Wednesday, December 25, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - ডিসেম্বর ২০১৮বামপন্থীদের কাছে প্রত্যাশা — অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বামপন্থীদের কাছে প্রত্যাশা — অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বক্তব্য রাখছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বক্তব্য রাখছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

[একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া, আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, জনগণের আস্থাহীন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবিতে বাম গণতান্ত্রিক জোটের উদ্যোগে গত ২৩ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে এখানে ছাপানো হল।]

বাংলাদেশে আমরা বহু রাজনৈতিক দল দেখছি, জোট দেখছি, অনেক জোট গঠিত হচ্ছে। কিন্তু আসল কথা হলো এটা যে – বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল অনেক, কিন্তু রাজনীতির ধারা দুইটি। একটা ধারা বুর্জোয়াদের, একটা ধারা বামপন্থীদের। এই দুই ধারা একেবারেই স্বতন্ত্র ধারা। আমরা যাদেরকে বুর্জোয়া বলি তারাই ক্ষমতায় থাকে, তারা লুটপাট করে, তারা ভোট করে এবং তারাই দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে। এই যে ব্যবস্থা, এই ব্যবস্থায় রাজনীতির প্রধান সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে – সেই জোটরা কে কতটা ওই ভোগের, ওই লুটের, ওই সম্পদ পাচারের সুযোগ পাবে। প্রতিযোগিতা চলছে তার ভিত্তিতে। তার বিপরীতে যে শক্তি, সে শক্তি হলো বাম শক্তি। এই যে শক্তি, এই শক্তির সাথে সেই বুর্জোয়া শক্তির যে অবস্থান তা ভিন্ন বিকল্প নয়, সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বুর্জোয়া রাজনীতির সাথে বাম রাজনীতির সন্ধির, আপোষের কোন সুযোগ নাই। পানির সাথে যেমন তেল মিশবে না, তেমনি এই দুই কখনো মিলবে না।

তাই যখন বামজোট গঠিত হয়, তখন আমরা আশান্বিত হই এই ভেবে – এটা কেবল একটা জোট নয়, এটা কোন নির্বাচনী জোট নয়, এটা একটা আন্দোলনের শক্তি এবং সেই আন্দোলন এদেশের রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনবে, এদেশের সমাজে পরিবর্তন আনবে- মানুষ যার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রতীক্ষা করছে। যুগ যুগ ধরে, শত শত বছর ধরে মানুষ প্রতীক্ষা করছে যে সামাজিক বিপ্লবের, সেই সামাজিক বিপ্লব ঘটবে। আমরা বৃটিশ আমলের রাজনীতি দেখেছি, পাকিস্তানের তেইশ বছরের রাজনীতি দেখেছি, আজকে সাতচল্লিশ বছর বাংলাদেশের রাজনীতি দেখছি। এই সমস্ত রাজনীতি একই রাজনীতি। যদিও পোশাকে, নামে, রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে রাজনীতিগুলো ভিন্ন। ভিন্ন্ এই রাজনীতি হলো ব্যক্তি মালিকানাকে কায়েম রাখা। এই রাজনীতি হচ্ছে লুন্ঠন, শোষণ, ভোগবাদিতা, সম্পদ পাচার এগুলোকে বিদ্যমান রাখা। এবং সেই রাজনীতি সবাই করেছে। বৃটিশ আমলে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ করেছে, পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ-আওয়ামী লীগ করেছে। এখনো একই রাজনীতি চলছে মূল জায়গায়। কাজেই বামপন্থীদের কর্তব্য হচ্ছে – এই ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা। ব্যক্তি মালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা এবং যে বিপ্লবের জন্য, যে সামাজিক বিপ্লবের জন্য মানুষ অপেক্ষা করছে সেই সামাজিক বিপ্লবকে সম্পন্ন করা।

আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। সেই চেতনা কোন বায়বীয় চেতনা ছিল না। যারা সেই চেতনার কথা বলে রাজনীতি করে তারা সেই চেতনার ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। সেই চেতনা ছিল বিপ্লবের চেতনা। এই যে তিরিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, এই যে তিন লক্ষ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে সেটা ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য নয়। একটা পুঁজিবাদী শক্তির হাত থেকে আর একটা পুঁজিবাদী শক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নয়। সেটা ছিল সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের জন্য, রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তনের জন্য। সেই পরিবর্তন ঘটেনি। আজকে বাংলাদেশে যে ঘটনা ঘটেছে তা হলো – পুঁজিবাদ মুক্ত হয়েছে, পুঁজিবাদ অবাধ হয়েছে। যারা পুঁজিবাদের ধারক-বাহক ও সুবিধাভোগী তারাই শাসন করছে, শোষণ করছে। আমাদের আন্দোলন, বামপন্থীদের আন্দোলন তাই এর বিরুদ্ধে। সমাজবিপ্লবের জন্য সারা পৃথিবীতে এই আন্দোলন চলছে। পৃথিবী জুড়ে মানুষ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। সারা পৃথিবীর মানুষ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। আমরা দেখছি সমাজে যে নিকৃষ্ট মানুষগুলো, তারা এখন কর্তৃত্ব করছে। ডোনাল ট্রাম্পের মত নিকৃষ্ট একজন মানুষ যার কথা ভাবা যায়না, সেই মানুষ সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের কর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমরা দেখছি কেমন করে ধর্ষণ চলছে, কেমন করে গণধর্ষণ চলছে আমাদের দেশে। একাত্তর সালে গণধর্ষণ চলেছে, এখন শিশুধর্ষণ চলছে। আমরা যে কোন একটা ঘটনা যদি দেখি, তাহলে দেখবো কেমন অবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতির। ক’দিন আগে আমরা দেখেছি ছোট্ট একটা ঘটনা। একজন মা তার শিশুকে ছাদ থেকে ফেলে দিল এবং সে আত্নহত্যা করল। এই যে মা শিশুকে ছুঁড়ে ফেলে দিল এবং নিজে আত্নহত্যা করল- এটা কোন বিছিন্ন ঘটনা নয়। আজকে বাংলাদেশে দিনে গড়ে ২৯ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে এবং কত মানুষ যে আত্মহত্যার সামনে দাড়িয়ে আছে তার সীমানা নাই। কিন্তু ওই যে মা তার চার দিনের শিশুকে হাসপাতালের ছাদ থেকে ফেলে দিল এবং নিজে ঝাঁপিয়ে পড়ল এর কারণ কী? নানা কারণ খুঁজে বের করা হবে- বলা হবে অসুস্থ ছিল মেয়েটি, বলা হবে ঝগড়া করেছিল। বাস্তবে অসুখ গোটা সমাজের। আজ সমাজে যেখানে মানুষ নিরাপদে নেই, যেখানে মানুষ আত্নহত্যা করে, যেখানে শিশুরা ধর্ষিত হয়, গণধর্ষিত হয়, যেখানে মানুষ গুম হয়, প্রতিদিন মানুষ খুন হয় এবং সড়ক দুর্ঘটনার নামে প্রতিদিন গড়ে দশ জন মানুষ খুনকরা হয়। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার।

এই জন্যই বামপন্থীদের ঐক্য দরকার। আমরা দেখছি সারা পৃথিবীব্যপী এই সংকট দেখা দিয়েছে। পুঁজিবাদ আজ পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলছে। বিজ্ঞানীরা বলছে- আর বারো বছর হাতে সময় আছে। এই বারো বছরের মধ্যে যদি নীতি পরিবর্তন করা না যায়, তাহলে এই গ্রহ, আমাদের এই পৃথিবী আর বসবাসের উপযোগী থাকবে না।

এই সংকটের সমাধান নির্বাচনে যাওয়ার লড়াই নয়। আগামীদিনে নির্বাচন হবে, বামপন্থীরা নির্বাচনে অংশ নেবেন কি নেবেন না সেটা অন্য কথা। নিলে আন্দোলনের অংশ হিসাবে নিবেন। আন্দোলনটাই আসল কথা, নির্বাচন আসল কথা নয়। আমরা ইন্দোনেশিয়ার খবর জানি। ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিষ্ট পার্টিতে কোটি কোটি সদস্য ছিল এবং চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এর পরে সেটাই ছিল বড় কমিউনিষ্ট পার্টি। ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে সেই কমিউনিষ্ট পার্টি একেবারে রাষ্ট্রক্ষমতার কাছাকাছি চলে গেল। তারপর আমরা দেখেছি কি নৃশংসভাবে লক্ষ লক্ষ বামপন্থীদের হত্যা করা হয়েছে। পুঁজিবাদীরাই বলে অন্তত ১০ লক্ষ বামপন্থীকে হত্যা করা হয়েছে। কাজেই নির্বাচন দিয়ে যে সমাজে বিপ্লব আনা যাবে না- এটা আমরা জানি। কিন্তু নির্বাচন আন্দোলনের একটা অংশ হতে পারে।

আজকে যেটা প্রয়োজন তা হলো- এই যে জোট গঠিত হলো, এই জোটকে গ্রামে-গঞ্জে নিয়ে যাওয়া। এই জোটে মেহনতি মানুষকে আনা, কৃষককে আনা, ছাত্রকে আনা, নারীকে আনা, যুবককে আনা এবং এই আন্দোলন গড়ে তোলা। এই আন্দোলন সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন, সমাজ বিপ্লবের আন্দোলন। বিপ্লব একদিনের ব্যাপার নয়, কারো মুখের কথা নয়, বিবৃতি প্রদানের ব্যাপার নয়। বিপ্লবকে ধারাবাহিকভাবে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে হয়, আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। এই কাজটা এখন বামপন্থীদের। সারাদেশ বামপন্থীদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই যে বুর্জোয়ারা যে রাজনীতি করছে তার যে খেলা, তার যে নাটক, তার যে ভয়াবহ কৌতুকতা সেগুলো দেখে মানুষ দুঃখ পায়। কিন্তু মানুষ প্রতীক্ষায় থাকে- কারা আছে এদের বিকল্প, এদের বিরুদ্ধে কারা। এদের বিকল্প হলো বামশক্তি। আমরা অত্যন্ত আশান্বিত এদেশের মানুষ,এটা দেখে যে বামপন্থীরা একটা প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছে। যে ঐক্য আমরা আগে কখনো দেখিনি এবং আমরা আশা করি এই ঐক্য আরো বিস্তৃত হবে, এই ঐক্য আরো গভীর হবে, আরো দৃঢ় হবে। এই ঐক্যের মধ্যে দিয়ে বাম রাজনীতি বাংলাদেশের মূল রাজনীতি হবে। এটা অসম্ভব নয়, যদি বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়। যদি তারা গ্রামে-গঞ্জে-শহরে ঐক্যবদ্ধ হয়।

একটা কথা বলে আমি শেষ করবো। সেটা হলো- বিপ্লব যে আমরা করবো তার জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন হবে। জ্ঞান ছাড়া কখনো কোনো বিপ্লব সম্ভব হবে না। পরিবর্তন সম্ভব হবে, কিন্তু আমরা যে বিপ্লব এর কথা বলছি সে বিপ্লব সম্ভব নয়। বুর্জোয়াদের যে অর্জন জ্ঞানের ক্ষেত্রে, সেই অর্জনকে আমাদের হার মানাতে হবে। হার মানাতে হবে আমাদের নৈতিকতায়। আমাদের নৈতিকতা তাদের নৈতিকতার চেয়ে ভিন্ন। তাদের নৈতিকতা ভোগবাদিতার, সম্পদ পাচারের, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, শোষণের। আমাদের নৈতিকতা সৃষ্টির, সাফল্যের, গড়ে তোলার এবং যা গড়ে তুলবো তা সকলের মধ্যে ভাগ করে নেবার। সেই যে নৈতিকতা, সেই যে জ্ঞানের চর্চা সেইটা খুব দরকার।

আমরা বাংলাদেশে দেখছি জ্ঞানের চর্চা খুব নীচু পর্যায়ে নেমে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছাত্র সংসদ নেই। রাষ্ট্রপতিরা বলেন, মন্ত্রীরা বলেন, রাজনৈতিক নেতারা বলেন যে- নির্বাচন হওয়া দরকার। কিন্তু নির্বাচন হয় না, হয় না এই কারণে যে শাসকশ্রেণী এই ছাত্র নির্বাচনকে ভয় পায়। কারণ এর মধ্যে দিয়ে যে কন্ঠ বেরিয়ে আসবে, এখানে যে জ্ঞানের চর্চা হবে, এখানে যে সংস্কৃতির চর্চা হবে সেটাকে তারা ভয় পায়। এই জন্য গত আটাশ বছরে আমাদের দেশে কোন ছাত্র সংসদ নেই। এটি বৃটিশ আমলে অকল্পনীয় ছিল, পাকিস্তান আমলে অকল্পনীয় ছিল এবং বাংলাদেশে প্রথম যুগে অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু আজকের শাসকশ্রেণী এটিকে মেরে দিয়েছে এবং জ্ঞানের চর্চাকে নিরুৎসাহিত করছে, সংস্কৃতি চর্চাকে নিরুৎসাহিত করছে, নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলাকে নিরুৎসাহিত করছে।

কাজেই বামদের দিকে আজকে মানুষ তাকিয়ে আছে। তারা জ্ঞানে, নৈতিকতায় এবং আন্দোলনে বিপ্লবী চেতনায় এমন আন্দোলন করবে, যে আন্দোলন সমাজকে পাল্টে দেবে। যার জন্য এদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে প্রতীক্ষা করছে। তাই কেবল আমি নই, এই যে ঐক্য গড়ে উঠেছে এই ঐক্যকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানায় সারাদেশের মানুষ এবং কামনা করে এই ঐক্য আরো গভীর, আরো দৃঢ় হোক, আরো বিস্তৃত হোক।

সাম্যবাদ ডিসেম্বর ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments