Monday, April 29, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জুলাই-আগষ্ট ২০১৫বাজেট : গরিব মানুষের ওপর লুটপাটের মাত্রা আরও বাড়াবে

বাজেট : গরিব মানুষের ওপর লুটপাটের মাত্রা আরও বাড়াবে

[dropcap]জু[/dropcap]লাই মাসের প্রথম দিন, নতুন অর্থবছর শুরু হচ্ছে, নতুন বাজেট কার্যকর হচ্ছে। ঠিক সে সময় জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া আমাদের সামনে এক অভিনব তথ্য হাজির করলেন। তিনি বলেছেন, কার্যকরভাবে বাজেট প্রণয়নে সংসদ সদস্যদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাদের কথার মাধ্যমে বাজেটের একটি হরফও পরিবর্তন হয় না। তাঁর মতে, বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণই আমলাতান্ত্রিক। আসলে ডেপুটি স্পিকার একটি পুরনো সত্যই নতুন করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। অগণতান্ত্রিক এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাজেট প্রণয়ন বহু দিন ধরেই হচ্ছে। তার ওপর এখন তো দেশে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক কায়দায় একটি অনির্বাচিত সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতাসীন। এই অনির্বাচিত সংসদে পুরনো প্রক্রিয়াই পুনরাবৃত্তি হয়েছে মাত্র।

উল্লেখ্য, গত জুন মাসের ৪ তারিখ জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত সেই বাজেটের ওপর সংসদে ২০০ জনেরও বেশি সংসদ সদস্য প্রায় ৬০ ঘণ্টা ধরে আলোচনা করেন। সংসদের এই বাজেট অধিবেশন পরিচালনা করতে ব্যয় হয় শত কোটি টাকা। এবং এই অর্থ ও সময়ের ব্যয় যে কতটা অর্থহীন তা তো আগেই বলা হয়েছে।

বাজেট শুধু আমলাতান্ত্রিকই নয়, অগণতান্ত্রিকও
এক দীর্ঘ ব্যয়বহুল অথচ অর্থহীন প্রক্রিয়া শেষে গত ৩০ জুন সংসদে পাস হল ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট। এদেশে বাজেট শুধু আমলাতান্ত্রিকই হয় না, অগণতান্ত্রিকও হয়। অগণতান্ত্রিক বলতে প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন সবদিক থেকেই অগণতান্ত্রিক। বাজেটের উদ্দেশ্য কি থাকে? বাজেটের উদ্দেশ্য থাকে দেশের শিল্পপতি-ব্যবসায়ী লুটপাটকারী চক্রের মুনাফা ও লুটপাটের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা।

এবারের বাজেটে খাতওয়ারি বরাদ্দ (শতাংশ) হল — সুদ পরিশোধ ১৮.৪, জনপ্রশাসন ১৫.৭, শিক্ষা ও প্রযুক্তি ১০.৯, প্রতিরক্ষা ৮.৫, ভর্তুকি ও প্রণোদনা ৯.৯, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ ৬.১, জনশৃংখলা ও নিরাপত্তা ৫.৯, পেনশন ৫.০, স্বাস্থ্য ৩.৬, পরিবহন ও যোগাযোগ ২.৬, কৃষি ২.৪, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ১.৫, বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম ০.৭, গৃহায়ণ ০.৫, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিস ০.৩ এবং বিবিধ ব্যয় ৮.০।

এবারের বাজেটে প্রস্তাবিত ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক ঋণের সুদ এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা মেটাতে খরচ হবে। এবার রাজস্ব বাজেটের পরিমাণ এক লাখ ৯৬ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রাজস্ব বাজেটের সবচেয়ে বেশি অর্থ ৫৬ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা চলে যাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন ভাতায়, যা মোট রাজস্ব বাজেটের ২৯ শতাংশ। আর সুদ পরিশোধে খরচ হবে ৩৫ হাজার ১০৯ কোটি টাকা বা ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ মোট রাজস্ব বাজেটের ৯১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা বা ৪৭ দশমিক ৭৩ শতাংশই খরচ হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং সুদ মেটাতে। মোট বাজেটের ৩৪ দশমিক ১ শতাংশই চলে যাবে এ দুই খাতে। প্রতিরক্ষা ধরলে তিন খাত মিলিয়ে ব্যয় বরাদ্দ দাঁড়াচ্ছে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ।

