Monday, December 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জুন ২০২১বামপন্থীদের চীন প্রীতি কী ইঙ্গিত বহন করে

বামপন্থীদের চীন প্রীতি কী ইঙ্গিত বহন করে

সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিংকে নিয়ে চীনের একটি রেডিও চ্যানেলে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড রাজেকুজ্জামান রতন বক্তব্য রেখেছেন। তাঁরা চীনের রাষ্ট্রপতির প্রশংসা করেছেন এবং সেই প্রেক্ষিতেই রাষ্ট্র হিসেবে চীনকে তারা কীভাবে দেখেন সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। খুব অল্প সময়ের এই সাক্ষাৎকারগুলোতে চীন প্রসঙ্গে তাদের দলের সামগ্রিক মূল্যায়ন পাওয়া না গেলেও কী দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা চীনকে দেখছেন, সে ব্যাপারে একটা ধারণা পাওয়া যায়। তারা ‘চীনের কমিউনিস্ট পার্টি’র শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পার্টির নেতা-কর্মী-সংগঠকদের শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন।

প্রশ্ন আসে ‘চীনের কমিউনিস্ট পার্টি’ বলে যে পার্টিটি এখন চীনের রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে, সেটা আদৌ কোনো কমিউনিস্ট পার্টি কি না। মাও সে-তুংয়ের নেতৃত্বে যে কমিউনিস্ট পার্টি চীনে বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতান্ত্রিক লাল চীন সৃষ্টি করেছিল, সেই কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব কি এখনও আছে? চীন কি এখনও একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র?

প্রশ্নগুলো এই সময়ের প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক। কারণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিবেচনায় চীন বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেরও নানামাত্রার প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতিতে প্রতীয়মান হয়। একইসাথে চীন এখন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। রাষ্ট্র হিসেবে চীন সম্পর্কে সঠিক বিশ্লেষণ বামপন্থীরা দেশের জনগণের সামনে তুলে ধরতে না পারলে চীনের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে বামপন্থা ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হবে। এদেশে শুধু বাসদ নয়, বামপন্থীদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তাদের দলীয় পত্রিকায় সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রশস্তি গেয়েছেন বিভিন্ন সময়। ফলে চীন সম্পর্কিত একটা আলোচনা দরকারী। আর এই আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি বামপন্থী দলের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে। কোনো একটি বামপন্থী দলের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, তাদের জাতীয় রাজনীতি সম্পর্কিত নীতিনির্ধারণ কেমন হবে – তা এই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়।

আমাদের এই আলোচনা একটি তাৎক্ষণিক ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা। ইতিহাসের ঘটনা ধরে ধরে চীন সম্পর্কিত একটি সামগ্রিক মূল্যায়ন আমরা হয়তো পরবর্তীতে করতে পারব।

মাও সে তুং-এর মৃত্যু ও চীনে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা

খোদ বাসদ-এর মুখপত্র ‘ভ্যানগার্ড’ পত্রিকার ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে প্রকাশিত সংখ্যাগুলোতে ধারাবাহিকভাবে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়। প্রবন্ধটির নাম ‘মাওয়ের লালচীন কোথায় যাচ্ছে?’ কলকাতার একটি সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধটি ভ্যানগার্ড পত্রিকায় পুনঃপ্রকাশ করা হয়। সেখানে মাও সে-তুংয়ের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে চীনের পরিস্থিতির একটি সম্যক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। তার পুঁজিবাদী অর্থনীতির দিকে যাত্রা, এই উল্টোপথে চলার ক্ষেত্রে কারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বা রাখছেন, পণ্য অর্থনীতির দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ তারা নিয়েছে এবং চীনের অর্থনীতি ও সমাজজীবনে তার প্রভাব কী এই চিত্রই সেখানে তুলে ধরা হয়েছে।

২০০২ সালের ৮ থেকে ১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ষোড়শ কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে ছিল সেই আলোচনাটি। এই কংগ্রেসের শুরুতেই চীনের পার্টিতে পুঁজিপতিদের স্বাগত জানানো হয়েছে। একইসাথে বলা হয়েছে যে সমাজতান্ত্রিক চীনে ব্যাপক সংস্কার সাধিত হবে এবং সেই সংস্কারের বড় শরিক হবেন পুঁজিপতিরাও।

এ বক্তব্যে গোটা বিশ্বের সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ মর্মাহত হলেও যারা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতেন এবং চীনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন, তাদের কাছে এটা আশ্চর্যের ছিল না। কারণ, পরিবর্তন অর্থাৎ উল্টোদিকে পরিবর্তনটা শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই, কমরেড মাও সে তুংয়ের মৃত্যুর পর। মাও সে-তুং জীবিত থাকতেও চীনের সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য তাকে এক কঠিন ও কষ্টকর লড়াই করতে হয়েছে। ১৯৪৯ সালের বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের সময় এই তর্ক উঠেছিল যে ‘Production in command’ নাকি ‘Politics in command’। মাওয়ের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। তিনি জানতেন তাঁদের উৎপাদন দরকার, এর জন্য দক্ষতা দরকার। কিন্তু তিনি যে কোনো প্রকারে উৎপাদন বাড়াবার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি জানতেন তাতে উৎপাদন বাড়বে, কিন্তু সমাজতন্ত্র মার খাবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজের সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তি সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারে না, রক্ষা করে রাজনৈতিক শক্তি অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক চেতনা। তাই তিনি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য Material incentive (বস্তুগত প্রেরণা) এর বিরোধিতা করতেন। তিনি Moral incentive (নৈতিক প্রেরণা)’র পক্ষে ছিলেন। তিনি বলেছেন ‘এক্সপার্ট’ চাই, কিন্তু চাই ‘রেড এন্ড এক্সপার্ট’। সমাজতান্ত্রিক চেতনাহীন, কেবলমাত্র ব্যক্তিগত লাভ ও উপার্জনের উদ্দেশ্যে নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগানো এই এক্সপার্টদের দিয়ে আমরা গড়ে না উঠা পর্যন্ত কাজ চালিয়ে নিতে পারি, কিন্তু সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সাম্যবাদের শিক্ষায় শিক্ষিত এক্সপার্ট তৈরি করতে হবে। এই দুই লাইন নিয়ে তখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে বিতর্ক উঠে। একটা লাইন নিয়ে লড়াই করেছেন মাও সে-তুং, অপরদিকে  বস্তুগত প্রেরণা দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির পক্ষে ছিলেন লিউ শাও চি। বাস্তবে লিউ শাও চির লাইন পরাস্ত হয়েছিল। মাওয়ের লাইন জয়যুক্ত হয়েছিল। আর এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চীন গড়ে তুলেছিল অসাধারণ অনেক চরিত্র।

ফলে দল ও রাষ্ট্রকে একটি সঠিক রাজনৈতিক লাইনে পরিচালিত করা ও তার ভিত্তিতে অর্থনৈতিকভাবে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য মাও সে-তুংকে দলের মধ্যে একের পর এক সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে, যা মাওয়ের মৃত্যুর পর অনুপস্থিত হয়ে যায়। দলের অভ্যন্তরে তখন সংকট শুরু হয়। মাওয়ের মৃত্যুর পর পার্টি দেন জিয়াও পিংয়ের কর্তৃত্বে চলে আসে। তিনি মাওয়ের লাইনের বিরোধী ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেংকে দলীয় পদ থেকে অপসারন করা হয়। কিন্তু মাওয়ের মৃত্যুর পর তিনিই সর্বময় ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠেন। বাস্তবে মাও পরবর্তীকালে চীনের যে রূপান্তর ঘটে, সে যুগটাকে দেং-এর যুগ বলা যেতে পারে। চীনের অর্থনৈতিক সংস্কারের মূল পরিকল্পনাকারী ও স্রষ্টা ছিলেন দেং। পরবর্তী নেতারা শুধু দেংয়ের পথ অনুসরণ করেছেন।

এই অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ার শুরু হয় দুটি স্লোগান দিয়ে, যা আজও আমরা চীনের নেতাদের মুখে শুনতে পাই। এক. চীনের বৈশিষ্ট্যে সমাজতন্ত্র (Socialism with chinese characteristics) দুই. সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি (Socialist market economy)।

এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় আঘাতের প্রথম লক্ষ্যবস্তু হয় চীনের কমিউনগুলো। চীনের এই কমিউনগুলো গড়ে উঠেছিল যৌথ উৎপাদন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে। চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এই কমিউনগুলোর প্রত্যক্ষ ও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই কমিউনগুলোকে হঠাৎ করে ভেঙে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই যৌথ উৎপাদনকে ভেঙে প্রথমে ‘পারিবারিক দায়িত্ব প্রথা’ নামে এক নতুন ব্যবস্থা নিয়ে আসা হয়। যৌথ উৎপাদনব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে জমিতে চাষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয় একক পরিবারের হাতে।

এ দিয়ে শুরু। এরপর ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারিকরণ, মুদ্রা নীতির সংশোধনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে চীনে দ্রুত পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে।

চীনের বর্তমান পরিস্থিতি কী?

