মবাদ, সেকেলে যত রকমের কুসংস্কার, যত যুক্তিহীন মানসিকতা এবং অন্ধতাকে গড়ে তোলে। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে অধ্যাত্মবাদ, তমসাচ্ছন্ন ভাবনাধারণা এবং যুক্তিহীনতার সাথে কারিগরি বৈজ্ঞানিক বিদ্যার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। এরকম ঘটনা যখন দেশে ঘটে তখন যুক্তিবাদী মন দেশে মরে যায়। তাই বামপন্থী আন্দোলন সম্পর্কেও আমি হুঁশিয়ার করে বলেছিলাম, যে বামপন্থীরা শক্তিবৃদ্ধির জন্য আলাপ-আলোচনার দ্বার বন্ধ করে দিয়ে গায়ের জোর প্রয়োগ করার নীতি গ্রহণ করে, যেহেতু তাদের শক্তি এবং দলবল বেশি বলে তা তখনকার মতো ডিভিডেন্ড (সুবিধা) দেয়; তারা কাউকে মুখ খুলতে দেয় না, কোনও যুক্তিতে কর্ণপাত করে না, তাদের কর্মীরা নিজেরা যুক্তি করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে এবং অপর মানুষের মধ্যেও এই মানসিকতা নষ্ট করে দেয়—তারা কি জানে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া কী? অসম্ভব মনে হলেও বাস্তব সত্য এই যে, যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, যারা কমিউনিজমের কথা বলছে, যারা বামপন্থার কথা, সংগ্রাম-বিপ্লবের কথা বলছে এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়ছে, তারাই আবার তাদের আচার-আচরণের দ্বারা এমন একটা যুক্তিহীন মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করছে যার পরিণতিতে গিয়ে সেই বামপন্থারই কবর খোঁড়া হবে, ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান হবে। কারণ, দেশের জমিতে যখন যুক্তিবাদী মন মরে যায় তখনই প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা সমাজজীবনে প্রবেশের সহজ রাস্তা সৃষ্টি হয়। একদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষে মানুষকে ফ্যানাটিক (অতিশয় উগ্র) করা, অন্যদিকে পুরনো ঐতিহ্যবাদ এবং ভাসাভাসা সমাজতন্ত্র, বিপ্লব আর প্রগতির স্লোগান-এই তিনটিকে যদি একত্রে মেলানো যায় তাহলেই একটা দেশে ফ্যাসিবাদের জমি তৈরি হয়। মনে রাখা দরকার, শাসক বুর্জোয়াশ্রেণী দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিভ্রান্ত করে একমাত্র তখনই এই তিনটিকে সুন্দরভাবে মেলাতে পারে যখন দেশে সত্যই যুক্তিবিজ্ঞানের ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনার মনোভাব সমাজজীবন থেকে তিরোহিত হয়ে যায়। এরূপ অবস্থাতেই ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠার সুবর্ণ সুযোগ। তাই আমি বামপন্থীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলাম যে, কংগ্রেস এবং শাসকশ্রেণীর দল দেশের মধ্যে এরকম যুক্তিহীন মানসিকতা গড়ে তুলতে চেষ্টা করবেই। তারা তো চাইবেই এ ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠুক। কিন্তু বামপন্থীরা নিজেদের দলীয় স্বার্থের জন্যও কেন এমন ধরনের আচরণ করবে? যদি করে তাহলে সাময়িকভাবে তা তার পক্ষে লাভজনক হবে, কিন্তু ভবিষ্যতে সেটাই হবে তার কবর খোঁড়ার প্রশস্ত রাস্তা। তাই যুক্তিহীন মনোভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাসের চর্চা, আলাপ-আলোচনা, পরস্পরের মতের উপর আলোচনা ও সমালোচনা এবং তর্কাতর্কির পরিবেশ থাকা দরকার। একমাত্র এ ধরনের পরিবেশ গড়ে উঠলেই শোষকশ্রেণীর কোনও দলের পক্ষে জনসাধারণের মধ্যে অনুপ্রবেশ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
ফ্যাসিবাদ হ’ল প্রতিবিপ্লবের একটি ইতিহাস নির্ধারিত রূপ, যার মধ্য দিয়ে আগাম পদক্ষেপের দ্বারা পুঁজিবাদ বিপ্লবকে প্রতিহত করতে চায়। এর উদ্দেশ্য হল, প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের মুখে পড়ে সংকটে জর্জরিত ও বিশৃঙ্খলতায় কলঙ্কিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। পরিস্থিতির এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে—যখন প্রচলিত স্বাভাবিক অর্থনৈতিক সংগঠন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনযন্ত্র পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান সংকটকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে যায়, যখন বাজারের কোনরকম স্থায়িত্ব রক্ষা করা ও সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে, যখন সংকটের ফলে জীবনে অনিশ্চয়তার কঠিন আঘাতে জনসাধারণ বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে থাকে— তখন এই পরিস্থিতিতে বুর্জোয়ারা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের মৌলিক নিয়মকে সবচেয়ে কার্যকরীভাবে বজায় রাখার জন্য, সংসদীয় গণতন্ত্রের আলখাল্লা পরিয়ে বুর্জোয়াশ্রেণীর একনায়কত্বকে আড়াল করার যাবতীয় প্রকরণকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এই সব ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ফ্যাসিবাদের মধ্যে কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়, সেগুলিই তাকে চিনে নিতে সাহায্য করে। সেগুলি হ’ল প্রধানত অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ, রাষ্ট্রের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা সর্বাধিক কেন্দ্রীভূত করা এবং প্রশাসনে চূড়ান্ত ক্ষতিকারক দৃঢ়তা (rigid firmness); এইগুলি বেশি বেশি করে রাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থের একাত্মতা গড়ে তোলে এবং সংস্কৃতির যন্ত্রীকরণ (cultural regimentation) সৃষ্টি করে। এই অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ, রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করা, প্রশাসনিক কঠোরতা, সংস্কৃতির যন্ত্রীকরণ এবং রাষ্ট্র ও একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থের একাত্মতার চেহারা সব দেশে এক নয়। এটা নির্ভর করে প্রতিটি দেশে তার আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির উপর, স্বাভাবিকভাবেই যা দেশে দেশে ভিন্ন।
এমনকী, বাহ্যিক রূপের ক্ষেত্রেও ফ্যাসিবাদের বাঁধাধরা কোন প্যাটার্ন বা ধাঁচা নেই। বিভিন্ন দেশের অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি কর্ণপাত করে না, তাদের কর্মীরা নিজেরা যুক্তি করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে এবং অপর মানুষের মধ্যেও এই মানসিকতা নষ্ট করে দেয় – তারা কি জানে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া কী? অসম্ভব মনে হলেও বাস্তব সত্য এই যে, যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, যারা কমিউনিজমের কথা বলছে, যারা বামপন্থার কথা, সংগ্রাম-বিপ্লবের কথা বলছে এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়ছে, তারাই আবার তাদের আচার-আচরণের দ্বারা এমন একটা যুক্তিহীন মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করছে যার পরিণতিতে গিয়ে সেই বামপন্থারই কবর খোঁড়া হবে, ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান হবে। কারণ, দেশের জমিতে যখন যুক্তিবাদী মন মরে যায় তখনই প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা সমাজজীবনে প্রবেশের সহজ রাস্তা সৃষ্টি হয়। একদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষে মানুষকে ফ্যানাটিক (অতিশয় উগ্র) করা, অন্যদিকে পুরনো ঐতিহ্যবাদ এবং ভাসাভাসা সমাজতন্ত্র, বিপ্লব আর প্রগতির স্লোগান-এই তিনটিকে যদি একত্রে মেলানো যায় তাহলেই একটা দেশে ফ্যাসিবাদের জমি তৈরি হয়। মনে রাখা দরকার, শাসক বুর্জোয়াশ্রেণী দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিভ্রান্ত করে একমাত্র তখনই এই তিনটিকে সুন্দরভাবে মেলাতে পারে যখন দেশে সত্যই যুক্তিবিজ্ঞানের ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনার মনোভাব সমাজজীবন থেকে তিরোহিত হয়ে যায়। এরূপ অবস্থাতেই ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠার সুবর্ণ সুযোগ। তাই আমি বামপন্থীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলাম যে, কংগ্রেস এবং শাসকশ্রেণীর দল দেশের মধ্যে এরকম যুক্তিহীন মানসিকতা গড়ে তুলতে চেষ্টা করবেই। তারা তো চাইবেই এ ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠুক। কিন্তু বামপন্থীরা নিজেদের দলীয় স্বার্থের জন্যও কেন এমন ধরনের আচরণ করবে? যদি করে তাহলে সাময়িকভাবে তা তার পক্ষে লাভজনক হবে, কিন্তু ভবিষ্যতে সেটাই হবে তার কবর খোঁড়ার প্রশস্ত রাস্তা। তাই যুক্তিহীন মনোভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাসের চর্চা, আলাপ-আলোচনা, পরস্পরের মতের উপর আলোচনা ও সমালোচনা এবং তর্কাতর্কির পরিবেশ থাকা দরকার। একমাত্র এ ধরনের পরিবেশ গড়ে উঠলেই শোষকশ্রেণীর কোনও দলের পক্ষে জনসাধারণের মধ্যে অনুপ্রবেশ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
এমনকী, বাহ্যিক রূপের ক্ষেত্রেও ফ্যাসিবাদের বাঁধাধরা কোন প্যাটার্ন বা ধাঁচা নেই। বিভিন্ন দেশের অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তা বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। কোথাও সে ব্যক্তি একনায়কত্বের রূপ নিয়েছে, কোথাও মিলিটারি শক্তির স্বৈরাচারী শাসনের রূপ পরিগ্রহ করেছে। আবার অন্য কোন কোন দেশে সংসদকে টিকিয়ে রেখে, সাথে সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণের সাহায্যে তার ক্ষমতাকে সীমিত করে, ফ্যাসিবাদ একটা গণতান্ত্রিক মুখোশ ধারণ করে। দ্বিদলীয় পরিষদীয় ব্যবস্থার সরকার গড়ার মাধ্যমে ‘গণতান্ত্রিক’ রূপে ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান ঘটানো নিশ্চিতভাবে যুদ্ধপরবর্তী একটি সামাজিক ঘটনা – ইতিহাসে যার কোন নজির নেই। আপাতদৃষ্টিতে এর গণতান্ত্রিক আবরণ থাকায় একইসাথে এটি চরম প্রতারণাপূর্ণ। এবং বাস্তবে এটা বহু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী যারা ফ্যাসিবাদকে, পূর্বের অনুচ্ছেদে আলোচিত তার মূল চরিত্র বা বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার না করে এর বাহ্যিক রূপ দিয়ে বিচার করার চেষ্টা করেন – তাঁদেরকে প্রতারিত বা বিভ্রান্ত করেছে। …
ফ্যাসিবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ, রাষ্ট্রের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সর্বাধিক কেন্দ্রীভূত করা, প্রশাসনে কঠোর দৃঢ়তা, সংস্কৃতির যন্ত্রীকরণ এবং একচেটিয়া পুঁজিপতি ও রাষ্ট্রের স্বার্থের একাত্মতা – এগুলি নিঃসন্দেহে বিশ্বের সমস্ত পুঁজিবাদী দেশে কমবেশি মাত্রায় ফুটে উঠছে – এশিয়া বা আফ্রিকার পিছিয়ে পড়া দেশগুলিও এর বাইরে নয়। যুগের এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে এযাবৎকাল প্রচলিত ধারণাকে পরিবর্তন করার দাবি রাখছে। যুদ্ধ-পূর্ব দিনগুলিতে ইটালি ও জার্মানির মতো দু’টি উন্নত পুঁজিবাদী দেশ, যাদের বাস্তবে কোন উপনিবেশ ছিল না, সেখানে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, একমাত্র শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশেই ফ্যাসিবাদের জন্ম ও বিকাশ ঘটতে পারে। মনে করা হত এই ধরনের অত্যন্ত উন্নত পুঁজিবাদী অর্থনীতি যখন বাজারের নিদারুণ অভাবে ভুগতে থাকে এবং প্রবল সামরিক শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে, তখনই সেখানে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় উপাদান সৃষ্টি হয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে অতীতের তত্ত্বগত ধারণা যে ভ্রান্ত তা আজ প্রমাণিত হচ্ছে এশিয়া ও আফ্রিকার অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে দুর্বল কিছু পুঁজিবাদী দেশে ফ্যাসিবাদের যে ক্রমবর্ধমান ঝোঁক দেখা দিচ্ছে এবং এই ধরনের আর কিছু দেশে যেভাবে সামরিক ও ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তার মধ্য দিয়ে।…
ফ্যাসিবাদ সর্বত্র এবং সবসময় দু’মুখো নীতি নিয়ে চলে, তা হ’ল, একদিকে জনগণকে দমন করা, অন্যদিকে তাদের বুঝিয়ে-সুুঝিয়ে বা ঠকিয়ে নিজেদের দিকে টেনে আনার নীতি। এর লক্ষ্য যতটা না জনশক্তিকে নির্মমভাবে দমন করা, তার চেয়ে বেশি হল কৌশলে তাদের মন জয় করে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসা এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে তৈরি করা, যারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে ‘জাতীয় পুনর্গঠনের’ ফ্যাসিবাদী পরিকল্পনা ও কর্মসূচিগুলিকে কার্যকরী করতে ইচ্ছুক হয়ে ওঠে। সহযোগী জনশক্তি পিছনে না থাকলে ফ্যাসিবাদ তার শাসন কায়েম করতে পারে না। তাই ফ্যাসিবাদ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে, জনগণকে ছোটখাট অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়, পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং তা থেকে উদ্ভুত জীবনের অনিশ্চয়তা, যেমন বেকার সমস্যা ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এইভাবে ফ্যাসিবাদ পুঁজিপতিদের সামগ্রিক স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে এমন কী ব্যক্তি পুঁজিপতিদের উপর এবং তাদের যথেচ্ছ উৎপাদনের স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। সংক্ষেপে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র তথাকথিত বুর্জোয়া কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অবস্থান গ্রহণ করে। এই তথাকথিত কল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করার সাথে সাথে ফ্যাসিবাদ বিপ্লবী চিন্তাকে নির্মূল করার জন্য নিরলস তীব্র আদর্শগত লড়াই চালিয়ে যায়। আর যখন অসচেতন জনতা এই পদক্ষেপগুলিকে পুঁজিবাদবিরোধী ও জনমুখী বলে মনে করতে থাকে এবং ফ্যাসিস্টদের পরিকল্পনা ও কর্মসূচিগুলিকে কার্যকর করার জন্য সোৎসাহে সমর্থন জানায়, তখন ফ্যাসিস্টরা চিন্তাগতভাবে কমিউনিজমকে এবং শারীরিকভাবে কমিউনিস্টদের পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করার জন্য তাদের সমস্ত ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে। কমিউনিজমের বিরুদ্ধে তার এই যুদ্ধে ফ্যাসিবাদ সোস্যাল ডেমোক্র্যাসি উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অতীন্দ্রিয়বাদের বিচিত্র সংমিশণে তৈরি ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির জয়গান করে।…
জাতীয় উন্মাদনা সর্বদাই বুর্জোয়াদের হাতে একটি শক্তিশালী অস্ত্র – যার দ্বারা তারা জনমানুষকে শ্রেণীসংগ্রামের আদর্শ এবং সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলে। ফ্যাসিস্টরা নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে। একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বুর্জোয়ারা যে প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ প্রচার করে, তা এবং জনসাধারণের দেশপ্রেম, এ দুটি এক জিনিস নয়। বিষয়বস্তু ও চরিত্র, দু’দিক থেকেই এরা ভিন্ন। জনসাধারণের দেশপ্রেমের সঙ্গে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শের কোন বিরোধ নেই, বরং বর্তমান যুগে কেউ প্রকৃত দেশপ্রেমী হতে পারে না, যদি না সে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী হয়। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন। তাছাড়া যেখানে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ বিশ্ব বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন মাত্র এবং মানুষের দেশপ্রেমের আবেগ বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থে শোষকের হাতে হাতিয়ার, সেখানে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শের দ্বারা পরিচালিত দেশপ্রেমের ধারণা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ব্যবস্থার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে শোষিত জনগণের হাতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। যেখানে সমাজপ্রগতির পথে বাধা যে পুরাতন-পচাগলা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থান্বেষী বুর্জোয়া উদ্দেশ্য থেকে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ উদ্ভুত হয়, সেখানে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শে বলীয়ান দেশপ্রেম মানুষের প্রতি প্রকৃত ভালবাসার উৎস থেকে উৎসারিত হয় এবং সমাজপ্রগতির পথে সমস্ত বাধাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। অতএব ফ্যাসিবাদ মানুষের প্রকৃত দেশপ্রেমের অনুভূতিকে সহ্য করতে পারে না।
শ্রেণীসংহতি, শ্রেণীঐক্য, শ্রেণীঊর্ধ্ব জাতীয় স্বার্থের যে ধারণাকে ফ্যাসিবাদীরা প্রচার করে, সাধারণ মানুষের সামনে তাকে তারা এক বিশেষীকৃত রূপে তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করে। তাই ফ্যাসিবাদ কখনও কখনও অতিমানবের ধারণার প্রচার করে, যে অতিমানব হচ্ছে জাতীয় ইচ্ছা ও স্বার্থের মূর্তরূপ। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, পুঁজিবাদ তার অধিকার প্রতিষ্ঠার সূচনাপর্বে যে ঈশ্বরচিন্তা ও মায়াবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিল, আজ ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার দিকেই আবার ঝুঁকছে এবং তাকে অবলম্বমন করেই টিকে থাকার চেষ্টা করছে।…
ভারতীয় বুর্জোয়ারা ‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ’ নামক অর্থনৈতিক স্লোগানের পরিপূরক ‘জাতীয় স্বার্থে জাতীয় ঐক্য’র রাজনৈতিক স্লোগান তুলে ধরেছে। এর লক্ষ্য হল, শ্রেণীসংগ্রামের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া ও বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের শ্রমিকশ্রেণীর এবং জনগণের অন্যান্য শোষিত অংশের সংগ্রামে তাদের আদর্শগতভাবে নিরস্ত্র করা। একটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজে একটি জাতি অখ- সত্তা নয়, তা বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। ভারতীয় জাতিও একটি অখ- সত্তা নয়; বরং এর একদিকে রয়েছে টাটা, বিড়লা, ডালমিয়া, সিংহানিয়া ও অন্যান্য পুঁজিপতি, জোতদার, কুলাক, আমলাতন্ত্রের উচ্চস্তরের পদ দখল করে থাকা বড় বড় অফিসার এবং বুর্জোয়াদের অনুগত ভৃত্যরা, অন্যদিকে রয়েছে শ্রমিক, মধ্য ও গরিব চাষী, কৃষি মজুর ও অন্যান্য শোষিত অংশের মানুষ। ফলে ঐতিহাসিকভাবে আমাদের সমাজে সামাজিক শক্তিগুলি নির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র শ্রেণীস্বার্থে এবং তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে নানান শ্রেণীতে বিভক্ত। কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, একে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। এটা কমিউনিস্টদের সৃষ্টি নয়, নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ইতিহাস নির্ধারিত প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি। কমিউনিস্টদের ‘অপরাধ’ হ’ল, তারা এই বাস্তব ঘটনাকে স্বীকার করে এবং সমাজ অগ্রগতির নিয়মকে উপলব্ধি করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের মতো বুর্জোয়া সমাজে সব সময় জনগণের সামনে পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থকেই জাতীয় স্বার্থ হিসাবে তুলে ধরা হয়। ‘জাতীয় স্বার্থের জন্য জাতীয় ঐক্য’ স্লোগানটি নতুন স্লোগান নয়। সারা বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে ফ্যাসিস্টরা এই স্লোগান তুলেছে। আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী হলেও এটাই বাস্তবে সত্য যে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, যারা আমাদের দেশের ফ্যাসিবাদের অগ্রগতিকে প্রতিরোধ করতে চায় বলে আমরা মনে করি, তারা ‘জাতীয় স্বার্থের জন্য জাতীয় ঐক্যে’র স্লোগানের সাথে সুর মিলিয়ে আমাদের দেশের শ্রেণীসংগ্রাম ও বিপ্লবের লক্ষ্য পূরণে খুবই ক্ষতিসাধন করছে।
ফলে, আমরা দেখছি যে, কংগ্রেসের ‘জাতীয় পুনর্গঠনের’ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচিগুলি ভারতবর্ষে ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করছে। ‘জাতীয় স্বার্থের জন্য জাতীয় ঐক্যে’র স্লোগানটির লক্ষ্য হল শ্রেণীসংগ্রামের প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া। প্রতিক্রিয়াশীল উগ্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনাকে ফেনিয়ে তোলা হচ্ছে, এবং এমনকী ‘জাতীয় ঐক্য’ ও ‘জাতীয় স্বার্থে’র প্রতীক হিসাবে সূক্ষ্মভাবে সুপারম্যান-এর ধারণা প্রচার করা হচ্ছে। এই উদ্দেশ্য থেকেই পণ্ডিত নেহেরুকে ‘জাতীয় নেতা’ এবং ‘ শ্রেণীঊর্ধ্ব জাতীয়স্বার্থে’র মূর্তরূপ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। ফলে, ফ্যাসিবাদের সমস্ত উপাদানই মজুত রয়েছে। শুধু অভাব ছিল একটি ফ্যাসিবাদী পার্টির অস্তিত্বের। সে অভাবও অতি দ্রুত পূরণ হয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনের সময় আগের চাইতে কংগ্রেস দল হিসেবে আরও বেশি ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এটাও ঠিক যে, এই দলটি এখনও ফ্যাসিস্ট পার্টির মনোলিথিক চরিত্র অর্জন করতে পারেনি। এখনও এর মধ্যে এমন ঢিলেঢালা ভাব, প্রকাশ্য গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব এবং অন্যান্য সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে – যা ফ্যাসিবাদ বরদাস্ত করে না। কিন্তু এটা ফ্যাসিবাদী একটি পার্টি হিসাবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।…
(চলবে)
তথ্য সূত্র :
১. ফ্যাসিবাদ ও বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নৈতিকতার সংকট
২. সময়ের আহবান