আসলে এ হল সরাসরি দেয়া বরাদ্দ, যা খোলা চোখে দেখা যাচ্ছে। এর বাইরেও অপ্রত্যক্ষ বরাদ্দও আছে যা এসব খাতে যুক্ত হয়। বছর শেষে সংশোধনীর মাধ্যমেও আরো কিছু বরাদ্দের অনুমোদন দেয়া হয়। রাজস্ব বাজেট হল বাজেটের সেই অংশ যা সরাসরি জনগণের কাছ থেকে আদায় করা টাকার ভিত্তিতে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে হল, দেশের সাধারণ মানুষের দেয়া টাকার অর্ধেকটাই চলে যায় আমলাতান্ত্রিক ও অনুৎপাদনশীল খাতে। সুতরাং, বাজেটের উদ্দেশ্য যে জনগণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান ইত্যাদি মৌলিক অধিকারের বাস্তবায়ন নয় সেটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

সাধারণ মানুষের জন্য বরাদ্দ কতটুকু?
এ-সংক্রান্ত তথ্যও সরকারের কর্তাব্যক্তিরাই আমাদের সামনে তুলে ধরছেন। বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, বিগত দুই যুগের মধ্যে গত দুই অর্থবছরেই স্বাস্থ্য খাত সবচেয়ে কম বরাদ্দ পেয়েছে। কয়েকদিন আগে সংসদে তিনি বলেন, ২০১২-’১৩ অর্থ বছরে জাতীয় বাজেটের ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং ২০১৩-’১৪ অর্থ বছরে ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল স্বাস্থ্য খাতের জন্য। আর এবার জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত ১৫ লাখ ৭২ হাজার ৩০২ কোটি টাকার মধ্যে স্বাস্থ্য খাত পেয়েছে ৯১ হাজার ৬৪৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যা জাতীয় বাজেটের ৪.৩ শতাংশ মাত্র।

Budgwt chart5একই সত্য স্বীকার করছেন সরকারের শিক্ষামন্ত্রী, তিনি বলছেন : “ঘানা, কেনিয়ার মতো দেশে শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয় ৩১ ভাগ। আমাদের ব্যয় সেখানে মাত্র ৪ দশমিক ৩ ভাগ।” শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, “শিক্ষা খাতে উন্নয়নের জন্য দরকার ১৬ হাজার কোটি টাকা, দেওয়া হয়েছে মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা। এ দিয়ে বেতন দেব নাকি অবকাঠামো উন্নয়ন করব?”

প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এ দেশের বেশিরভাগ মানুষই দরিদ্র। যে মানুষদের পক্ষে তিনবেলা পেট ভরে ভাত খাওয়াই কঠিন, তারা শিক্ষা-চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজন কেমন করে মেটাবে? তাদের মৌলিক অধিকার পূরণ করা, মানবিক জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করাই তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু তাদের পক্ষে রাষ্ট্রী ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা-চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক অধিকারের সুযোগও দিনে দিনে সংকুচিত করা হচ্ছে। যার অর্থ, দেশের বেশিরভাগ মানুষের প্রয়োজন বাজেটে উপেক্ষিতই থাকে।

দেশের দরিদ্র মানুষের সন্তানেরা যে ভাঙাচোরা প্রাইমারি স্কুলগুলোতে পড়ে, সেগুলোর হাল সবারই জানা। তাদের কথা বাদ দেওয়া যাক। দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের একটা বড় অংশ এখন পড়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সরকারি ও পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নিজেদের জমি-জমা বিক্রি করে হলেও সন্তানদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। শিক্ষার এই বাণিজ্যিক ধারাকে সংকুচিত করা দূরে থাক, সরকার এই শিক্ষার্থীদের ওপর ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করার পরিকল্পনা করছে।