১৯৯৪ সালে চীন শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের মজুরি দাসে পরিণত করে। শ্রমিকদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয় এবং শ্রমকে মজুরির বিনিময়ে বিক্রয়ের পণ্য হিসেবে গণ্য করে। চীনের শ্রম আইনের আর্টিকেল ১০-এ আছে যে, শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্র প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজকে উৎসাহিত করবে। ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হয়। ফোবর্সের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী বেইজিংয়ে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিলিয়নিয়ার বাস করেন। ১০০ জন বিলিয়নিয়ার নিয়ে তালিকার শীর্ষে বেইজিং। অপরদিকে ৯৯ জন বিলিয়নিয়ার নিয়ে এই তালিকায় দ্বিতীয় নিউইয়র্ক। ৭২৪ জন বিলিয়নিয়ার নিয়ে শীর্ষ রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র। আর ৬৯৮ জন বিলিয়নিয়ার নিয়ে তাকে ছুঁয়ে ফেলতে পেছনে পেছনে ছুটছে চীন। টেনসেন্ট, আলীবাবা, বাইদুং, বাইটড্যান্স এর মতো টেক জায়ান্টের মালিক এখন চীনের পুঁজিপতিরা।

১৯৭৬ সালে চীন সফর শেষে আমেরিকান অধ্যাপক ড. ডোনাল্ড ক্লাইন লিখেছিলেন, “প্রতিশ্রুতি এবং প্রতিশ্রুতি পালন চীনে এক হয়ে আছে, বিশেষত বেকার সমস্যার প্রশ্নে। বেকার সমস্যা নেই। সংবিধানে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ‘কাজ পাবার অধিকার’ এখানে বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে।”

সেই চীনের এখন কী অবস্থা? এ বছরের ১৫ মার্চ চীনের ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস্’-এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী চীনের শহর এলাকায় বেকারত্বের হার ৫.৫%। তরুণদের মধ্যে বেকাররত্বর হার ১৩.১%। তাদের হিসাব অনুযায়ী ২০২১ সালে ৯০ লক্ষের উপর শিক্ষার্থী পাশ করে চাকরিপ্রার্থী হবে। অর্থাৎ বেকারত্ব আরও বাড়বে।

চীন ১৯৬৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সকল ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছিল। নিজেদের আভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধিত হয়ে যায় ১৯৬৮ সালের মধ্যেই। তখন চীনের আর কোনো জাতীয় ঋণ ছিল না। আর এখন চীনের জাতীয় ঋণের পরিমাণ ৮ লক্ষ ৮৪ হাজার ৭১৯ কোটি মার্কিন ডলার।

এটা গেল অর্থনীতির কথা। সমাজজীবনের চিত্র কী? গত ১৯ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’-এর আর্টিকেল থেকে প্রথম আলো তাদের লেখাটি তৈরি করে। সেই আর্টিকেলে চীনের কয়েকজন শীর্ষ বিলিয়নিয়ারের জীবন ও বেড়ে উঠার বর্ণনা ছিল। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট এই ধরনের আর্টিকেল কেন করল? প্রথম আলো লিখেছে, “ … বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চেয়ে চীনে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা দিনকে দিন দ্রুত বেড়েই চলেছে। চীনের অনেক বাবা-মা চায়না ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ‘বিলিয়নিয়ার র‌্যাংকিং’-এ উঠানামাগুলো পড়ে শোনান। তাদের ধারণা, এতে শিশুরা বিলিয়নিয়ারদের জীবন থেকে শিক্ষা নেবেন। মা-বাবার লক্ষ্য, সন্তানেরা সফল ওই ব্যক্তিদের সফলতার গল্পগুলো জেনে নিজের জীবনকে সাজিয়ে নেবে নিজের মতো করে।”এই হচ্ছে নতুন চীনের বাবা-মায়ের জীবন সম্পর্কিত ধারণা। নতুন কিশোর-তরুণদের বড় হয়ে উঠার আইডল, তাদের স্বপ্ন।

আমরা একটু পেছনে যাই। অরভিল শেল ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির বার্কলে স্কুল অব জার্নালিজমের ডিন ও একজন বিখ্যাত সাংবাদিক। চীন ঘুরে এসে ১৯৭৫ সালে তিনি লিখেন, “একটা দেশের সত্যিকারের হাড়ির খবর পেতে হলে এদের ব্যক্তিগত জীবনটা দেখা দরকার। আমি চীনের যুবসমাজের একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম। অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি। যে বিষয়টা আমাকে খুব চমৎকৃত করেছে তা হলো নর-নারীর জীবনকে ওরা এক অদ্ভুত স্ট্যান্ডার্ডে তুলেছে। আমাদের দেশে বিলাসী পোশাক, ভাল সাজ-গোজ, চুলের বাহার প্রায় সবারই আকাক্সিক্ষত বিষয়, কিন্তু চীনে মানুষকে বিচার করা হচ্ছে তার কাজের দ্বারা, তার রাজনৈতিক চেতনার দ্বারা, সামাজিক দায়িত্বশীলতার দ্বারা। আমি দেখেছি, এটা কোনো পড়িয়ে দেওয়া বক্তৃতা নয়। সেখানে একজন যুবতী তোমাকে অকপটে বলবে যে, সে ত্রিশ বছরের আগে বিয়ে করতে চায়না, কারণ জীবনের সবচাইতে সোনালী দিনগুলোকে সে সমাজতন্ত্র গড়ার কাজে নিয়োগ করতে চায়। এরপরে সে যখন বিয়ে করবে, সে তখন এমন মানুষকেই সঙ্গী করবে যার রাজনৈতিক চেতনার মান উঁচু, যে কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং সর্বদা জনগণের সেবা করতে আগ্রহী। আরও অনেক কথা আছে। কিন্তু এইটুকুই কি আমাদের দেশে আছে? আমেরিকার বিলাসী যুবতীটি তোমাকে বরং অকপটে বলবে যে, সে একজন ফুটবল ক্যাপ্টেনকে উদ্দামভাবে ভালোবাসে। আমরা এই জায়গাতেই পড়ে আছি।”

জীবনের উদ্দেশ্য কিংবা জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমেরিকার সমাজের সাথে চীনের সমাজের যে পার্থক্য এই শিক্ষক ও সাংবাদিকের চোখে পড়েছিল এবং যার জন্য তিনি আফসোস করেছিলেন, আজ ২০২১ সালের চীনে তার লেশমাত্র আছে কি? নেই, কারণ চীনের অর্থনেতিক ভিত্তিটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যৌথতার বদলে ব্যক্তিগত লাভ প্রাধান্যে এসেছে। ফলে বদলে গেছে এর উপরিকাঠামো, মানুষকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। প্রেম, ভালোবাসা, যৌন জীবন, মূল্যবোধ, নৈতিকতা – সব জায়গায়ই এর প্রভাব পড়েছে।

এরিকা জেন নামে একজন অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিশিয়ান, যিনি পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার শিক্ষক ছিলেন, ১৯৭০ সালে পিকিং ইউনিভার্সিটিতে উচ্চতর শিক্ষার জন্য পড়াশোনা করছিলেন। তিনি ছিলেন চীন বিপ্লবের পর চীনে শিক্ষা নিতে যাওয়া প্রথম আমেরিকান এবং প্রথম বিদেশি শিক্ষার্থী। তাঁর একটা টুকরো স্মৃতি শুনুন, “একদিন দেখতে পেলাম আমার রুমমেট কাঁদছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল যে, সে বুঝতে পারছে তার একটা বদ অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে, তা হচ্ছে বিকালে দু’ঘণ্টা করে ঘুমানো। সে যখন গ্রামে কৃষিকাজ করত, তখন সে মাঠে এই সময়টা অতিরিক্ত কিছু কাজ করত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিশ্রমহীন জীবন তাকে অলস করে তুলেছে এবং তার কাজের প্রতি নিষ্ঠা নষ্ট করে দিচ্ছে। বারবার সে আশঙ্কা প্রকাশ করছিল যে, এই বিশ্ববিদ্যালয় তাকে শ্রমিক কৃষকের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা জীব করে ছাড়বে। এই ঘটনা আমাকে অবাক করে দিয়েছিল।”

শারীরিক ও মানসিক কষ্ট অসহনীয় হলে মানুষ কাঁদে। কান্না আবেগের প্রকাশ। হাসি-কান্না-রাগ-অভিমান – এ সবই মানবিক অভিব্যক্তি। কিন্তু এর প্রকাশই বলে দেয় এর গভীরতা, রুচি ও সংস্কৃতি কী, এর পেছনে জীবনবোধ কেমন। জীবনকে নিয়ে, জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে সচেতন ও গভীর ভাবনা না থাকলে এই ধরনের ঘটনায় চোখে জল আসে না।

সেই চরিত্র, সেই চরিত্র সৃষ্টির আন্দোলন চীন থেকে বিদায় নিয়েছে। চীনের যৌবন এখন বিলিয়নিয়ার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কী ধরনের শাসন সেখানে চলছে

উপরের আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, চীনে যদি অর্থনৈতিক সামাজিক সবদিক থেকে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে, তবে তা কমিউনিস্ট পার্টি নামক যে পার্টিটি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে, তার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ সে পার্টিটিও আর কমিউনিস্ট পার্টি নেই, কমিউনিস্ট নাম নিয়ে বাস্তবে সে চীনের বড় বড় পুঁজিপতিদের স্বার্থ সংরক্ষণ করছে। চীন শুধু একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র নয়, সে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র। চীনের পুঁজিপতিদের উদ্বৃত্ত পুঁজি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাটে, সে দেশের সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল শোষণ করে। চীনের অভ্যন্তরে এই পুঁজিপতিরা অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশের তুলনায় দ্রুত সংহত হচ্ছে। অতি ধনী সৃষ্টি হওয়ার হারে চীন বিশ্বে প্রথম। এর কারণ চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের পুঁজিকে নিশ্চয়তা দিয়েছে, অবাধ শ্রম শোষণ করার সুয়োগ দিয়েছে। চীনের শ্রমিকশ্রেণি ও জনগণের উপর শোষণ যে কোনো সাম্রাজ্যবাদী দেশের তুলনায় অনেক বেশি।

যেসকল তথ্য প্রমাণ আমাদের কাছে আছে, যে তথ্যগুলো চীনের সরকারি সংস্থা থেকেই প্রকাশিত, তাদের প্রবল সেন্সরের মাধ্যমে প্রকাশিত পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত – সেগুলো বিচার করলেই বোঝা যায় চীন একটি পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি এই পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রকে রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে।  এই দেশের মারাত্মক শোষণমূলক চরিত্রকে না দেখিয়ে শাসক দলকে একটি কমিউনিস্ট দল মনে করা ও তার নেতাকে প্রশংসা করা কী ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনায় সম্ভব হতে পারে, তা আমাদের বুদ্ধির অতীত। খালি চোখে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, একটি বিরাট ক্ষমতাধর চীন যদি একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হতো তাহলে তার আশেপাশে এবং পৃথিবীর দেশে দেশে চীনকে কেন্দ্র করে সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে উৎসাহ সৃষ্টি হওয়ার কথা। তার কোনো কিছু কি আছে? বরং চীন দেশের পিতামাতারা তাদের ছেলেমেয়েদের কোটিপতিদের গল্প শোনাচ্ছে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন প্রাক্তণদের মধ্যে কতজন কোটিপতি হয়েছে, তার তালিকা প্রকাশ করছে।

এরপরও চীনকে সমাজতান্ত্রিক মনে করা, তার নেতার প্রশংসা করা এদেশের বামপন্থীদের চিন্তার দারিদ্র্য হতে পারে, ভুল দৃষ্টিভঙ্গিও হতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার সাথে সাথে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর অনেকের মনে আজ এই ধারণা জন্মেছে যে, খাঁটি সমাজতন্ত্র এখন অচল। এখন কিছুটা মিশিয়ে, কিছুটা সরিয়ে একটা চেষ্টা করতে হবে। কর্পোরেট জায়ান্টদের উত্থান ঘটিয়ে, তীব্র শ্রম শোষণ করে এবং সকল প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে কীভাবে যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, তা আমাদের বুদ্ধির অগম্য। যে বামপন্থী নেতারা চীনা সাম্রাজ্যবাদের ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোডকে একটা বিরাট কমিউনিস্ট উদ্যোগ মনে করেন, তারাই সেটা ভালো বলতে পারবেন। হয়তো তারা মনে করেন, আগামীদিনের সমাজতন্ত্র জ্যাক মা, রবিন লি, লেই জুংদের মতো বিলিয়নিয়াররাই গড়বে, মাও সে তুং সেখানে জরুরি নয়। আমরা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি এবং আমাদের শক্তির সাপেক্ষে এখনও এটা স্বপ্ন তা ঠিক, কিন্তু এই ধরনের সমাজতন্ত্রের ধারণা আমাদের স্বপ্নেও আসেনি। সমাজতন্ত্র একটা কল্পনাবিলাস নয়, তার একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি আছে। সেটা বিশ্বের এক বিরাট অংশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, একটা নতুন সমাজ ও মানুষের উদাহরণ মানবজাতিকে দেখিয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতনের কারণ অনুসন্ধান করে ভুল শুধরে লড়াই জোরদার করা বামপন্থীদের কর্তব্য, সমাজতন্ত্রের নাম ভাঙিয়ে নির্মম পুঁজিবাদী শাসন যারা করে, তাদের সমর্থন করা নয়।

সাম্যবাদ – জুন ২০২১

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments