মাসের শুরুতে রহিম সাহেবের খুব হিসাব নিকাশ। পুরো বেতনে মাস চলবে কি ভাবে? ছোট ছেলেটার ঠান্ডা-জ্বর। তার চিকিৎসা করাতে হবে। এরপর আছে বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ। শুধু রহিম সাহেব নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য যে কোনো শিক্ষিত মানুষের কাছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার চিন্তাটাই প্রধান। জাপানের নাটক-‘একশ বস্তা চাল’-এ দেখা যায় আরও একটু উন্নত দৃষ্টান্ত। খরা আক্রান্ত একটা গ্রামে প্রচন্ড খাদ্য সংকট থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, চাল বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে স্কুল করা হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর পরিস্থিতিতে জাপানকে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে শিক্ষা যে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল-তা আজ কারোই অজানা নয়।
জুন মাসে আমাদের দেশে নতুন বাজেট পাশ হয়। বাজেটের মাধ্যমে বোঝা যায় যে দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাতে রাষ্ট্রের আর্থিক পরিকল্পনা কী? ১৯৭২ সালে জাতীয় বাজেটের ২১ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল। তারপর থেকে জাতীয় বাজেটে মোট টাকার পরিমাণ বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হার শতকরা কমেছে। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে ১০.৭ শতাংশে। দেশের পত্র-পত্রিকা-বিলবোর্ডে প্রচারিত হচ্ছে যে, আমাদের দেশের জিডিপি বাড়ছে। কিন্তু জিডিপি বাড়ছে যাদের শ্রমে-ঘামে, তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি বাজেটে গুরুত্ব পাচ্ছে কি? ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিলো জিডিপি’র ২.২৩ শতাংশ। শিক্ষাখাতে জিডিপি’র শতাংশ বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অবস্থান ১১৮তম । আফ্রিকার অনেক দেশও বাংলাদেশের চেয়ে শতাংশ হিসাবে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তাছাড়া আমাদের দেশের সামগ্রিক শিক্ষাখাতে যে ব্যয় করা হয় তার ৯০ ভাগই ব্যয় হয় অনুন্নয়ন খাতে এবং বাকি ১০ ভাগ ব্যয় বরাদ্দ করা হয় উন্নয়ন খাতে। এই উন্নয়ন খাতের বড় অংশ আবার ব্যয় করা হয় ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে। ফলে শিক্ষার মান উন্নয়ন আর সম্প্রসারণ যে কতটুকু গুরুত্ব পায় তা সহজেই অনুমেয়। শিক্ষার প্রতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি কি তা বিগত দিনের বাজেট পর্যালোচনায় বুঝতে পারা সম্ভব।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ বামপন্থী সংগঠনগুলোর দাবি হলো জাতীয় বাজেটের ২৫% শিক্ষাখাতে বরাদ্দের। কারণ, প্রথমত শিক্ষার অধিকার মনুষ্যত্বের অধিকার। মানুষের সামষ্টিক সংগ্রামের ফলে অর্জিত যে জ্ঞানভান্ডার — তার উপর অধিকার সবার। কারও ব্যক্তিগত অর্থ আছে কি না-এ প্রশ্ন এক্ষেত্রে অবান্তর। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিপুল জনগোষ্ঠীকে সম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য চাই শিক্ষা। বিগত দিনের বহু গবেষক প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, শিক্ষা কিভাবে মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ থিওডোর শুলট্জ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, ১৯৫৪-৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে তার জন্য যন্ত্রপাতি, দালানকোঠা ইত্যাদির তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবদান অনেক বেশি। লেনিনগ্রাদের ধাতুশিল্পে কর্মরত একদল শ্রমিকের উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধিতে শিক্ষার ভূমিকার উপর অর্থনীতিবিদ এস. জি স্ট্রুমিলিনের গবেষণায় দেখা যায়- মাত্র এক বছরের শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত সাধারণ দক্ষতা শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। নিরক্ষর শ্রমিকদের তুলনায় অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন শ্রমিকদের উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ২ গুণ। সম্পূর্ণ নিরক্ষর শ্রমিকদের চেয়ে চার বছরের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রাপ্তদের উৎপাদনক্ষমতা ৪৩% বেশি। আর মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্তদের ১০৮ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্তদের ৩০ শতাংশ বেশি।
অথচ শিক্ষা নিয়ে শাসকদের পরিকল্পনা বরাবরই ছিল অন্যরকম। শিক্ষা এখন পুঁজিপতিদের মুনাফার উপকরণ। তাই রাষ্ট্র নাগরিকদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব ক্রমাগত অস্বীকার করছে। বেসরকারি স্কুল এখন স্কুল শিক্ষার প্রধান ধারা । লাখ লাখ শিশু এখনও প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে। আর্থিক সঙ্গতি নেই বলেই এই পরিস্থিতি। তার উপর আছে কোচিং, গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্রমাগত ছাত্র বেতন-ফি বাড়ানো হচ্ছে। ‘অভ্যন্তরীণ আয়’ বৃদ্ধির নামে খোলা হচ্ছে বিভিন্ন রকম বাণিজ্যিক কোর্স। অবকাঠামো ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দ থাকে এক শতাংশেরও কম। বিভিন্ন সমস্যা সংকটে পড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অথর্ব- অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গ্রেডিং পদ্ধতির নিয়মে বছরে ২১০ দিন ক্লাস হবার কথা থাকলেও ক্লাসরুম-শিক্ষক সংকটের কারণে ৬০-৭০ দিনের বেশি ক্লাস হয় না। লাইব্রেরি-সেমিনার-গবেষণাগার সবকিছুই খুবই অপ্রতুল। অথচ মাত্র কয়েক হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট দূর করা সম্ভব।
প্রতি বছর সামরিক খাতের মত অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। এ বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকার রিজার্ভ চুরি, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকের দুনীতিতে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। অথচ শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষাখাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে এত কার্পণ্য। এর কারণ কি? এ প্রসঙ্গে মহামতি লেনিন বলেছিলেন, “মন্ত্রীমহোদয় শ্রমিকশ্রেণীকে মনে করে বারুদের স্তূপের মতো। এবং জ্ঞান ও শিক্ষা তার কাছে স্ফুলিঙ্গের শামিল। তিনি খুব ভালোভাবেই বোঝেন যে, ঐ অগ্নি স্ফুলিঙ্গ যদি বারুদের উপর পড়ে তা হলে যে বিস্ফোরণ ঘটবে তা সকলের আগে সরকারের বিরুদ্ধেই নিক্ষিপ্ত হবে।”
বাংলাদেশে বারবার শাসকশ্রেণীর নাম পাল্টেছে, কিন্তু তাদের প্রকৃতিতে কোনো পরিবর্তন নেই। তাই জাতীয় বাজেটে ২৫ ভাগ বরাদ্দের দাবি বরাবরই উপেক্ষিত। কিন্তু জনগণ কি তার অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবে না? রহিম সাহেব যেমন তার কষ্টোপার্জিত অর্থের হিসাব সম্পর্কে সচেতন, ঠিক তেমনি দেশের বাজেট সম্পর্কে প্রতিটি মানুষের সচেতন থাকা প্রয়োজন। শিক্ষাখাতে-স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের উপর নির্ভর করবে আগামী বছর তার পরিবার কেমন চলবে। ছেলে-মেয়েদের স্কুল কলেজের বেতন বাড়বে কি না, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথেষ্ট দায়িত্ব নেবে কি না, দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নতুন করে ছিটকে পড়বে কি না, সবই নির্ভর করবে বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের উপর। জনগণের জীবনের সাথে বাজেটের এমন সম্পর্ক অথচ আমাদের দেশে বাজেট পাশ হয় জনগণবিচ্ছিন্নভাবে। যদিও বাজেটের অর্থের যোগানদাতা দেশের সাধারণ মানুষ। নিজের আয়ের উপর তার যেমন অধিকার, বাজেটের উপরও তেমনি তার অধিকার। কাজেই আমাদের প্রত্যাশা, দেশের সাধারণ জনগণ, ছাত্র-যুবসমাজ তাদের অধিকার আদায়ে সচেতন হবে।