আসলে বাজেট আমাদের দেশে চলমান অর্থনীতিরই একটি ক্ষুদ্র প্রতিফলন মাত্র। দেশের বেশিরভাগ মানুষের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে গুটিকয়েক শিল্পপতি-ব্যবসায়ী লুটপাটকারীর পকেট ভারি করার প্রক্রিয়াই বাজেটে অনুমোদন করা হয়। কিন্তু এই সত্যটাকে ‘প্রবৃদ্ধি’, ‘উন্নয়ন’, ‘গড় আয় বৃদ্ধি’, ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ ইত্যদি শব্দের আড়ালে লুকিয়ে রেখে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়।
সাধারণ মানুষের উপরেই ট্যাক্স-ভ্যাট-করের বোঝা

এবারের বাজেটে ২ লক্ষ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকার ট্যাক্সের খাঁচার পুরে গরিব-মধ্যবিত্তকে তীব্র শোষণ করার পথ করা হয়েছে। ট্যাক্স-ভ্যাট ইত্যাদি নানা কায়দায় সরকার টাকা আদায় করে জনগণের পকেটে থেকে, আর সেটা খরচ করে আমলাতন্ত্রের পেছনে, কর ফওকুফ বা ট্যাক্স হলিডে, রপ্তানি বোনাস ইত্যাদি নানা নামে জনগণের টাকা তুলে দেয় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের পকেটে। আর শিল্পপতি-ব্যবসায়ী লুটেরদের লুটপাট তো আছেই। এভাবেই জনগণের সম্পদ ধনীদের পকেটে কেন্দ্রীভবনের প্রক্রিয়া চলছে। বাজেটে এ প্রক্রিয়াটাকেই সামান্য রদবদল করে অনুমোদন করা হয় মাত্র।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজেটের রাজস্ব সংগ্রহ, ব্যয় বরাদ্দ এবং সরকারি ঋণ সংগ্রহ ও ব্যবহারের গতি-প্রকৃতির মাধ্যমেই বাজেটের চরিত্র বোঝা যায়। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ১০ শতাংশ। যার অর্থ হল, এ দেশের ধনী ব্যক্তিদের কর দিতে বাধ্য করার ব্যাপারে সরকারগুলোর ব্যর্থ। সর্বগ্রাসী প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বিস্তারের কারণে এ দেশে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট), আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও সারচার্জের মতো পরোক্ষ করের ওপরই বাজেট প্রধানত নির্ভরশীল। ব্যবসায়ী বা আমদানিকারকরা এসব পরোক্ষ কর আদায় করতে ভূমিকা পালন করলেও তাঁরা এসব করের শুধুই ‘সংগ্রহে সহায়তাকারী’, পরোক্ষ করের প্রকৃত করদাতা ভোক্তা হিসেবে খুচরা ক্রেতারা।

প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ সব ধরনের কর-ভ্যাট দিয়ে থাকেন দেশের সাধারণ মানুষ। তাদের দেয়া করের ওপরই বাজেট প্রণয়ন করা হয়। বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা আইনের নানা ফাঁক-ফোঁকর কাজে লাগিয়ে কর না দেয়া অথবা কর ফাঁকি দেন। ড. মইনুলের এই বক্তব্যেরই সমর্থন ভিন্ন ভাবে পাওয়া গেল অর্থমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এক মন্তব্যে। তিনি বলছেন, জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ অপচয় হয় দুর্নীতিতে। ৩ শতাংশ ধরলেও এই অপচয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ, বিচার — এসব রাষ্ট্রীয় সেবামূলক ক্ষেত্রে দুর্নীতির পরিমাণ জিডিপির আড়াই শতাংশের মতো। আর রাষ্ট্রের বড় ক্রয় খাতে যোগসাজশের যে দুর্নীতি হয় তার পরিমাণ জিডিপির ৩ শতাংশের মতো। সব মিলিয়ে দুর্নীতির পরিমাণ কমপক্ষে জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি। এই দুর্নীতি কারা করছে? সে তথ্যও কিন্তু আমাদের জানা। সম্প্রতি হলমার্ক জালিয়াতি নিয়ে বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী সংসদেই বলেছেন যে দলের মধ্য থেকে ‘বাধা’ পাওয়ায় কারণেই এসব দুর্নীতির বিচার করা যাচ্ছে না।

সাধারণ মানুষের অর্থে লুটেরাদের প্রতিপালন
Bank debt_bonikbartaএদেশের বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ী গোষ্ঠী শুধু যে কর ফাঁকি দেয় তাই নয়। সাধারণ মানুষের পকেট থেকে আদায় করা টাকায় নানাভাবে তাদেরই প্রতিপালন করা হয়। সম্প্রতি দেশের ১৫ শিল্প গ্রুপের প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করা হয়েছে। শিল্প গ্রুপগুলোর পক্ষে ঋণদাতা ব্যাংকই এ আবেদন করেছে। সংবাদপত্রগুলো ভাষ্য মতে, এসব গ্রুপের মালিকানার সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা যেমন রয়েছেন, তেমনি আছেন ব্যবসায়ী নেতা ও দেশের আলোচিত ঋণখেলাপিদের পরিবারের সদস্যও। কয়েকটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক গতবছর ডিসেম্বরে বৃহৎ ঋণ পুনর্গঠনের একটি নীতিমালা তৈরি করতে বাধ্য হয়। ওই নীতিমালার আওতায় এখন বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, একক গ্রুপ হিসেবে সর্বোচ্চ ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করা হয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের পক্ষে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সাত ব্যাংক এ গ্রুপটির প্রায় ৪ হাজার ৯৫১ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করেছে। বেক্সিমকো গ্রুপ এবং এর ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজারে খুবই আলোচিত নাম। এ গ্রুপটি এর আগেও একাধিকবার খেলাপি ঋণের বিপরীতে নানা ধরনের সুবিধা নিয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় ১ হাজার ৪১২ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করা হয়েছে যমুনা গ্রপের জন্য যার চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলও একজন আলোচিত ব্যক্তি। এদের ঋণ আছে সরকারি-বেসরকারি ৮টি ব্যাংকে। ঋণ পুনর্গঠনের জন্য আবেদন করা অন্য ১২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিকদার গ্রুপের ৬৮৬ কোটি, থার্মেক্সের প্রায় ৬৬৭ কোটি, কেয়ার প্রায় ৮৭৯ কোটি, এস এ গ্রুপের প্রায় ৭১৯ কোটি, আব্দুল মোনেমের প্রায় ৪৯৭ কোটি, বিআর স্পিনিংয়ের ৪৭৩ কোটি, রতনপুর গ্রুপের ৪৩৫ কোটি, ইব্রাহিম গ্রুপের ৩৪০ কোটি, নাসা গ্রুপের ২০০ কোটি, গিভেন্সির ৬০ কোটি, দেশবন্ধুর প্রায় ৫৭ কোটি এবং ক্যান-অ্যাম প্রায় ১৫ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের জন্য আবেদন করেছে।

এই লুটপাটকারীদের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে বাজেটে সংশোধনী এনে করের পরিমাণ কমানো হয়েছে। বাজেট ঘোষণায় সব ধরনের পণ্যে রফতানির ওপর ১ শতাংশ উৎসে কর কাটার প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। অথচ বাজেট অনুমোদনের সময় তা কমিয়ে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। অর্থাৎ ১০০ টাকা রফতানি আয় হলে তার বিনিময়ে ৬০ পয়সা কর দিতে হবে গার্মেন্ট মালিকদের। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবেই এ কর কমানো হয়েছে।

দেশের শ্রমিকদের রক্ত শোষণ করে যারা অবাধে মুনাফা করছে, যাদের জন্য নানা ধরনের কর অবকাশের সুযোগ রাখা হয়েছে, যাদের জন্য প্রায় বিনা শর্তে, বিনা সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা আছে, যারা ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তাদের সুবিধার জন্য আইন পর্যন্ত পাল্টানো হয় সেই শিল্পপতি-ব্যবসায়ী চক্রের জন্য কর কমানোর কথা সুপারিশ করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। আর কর বাড়াচ্ছেন কাদের? এর আরো একটি নমুনা দেখুন। এবারের বাজেটে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর আয়করের হার ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছর থেকে কোনো ব্যক্তির বাৎসরিক আয় আড়াই লাখ টাকার বেশি হলে (অর্থাৎ যাদের মাসিক আয় মাত্র ২১ হাজার টাকা) তাকে ৪ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে।

বাজেট প্রণয়নের আগে গত ৫ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দেয়ার ইজ নো কালো টাকা ইন দিস বাজেট’। অথচ এবারও কিন্তু কালোটাকা সাদা করার পুরনো রীতি বহাল রাখা হল। শুধু তাই নয়, দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া লক্ষ কোটি টাকা ফিরিয়ে আনা, এসবের মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কোনো কথাই বাজেটে বলা হল না।

গরিব মানুষকে বাঁচানোর কোনো পরিকল্পনা বাজেটে নেই
এ দেশ থেকে সামান্য কাজের প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার লোককে সমুদ্রপথে পাচার করা হয়। তাদের জিম্মি করা হয়, বিদেশের জঙ্গলে বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়। অনেকেই লাশ হয়ে সাগরে ভেসে যায়, অথবা গণকবরে ঠাঁই পায়। নয়ত তারা বিভিন্ন দেশের কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করে। নারীরা পাচায় হয়ে ঠাঁই পায় বিভিন্ন দেশের পতিতালয়ে। সে-দেশে মানুষের কর্মসংস্থান কত জরুরি বিষয় তা কি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু শুধু এবার নয়, বিগত বছরগুলোতে দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কখনোই বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়নি। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা স্থাপন। কিন্তু এ লক্ষ্যেও কখনো কোনো উদ্যোগ নেয়া হনি। গ্রাম-শহরের গরিব মানুষের জন্য রেশনিং, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন প্রকল্প, সমস্ত বয়স্ক ও অক্ষম নারী-পুরুষের বার্ধক্য ভাতা চালু করার দাবি সম্পূর্ণ উপক্ষো করা হয়েছে। এ বাজেটে কৃষির ওপর নির্ভরশীল বিরাট সংখ্যক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য সামান্যতম রাষ্ট্রীয় সহায়তা নেই। সেচের ডিজেল-বিদ্যুৎ, সার-বীজের ওপর প্রত্যক্ষ ভর্তুকি নেই। উৎপন্ন ফসলের জন্য মূল্য সহায়তা নেই, সুলভ কৃষি ঋণের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। একইভাবে দেশের শ্রমিক জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো সহায়তা, কর্মপ্রত্যাশীদের জন্য কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হয়নি। পাচার হওয়া হাজার হাজার মানুষকে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যও কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।

সংগঠিত হোন, প্রতিবাদের শক্তি গড়ে তুলুন
বাজেট কি, বাজেট কেন হয় — দেশের বেশিরভাগ মানুষ, এমনকি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত অনেক মানুষও এসব প্রশ্নের সামনে অসহায় বোধ করেন। এক সময় বাজেটকে কেন্দ্র করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর রেওয়াজ ছিল প্রবল। মানুষ ভাবত, বাজেট মানেই জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি। মূল্য বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়া আর আগের মতো নেই। এর অর্থ এই নয় যে মূল্যবৃদ্ধি কমছে। আসলে বাজেট প্রণেতা এবং বাস্তবায়নকারীরা এখন অনেক সতর্ক, চতুর। সুতরাং মূল্যবৃদ্ধির কাজটা সারা বছর ধরেই চলে। এর সাথে যোগ হয়েছে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন করের নতুন হাতিয়ার। জিনিসপত্রের দাম বাড়ুক বা না বাড়ুক, খোদ ক্রেতা বা ভোক্তাকেই কর দিতে হবে সে আপনি যাই কিনুন। আসলে বাজেট হল কোনো দেশে চলমান অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার একটার সারাংশ, যা আমরা উপরে তুলে ধরেছি।

আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে সে সম্পর্কে আমরা খুব কম মানুষই সচেতন। কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের অভাব-অভিযোগ, সমস্যা-সংকট এই ব্যবস্থা থেকেই উদ্ভূত। বাংলা প্রবাদে বলে, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না। ঠিক তেমনি আমরা যত উদাসীন, যত অসচেতনই থাকতে চাই না কেন, জীবনের সংকট আমাদের পিছু পিছুই আসবে। সুতরাং অন্ধভাবে অচেতনভাবে লুটেরা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিগোষ্ঠীর শিকারে পরিণত হওয়ার পরিবর্তে আসুন সচেতনভাবে ব্যবস্থাটিকে বুঝে নেই। জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রতিদিনকার সমস্যা সংকট নিয়ে সংগঠিত হই, প্রতিবাদের শক্তি, আন্দোলনের শক্তি গড়ে তুলি।

সাম্যবাদ জুলাই-আগষ্ট ২০১৫

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments